সাক্ষাৎকার
বাংলাদেশ নিয়ে ট্রিলজি লিখতে চান সমরেশ মজুমদার
পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ (বাংলা ১৩৪৮ সালের ২৬ ফাল্গুন) পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। সেখানকার ডুয়ার্সের চা বাগানে কেটেছে তাঁর শৈশবজীবন। যার খণ্ড খণ্ড চিত্র পাওয়া যায় তাঁর জনপ্রিয় তিন উপন্যাসের প্রথম পর্ব ‘উত্তরাধিকার’-এ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষে গ্রুপ থিয়েটারে সম্পৃক্ত হন তিনি। নাটক লিখতে গিয়ে তাঁর প্রথম গল্প লেখা শুরু। প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ লিখেই তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে, তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি ও আঙ্গিক গতানুগতিকতার একঘেঁয়েমি থেকে মুক্ত। তাই সাহিত্যের পাঠকদের হৃদয়ে তিনি জায়গা দখল করে নেন অনায়সে। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আনন্দ পুরস্কার (১৯৮২), সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৪)। দুই বাংলায় জনপ্রিয় এই কথাশিল্পীর মুখোমুখি হন অঞ্জন আচার্য।
অঞ্জন আচার্য : নতুন কোনো লেখায় হাত দিচ্ছেন?
সমরেশ মজুমদার : একটা বৃহৎ উপন্যাসের পরিকল্পনা আমার মাথায় বহুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে কিছুতে শুরু করতে পারছি না। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ আজকের এই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ট্রিলজি উপন্যাস লিখব ভাবছি। জানি না হবে কি না। তবে এর জন্য আমি প্রচুর বই পড়েছি, অনেক উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। কিন্তু কাজে হাত দিতে দেরি হচ্ছে।
আচার্য : কেন?
মজুমদার : ভয় করছে।
আচার্য : ভয়?
মজুমদার : হ্যাঁ, ভয়। পাছে অন্ধের হস্তি দর্শন না হয়ে পড়ে।
আচার্য : কোন সময়টাকে মূলত ধরতে চাইছেন?
মজুমদার : দেখো, আজকের এই বাংলাদেশের পটভূমি অনেক ঘটনাবহুল। এই পটভূমিতে অনেক গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা হয়েছে। আমি মূলত ’৪৬-এর দাঙ্গা থেকে ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে ধরতে চাই। এর ভেতরে ’৪৭-এর দেশ বিভাগ, ’৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৭৫-এর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ আরো অনেক কিছু আসবে। যদিও এসব বিষয়বস্তু বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। একেকজন একেকভাবে তা তুলে ধরেছেন। আমি সেইসব লেখা যতটুকু সম্ভব সংগ্রহ করে পড়ে যাচ্ছি। আসলে আমার জন্মটা যদি এই বাংলাদেশের মাটিতে হতো এবং সেইসব ইতিহাসের ভেতর আমাকে যদি দিন অতিবাহিত করতে হতো, তবে লেখাটা অনেক সহজ হতো আমার জন্য।
আচার্য : বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় ভাষা আন্দোলন? আজ সেটি বিশ্বস্বীকৃত একটি দিবস। এটি আপনার ট্রিলজিতে কতখানি গুরুত্ব পাচ্ছে? বাংলাভাষী একজন লেখক হিসেবে সেটিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মজুমদার : ভাষা আন্দোলনের ওপর আলাদা একটি অধ্যায়ই রাখার পরিকল্পনা আছে। কারণ সেখানেই নিহিত আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রদীপ জ্বালাবার আগে তার পূর্বপ্রস্তুতি স্বরূপ যেভাবে সলতে পাকাতে হয়, সেই কাজটিই করেছে বাংলাদেশের মানুষ। তারা তাদের মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে, প্রাণ দিয়েছে, যা অন্য কোনো জাতিকে করতে হয়নি। ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। ঘোষিত সেই দিনটি ছিল ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। একজন বাংলাভাষী মানুষ হিসেবে আমি এর জন্য অত্যন্ত গর্বিত।
আচার্য : আপনার ‘সাতকাহন’ উপন্যাসের দীপাবলি, ‘কালবেলা’র মাধবীলতা, ‘গর্ভধারিণী’র জয়িতার মতো বলিষ্ঠ নারী চরিত্র অনেক লেখায় দেখা যায়। বাস্তব জীবনের কোনো নারী চরিত্রের প্রতিফলন কি এখানে ঘটেছে?
