সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

না, জুলেখার বিত্তান্ত দেইখ্যা খালি ইসুফ মিয়ার মায় কী মংলার মায়ের পরানই ডরে খাবাজাবা খাওয়া ধরে নাই, সেই বিত্তান্ত ইমাম হুজুরের চিত্তেও ডর ধরাইয়া দিছে!
এইটা কিয়ের তেনে কী হইতাছে! কিয়ের তেনে কী চলতাছে! মাইয়ায় যুদি ফিরতিই আইলো, তাইলে সেয় এমুন চেতন-শূন্যি ক্যান! জাগনা হইতে পারতাছে না ক্যান জুলেখায়! কী হইছে অর! কোনখান তেনে আইছে উয়ে! একলা আইছে, না কেউ অরে লইয়া আইছে? যুদি একলা আইয়া থাকে, তাইলে এমুন বেহুঁশ অবস্থায় সেয় ঠাকুরবাড়ির ঘাটলা তরি আইলোই বা কী প্রকারে!
কতো রকমের কতো কথা যে ঘুরপাক খাইতে থাকে মাতারি তিনজোন আর ইমাম হুজুরের ভিতরে! এই সগল কথার জব দিয়া যেয় তাগো অন্তরের অশান্তি সরাইতে পারে, সেয় তো কিছু মাত্র হুঁশে নাই! তার হুঁশ ফিরোনের লেইগা বার চাওয়া ছাড়া তাগো আর কী করোনের আছে! কিচ্ছু করোনের নাই।
তাও তারা চাইর জোনে নিজেরা নিজেরা নানান কথা কইতে কইতে জুলেখারে জাগনায় আনোনের চেষ্টার কোনো সীমা রাখে না। কিন্তুক কিয়ের কী!
মাইয়ারে কোনো প্রকারেই সেই দিন, সেই পইল্লা দিন, পুরা জাগনায় আনা যায় না! কোনো প্রকারেই না। যেই ঝিমানির সেই ঝিমানিতেই ঢুইল্লা থাকে জুলেখায়!
ইসুফ মিয়ার মায় জুলেখায় থোতায় ধইরা কতো ঝাঁকানি দেয়। মাইয়ায় তবদা দিয়াই পইড়া থাকে; কোনো লইড়-চইড় দেহা যায় না অর। ইমাম হুজুরে কতো না বার কতো মতে ডাক পাড়ে! কোনো ডাকই য্যান অর কানেও ঢোকে না!
জুলেখার মায় কান্দতে কান্দতে মাইয়ার পিঠে চাপড়ানি দিয়া তারে হুঁশে আনার চেষ্টা করে। বহুতখোন ধইরা চেষ্টা করে। সেই চেষ্টাও কোনো কামে লাগে না। কিছু দিয়াই কিছু করোন যায় না। মাইয়ায় যেমুনকার হুঁশহারা, তেমুনই থাকে!
না পাইরা শেষ-কাটালে ইমাম হুজুরে মংলার মায়রে কয়, ‘মাইয়ার কান্ধায় ধইরা ঝাঁকি দে দেহি মংলার মা! অর হুঁশ না আইলে শোধন কাইজ্জ কেমনে করা যাইবো? ক!’
মংলার মায় জুলেখার দুই কান্ধা ধইরা অরে কেমুন ঝাঁকানিটিই না দেয়! কিন্তুক কিয়ের কী! মাইয়ার জাগনায় আহোনের কোনো নিশানা দেহা যায় না! ডাকলে যেমুন তার কানে ঢোকতাছে না, কোনো প্রকার ধাক্কাও য্যান মাইয়ার গতরে লাগতাছে না।
এইটা কিমুন কথা! এইটা কোন কালঘোমে ধরছে জুলেখারে! কী হইছে অর!
কান্ধায় ঝাঁকানি দেওনের পরেও জাগনা হয় নাই জুলেখায়, কিন্তু কান্ধা ঝাঁকনির সোম ছোটো একটা ফল কিন্তুক ফলতে দেহা যায়!
যহন কইস্সা ঝাঁকনি দিতে দিতে মংলার মায় জোরতে জোরতে জুলেখারে ডাক দিতাছিলো, সেইসোম সগলতে দেহে যে—জুলেখায় কোনোমতে য্যান চোখটা এট্টু মেলোনের চেষ্টা করতাছে! এট্টু, কোনো রহম খালি, চক্ষের পাতা দুইটা ফাঁক করতে চাইতাছে য্যান মাইয়ায়। এই এট্টু, এই হাছামিছা কোনোরকম এট্টু! তার বাদে আবার যেই কে সেই! চোখ পুরা বুজাইন্না হইয়া যায় জুলেখার! যেই চেতন-ছাড়ার সেই চেতন-ছাড়াই হইয়া থাকে সেয়।
অহন করা কী!
