গপ্পো তক্ক যুক্তি
ছবির সঙ্গে মিশে যেতে চাই : ওয়েস অ্যান্ডারসন

ওয়েসলি ওয়েস অ্যান্ডারসন, সংক্ষিপ্ত নাম ওয়েস অ্যান্ডারসন। ১৯৬৯ সালের ১ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেন তিনি। সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে ওয়েস অ্যান্ডারসন স্বকীয়তা তৈরি করেছেন। ২০০১ সালে ‘দ্য রয়েল টেনেমবামস’, ২০১২ সালে ‘মুনরাইজ কিংডম’ এবং ২০১৫ সালে ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ ছবির সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের জন্য তিনবার অস্কার মনোনয়ন পান তিনি। ২০১৫ সালের বাফটায় পাঁচটি পুরস্কার পায় ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’। মৌলিক চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কৃত হন অ্যান্ডারসন। গোল্ডেন গ্লোবে কমেডি এবং মিউজিক্যাল ক্যাটাগরিতে সেরা ছবির পুরস্কার পায় এটি। সেরা ছবি, সেরা পরিচালকসহ সর্বোচ্চ নয়টি ক্যাটাগরিতে ২০১৫ সালে অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিল ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’। পুরস্কার জিতেছিল চারটি বিভাগে। ১৯৯৬ সালে ‘বোটল রকেট’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন অ্যান্ডারসন। এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে দ্য টকস থেকে।
প্রশ্ন : মিস্টার অ্যান্ডারসন, আপনার কাছে কি মনে হয় আপনার ছবির জগৎটা আপনার হাতের মুঠোয় বন্দি এবং আপনি একাই সেটার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন?
উত্তর : এটা মনে হয় সত্যি। আমার মনে হয়, এখানে কিছু মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার কাজ করে। কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ আছে, যারা নিজেদের মতো করে সবকিছু সাজিয়ে নিতে চায়। আবার কেউ কেউ আছে, যারা বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে চায়।
প্রশ্ন : ওয়ার্নার হেরজগের মাথায় চলে এলো...
উত্তর : অথবা আপনি উদাহরণস্বরূপ রবার্ট আল্টম্যানের কথাও ভাবতে পারেন। তাঁর সিনেমা বানানোর পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিল অগোছালো। শুধু ক্রমাগত কিছু মুহূর্তের ছবি তুলে যেতেন তিনি। পরে সেগুলো সাজিয়ে ফেলতেন সম্পাদনার সময়। শুটিংয়ের সময় তিনি যেটা চাইতেন, সেটা হলো অভিনেতারা তাদের কাজটা করে যাবে। তখন যদি উল্টাপাল্টা কিছু হতো বা নিজের মনমতো না হতো, তিনি সেটা চালিয়ে যেতেন এবং দেখতে চাইতেন ব্যাপারটা শেষমেশ কী দাঁড়ায়। আমার মনে হয়, উনি কিন্তু একই সঙ্গে ইউনিটের জন্য একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন। তাই এটা কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যাপার নয়; বরং উল্টো একজন নেতার মতো পথ দেখানো এবং ভুল হলেও সেগুলো শুধরে নেওয়া। তাই আমার মনে হয়, প্রায় সব শিল্পের ক্ষেত্রেই এটা ঘটে।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনার ছবিগুলো অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত।
উত্তর : অবশ্যই। আল্টম্যানের ছবির চেয়ে অনেক বেশি গোছানো। এ রকম অনেক ঘটনা রয়েছে, আমরা আমাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একটা দৃশ্যধারণের কাজ শুরু করেছি এবং পরিকল্পনার বাইরে একটা শটও নেওয়া হয়নি। এভাবেই আমরা প্রতিটি কাজ করে থাকি এবং এভাবেই কাজগুলো করে যাব। কারণ, এটাই আসলে সব এবং এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই শুটিংয়ের সময়ে আমাদের আলাদা কোনো চিন্তা কাজ করে না, আমরা পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে থাকি। আর বছরের পর বছর ছবি বানাতে গিয়ে আমিও কীভাবে ছবি বানানোর পরিকল্পনা করতে হয়, সেটা শিখে গেছি। এখন সেটা অনেক ভালো কাজে দিচ্ছে আমার ক্ষেত্রে। আশা করি, আমার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অভিনেতারা ফাঁদে পড়েন না।
প্রশ্ন : এমন কোনো অভিনেতাকে কি পেয়েছেন যে আপনার কাজের ধরনের সঙ্গে বা পরিচালনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি?
