ব্যক্তি সুনীল, কবি সুনীল এবং তাঁর প্রথম কবিতা
১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যার দেশ পত্রিকা। সেখানেই প্রথম প্রকাশিত হয় সুনীলের কবিতা। দেশের বয়স তখন ১৮। আর কবির বয়স ছিল ১৭। কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’। তখনো কবির নামের পেছনে ঝুলে ছিল ‘কুমার’ শব্দটি। এরপর ১৫ জানুয়ারি ১৯৫৫ সংখ্যায় ‘কুমার’ শব্দটি খসে পড়ে কবির নাম থেকে। নাম হয় শুধুই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথম লেখাটি ছিল এক কিশোরীর মন পাওয়ার আশায় রচিত। কারণ সুনীল জানতেন, সেই কিশোরীর বাসায় অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে রাখা হতো দেশ পত্রিকাটি। তাই তার মন পাওয়ার জন্য অথবা নিজের অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করার জন্য বের করলেন অভিনব এক বুদ্ধি। নিজেকে কবি হিসেবে কিশোরীর কাছে পৌঁছানোর অন্য কোনো উপায় না পেয়ে এ রকম পথ বেছে নেন তিনি।
সুনীলের নিজের কথায়– “একটি রচনা ঝোঁকের মাথায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়। কবি-খ্যাতির আশায় নয়, শুনেছিলাম, কোনো লেখা ছাপা হলে সেই পত্রিকা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয়, সত্যিই ডাকযোগে একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার একটি প্যাকেট পেলাম। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯৫১ সালের কোনো এক মাসের ‘দেশ’ পত্রিকায়, কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’ (দেশ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক হর্ষ দত্তের হিসাবমতে ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যা; সূত্র : ‘প্রিয় ‘দেশ’, প্রিয় ‘মানুষ’, হর্ষ দত্ত, দেশ, ১৬ কার্তিক ১৪১৯, ২ নভেম্বর ২০১২, ৮০ বর্ষ, ১ সংখ্যা, পৃ ৪০)। বন্ধুবান্ধব এবং সেই কিশোরী আমায় বলেছিল দেখেছ, দেশ-এ একজন একটা কবিতা লিখেছে। ঠিক তোমার সঙ্গে নাম মিলে গেছে। আমিই যে ওটা লিখতে পারি কেউ কল্পনাও করেনি, আমিও বলিনি।’
প্রথম কবিতা প্রকাশের আরো কিছু তথ্য জানা যায় সে-সময়ে দেশ পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এক লেখায়– ‘আমি এককালে দীর্ঘ ২৫ বছর দেশ পত্রিকায় কবিতাবিভাগ সম্পাদনা করেছি। একদিন ফাইল খুলে দেখি প্রচুর কবিতা জমে আছে। কিছু কবিতা মনোনীত হতো, অমনোনীত কবিতা ডাকটিকিট থাকলে ফেরত পাঠানো হতো, না হলে ফেলে দিতে হতো। সেখানে সুনীল কুমার গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজনের কবিতা আমার খুব ভালো লেগে যায়। আমি সেই কবিতাটি মনোনীত কবিতার ফাইলে রেখে দেই। …নতুন কেউ ভালো লিখছে, এ তো খুবই আনন্দের। আমি তখন সুনীলকে একটা চিঠি লিখি, ঠিকানা দেওয়া ছিল তো। সুনীল পরে আমাকে বলে যে, চিঠিটা পেয়ে সে খুব সঙ্কোচ বোধ করেছিল। সুনীল আর সেই চিঠির কোনো উত্তরই দেয়নি।’ (‘কখনও মানুষে বিশ্বাস হারায়নি’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দেশ, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৭)।
কবিতাটি যে সুনীল সেই কিশোরীর উদ্দেশেই লিখেছিলেন তা তিনি ওই বয়সে না হোক; পরে অবশ্য অকপটেই স্বীকার করেছেন তাঁর অনেক লেখায়। তাছাড়া সে-সময় প্রেমের ক্ষেত্রে কবিদের পাতে মোটামুটি ভাত জুটত বলা যায়। আর সাহিত্যপ্রেমী নারীদের কাছে তো কথাই নেই। যাই হোক, হুট করে একদিন দেশ পত্রিকার দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কবিতা, ছাপাও হয়ে গেল। তবে ঘটনা অন্য জায়গায়। সেই কবিতা দেখিয়ে ওই কিশোরী এসে সুনীলকে বলেছিল – ‘দেখো দেখো, দেশ পত্রিকায় একজনের কবিতা বেরিয়েছে। তার নামও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’
দেখ কাণ্ড! যে কিশোরী এ কথাগুলো বলছিল তার চোখের সামনেই যে স্বয়ং কবি দাঁড়ানো তা তাকে কে বোঝায়? তার ওপর মেয়েটি জানতেও পারেনি সেই কবি তার উদ্দেশেই এ-কবিতা লিখেছেন। নিজের কবিতার বিষয়ে অক্লেশে বলে গেছেন সুনীল, কোনো রাখঢাক কখনো কোথাও ছিল না (কেবল নীরা-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর ছাড়া, এ প্রশ্নে সুনীল বরাবরই বড় রহস্যময় ছিলেন) – ‘আমি প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি একটি মেয়েকে উদ্দেশ করে, আমার বয়স তখন পনেরোর একটু কম (হিসাব অনুযায়ী ১৭)। কিন্তু কথা হচ্ছে এই, হঠাৎ আমি কবিতা লিখতে শুরু করলাম কেন? আমাদের বংশে বা পরিবারে কেউ কখনো লেখক ছিলেন না। সাহিত্যানুকূল আবহাওয়া ছিল না আমাদের বাড়িতে। আমার ধারণা থাকা স্বাভাবিক ছিল যে, কবিতা রচনা অন্য একপ্রকার মনুষ্যজাতির কাজ– কারণ আমার চেনাশোন আত্মীয়স্বজন, বাবা-কাকা-জ্যাঠামশাইরা আহার-বাসস্থান সংগ্রহেই ব্যতিব্যস্ত। তবে আমার মধ্যে দুর্বলতা হঠাৎ জেগে উঠল কীভাবে?’ (সূত্র : কবিতার সুখ-দুঃখ, যুগলবন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; প্রথম দে’জ সংস্করণ : শ্রাবণ ১৪০২, আগস্ট ১৯৯৫, পৃ ৯)