ইমাম হুজুরে কয়, পরেরটা পরে বুঝা যাইবো নে! আগে তো শোধন কাইরজ হউক!
তহন না মাতারি তিনোজোনে পরিষ্কার বোঝে যে, জুলেখার জাগনা হওনের আশায় বইয়া থাইক্কা ফল নাই! যা যা নিয়ম-শোধন করোনের কর্ম আছে, তার হগলই করতে হইবো জুলেখারে অই ঝিমান্তিতে থুইয়াই। নাইলে মাইয়ারে ঘরে তোলতে দেরি হইয়া যাইবো। দেরি হইলে হেশে কিয়ের তেনে যে কী হইয়া যাইবো—সেইটা কে কইতে পারে!
বিষয়টা মাথায় নিয়া জুলেখার মায় তরাতরি উইট্টা খাড়ায়। নিবো আলা সেয় তার মাইয়ারে গোছল দেওনের থানে। যেমনে পারে নিবো সেয় তার আবাগী মাইয়ারে, ভিটির নিমগাছের তলে। নিমগাছের তলেই তো ইমাম হুজুরে শোধন-গোসলের জায়গা সাব্যস্ত করছে। সেইনে জুলেখারে খাড়া করাইয়া এইবার দেখবো জুলেখার মায়—তাগো মায়ে-ঝিয়ের কপালের গরদিশ কাটে কি না! তরাতরি কইরা জুলেখার শইল্লে-মাথায় সাত লোটা সাত লোটা হিসাবে পানি ঢাইল্লা তাইলে একবার দেখোনের তো কাম—সেই টোটকায় কোনো ফল দেয় কি না!
তার বাদে যা কিসমতে আছে, যা কপালে লেখছে খোদায়—সেইটা হইবো নে! কিন্তু আগে হুজুরের কথা মাফিক শোধন-কাইজ্জ তো কইরা লউক জুলেখার মায়।
কিন্তুক কপালের ফের দেহো! দেহ তার অচল হইয়া গেছে য্যান লাগে! পুরা অচল হইয়া গেছে। তাইলে একলা সেয় কেমনে টাইন্না নিবো ঝুমতে থাকা মাইয়াটারে! অরে লাগতাছে য্যান একটা পাত্থরের লাহান ভারী! একলা নি আর সেয় পারে অই আধা-ঘুমাইন্না পাত্থররে গোছলের জায়গায় টাইন্না নিতে! পারে না পারে না, আর পারে না।
জুলেখার মায়ের লগে আইয়া হাত লাগায় মংলার মায়। ইসুফ মিয়ার মায় যে অই টানাটুনির কামে হাত দেয়, তার সেই উপায় নাই। আইজ-কাইল আর সেয় এইটা পারে না; তার কোমরে বিষ।
সেয় করে কী—রান্ধন ঘরের ভোমা পিঁড়িখান হাতে নিয়া আগে আগে গিয়া খাড়ায় নিমগাছের তলে। পায়ের তলে কাঠ, মাথার ওপরে কাঠ। এই দুইখান বিষয় হইলো শোধন-করমের মূল। সেইটার ভাও না কইরা খালি আন্ধা-ঘোন্ধা মাথায় পানি ঢাললেই কাম হয়? কোনো দিনও হয় না।
নিমগাছের তলে সিজিল মতোন পিঁড়ি পাতে ইসুফ মিয়ার মায়। তয়, পিঁড়ি পাইত্তা দিয়াই কী নিজের দায় শেষ করে সেয়!
না না! হাত তুইল্লা খাড়াইয়া থাকোনের মানুষ না এই মাতারি। সেয় কেউর লেইগা করতে চাইলে, গলা পানিত নাইম্মা হইলেও তার উপকার কইরা দেয়। আর, জুলেখার লেইগা তো লাগলে সেয় নিজের কইলজা খুইল্লা দিয়া দিবো! ইসুফ মিয়ার মায় স্থির করে যে, সেয় নিজের হাতে জুলেখারে শোধনের সগল কাম করবো।
মংলার মায়রে লইয়া জুলেখার মায় তাইলে কী করবো?
