স্মৃতিচারণ

দ্বিজেনমঙ্গল

Looks like you've blocked notifications!

উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্লাস চলছে। বাইরে ঠাঠা রোদ। নটর ডেম কলেজের তিনতলার সেকশন ছয়ে চলছে ক্লাস। ভেতরে শুধু ফ্যানের আওয়াজ। ছাত্র রয়েছে জনা চল্লিশের মতো। তারপরও চুপচাপ। কারণ, ক্লাস নিচ্ছেন সে সময়কার ‘ভীতিকর’ শিক্ষক মিজানুর রহমান। ছয় ফুটের মতো উচ্চতা, মুখভর্তি দাড়ি। আর সব সময় এক রঙের পাঞ্জাবি পরেন। তিনি একে একে সবাইকে দাঁড়াতে বলছেন আর বই থেকে পাঠ করতে বলছেন। একজনের এক অনুচ্ছেদ পড়া শেষ হলে, তিনি সেই বিষয়টি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। নটর ডেম কলেজে যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন এই কলেজটিকে বলা হয় মতিঝিলের ফুসফুস, কারণ এর গণ্ডির ভেতর বিপুল সবুজের সমারোহ। বিশাল বিশাল গাছ। সেগুলো ঝুমবর্ষায় যেমন এক ধরনের সৌন্দর্য ধারণ করত, আবার গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে এদের দেখাত উজ্জ্বল আকর্ষণীয়। তো, আমি জানালার ধারে বসে প্রায়ই সেই সবুজ উপভোগ করতাম। সেদিনের সেই ক্লাসেও আমার দৃষ্টি ছিল সবুজের দিকে, অমলকান্তির মতো, তবে আমি রোদ্দুর হতে চাইনি। তখন কবি হতে চাইছি মনেপ্রাণে।

হয়তো তখন সবুজ পাতায় ছলকে ওঠা চকচকে রোদ দেখতে দেখতে কবিতার লাইনই ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে, এমন সময় মিজান স্যার বললেন, ‘এই তুই দাঁড়া, পড়।’ বইয়ের পাতা ঠিকঠাক খুলে পড়তে শুরু করলাম আর উনি একটু পরই থামিয়ে দিলেন। আর এই থামিয়ে দেওয়ার কারণেই আমার সঙ্গে পরে পরিচয় হয় একজন জীববিজ্ঞানের শিক্ষক দ্বিজেন শর্মার। লেখক ও অনুবাদক দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে আমার পরিচয় আরো কিছুদিন পর। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

মিজান স্যার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোর গলাটা তো বেশ মোটা! কণ্ঠে দাপট আছে।’ এই ফাঁকে বলে রাখি আমি দশম শ্রেণি থেকেই আবৃত্তি করি, নিজে নিজে, আর নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি সেখানে আবৃত্তি দল আছে, তখন সেখানকার সদস্য হয়ে যাই, পরে সভাপতিও হই। যাক, তখন স্যার বললেন, ‘ক্লাস শেষে তুই আমার রুমে আসবি, কথা আছে।’

ক্লাস শেষে বন্ধুরা যারপরনাই অবাক! যে শিক্ষক ধমক ছাড়া কথা বলেন না, তিনি কি না বিধানের প্রশংসা করে দেখা করতে বলছেন? যাক, আমি ক্লাস শেষে উনার কাছে গেলাম। এবং উনি বললেন আমাকে উনার প্রয়োজন। কারণ ওই বছর, মানে ১৯৯৯ সালে নটর ডেম কলেজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হবে। এবং সেটির পরিচালনা করবেন মিজানুর রহমান স্যার। বিটিভিতে কিছুদিন কাজ করার সুবাদে ভিজুয়াল মিডিয়ার ওপর তার খানিকটা দখল ছিল।

তো, সেই প্রামাণ্যচিত্রে আমার ভূমিকা অনেক। এক, উনার সঙ্গে থাকতে হবে সহকারী হিসেবে। দুই, প্রামাণ্যচিত্রে পুরুষ যে কণ্ঠটি যাবে সেটি আমাকে দিতে হবে। এবং তিন, নটর ডেম কলেজের বিখ্যাত কজন প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। মিজান স্যারের সঙ্গে এই কাজ করতে গিয়েই প্রথম সিনেমার ভূত আমার মাথায় ঢোকে। এবং ওই সময় আমি লিনিয়ার এডিটিং প্যানেল কী, জিনিস তা দেখি। এখন অবশ্য এই জিনিস মাথা ঠুকেও পাওয়া যাবে না। এখন সব জায়গাতেই ননলিনিয়ার এডিটিং প্যানেল।

ওই প্রামাণ্যচিত্র আমার জীবনের, আমি মনে করি বিশাল মাইলফলক। আমি আর কিছু নিয়ে বিনয় করলেও ওই কাজটি নিয়ে আমি প্রকাশ্যে গর্ব করি। কারণ, প্রামাণ্যচিত্রে আমার মতো পুঁচকে (তখন বয়স টেনেটুনে ১৮) ছোড়ার সঙ্গে নারী কণ্ঠ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কীর্তন আঙ্গিকের গান ও পূজাবিষয়ক গানের শিল্পী প্রমীলা ভট্টাচার্য। উনি আমাদের কলেজে বাংলা পড়াতেন। কণ্ঠ ধারণের সময় আমার পাঠের প্রশংসা তিনি যেভাবে প্রাণখুলে করেছিলেন, আমার সারা জীবন সেটা মনে থাকবে।