মজুমদার : আমাদের সৌভাগ্য যে, বাংলা সাহিত্যের এমন অনেক নারী এসেছেন, যাঁরা দৃঢ় ও ব্যতিক্রমী। পশ্চিমবঙ্গের আশাপূর্ণা দেবীর কথা বলা যায়। তিনি ঘর-সংসার করে, গৃহের অভ্যন্তরে অধিকাংশ সময় কাটিয়েও অমূল্য সব সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। তা ছাড়া মহাশ্বেতা দেবী তো আছেনই। তাঁর কর্মে, চিন্তায়, লেখায় এমন দৃঢ়তা দেখা যায়। বাংলাদেশের আরেকজন লেখক সেলিনা হোসেনেরও অনেক ভালো ভালো কাজ আছে, যাতে করে তাঁকেও ব্যতিক্রমী বলতে হয়। তা ছাড়া আমার চারপাশে প্রতিদিনের দেখা এমন অনেক নারী আছেন, যাঁরা সাধারণ, খ্যাতিমান নন। কিন্তু অনেক বেশি সংগ্রামী- দৃঢ়চিত্ত। সেসব অসংখ্য ব্যতিক্রমী মানুষের নির্যাস নিয়ে আমি এই চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছি।
আচার্য : বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাইছি।
মজুমদার : বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অংশ এই বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কবিতা ও গল্প বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে আমি শওকত ওসমানের লেখা পড়েছি। তাঁর লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর গদ্যের একটা লাইন আমার এখনো মনে পড়ে, ‘ঘষা আদুলির মতো চাঁদটা গাছের ডালে লাফ দিয়ে বসল।’ অসাধারণ এই বাক্যটি আমাকে আজও মোহিত করে। আমি ভেবে পাই না, এটা কোনো গল্পের লাইন নাকি কোনো কবিতার লাইন।
আচার্য : ‘নির্বাচিত কলাম’ বইয়ে উনার সঙ্গে আপনার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা পড়েছিলাম। সেটা যদি একটু বলতেন।
মজুমদার : সময়টা সম্ভবত ১৯৮৮-৯০ সালের দিকে হবে। সেবার এক আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছি। উঠেছি ঢাকা ক্লাবে। একদিন খুব সকালে আমার দরজার টোকা পড়ে। আমি ঘুম ভাঙা চোখে দরজা খুলি। দেখি দরজার ওপাশে একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কাকে চাইছেন? তিনি উত্তর না দিয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আমি কি জানতে পারি, আমি কার সমানে দাঁড়িয়ে আছি? আমি বললাম, আমার নাম সমরেশ মজুমদার। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, এবার আমি কি জানতে পারি, আমি কার সামনে দাঁড়িয়ে আছি? তিনি উত্তর দিলেন, আমি একজন পাঠক। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, পাঠকের নামটা কি জানা যাবে? তিনি উত্তর দিলেন, পাঠকের পিতৃদত্ত নাম শওকত ওসমান।
আচার্য : দাদা, এটা তাঁর পিতৃদত্ত নাম নয়। লেখক নাম। তাঁর আসল নাম শেখ আজিজুর রহমান।
মজুমদার : আমি তা জানতাম না। তিনি আমাকে ওই নামই বলেছিলেন। হয়তো সেই নামেই তিনি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন অথবা নামটি সাহিত্য মহলে পরিচিত নাম বলে আমাকে ওই নাম বলেছিলেন। তো, যাই হোক, আমি তো রীতিমতো অবাক! আসলে সেই সময়ে তাঁর বাড়ি থাকা সত্ত্বেও বাড়ি থেকে বিতাড়িত একজন মানুষ। আমাকে তিনি সে সময়ে অনেকগুলো কবিতার মতো ব্যঙ্গপঙক্তি দিয়েছিলেন, যার সবই ছিল মৌলবাদবিরোধী।
আচার্য : আর কার কার লেখা আপনার ভালো লাগে?