উত্তর : অনেক বছর আগে আমি একজন খুবই ভালো এবং চ্যালেঞ্জিং অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছিলাম, তাঁর নাম জেন হ্যাকম্যান। আমার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কিন্তু তিনি খুব যে নিশ্চিন্ত ছিলেন, ব্যাপারটা সে রকম নয়। তিনি খুবই জটিল একটা শট দিয়েছিলেন, যেখানে তাঁকে বারবার ফ্রেমের মধ্যে থাকতে হচ্ছিল; আবার এর মধ্যেই ফ্রেম থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছিলেন, আবার ফ্রেমে ফিরে আসছিলেন। অনেকটা থিয়েটারের মতো ছিল ব্যাপারটা। এভাবে অভিনয় করাটা তাঁর জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু শুটিংয়ের সময় আমি এমন পরিবেশ তৈরি করেছিলাম, যাতে অভিনয়টা করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যেন নিজের মতো করে করতে পারেন।
প্রশ্ন : আপনি কি চান, আপনার ছবি বানানোর ধরনের জন্য মানুষ আপনার ছবিগুলো মনে রাখুক?
উত্তর : আমি এমন কোনো ধরন তৈরি করতে চাই না, যেটা মানুষ বুঝতে পারবে না। তবে আমার ট্রেডমার্কে কোনো ধরন যদি তৈরি হয়ে থাকে, তাতে আমার করার কিছু নেই। আমার লেখালেখি বা ফিল্মিংয়ের ধরন, দৃশ্য সাজানোর বিষয়গুলো আমি নিজের মতো করে করি। এগুলো দেখে মানুষ যখন বুঝতে পারে এটা আমার কাজ, সেটা কিন্তু তাদের বোঝানোর জন্য আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করি না। এটা এমনিতেই ঘটে। এটা জাস্ট একজন ডিরেক্টর হিসেবে আমার ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে।
প্রশ্ন : জটিল দৃশ্য ধারণের সময় আপনি কি কোনো চাপ অনুভব করেন?
উত্তর : দৃশ্য ধারণের পর সেটা বদলে নেওয়ার কোনো সুযোগ আমার থাকে না। তাই যা করি, সেটাই চূড়ান্ত। কারণ, পুরো জিনিসটা আবার নতুন করে করা অসম্ভব। অনেক কিছু আছে, যেটা আমরা সম্পাদনার টেবিলে ঠিক করি। কিন্তু সেটা হচ্ছে আমরা যেটা তুলেছি, সেটাকে আরেকটু উন্নত করে তুলি। নতুন কিছু সেখানে সৃষ্টি করা হয় না। তাই আমরা সঠিক পরিকল্পনার ওপর খুব জোর দিই। কারণ, কাজটা একবারেই তুলে আনতে হবে।
প্রশ্ন : ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য কোনো চাপ অনুভব করেন কি?
উত্তর : আমি পয়সা বাঁচাতে পছন্দ করি, আমি ছবিতে সব সময় খুব হিসাব করে খরচ করি। এর মূল কারণ হচ্ছে, আমি নিশ্চিত করতে চাই যে পুরো টাকাটাই ছবির পেছনে যেন খরচ হয়। কোথাও যেন বাজে খরচ না হয়, টাকাটার যেন অপচয় না হয়। ছবিটা যখন পয়সা কামানো শুরু করে, তখন সেটাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে হয়, সেটা আমি জানি না। আমি চাই না যে আমাকে কেউ জ্ঞান দিক, ‘ছবিটা এভাবে বানান, তাহলে এটা হিট হবে।’ এটা কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। কম বাজেটে ছবি করতে গেলে এসব কথা শুনতে হয় না। লাইফ অ্যাকুয়াটিক (২০১৪) ছবিটা বিগ বাজেটের ছিল এবং এর আয়োজনটাও বড় ছিল। এমনকি ছবিটার শুটিং যখন করছিলাম, তখন মনে মনে ভাবছিলাম, এই ছবির পেছনে এত টাকা ঢালাটা ঠিক হচ্ছে না। এটা খুব বেশি ব্যবসা করতে পারবে না।
প্রশ্ন : ছবির মাঝখানে এ রকম মনে হওয়াটা তো খারাপ।
উত্তর : এর পরেই আমি সিদ্ধান্ত নিই, নিজেকে আর এ রকম পরিস্থিতিতে ফেলব না। বানানোর জন্য একটা কঠিন ছবি ছিল ওটা। ১০০ দিনের শুটিং শিডিউল ছিল এবং আমরা রীতিমতো সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। ১০ বছর আগে ওই ছবি বানাতে আমাদের খরচ হয়েছিল ছয় কোটি ডলার, আজকের দিনে একই ছবি করতে আট কোটি ডলারের মতো লাগবে। একটা ছবির জন্য এটা অনেক বড় বাজেট, সেটা অবশ্যই অদ্ভুত। এটা আসলে কোনো নির্দিষ্ট জনরার ছবি ছিল না। ওই সময়ে আমি আসলে এত কিছু বুঝিওনি।
প্রশ্ন : আপনি সাধারণত কীভাবে শুরু করেন? একটা ইমেজ দিয়ে না গল্প দিয়ে?
