বিখ্যাতদের বিচ্ছেদপত্র

ভালোবাসার মতো বিচ্ছেদও মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অধ্যায়। যে মানুষ ভালোবেসেছেন, সেই মানুষটিই আবার সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন-এ রকম গল্প অহরহ। বিখ্যাত মানুষরা এই স্বাভাবিকতার বাইরে নন। তাঁরাও যেমন প্রেমের সম্পর্কে, বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন, তেমনি আবার সরেও গিয়েছেন। তাঁদের সরে যাওয়ার সে অভিজ্ঞতা বিচিত্র, তার প্রকাশও বিচিত্র। বিচ্ছেদপত্রে তাঁরা জানিয়েছেন বিচ্ছেদবার্তা। কেউ সরাসরি জানিয়েছেন, কেউ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। বিখ্যাত মানুষদের এ রকমই কিছু বিচ্ছেদপত্র প্রকাশ করেছে নিউইয়র্কার পত্রিকা।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বিচ্ছেদপত্রে লিখেছিলেন :
আমাদের সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি ছিলাম সবচেয়ে অবহেলিত। আমি এখন বুঝতে পারি, সম্পর্কটা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি প্রতিদিন আমাকে ব্যবহার করেছো। তুমি কি জানো না, এটা আমার জন্য কতটা অপমানজনক? তোমার জন্য এখন অপরিহার্য হচ্ছে বিশ্ববিজ্ঞান জানার জন্য মনোযোগী হওয়া এবং তোমার জিহ্বা নাড়ানো বন্ধ করা। আমি খুবই বিরক্ত হতাম ব্যাপারটাতে।
কার্ল মার্কস লিখেছিলেন :
আমরা আসলে একত্রে কী করছিলাম? প্রতিটি দিন তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলে। গত এক মাসে আমরা একে অপরের সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলিনি। এমনকি আমার অসুখ সেরে ওঠার পর একসঙ্গে সেটা উদযাপনও করা হয়নি। মানুষের হাতে গড়া সংরক্ষণশীল এই স্বর্গ যাকে ‘সম্পর্ক’ বলা হয়, আমি তার বিচার চাই।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসে লিখেছিলেন :
তুমি কি হাঁসগুলোর সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলো মনে করতে পারো? সেটা ছিল খুবই ঠান্ডা এবং বর্ষার দিন। আকাশ যেন পূর্বাভাস দিয়েই প্রতিটি বাতাসের ঝাপ্টা দিয়ে আমাদের ভাগ্যকে পরীক্ষা করছিল। আমরা তাই দ্রুত এক গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলাম সেখানে দেখেছিলাম একটা হাঁসের পরিবার ঘর বেঁধেছে। আমার মনে আছে, আমি তোমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘ওদের ঘর বেশিদিন টিকবে না’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি টিকে থাকে? এমনকি মৌমাছিও পরাগ নেওয়ার পর আর সেই ফুলে ফিরে আসে না। পৃথিবীর নিয়মই এগিয়ে চলা বা তলিয়ে যাওয়া। খুব শিগগির একদিন তোমার আরেক পুরুষের সঙ্গে দেখা হবে এবং সেও ধীরে ধীরে তোমার জীবনে ছাই থেকে উঠে আসা এক ফিনিক্স পাখি হয়ে উঠবে। এবং আমি প্রার্থনা করি, সে তোমাকে সিফিলিসে আক্রান্ত করবে না।
গ্রিক দার্শনিক এবং গণিতবিদ প্লেটো লিখেছিলেন :
এটা আমার জন্য স্বীকার করা কষ্টকর কিন্তু বলতেই হচ্ছে সক্রেটিস তোমার ব্যাপারে ঠিক কথা বলেছিলেন। তুমি নিজেকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারো না। শেষ কবে তুমি আমাকে দেখতে এসেছিলে, মনে পড়ে? আমি দীর্ঘদিন ধরে তোমার অবজ্ঞা সহ্য করে আসছি। শেষ পর্যন্ত আমি অনুভব করতে পেরেছি তোমার ভালোবাসা সত্যি নয়। সৌন্দর্যে তুমি সবার সেরা, সন্দেহ নেই কিন্তু তুমি পীড়াদায়কভাবে বিমূর্ত। আমাকে জাগতিক বিশ্বের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকার সুযোগ করে দাও, দয়া করে চলে যাও।