মজুমদার : অনেকের লেখাই ভালো লাগে। কত নাম বলব? শামসুর রাহমান, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, রফিক আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ...।
আচার্য : এই দেশের জনপ্রিয়ধারার সাহিত্য প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাইছি।
মজুমদার : এই দেশের জনপ্রিয় ধারার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনসহ অনেকেই আছেন। আমি মনে করি, হুমায়ূনের মধ্যে কিছু একটা আছে। তাঁর বইয়ের বিক্রি দেখে আমি বিস্মিত হই। তবে তাঁর লেখা পড়ে আমি তাঁকে বলেছি, তোমার লেখায় কোনো টাইম বা স্পেস থাকে না। তোমার নায়ক কখনো মিটিং-মিছিল বা বাজার করে না, যাতে করে সেই সময়টাকে বুঝতে পারা যায় না। তোমার নায়কের শরীরে কোনো আঁচড় লাগে না। আমি মনে করি, সময় ধরে সাহিত্য রচিত হলে পাঠক সময়কে আইডেন্টিফাই করতে পারে, তা না হলে সবকিছুই ভাসা ভাসা হয়ে যায়।
আচার্য : সাহিত্যের অমরতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মজুমদার : আমি তো মনে করি, কেউ মরে না। সবাই বেঁচে থাকে মনের গহিনে। সময়ে সময়ে তারা জেগে ওঠেন বা বেঁচে ওঠেন। সাহিত্যও তাই।
আচার্য : একটু ব্যাখ্যা করে যদি বলতেন।
মজুমদার : রবীন্দ্রনাথের গোরা, চতুরঙ্গ আজও বেঁচে আছে। আরো বহুদিন বেঁচে থাকবে। শরৎ, বিভূতি, তারাশঙ্কররা আরো ৫০ বছর বেঁচে থাকবেন। তাঁরা তো আছেনই। ধরো, আজ এ মুহূর্তে আমার ‘সাতকাহন’ বইটির কথা ৫০ বছরের কোনো লোক যদি আমাকে দেখে বলেন, বইটি পড়ে তাঁর খুব ভালো লেগেছে, তাতে আমার পুলকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, ওটা আমার ৩০ বছর আগের লেখা বই। যে আজ ৫০ বছর বয়সী, সে ৩০ বছর আগে ওটা পড়েছে এবং পরবর্তী সময়ে আমার আর কোনো লেখা পড়েনি বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ১৫ বছরের কোনো কিশোরী যদি বলে, এই বইটা পড়ে ভালো লেগেছে, তাতে করে ধরে নেওয়া যায় যে সে ওটা ইদানীংকার সময়ে পড়েছে। তাতে করে মনটা ভরে ওঠে এই ভেবে যে, বইটা এখনো পাঠক মহলে বেঁচে আছে। এটা অনেকটা অলিম্পিকের মশালের মতো। যেমন ধরো ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটির কথা, এ মুহূর্তে বইটি যদি কেউ পড়ে, তাহলে শহীদজননী জাহানারা ইমাম বেঁচে উঠবেন। এ বইটা আমার মনে এখনো দাগ কেটে আছে। দাগটা হয়তো আমৃত্যু থেকে যাবে।
আচার্য : আপনার মূল্যবান সময় থেকে খানিটা সময় আমাকে দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ, দাদা।
মজুমদার : তোমাকেও ধন্যবাদ, অঞ্জন। তোমার জন্য শুভকামনা।