কুরোসাওয়া কথা
কেইকা মিডল স্কুল

ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আমি যখন কেইকা মিডল স্কুলে ভর্তি হলাম, সেটির ক্যাম্পাস ছিল কেইকা কমার্স স্কুলের [যেখানে উয়েকুসা ভর্তি হয়েছিল] সঙ্গে সংযুক্ত, টোকিওর ওচানোমিজু অঞ্চলে। এটির অবস্থান এখনো সেখানেই : জুনতেদো হাসপাতাল ও একটি প্রশস্ত রাস্তার মধ্যকার অবস্থানে, স্যান্ডুইচের মতো চ্যাপ্টা অবস্থায়! আমাদের সময়ে ওচানোমিজুর, অর্থাৎ, যেটির আক্ষরিক অর্থ ‘চায়ের পানি’, যার স্বাক্ষী কেইকা স্কুলের গান ‘বিহোল দ্য ভ্যালি অব টি...’ ও ইত্যাদি—সেটির ল্যান্ডস্কেপকে চীনের বিখ্যাত সুদৃশ্য জায়গাগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়; যদিও তা করলে খানিকটা অতিরঞ্জনই হবে!
আমার ১৯২৭ সালের গ্রাজুয়েটিং ক্লাসের ক্লাস রিপোর্টের একটি অনুচ্ছেদে সে সময়কার ওচানোমিজু টোটোগ্রাফি ও আমার নিজের—উভয়েরই একটি বর্ণনা পাওয়া সম্ভব; সে সময় বলতে মিডল স্কুলে আমার প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের কথা বলছি। এটি যদিও আমার তখনকার দিনের এক বন্ধু লিখেছিল, তবু লেখাটি থেকে আমি উদ্ধৃতি দিচ্ছি এখানে :
“ওচানোমিজু বাঁধটি এমন অতি-বাড়ন্ত অশেষ বুনো ঘাসে ভরা, যেগুলোর সৌরভ আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না। সেই খালের দিকটি নিয়ে অনবদ্য নস্টালজিয়ায় ভুগি। ক্লাস যখন অবশেষে শেষ হয়ে যেত, কেইকা মিডল স্কুল গেট [বস্তুতপক্ষে সেই ছোট্ট গেটটি কালেভদ্রে ব্যবহার করা হতো] দিয়ে অবাধ স্বাধীনতায় বেরিয়ে পড়তাম আমি, পেরিয়ে যেতাম সেই প্রশস্ত অ্যাভিনিউ—যেখান দিয়ে শহরের ঠেলাগাড়ি এসে হঙ্গো মোতামাচিতে এসে থামত, অপেক্ষা করত একটি সুযোগ নেওয়ার, যেন বাঁধের পুরুষ্ঠ উদ্ভিদরাজির মধ্যে লেখা ‘প্রবেশ নিষেধ’ সংকেতটি উপেক্ষা করে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। সে মুহূর্তে আমি লোকচক্ষুর নিরাপদ আড়ালে চলে এসেছি; ফলে ঢালু পথ ধরে খুব সাবধানে নেমে পড়তাম। তারপর সমতল এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছুতাম—যেখানে পিছলে নিচে পড়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই; নিজের স্কুলব্যাগটিকে বালিশ বানিয়ে, ঘাসের বুকে শুয়ে পড়তাম আমি।”
“নিচে, পানির কিনারে নেমে যেতাম, সেখানে স্রেফ এমন একটি সমতল পরিসর ছিল—যেখানে একটামাত্র মানুষের পক্ষেই হেঁটে যাওয়া সম্ভব। সুইদোবাশি এলাকায় পৌঁছানোর আগপর্যন্ত, এভাবেই হেঁটে যেতাম আমি; এবং তারপর হামাগুড়ি দিয়ে তীরে উঠে, রাস্তায় উঠে আসতাম।...
“আমার এতকিছু করার কারণ ছিল একটিই—স্কুল থেকে সোজা বাড়ি ফিরতে না চাওয়া। আমার আরেক বন্ধুর মন-মানসিকতা ছিল এ রকমই, তার নাম—আকিরা কুরোসাওয়া। আমি আর সে একসঙ্গে এভাবে দুই-তিনবার নদীর তীর বেয়ে নেমেছি। একবার আমরা ঘাসের ঝোপে এক জোড়া সাপকে সঙ্গমরত অবস্থায়ও দেখেছিলাম। একত্রে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওরা যেন দাঁড়িয়ে উঠছিল; দেখে ভীষণ ভড়কে গিয়েছিলাম আমরা।
“কম্পোজিশন আর পেইন্টিং ছাড়া বাদবাকি সব সাবজেক্টে আকিরা কুরোসাওয়া ছিল খুবই খারাপ। স্কুল ম্যাগাজিনে তার সৃষ্টিকর্ম ছাপা হতো প্রায়ই। যতদূর মনে পড়ে, মুদ্রিত হওয়া সেই পেইন্টিংগুলোর একটি ছিল এক ধরনের ফলের এক সেইল-লাইফ; ছবিটির ছাপ আমার মনে এখনো গভীরভাবে রয়ে গেছে। আসল পেইন্টিংটি স্বয়ং যে আরো অনেক বেশি প্রেরণাদায়ী, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। শুনেছি, আমাদের প্রাণবন্ত তরুণ শিক্ষক ইওয়ামাৎসু গোরু ওর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন বলেই সে [আকিরা] এতটা মেধাবী হয়ে উঠেছিল।
“শারীরিক শিক্ষায় কুরোসাওয়ার সক্ষমতা ছিল শূন্য। সে যখন চিনিং বারে যেত, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের দুটি পা বালুতে ঠেস দিয়ে ঝুলত। তা দেখে আমার ভীষণ উৎকণ্ঠা হতো। কুরোসাওয়ার কণ্ঠস্বরও ছিল একেবারেই মেয়েলি। এই লম্বাটে ও ফ্যাকাশে তরুণের সঙ্গে, পাহাড়ি পথ বেয়ে নদীতীরে নেমে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুয়ে শুয়ে যখন আকাশ দেখতাম, মনে পড়ে, এক আজব ধরনের তিক্তমধুর অনুভূতি হতো আমার।”
###
এই লেখাটি পড়ে, সে বয়সে নিজের মধ্যে তখনো থেকে যাওয়া এক ধরনের নির্দিষ্ট মেয়েলি স্বভাব সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র মনোভাব আমি উদ্ধার করতে পারি। এটির মধ্যে আমার জন্য একমাত্র স্বস্তির ব্যাপারটি হলো, আমার কোনবেতো-সান পিরিয়ডটি যেখানে স্রেফ মধুর ও প্রশ্রয়দানকারী ছিল, সেখানে এ বেলায় এসে আমি অন্তত ‘তিক্তমধুর’ হয়ে উঠতে পেরেছি; তার মানে, আমি খানিকটা বড় হয়ে গেছি বলেই ধরে নিতে পারি।
যখন নিজের অতীতের কথা ভাবি এবং অন্য কারও স্মৃতিচারণায় আকিরা কুরোসাওয়াকে খুঁজে পাই, তখন এ দুটির মধ্যে সবসময়ই এতটা অমিলের দেখা মেলে—আমি অস্বস্তিকর রকমের বিস্ময়ের ভেতর পড়ে যাই। যখন থেকে আমি একজন বালক সোর্ডসম্যানের ভঙ্গিমাগুলো রপ্ত করে ফেলেছি, তখন থেকে নিজেকে প্রবলভাবে পুরুষালি হিসেবেই কল্পনা করতে শিখেছিলাম। এই যে উপরে উল্লেখিত লেখাটি আমার শারীরিক সক্ষমতাকে ‘শূন্য’ বলে অভিহিত করা হলো, এর তাহলে কী মানে হতে পারে? এ ব্যাপারটিতে আপত্তি তোলার তাগাদা বোধ করছি।
আমার বাহুতে কোনো শক্তি ছিল না, আর আমি বারে স্রেফ ঝুলে থাকতাম—এ কথা সত্য। বারে ভর দিয়ে নিজেকে শূন্যে তুলতে পারতাম না—এ কথাও সত্য। কিন্তু আমার শারীরিক শক্তি শূন্য ছিল—এ কথা সত্য নয়। বাহুতে জোর দেওয়ার তেমন বালাই নেই—এমনতর সকল খেলাতেই আমি বেশ ভালো করতাম। কেন্দো সোর্ডসম্যানশিপ—যেটির কথা আগেই উল্লেখ করেছি, তাতে আমি টপ-র্যাঙ্কে পৌঁছেছিলাম। বেসবল খেলায় যখন বল মারতাম, ক্যাচাররা সে বল ধরার ব্যাপারে ভড়কে থাকত; আর যখন বল মারতাম না, তখন শর্টস্টপ হিসেবে খেলতাম, আর ইনফিল্ড গ্রাউন্ডারসে স্ন্যাপ-আপ করার সক্ষমতা নিয়ে রীতিমতো সুনাম ছিল আমার। সাঁতারে আমি দুটি জাপানি-স্টাইল স্ট্রোকস শিখেছিলাম, এবং পরবর্তী সময়ে নতুন আমদানিকৃত অস্ট্রেলিয়ান ক্রাউলে মাস্টারতুল্য হয়ে উঠেছিলাম। আমি কখনোই দ্রুতগতির সাঁতারু না হলেও, এখনো, এ বয়সেও সাঁতরাতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। গলফ খেলায়, আগেই বলেছি, পুটিংয়ে আমি খুবই খারাপ; তবে খেলাটি ছেড়ে দেইনি।
যাহোক, সহপাঠীরা যখন আমার মধ্যে শারীরিক সক্ষমতার কোনো চিহ্ন খুঁজে না পায়, তখন অবশ্য অবাক হওয়ার কিছুই নেই আমার। কেইকা মিডল স্কুলে আমাদের শারীরিক শিক্ষার ক্লাস নিতেন একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা; এবং তিনি সেসব খেলাধূলার ওপর বেশি জোর দিতেন, যেগুলোতে বাহুর শক্তির প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। তার মুখ ছিল রক্তাভ-লাল; ফলে আড়ালে-অবডালে তাকে আমরা বিফস্টেক বা কাটলেট বলে ডাকতাম।
একবার এই বিফস্টেক আমার সঙ্গে একটা চাতুরী করেছিলেন। বরাবরের মতোই চিনিং-বারে ঝুলছিলাম আমি এবং তিনি আমাকে আরেকটু পুশ-আপ করার চেষ্টা করাচ্ছিলেন। জোর করে পুশ-করাটা আমার ভালোলাগেনি বলে বারটির ওপর উঠে, নিজের শরীরের সব শক্তি নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম বিফস্টেকের ওপর; ফলে বালুতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন তিনি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বালু-মাখা মিস্টার বিফস্টেককে দেখতে লাগছিল একটা ভাজা কাটলেটের মতো!