আর ওই প্রামাণ্যচিত্রের বদৌলতেই আমি সাক্ষাৎকার নিতে পারি দ্বিজেন শর্মার। মিজান স্যার আমাকে বলেছিলেন, উনি খুব বড় মাপের উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং লেখক। ১৮ বছরের বালক আর কী-ই বা প্রশ্ন করতে পারে। তার তখনো দ্বিজেন শর্মাকে পড়া হয়ে ওঠেনি। আমার এখনো মনে পড়ে দ্বিজেন শর্মা কলেজের একটি উদ্যানে বসে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই উদ্যান তিনিই বানিয়েছিলেন। গোড়াপত্তন তাঁর হাত দিয়েই। কলেজের পেছনের দিকে মার্টিন হলের সামনে। নটর ডেম কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। এরপরই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুবাদকের কাজ নিয়ে দেশ ছাড়েন। ওই ১০ বছরের মধ্যেই দ্বিজেন শর্মা নটর ডেম কলেজে প্রচুর গাছপালা লাগিয়েছেন নিজ হাতে।

নিজের করা উদ্যানে স্মৃতি রোমন্থনের মধ্য দিয়েই চলছিল সাক্ষাৎকার পর্ব। আর সেটি ধারণ হয়েছিল দুই ক্যামেরায়। আমার হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল মাইক্রোফোন ধরে রাখতে রাখতে। আর দ্বিজেন শর্মা তখন বলে চলেছেন তাঁর সুদীর্ঘ উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা। আমি শুনছি, ভালো লাগছে, আবার অস্থিরও হচ্ছি ভেতরে ভেতরে। কখন শেষ হবে। আমার হাত ব্যথায় টনটন করছে। নড়াচড়ার সুযোগ নেই। পেছনে ক্যামেরা, নড়লে যদি এনজি শট হয়? আর মিজান স্যার ‘কাট’ না বলা পর্যন্ত কীভাবে নড়ি?

সেদিনই আমার সঙ্গে শিক্ষক দ্বিজেন শর্মার প্রথম পরিচয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি মানুষটিকে আবিষ্কার করতে শুরু করি একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। এই প্রেক্ষাপট বলার আগে এটা বলা জরুরি, আমি মোটামুটি অষ্টম শ্রেণি থেকে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই এবং শিবদাস ঘোষের বইপত্র নিয়ে ঘুরি আর বোঝার চেষ্টা করি। তো সেই সুবাদে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা ছিলই। হাজার হোক, পৃথিবীর একসময়কার বিশাল এই দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিল। লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি—এসব নাম যেমন তখন মাথার ভেতর ঘুরত, তেমনি হাতে হাতে ফিরত রাশিয়ার প্রগতি, রাদুগা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হওয়া অনুবাদ করা বিভিন্ন রকমের বাংলা বই। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না আমার সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন এইসব প্রকাশনীতে শুধু অনুবাদ করে। আহা, আফসোস! তাহলে সাক্ষাৎকারটা আরো জমানো যেত বোধহয়।

কলেজ পাস করার কিছুদিন পরই আমি ফুটপাত থেকে একটি বই কিনি, বইটির নাম ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, লেখক তিনজন—কো. আন্তোনভ, গ্রি. বোন্গার্দ লেভিন ও গ্রি কতোভ্স্কি। বইটি বেরিয়েছে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনী থেকে। এবং রাস্তায় বইটি উল্টে দেখি অনুবাদ করেছেন মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও দ্বিজেন শর্মা। আমার অবস্থা তখন আনন্দে আটখানা হওয়ার মতো। আরে এ তো সেই দ্বিজেন শর্মা, যাঁর সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি! এর পর থেকে লেখক দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে আমার পথচলা শুরু। এর পর একে একে তাঁর ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ড্যালটন হুকার’, ‘চার্লস ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’ ইত্যাদি বই আমার হাতে এসেছে, পড়েছি।

দ্বিজেন শর্মার রচনা পত্রিকায়ও পাই, পড়ি। এরই মধ্যে অনেক দিন গড়িয়ে যায়। ২০০৩-০৪ সাল থেকে আমরা কজন শিশু-কিশোরের জন্য একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা বলতে হাসান খুরশীদ রুমী, সাজ্জাদ কবির ও আমিসহ আরো অনেকে। এই তৎপরতা চলে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত। এর সময়ের ভেতরই একবার আবারও দীর্ঘ সাক্ষাৎ ও আড্ডা হয় দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে। এবার তাঁর মৌচাকের বাসায়। সঙ্গে ছিলেন নিসর্গ প্রেমিক মোকারম হোসেন। সময়টা ছিল বিকেলবেলা। উনি খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন, আর কথার মধ্যে ছিল সিলেটি ভাষার টান। আমি মুগ্ধ হয়েই তাঁর বিচ্ছিন্ন আলাপ শুনছিলাম, এটা মনে আছে। উনি আমাদের পত্রিকার জন্য একটি লেখা লিখে দিয়েছিলেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও।

আর আলাপ না বাড়িয়ে শুধু বলব, তাঁর লেখার সারল্য আমাকে যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি তিনি যে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রায় দুই দশক সোভিয়েত রাশিয়ায় বসে অনুবাদ করে গেছেন নানা সাহিত্য, সেই একাগ্রতাও আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করে, কিছুটা ঈর্ষান্বিতও। আমার মনে হয়, আহা দ্বিজের শর্মার জীবন যদি পেতাম! বিশুদ্ধ লিখেই যিনি পার করেছেন ১৭ বছর, স্বপ্নের সমাজতন্ত্রের দেশে!

[লেখাটি দ্বিজেন শর্মার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘প্রকৃতিপুত্র দ্বিজেন শর্মা’ স্মারকগ্রন্থে প্রথম সংকলিত হয়। সৈকত হাবিব ও মোকারম হোসেন সম্পাদিত বইটি প্রকাশ হয় ২০১৫ সালের জুন মাসে।]