হেরা একটা কাম করলে ইসুফ মিয়ার মায়ের বড়োই উবকার হয়! সেইটা কইরা দেউক তারা। হেরা দোনোজোনে জুলেখারে শক্ত কইরা ধইরা খাড়াইয়া থাউক। বাকি সগল নিয়ম-সিয়মের কাম ইসুফ মিয়ার মায়ই একলা হাতে সোন্দর হালে শেষ করতে পারবো।
জুলেখার শইল্লে নিমপাতা-হলদি বাটা মাখোন্তি, সাত লোটা দুধ-পানি ছেড়ির তাউল্লায় ঢালুন্তি, আবার তার লগে লগে জালালি দোয়া পইড়া পইড়া জুলেখার পুরা শইল্লে ফুঁ দেউন্তি—এই সগল কাম ইসুফ মিয়ার মায় নেক-দিলে, জান-পরান ঢাইল্লা দিয়া করে।
ঘরের ছঞ্ছাতলায় জুলেখারে আইন্না—তার চুলের আগা নিজের হাতে কাইট্টা—সেই চুল বাড়ির নামার জিক্কা গাছের তলে পোতাইতেও সেয় কিছুমাত্র দেরি হইতে দেয় না। তার বাদে জুলেখার পিন্ধনের পুরান কাপোড়খান তগ-নগদ পোড়ানের বেবস্থা নিতেও কোনো গাফিলতি হইতে দেয় না ইসুফ মিয়ার মায়ে। সবই হয় সুহালে। কিন্তুক যেই ছেড়িটারে ঘরে তোলোনের লেইগা এতো এতো ক্রিয়া-করম, সেয়ই থাকে চেতন-হারা। তার শইল্লে পানি পড়তাছে, না আগুন জ্বলতাছে—সেইটা বোঝোনের য্যান কোনো ঠেকা নাই তার।
শোধন-সিনান তো যেমুন-তেমুন কইরা সামলানি দেওন যায়, কিন্তুক এই বেহুঁশ মাইয়ারে পড়া-পানি খাওনের উপায় কী! অই চেতন-ছাড়া দেহখানরে তো আর খাড়া রাইক্ষা পানি গিলান যাইবো না!
সগলতে বোঝে জুলেখারে পানি-পড়া খাওয়ানের উপায় একটাই! অর মোখে দফায় দফায় এট্টু এট্টু কইরা পানি দেওন যায় যুদি, তাইলেই একটা উপায় হয়! মাতারিরা কোনোমতে ধরাধরি কইরা জুলেখারে ঘরে নিয়া মাইজ্জালে শোয়ানিও দেয়। দিয়া, ঝিনুকে তুইল্লা তুইল্লা এক কোশ এক কোশ কইরা সবটি পড়া-পানিও ছেড়িটারে ঠায়-ঠিক হালে খাওয়ানি দেয় ইসুফ মিয়ার মায়েই।
কিন্তু কী আফসোস! যার লেইগা এতো লৌড়-ঝাঁপ সেয় যেমুন আধা বেহুঁশ দশায় আছিলো, বরাবইর তেমুনই বেহুঁশ বেবোধা পইড়া থাকে। তার নাকের সামোনে খোনে খোনে হাত যাইতে থাকে গা মাতারি তিনোজোনের। সেই হাতেরা পষ্টই বোঝে যে, দম পড়তাছে সোন্দর হালেই। তাইলে চেতন নাই ক্যান তাগো মাইয়ার!
ইমাম হুজুরে দিতে পারে না এই ভেদের মীমাংসা? হেয় না দিন-দুনিয়ার ভালা-বুরা কতো কিছু জানে! হেয় না মাইনষেরে কতো নিদানের খোঁজ দেয়! ছাই-কপালি জুলেখার মাওয়ের লেইগা হের কাছে কোনো নিদান নাই! দুনিয়ার এইটা কিমুন বিচার!
জুলেখার মাওয়ের এই চিক্কুররে যে এট্টু কোনো বুঝ দিয়া থামায়, ইমাম হুজুরে সেই সাহসখান পায় না নিজের দিলে। না না! এমুন বিত্তান্তরে সেয় জানে-শোনে না। এমুন আলামতরে সেয় চিনে তো নাইই। তাইলে এই বিষয়ে কোন মোখে কী কইতে যাইবো সেয়! কিচ্ছু কওনের মোখ নাই তার। কোনো মোখ নাই!
সেয় অখন খালি আল্লাহপাকের দরবারে মুনাজাত ধরতে পারে। গায়েবের মালিক আল্লায়! ভালা-বুরা সব তার হাতে! হেয় যুদি এই ভেদের মীমাংসা দেয়, তাইলে যুদি কোনো সুরাহা হয়।
অখন সগলতে মিল্লা আল্লার দরবারে কান্দাকাটি করোন ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেহে না ইমাম হুজুরে!
(চলবে)