ফলে শারীরিক শিক্ষায় শূন্য পেয়ে আমি স্কুলে যে নতুন রেকর্ডটি করেছিলাম, এর ফলেই বোধ করি এই টার্মটি ভাগ্যে জুটে গেছে! কেইকা মিডল স্কুলের ইতিহাসে এটি [শূন্য পাওয়া] ছিল প্রথম ঘটনা। তবে মিস্টার বিফস্টিকের ক্লাসে আমার সঙ্গে অন্যকিছুও ঘটেছিল। রানিং হাই জাম্প করছিলাম আমরা, এবং যারা বারটি মিস করছিল, তাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছিল : এটি একটি প্রতিযোগিতা ছিল বলে, বারটি তুলনামূলক উঁচুতে রাখা হয়েছিল। যখন আমার বেলা এলো, আমি দৌড়াতে শুরু করতেই সব সহপাঠী ভেঙে পড়ল অট্টহাসিতে। এই হাসির অর্থ, তারা সবাই ধরে নিয়েছিল, আমি দৌড়ে এসে বারটির নিচে দিয়েই নিজেকে গলে দেবো! কিন্তু আমি ঠিকই সেটির উপর দিয়ে লাফিয়ে গিয়েছিলাম। আর সবাই হয়ে গিয়েছিল হতভম্ব।
প্রত্যেক রাউন্ডেই বারটি একেক ধাপ করে উপরে ওঠানো হতো, এবং একদল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিটকে পড়ত আর সাইলাইনটি উপরে ওঠতেই থাকত। কিন্তু বারবার বারটি ক্রমাগত উপরে ওঠানোর পরও, বেশ কয়েকটি জাম্পের পরও, প্রতিযোগী হিসেবে আমি টিকেই রইলাম। দর্শকরা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেল। এবং ঘটে গেলে অসম্ভব ঘটনাটি : বারের সামনে শেষ পর্যন্ত আমি একা দাঁড়িয়ে। বিফস্টেক আর আমার সব সহপাঠী নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
কীভাবে ঘটেছিল এটা? বারের দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় আমাকে দেখাচ্ছিল কেমন? প্রথম যখন শুরু করেছিলাম, বারের যতই কাছাকাছি পৌঁছেছি, বিদ্রূপহাসির স্বর ততই বাড়তে শুনেছিলাম; ফলে অবাস্তব কিছু একটা করে দেখানোর দরকার ছিলই আমার। এ ঘটনাটির কথা এখন ভাবতে গেলে, এখনো সত্যিকারঅর্থেই কিছু বুঝে ওঠতে পারি না। এ কি কোনো স্বপ্ন ছিল? যে বালকটি শারীরিক শিক্ষার ক্লাসে সবসময়ই হাসাহাসির পাত্র হতো, সে কি শেষ পর্যন্ত স্বপ্নেই তা সফল করে দেখিয়েছে?
না; এটি স্বপ্ন ছিল না। আমি সত্যি-সত্যিই বারটির ‘উপর’ দিয়ে লাফিয়ে গিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় আমি একলাই টিকে ছিলাম, আর তারপরও বারবার, বহুবার তা অব্যাহত রেখেছি। জিমে শূন্য পেতে দেখে এই বালকটির প্রতি হয়তো কোনো দেবদূতের মায়া জন্মেছিল, আর সে-ই হয়তো নিজের ডানা-দুটো তাকে একমুহূর্তের জন্য দিয়েছিল ধার।
(চলবে)