কুরোসাওয়া কথা
মেইজির সুবাস, তাইশোর শব্দ
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
তাইশো যুগের সূচনাকালে, ১৯১২ সাল ও এর পরবর্তী বছরগুলোতে, পূর্ববতী মেইজি যুগের একটা সুবাস ছড়িয়ে রয়ে গিয়েছিল। আমরা প্রাইমারি স্কুলে, প্রাণোদ্দীপ্ত স্বরে ভরা যে গানগুলো গাইতাম, সেগুলোতেও এর সাক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে দুটি গান এখনো আমি ভীষণ ভালোবাসি—‘দ্য ব্যাটল অব দ্য জাপান সী’ ও ‘দ্য ন্যাভাল ব্যারেকস’। গানগুলোর কথা ছিল মন-খোলা; মেলোডি ছিল সহজ-সরল, আর তাতে এমন সব ঘটনার বর্ণনা ছিল বিস্ময়কর রকমের সোজাসাপ্টা ও গভীরতর সততা সহকারে— যা কি না আপনাআপনিই আবেগে প্রবল ঝাঁকুনি দেয়। পরবর্তীকালে আমি নিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরদের বলেছি, মুভি-কন্টিউনিটির [শুটিং স্ক্রিপ্টের] ঠিক এ রকমই হওয়া উচিত। মডেল হিসেবে এই গানগুলো ব্যবহার করা এবং এগুলোর বর্ণনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য তাদের আমি উদ্বুদ্ধ করেছি। আমি এখনো মনে করি, এটি একটি ভালো মেথড।
আমার বিশ্বাস, মেইজি যুগের মানুষেরা ঠিক তেমনই ছিলেন, যেমনটার বর্ণনা পাওয়া যায় সমকালীন ঔপন্যাসিক রিয়োতারো শিবার ‘ক্লাউডস ওভার দ্য হিল’ [১৯৬৮-৭২] উপন্যাস-সিরিজে। তারা এমনভাবেই জীবন কাটাতেন, যেন পাহাড় চড়ার সময় পেছনের মেঘগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধিত ছিল তাদের।
আমি তখনো প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, একদিন বাবা আমাকে আর আমার বোনদের নিয়ে গেলেন তোয়ামা আর্মি একাডেমিতে। বোল-আকৃতির একটি অ্যামফিথিয়েটারে বসে ছিলাম আমি— যেটির ধাপে ধাপে সাজানো ছিল কাচঘেরা বেঞ্চগুলো। নিচের গোলচত্বরে একটি মিলিটারি ব্যান্ডের কনসার্ট চলছিল।
এখন অতীতের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয়, এ যেন একেবারেই একটি মেইজি-যুগীয় দৃশ্য। ব্যান্ড সদস্যদের পরনে ছিল লাল ট্রাউজার; সূর্যের আলোকে চিকচিক করছিল ব্র্যাশ ইনস্ট্রুমেন্টগুলো; বাগানজুড়ে চমৎকারভাবে ফুটে ছিল আজালিয়া ফুল; নিজেদের মাথার ওপর রং-বেরঙের ছোট-ছোট ছাতাগুলোকে আদুরে ঢঙে ঘোরাচ্ছিলেন নারীরা; আর এমন আবহে আপনার পা তো আনমনেই বনের বাতাসের মেলোডির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ঠক-ঠক করতে থাকবে। যেহেতু আমি স্রেফ একটা বাচ্চা ছেলে ছিলাম, ফলে ভয়ঙ্কর সামরিকাবস্থার ন্যূনতম আভাসও চোখে পড়েনি আমার।
১৯২৬ সালে তাইশো-যুগের শেষে, জনপ্রিয় গানগুলো হয়ে পড়েছিল তমসাচ্ছন্ন, নিমজ্জিত হয়েছিল পুরো নৈরাশ্যে। কয়েকটি গান ছিল এমন— ‘নদী খাতের শুষ্ক এক প্যাম্পাস ঘাস ছাড়া আমি কিছুই নই’, ‘ভেসে যাচ্ছি স্রোতে’ ও ‘সন্ধ্যার অন্ধকার যখন আসে ঘনিয়ে।’
বালক বেলায় যে ধরনের সাউন্ড শুনে আমি অভ্যস্থ ছিলাম, তা এখনকার দিনের তুলনায় একেবারেই আলাদা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তখনকার দিনে ইলেকট্রিক সাউন্ডের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এমনকি তখনকার ফোনোগ্রাফও ইলেকট্রিক ফোনোগ্রাফ ছিল না। সবই ছিল ন্যাচারাল সাউন্ড। সেই সব ন্যাচারাল সাউন্ডের মধ্যে অনেকগুলোই ইতিমধ্যে চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমি স্রেফ কয়েকটির কথা স্মরণের চেষ্টা করতে পারি :
মধ্য-দুপুরের রিসাউন্ডিং ‘বুম’। এটি ছিল কুদান উশি-গা-ফুচি আর্মি ব্যারাকের কামানের শব্দ— যা প্রতিদিন দুপুরে একবার করে ফাঁকা-ফায়ার করা হতো।
ফায়ার-অ্যালার্ম ঘণ্টি। ফায়ার-ওয়াচম্যানের উডেন ক্ল্যাপারের সাউন্ড। তিনি যখন অধিবাসীদের কাছে আগুন লাগার জায়গাটির তথ্য জানান দিতেন, তখনকার ড্রামবিটস ও তার কণ্ঠের সাউন্ড।
তোফু [জাপানি খাবার বিশেষ] বিক্রেতার ভেঁপু। টোবাকো-পাইপ রিপেয়ারম্যানের হুইসেল। লজেন্স বিক্রেতার বগলে থাকা ড্রয়ারের তালার সাউন্ড। উইন্ড-চাইম [ব্রিজবেল] বিক্রেতার পণ্যগুলোর টুং-টাং। কাঠের খড়মের ফালি মেরামতকারী লোকটির ড্রামবিট। মন্ত্রজপরত যাযাবর ভিক্ষুর ঘণ্টিধ্বনি। ক্যান্ডি বিক্রেতার ড্রাম। ফায়ার-ট্রাকের ঘণ্টি। লায়ন-ড্যান্সের বিশাল ড্রাম। বানর প্রশিক্ষকের ড্রাম। মন্দিরে প্রার্থনাসভার ড্রাম। স্বাদুপানির ঝিনুক বিক্রেতা। চিনির শিরায় ভেজানো মুড়মুড়ি বিক্রেতা। লালমরিচ বিক্রেতা। গোল্ডফিশ বিক্রেতা। কাপড় শুকানোর বাঁশের খুঁটি বিক্রেতা। চারাগাছ বিক্রেতা। নৈশভোজের নুডলস বিক্রেতা। ওডেন [ঝোল মিশ্রিত পুডিংবিশেষ] বিক্রেতা। সিদ্ধ করা মিষ্টি আলু বিক্রেতা। ছুরি-কাঁচি শান দেওয়ার লোক। ঝালাইকারী লোক। মর্নিং-গ্লোরি ফুল বিক্রেতা। মাছওয়ালা। সার্ডিন মাছ বিক্রেতা। সেদ্ধ শিম বিক্রেতা। পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রেতা : ‘লাগবে নাকি...!’ ঘুড়ির সুতোর গুঞ্জন। র্যাকেট [হালকা ব্যাটবিশেষ] ও শ্যাটলককের টক-টক শব্দ। কোনো বল লাফিয়ে ওঠলে যে গানগুলো গাইবেন আপনি। শিশুদের গানগুলো।
এই হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলোকে আমার শৈশব স্মৃতি থেকে আলাদা করা একেবারেই অসম্ভব। এগুলো সবই ঋতুর সঙ্গে জড়িত। এগুলো শীতল, উষ্ণ, গরম কিংবা ঠান্ডা শব্দ এবং এগুলো নানা ধরনের অনুভূতির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে। হাসিখুশি শব্দ, নিঃসঙ্গ শব্দ, বিষণ্ণ শব্দ ও আতঙ্ক-জাগানিয়া শব্দ। আগুন আমি অপছন্দ করি; ফলে ফায়ার অ্যালার্মের শব্দটি এবং আগুন লাগার খবর জানান দেওয়া ফায়ার-ওয়াচম্যানের কণ্ঠ ও ড্রামের শব্দ আমাকে আতঙ্কিত করে তুলত। ‘বং, বং...! জিনবোচো অঞ্চলের কান্দা তল্লাটে আগুন লেগেছে।’ এমন সব শব্দ শুনলে আমি আতঙ্কে কাঁথা মুড়ি দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করতাম।
‘কনবেতো-সান’ সময়ের দিনগুলোতে একদিন মাঝরাতে আমার বোন আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। ‘আকিরা, আগুন লেগেছে এখানে। তাড়াতাড়ি উঠে, পোশাক পরে নাও।’ ঝটপট নিজের কিমোনো পরে, দৌড়ে সদর দরজার দিকে ছুটে গিয়ে দেখি, আমাদের গেটের একদম উল্টোদিকের বাড়িটি থেকে আগুনের প্রকাণ্ড উজ্জ্বল লাল শিখা দেখা যাচ্ছে। এরপর আর কিছুই মনে নেই আমার।
যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, দেখি, কাগুরাজাকা পাহাড়ে আমি একা একা হাঁটছি। একছুটে বাড়ির কাছে ফিরলাম। দেখি, আগুন নিভে গেছে ঠিকই, তবে পুলিশ আগুনের এলাকাটিতে একটা জরুরি নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করে পাহারা দিচ্ছেন, ফলে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। আমি যখন রাস্তার অপরপ্রান্তটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘ঐটা আমাদের বাড়ি’, তখন আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন পুলিশটি এবং আমাকে যেতে দিলেন।
আমি বাড়ি ঢুকতেই বাবা রাগে ফেটে পড়লেন। কী হয়েছে, বুঝতে না পেরে বোনের কাছে জানতে চাইলাম। ঘটনা হলো, আগুন দেখেই আমি এক দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ‘আকিরা! আকিরা!’ বলে আমার বোনটির কান্না সত্ত্বেও, আমি সদর দরজা খুলে, মিলিয়ে গিয়েছিলাম রাতের আঁধারে।
আগুন প্রসঙ্গে আরেকটি কথা মনে পড়ে গেল : তখনকার দিনে ঘোড়ার গাড়িতে ফায়ার-ওয়াজন বা অগ্নি-কামরা ছিল। এ জন্য চমৎকার সব ঘোড়া বেছে নেওয়া হতো এবং সবকিছুর সঙ্গে সেগুলো [ফায়ার ওয়াজন] এত চমৎকারভাবে মানিয়ে যেত যে, দেখে মনে হতো, গাড়ির উপরে যেন খাঁটি উষ্ণতা-ছড়ানো বোতলের মহিমা। আগুন আমার অপ্রিয় ঠিকই, কিন্তু সেসব ফায়ার ওয়াজন আমি স্রেফ আর একটিবার যদি দেখতে পেতাম— সেই আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিন মনে পুষে রেখেছি! অনেক বছর পর অবশেষে সেই সুযোগটি পেয়েছিলাম, টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি-ফক্স স্টুডিওর এক ওপেন-সেটে। পুরোনো দিনের নিউইয়র্ক সিটির দৃশ্য ছিল সেটি; আর ফায়ার ওয়াজনটি ছুটে গিয়েছিল একটি গির্জার সামনে— যেখানে অজস্র লাইলাক ফুল ফুটে ছিল।
তাইশো যুগের সাউন্ডের কথায় ফেরা যাক আবার। এসব সাউন্ডের সঙ্গেই স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার। যখন স্বাদুপানির ঝিনুক বিক্রেতা কোনো শিশুকে দেখতাম, যে নিজের দ্রব্য বিক্রি করতে করুণ মিনতি সহকারে বিলাপ করত— তখন নিজের জীবনের জন্য নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবান মনে হতো আমার। গ্রীষ্মের শ্বাসরোধী দুপুরে লালমরিচ বিক্রেতা যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যেত, মনে পড়ে, আমি তখন হাতে বাঁশের একটা কঞ্চি নিয়ে নিজের মাথার ওপরের ওক গাছটি থেকে গোবড়ে পোকা ধরার চেষ্টা করতাম, আর পোকাটির নড়াচড়ার ওপর গবেষণায় মগ্ন হতাম। নাকানোহাশি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে, এক হাতে সুতো ধরে রেখে, ঘুড়ির সুতোর গুঞ্জরণের শব্দ যখন আমি শুনতাম, শীতের আকাশের নিচের সেই বাতাস এতই প্রবল ছিল যে, আমাকে প্রায় উড়িয়েই ফেলত!
শব্দের প্রতি উদ্দীপনা জাগানো শৈশবের স্মৃতিগুলোকে যদি আমি একে একে উল্লেখ করতে যাই, তাহলে তার কোনো শেষ হবে না। কিন্তু এখন যখন এখানে বসেছি নিজের শৈশবের সেই শব্দগুলো নিয়ে লিখতে, তখন আমার কান জর্জরিত করে দিচ্ছে টেলিভিশন, হিটার এবং পুরোনো সংবাদপত্রের বিনিময়ে টয়লেট পেপার দেওয়ার বিজ্ঞাপন-ভরা সাউন্ড-ট্র্যাক : এ সবই ইলেকট্রিক্যাল সাউন্ড। আজকের দিনের শিশুরা হয়তো এসব সাউন্ডের কাছ থেকে খুব একটা ঋদ্ধ স্মৃতি অর্জন করতে পারবে না। তাদের অবস্থা সম্ভবত সেই স্বাদুপানির ঝিনুক বিক্রেতা শিশুটির চেয়েও অধিক করুণ।
(চলবে)