ফরাসি দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ রেনে দেকার্ত লিখেছিলেন :
পান করার জন্যই আমি টিকে আছি, সে কারণেই আমি মাতাল। হা হা হা! ওয়াইনভর্তি ছয় নম্বর গ্লাসটা হাতে তুলে নেওয়ার পর আমার মনে হলো লেখাটা এভাবে শুরু করলে আমার জন্য সহজ হবে। কিন্তু আমি এখনো কী লিখব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ওহ, তুমি ছাড়া আমার জগৎটা যে কত ছোট সেটা কী করে তোমাকে বোঝাব আমি? আচ্ছা আমি আবার একটু গুছিয়ে শুরু করি। দর্শন হচ্ছে একটা গাছের মতো, এর সব ডালপালাই পাখা মেলে গাছটা থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তুমি হচ্ছো ঝোপের মতো। ছোট এবং সুন্দর কিন্তু যুক্তিবাদী চিন্তায় একেবারেই অজ্ঞ। আমি কী বলতে চাচ্ছি সেটা কি তুমি বুঝতে পেরেছো?
ড্যানিশ দার্শনিক, কবি এবং সমালোচক সোরেন কিয়ের্কেগার্দ লিখেছিলেন :
আমি তিন ধাপে আমাদের সম্পর্কটা ভাঙব। প্রথম ধাপটির সংজ্ঞা রয়েছে নন্দনত্ত্বে। আমি কোপেনহেগেনে আমার খুব প্রিয় একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ তোমাকে দেখলাম ক্যারেজ থেকে নামতে। প্রথম দেখাতেই আমার মনে হয়েছিল, তোমাকে চাই। দ্বিতীয় ধাপে আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে আমাদের নৈতিকতার ওপর। একটা সময়ে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম তুমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে আমার বন্ধু হান্সের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছো। এবং আমি জানতাম এই অবস্থায় যদি আমি তোমাকে প্রেমের কথা জানাই, সেটা হান্স সহ্য করতে পারবে না। তৃতীয় যে ধাপের কথা বলব, সেটা সম্পূর্ণ ধর্মীয়। হান্সের ব্যাপারে আমি খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না, সে কারণেই তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিই। যাই হোক, আমরা দুজনেই সীমাহীন পাপে জড়িয়েছি। এই অনৈতিকতা থেকে আমাদের সরে আসা উচিত। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।
ফরাসি দার্শনিক ও লেখক জঁ পল সার্ত্রের অভিমানী পত্র সিমন দ্য বুভোয়াকে:
মাই ডিয়ার লিটিল গার্ল, আমি আরেকদিন বালজাকের সঙ্গে দেখা করেছি, তখন আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি আমার কী করা উচিৎ। আমি তোমার প্রেমে ভীষণরকমভাবে মজে আছি আবার যুগপৎভাবে ঘৃণাও করছি। বোঝার চেষ্টা করো: ছোট ছোট সূক্ষ্ম মুহুর্তগুলোতে আমি তোমাকে নিয়ে ভাবি, যেমন ধরো যখন ছটফটে এক কাঠবিড়ালিকে দেখলাম রাস্তা পেরুতে অথবা যখন গৃহহীন কোনো মানুষ নিজের সুখ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেন তুইলেরিসের ঝোপঝাড়ে। এরই মধ্যে তুমি হয় তো কাউকে খুঁজে পেয়েছো, যে তোমাকে বোঝে, আমাদের তিন জনের ভেতর নানা নীতিনৈতিকতা নিয়েও হয়তো কথা বলে।
ফরাসি নারীবাদী দার্শনিক ও লেখক সিমন দ্য বুভোয়ারের ক্ষোভ মিশ্রিত চিঠি সার্ত্রের প্রতি:
যাই হোক, তুমি একটা গর্দভ।