উত্তর : একেকটা ছবির জন্য ব্যাপারটা একেক রকম। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার প্রথম ছবিটা ছিল ভিজ্যুয়াল আইডিয়ার ওপরে করা। এবং সেটা আসলে গল্পের ওপর খুব একটা নির্ভরশীল ছিল না, ছবির আয়োজনটাই ছিল মূল ব্যাপার। আবার ‘দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ ছবিটা করার সময় প্রথমেই একটা চরিত্রের কথা ভেবেছিলাম। আমরা চরিত্রটা নিয়ে খুবই আগ্রহী ছিলাম। চরিত্রটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আর অল্প কিছুটা গল্প ছিল আমাদের সম্বল। পরে আমার মাথায় আইডিয়া আসে যে স্টিফান জোয়েগের (মার্কিন কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক) সঙ্গে জড়িত এ রকম কিছু একটা আমি করতে চাই।
প্রশ্ন : আপনার জীবনী নিয়ে যে ছবিটা হবে, সেটাতে কি আপনার নিজের গল্প বলার ঢং টা থাকবে? যেমন ধরুন, ‘দ্য রয়েল টেনেনবামস’-এর বাবার চরিত্রটা কি আপনার বাবার চরিত্র থেকে ধার করে করা?
উত্তর : ‘দ্য রয়েল টেনেনবামস’ ছবিতে আমি এমন কিছু জিনিস ব্যবহার করেছি, যেটা আমার নিজের জীবনে ঘটেছে। কিন্তু যখন সেটা ছবিতে দেখিয়েছি, ঘটনাগুলো অনেক পাল্টে গেছে। ব্যাপারগুলো আমি স্মৃতি থেকে ধার করে লিখেছি। আমার মনে হয়েছিল, নিজের জীবনের এই ঘটনাগুলো আমি এখানে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু বাবা-ছেলের ব্যাপারটায় গিয়ে আমার মনে হয়েছিল মানুষের জীবনে এই ব্যাপারগুলো ঘটে এবং সবার জীবনেই এটা রয়েছে। বাবার বয়সী আমার কিছু বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁরা আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সত্যিকারের চরিত্র। এভাবে দেখলে আসলে বাস্তব চরিত্রগুলো নিয়েই ছবিটা করা হয়েছে।
প্রশ্ন : কোন ধরনের ছবি করতে আপনি বেশি আগ্রহী?
উত্তর : আমি যে ধরনের ছবি করতে চাই, সেটা একইভাবে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান। আবার জাপানিজ ও ভারতীয়ও বটে। কিন্তু মোটাদাগে ইউরোপিয়ান, মার্কিন ও ব্রিটিশ ঘরানার। ক্লাসিক্যাল ঘরানার ছবি করতে আমার বেশি ভালো লাগে। আমি আসলে ছবির সঙ্গে মিশে যেতে চাই, আমার মনে হয় না ছবির নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি খুব বেশি রক্ষণশীল। এটা এসেছে সিনেমার পরম্পরা থেকে। আমার প্রিয় নির্মাতাদের মধ্যে রয়েছেন জন হুস্টন, ওরসন ওয়েলেস, জঁ রেনোয়া, রোমান পোলানস্কি, স্ট্যানলি কুবরিক, ফেলিনি এবং বার্গম্যান—এঁদের দেখেই আমার সিনেমা বানানোর দিকে এগিয়ে যাওয়া। এঁরাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাব।
প্রশ্ন : আপনি এখনো ফিল্মে শুট করেন। ডিজিটাল ক্যামেরায় কবে কাজ করবেন?
উত্তর : আমি জানি না। আগামী বছর অথবা আগামী দুই বছরের মধ্যে। আমি জানি না, এ সময়ের মধ্যে ফিল্মে শুট করার সুযোগ থাকবে কি না। এখন দেখা যায়, আমি একটা ছবি দেখলাম; কিন্তু পরে দেখার সময় মনে হয় না যে সেটা ডিজিটালি করা হয়েছে। আমি সব ধরনের সিনেমা বানানোতে আগ্রহী। আমি জানি না, কোনো কিছু আমার অগোচরে ফসকে গেল কি না। শক্ত মনের অধিকারী অনেক ফিল্মমেকার আছেন, যাঁরা নিজেদের বিশ্বাসকেই সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন।