কুরোসাওয়া কথা
ওচিয়াই ফেন্সিং স্কুল
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আমি সম্ভবত আলোচ্য বিষয়টি থেকে সরে গেছি; এবার বরং ওচিয়াই ফেন্সিং স্কুল, কেন্দো ও আমার নিজের কথাতেই সংক্ষেপে ফেরা যাক। যখন থেকে আমি ওচিয়াই স্কুলে নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করলাম, বালক ফেন্সারের বা তলোয়ার-খেলোয়াড়ের সকল ভঙ্গিমা আত্মস্থ করে নিলাম। যেহেতু আমার ছিলাম বাচ্চা ছেলে, ফলে আমার এই আচরণ ছিল অনুমানযোগ্যই। তা ছাড়া তসুকাহারা বোকুদেন [১৪৮৯-১৫৭১] থেকে শুরু করে আরাকি মাতায়েমন [১৫৯৯-১৬৩৭] পর্যন্ত সব কিংবদন্তি সোর্ডসম্যানের ওপর লেখা নানা বইপত্র আমি মিস্টার তাচিকাওয়ার লাইব্রেরি থেকে পড়ে ফেলেছিলাম।
মোরিমুরা গাকুয়েনের বদলে তখন বরং আমার পোশাক বলতে ছিল কুরোদা প্রাইমারি স্কুলের পোশাকটিই—যেটি ছিল সামুরাই সোর্ডসম্যানের পোশাকের সঙ্গে অনেকটাই মানানসই : ডাক-ক্লথ হাকামা ট্রাউজারের ওপর একটি স্প্ল্যাশ-প্যাটার্নের কিমোনো, আর পায়ে ভারী কাঠের খড়ম। আমার প্রথম সিনেমা ‘সুগাতা সানশিরো’য় কেন্দ্রীয় চরিত্রে ফুজিতা সুসুমুর পোশাকটি কল্পনা করে নিলেই, প্রিয় পাঠক, আপনি এ বিষয়টির পরিষ্কার ছবি অনুভব করে নিতে পারবেন। তারপর তাকে [মনে মনে] চেপে লম্বায় তিনভাগের একভাগ, আর পাশে অর্ধেক করে ফেলুন; এবং তার কেন্দো পোশাকটিকে শক্ত করে বেঁধে রাখা সাশি বা উত্তরীয়টির মধ্যে একটি বাঁশের তলোয়ার সেঁটে দিন। এই তো, হয়ে গেলাম আমি!
প্রত্যেক ভোরে, পুবের আকাশ যখনো কালো, এদোগাওয়া নদীমুখী সড়কবাতির আলো ধরে বেরিয়ে পড়তাম আমি, কাঠের খড়ম পরা পা দুটো রাস্তা ধরে টেনেহিঁচড়ে টানতে টানতে। কোজাকুরাবাশি ব্রিজ পেরিয়ে, ইশিকিরিবাশি ব্রিজ পেরিয়ে, ইশিকিরিবাশি ব্রিজ পার হওয়ার পর ট্রলি-ট্র্যাকঅলা রাস্তাটিতে নামতাম; তারপর যখনই হাত্তোরিবাশি ব্রিজে পৌঁছতাম, ঠিক তখনই রাস্তার অপরদিকে ছুটে যাওয়া দিনের প্রথম ট্রলিটি পেরিয়ে যেতাম। এরপর এদোগাওয়াবাশি ব্রিজটি পার হতাম আমি। মোটামুটি ত্রিশ মিনিট লাগত এ জার্নিতে আমার এ পর্যন্ত আসতে। তার পর সেখান থেকে আরো পনেরো মিনিটের মতো হেঁটে যেতাম ওতোয়ার পথ ধরে; তারপর বাঁয়ে ঘুরে, আস্তে আস্তে চড়তে থাকতাম মেজিরো পর্বতের ওপর। আরো ২০ মিনিট এভাবে আগানোর পর আমার কানে ভেসে আসত ওচিয়াই ফেন্সিং স্কুলের সকালের পাঠ শুরু হওয়ার ঘোষণামূলক ঢাকের শব্দ। তারপর পড়িমরি ছুটে, আরো পনেরো মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতাম স্কুলে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর, কোনোখানে কোনোরকম না থেমেই, টানা হেঁটে, এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হতো আমাকে।
ওচিআই স্কুলে পাঠ শুরু হতো মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে। ওচিআই মাগোয়েমনের [তার নাম আসলে কী ছিল?] সব রীতিনীতি একত্রে জড়ো করে, ফরমাল পজিশনে ফ্লোরে বসে পড়তে হতো—সেই শিনতো দেবদেবীর মূর্তিভরা তাকটির দিকে মুখ করে—যেখান থেকে আলো ছড়াত প্রার্থনার মোমবাতি। আমরা আমাদের পাকস্থলীকে সব শক্তি দিয়ে ভেতরে টেনে নেওয়ার এবং দুনিয়ার সকল ভাবনা-চিন্তা মন থেকে উধাও করে দেওয়ার ওপর মনোযোগ দিতে শুরু করতাম।
আমরা যে রুমটিতে বসতাম, সেটির ছিল শক্ত ও ঠান্ডা বোর্ডের পাটাতন। শীতের তাপমাত্রা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে যখন শরীরে এক চিলতে ফেন্সিং পোশাক ছাড়া আর কিছুই পরা থাকত না, তখন আপনাকে নিজের সকল শক্তি নিয়োজিত করতেই হবে নিজের পাকস্থলীতে। এতই ঠান্ডা ছিল যে, দাঁত খোলার শক্তি থাকত না; ফলে মাথার মধ্যে বলতে গেলে কোনো জাগতিক চিন্তা আসার কোনো সম্ভাবনাই তৈরি হতো না। শীতকালে আমাদের সবারই ভাবনা ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উষ্ণতার সান্নিধ্য পাওয়া; কিন্তু আবহাওয়া যখন ভালো থাকত, তখন এসব মানসিক বাধাবিঘ্ন উধাও করে দেওয়ার জন্য প্রবল মনোযোগের প্রয়োজন পড়ত। এই ‘সিটিং’ পর্ব শেষ হলে, প্যারিং-অ্যান্ড-থ্রাস্টিং বা আঘাত-প্রতিরোধ-ও-আঘাত-হানার প্র্যাকটিস শুরু হতো।
দক্ষতার নিমিত্তে আমাদেরকে আলাদা করা হতো এবং পূর্বনির্ধারিত লড়াইয়ে ত্রিশ মিনিট কাটাতাম আমরা। তারপর আবারও ফরমাল সিটিং পজিশনে আসীন হতাম, ফেন্সিং মাস্টারকে ধন্যবাদ জানাতে; আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটত সকালের পাঠের। তুমুল শীতের দিনগুলোতে, এ সময়ে আমাদের শরীর থেকে বের হতো ধোয়া। কিন্তু ফেন্সিং স্কুল থেকে বের হয়ে এসে, প্রার্থনালয়টির দিকে পা বাড়াতেই টের পেতাম, পায়ের পাতা ভারি হয়ে এসেছে আমার।
খালি পেটে আমার কেবলই নাশতার কথা মনে পড়ত। আর মনে হতো, যদি প্রার্থনালয়ে না গিয়ে বরং যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরতে পারতাম। আকাশ যখন পরিষ্কার থাকত, তেমন দিনগুলোতে এমন সময়ে সূর্যের প্রথম রশ্মির দেখা মিলত—প্রার্থনালয় কম্পাউন্ডের গিঙ্কো গাছটির ওপর থেকে। পূজার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে, কুমীরমুখো ঘণ্টিটি [একটি প্রশস্ত, ফ্লেটিশ আকারের গহ্বরঅলা ধাতুর ঘণ্টি—যেটি প্রার্থনালয়টির প্রধান বিল্ডিংয়ের বাইরের দিকে, অনেক উঁচুতে কালেকশন বক্সটির সঙ্গে কাপড়ের রশি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা ছিল] বাজাতাম আমি। প্রার্থনামূলক হাততালি দেওয়ার পরে, আমি যেতাম কম্পাউন্ডটির এক প্রান্তে অবস্থিত ধর্মযাজকের বাড়িতে; সেখানকার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে, চিৎকার করে বলে ওঠতাম, ‘শুভ সকাল!’ কিমোনো ও হাকামা পরিহিত ধর্মযাজক তার ধবধবে সাদা মুখ নিয়ে বেরিয়ে আসতেন। মুখে কোনো কথা না বলে, আমার হাত থেকে সেই ছোট্ট ডায়েরিটি নিয়ে, প্রার্থনালয়ের সিলমোহরসহ দিনক্ষণ সেঁটে দিতেন তিনি। তাকে যখনই দেখেছি, দেখতাম, তার গালগুলো ফুলে আছে এবং চোয়াল নড়ছে। ফলে আমার ধারণা, তার নাশতা সারার সময়ই, সবসময় তার সামনে গিয়ে পৌঁছাতাম আমি।
তারপর প্রার্থনালয়টির পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসতাম আমি, নিজের নাশতা সারার জন্য বাড়ি ফিরতাম সেই কুরোদা প্রাইমারি স্কুলের সামনে দিয়ে—সেখানে একটু পরই আমাকে যেতে হবে। ইশিকিরিবাশি ব্রিজের নিচে আসতেই আমার চোখের সামনে ধরা পড়ত এদোগাওয়া নদীর পাশে অবস্থিত আমাদের বাড়িটি; ততক্ষণে সকালের সূর্যটা অবশেষে গেছে উঠে, আর আমার মুখের ওপর টাটকা রোদ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। সকালে সব সময়ই আমার মুখের ওপর আলো ফেলে জেগে উঠত সূর্যটা; অথচ কোনো সাধারণ শিশুর মতো তখনই নিজের দিনটি শুরু করার কথা ভাবতে পারতাম না আমি। তবে আমার মধ্যে সে কারণে কোনো অসন্তোষ কাজ করত না; বরং এ ছিল এক ধরনের আত্মসক্ষমতা ও সন্তুষ্টির এক অনুভূতি।
এবং বস্তুতপক্ষে, এর পর থেকেই একজন সাধারণ শিশুর মতো দিন শুরু হতো আমার। তার মানে, এরপর সকালের নাশতা সারা, সারা দিন স্কুলে কাটিয়ে দুপুরে বাড়ি ফেরার স্বাভাবিক কর্মসূচি। তবে মিস্টার তাচিকাওয়ার শিক্ষকতার সঙ্গে তুলনা করলে, স্কুলে গিয়ে যে ধরনের শিক্ষা আমি লাভ করতাম—তা ছিল অতৃপ্তিদায়ক। ক্লাসরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুকনো মুখে, নীরস বসে থাকতাম; একটা বিশ্রীরকমের চর্চা সহ্য করতে হতো আমাকে। নতুন যে শিক্ষকটি আমাদের ক্লাস নিতেন, তার পড়ানো আমার ভালো লাগত না। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগপর্যন্ত, আমরা যেন নিরন্তরভাবে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার ভেতরই বন্দি ছিলাম। এই শিক্ষকটি মিস্টার তাচিকাওয়ার শিক্ষা-সংক্রান্ত দর্শনের হিসেবে প্রত্যেক বিষয়ের বিবেচনাতেই ছিলেন একেবারেই বিপরীত; এবং তাচিকাওয়ার পড়ানোর ধরনের প্রতি তার সব সময়ই ছিল সুতীব্র কটাক্ষ। তিনি বলতেন, ‘মিস্টার তাচিকাওয়া হলে হয়তো ‘এটা’ বলতেন’, কিংবা ‘মিস্টার তাচিকাওয়া হলে হয়তো ‘ওটা’ করতেন’; এবং কথা বলার সময় তার মুখে সব সময়ই বিরক্তিকর রকমের অবজ্ঞাসূচক হাসি লেগে থাকত। যখনই তিনি এমন কিছু বলতেন, তখনই আমার পাশে বসে থাকা বন্ধু উয়েকুসাকে আচ্ছামতো একটা লাথি মারতাম। বিদ্রূপাত্মক হাসির মাধ্যমে মুহূর্তেই সেটির প্রতি সাড়া দিতো উয়েকুসা। এমনকি একদিন এমন কাণ্ডও ঘটেছে—আর্ট ক্লাসে : ক্লাসরুমটিতে থাকা কসমস ফুলেভরা সাদা ফুলদানির একটি স্টিল-লাইফ পেইন্টিং করতে বলা হয়েছিল আমাদের। ফুলদানিটির আয়তনটিকে ধরতে চেয়েছিলাম আমি; ফলে এটির ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলগুলোকে ঘন বেগুনিরঙ দিয়ে গাঢ় করে তুলেছিলাম। ফুলগাছের পাতাগুলোকে হালকা সবুজ রঙে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে এঁকে, ফুলগুলোকে গোলাপি ও সাদা রঙে বিক্ষিপ্ত ছিটেফোঁটায় ফুটিয়ে তুলেছিলাম।
নতুন শিক্ষকটি আমার আঁকা ছবিটি হাতে নিয়ে, আমরা যেটিকে পিনআপ বোর্ড বলে ডাকতাম—সেই বোর্ডটির এক কোনায় সেঁটে দিলেন। সাধারণত ছাত্রদের ক্যালিগ্রাফি কিংবা কম্পোজিশন কিংবা ছবির মধ্যে সেরা উদাহরণটিকে বাকিদের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশেই এভাবে এখানে রাখা হতো। শিক্ষকটির ডাক দিলেন, ‘কুরোসাওয়া, উঠে দাঁড়াও।’ আমি ভীষণ খুশি মনে উঠে দাঁড়ালাম; নিশ্চিতভাবেই ধরে নিলাম, আবারও প্রশংসা শুনব নিশ্চয়ই। কিন্তু নতুন শিক্ষকটি আমার আঁকা ছবিটির দিকে ইঙ্গিত করে, আমাকে আচ্ছামতো অপদস্থ করতে লাগলেন : ‘এই ফুলদানিটির ওপর কিসের শেডিং দেখতে পেয়েছ তুমি—এখানে গাঢ় গোলাপি রঙের কোনো বালাই আছে নাকি? এই যে মেঘের মতো করে সবুজ রংগুলো দিয়েছ—এর মানেটা কী? তুমি যদি ভাবো কসমস ফুলের পাতা দেখতে এমন হয়—তাহলে তুমি আস্ত একটা পাগল।’ তার কথার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ভর্ৎসনা, প্রচুর পরিমাণ তাচ্ছিল্য ছিল। তার দোষারোপগুলো ছিল বিষে ভরা। যেন কোনো ছড়ির মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি; মনে হচ্ছিল, আমার চেহারা থেকে সব রং যেন মিলিয়ে গিয়েছে। কী ছিল এসব?
সেদিন স্কুল ছুটি হলে, উয়েকুসা আমার পিছু নিয়েছিল; আর নির্বাক হয়ে আমি হনহন হাঁটা দিয়েছিলাম হাত্তোরিজাকার ঢাল ধরে। ‘কুরো-চান, জঘন্য ব্যবহার করেছে, তাই না? খুবই হীন-ব্যবহার! কী বিশ্রী! এটা ক্ষমার অযোগ্য।’ বাড়ি ফেরার পুরোটা রাস্তা ধরে, এসব কথাই বারবার বলে যাচ্ছিল সে।
আমার ধারণা, মানুষের মনের ভেতর বাস করা অসভ্যতার সাক্ষাৎ এই প্রথম আমি পেয়েছিলাম। এই শিক্ষকের অধীনে পড়াশোনা করতে আমার আর কখনোই ভালো লাগেনি। তবে এই শিক্ষক যেন আর কখনোই আমার কোনো সমালোচনা করতে না পারেন, সে জন্য কঠোর পরিশ্রম করার প্রতিশ্রুতি নিজেকেই নিজে দিয়েছিলাম।
(চলবে)