এ প্রসঙ্গে সুনীল তাঁর সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই গ্রন্থের ‘স্বীকারোক্তি, স্মৃতি, স্বপ্ন’ শিরোনামের লেখায় এভাবেই উত্তর দিয়েছেন নিজে– ‘দুটি কারণে আমি প্রথম কবিতা লিখি। প্রথম যে বালিকার প্রণয়ে লিপ্ত হই সে কবিতা পড়তে ভালোবাসত– সে আমাকে যেসব চিঠি লিখত, তার অধিকাংশই কবিতার লাইনে সাজানো। সুতরাং তাকে মুগ্ধ করার জন্য স্বরচিত কবিতায় একবার চিঠি লেখার কথা মাথায় এলো। এই সময়েই ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরবর্তী ছুটিতে, আমার বাবা আমাকে দুপুরবেলা বাড়িতে আটকে রাখবার জন্য টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে দিতেন। কয়েকদিন বাদেই আমি নিজেই একটি কবিতা টেনিসনের বলে চালিয়ে দেই। সেটাই সন্ধ্যেবেলা সেই বালিকাটির হাতে দেই, আমার নতুন চিঠি হিসেবে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না ওটা পুরোপুরি আমার লেখা। তখন কবিতাটি কপি করে ডাকে পাঠিয়ে দেই ‘দেশ’ পত্রিকার ঠিকানায়। …‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয় আমার কবিতা, নাম ‘একটি চিঠি’। তখন আমি কলকাতার রাস্তাঘাটও ভালো করে চিনি না, ‘দেশ’ পত্রিকার কার্যালয় কোথায় তাও জানি না। আমি শুধু বন্ধুদের ও সেই বালিকাটিকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, ওই কবিতাটি আমারই লেখা এবং কবিতা লেখার ব্যাপারটা এমন কিছু শক্ত না।’ (‘কালের খেয়া’, সমকাল, ২ নভেম্বর ২০১২, পৃ ৬)।
কবি হওয়ার জন্য সুনীল মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। কবিতার আশপাশে ঘুরতে দেখা যায়নি তাঁকে কিশোর বয়সে। কবি হওয়ার স্বপ্ন তো দূরে থাক, বরং জীবনে তাঁর স্বপ্ন ছিল জাহাজের খালাসি হয়ে দেশে দেশে ভ্রমণ করার। ছাত্র বয়স থেকেই পায়ের তলে সর্ষে নিয়ে হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন সুনীল। নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনো দূরাকাঙ্ক্ষা ছিল না তাঁর। কলেজ-জীবনেও তাঁর সেই জাহাজের খালাসি হওয়ার স্বপ্নটা জিইয়ে ছিল। জাহাজের খালাসির চাকরি অবশ্য তাঁকে করতে হয়নি। তবে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে দিকশূন্যপুর যাত্রী নীললোহিতকে। নতুন কোথাও বেড়ানোর নেশা আমৃত্যু লালন করে গেছেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৬ অক্টোবর ২০১২ সালে প্রকাশিত সম্পাদকীয় পাতায় ‘শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ শিরোনামে যে-স্মরণ অংশটি প্রকাশিত হয় সেখানেও উঠে আসে সুনীলের আমৃত্যু বোহেমিয়ান চরিত্র – ‘ছাত্র বয়স থেকেই হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই বাউন্ডুলেপনা কোনো দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগনা থেকে প্যারিস, নিউইয়র্ক থেকে শান্তিনগর – সুনীলের উৎসাহ সমান।’
সুনীলের আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তি– ‘অনেক লেখকের খুব বাল্যকাল থেকে সাহিত্য রচনার দিকে অনেক ঝোঁক দেখা যায়। আমার ছিল না। আমি বই পড়তে ভালোবাসতাম, বই লেখার দায়িত্ব অন্য লোকের। আমার ঝোঁক ছিল নানারকম অ্যাডভেঞ্চারের দিকে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি কোনো না কোনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ-হঠাৎ বাইরে কোথাও চলে যেতাম। এমনও হয়েছে, সিমলা শহরের স্ক্যান্ডাল পয়েন্টে বসে বিখ্যাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি আমি আর আমার বন্ধু দীপক মজুমদার, পেটে দাউদাউ করে জ্বলছে খিদের আগুন, পকেটে একটাও পয়সা নেই, রাত্তিরে কী খাব তার ঠিক নেই। শুধু সঙ্গে আছে একটি রেলের পাস, তাও অন্যের নামে, সেটার সাহায্যে আমরা যেকোনো জায়গায় চলে যেতে পারি। … অনেকের মতো আমারও ছেলেবেলা থেকেই বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। জাহাজে আলুর খোসা ছাড়াবার চাকরি নিয়েও কোনো একদিন বিদেশে যাব, এ রকম ভেবে রেখেছিলাম এবং আর ফিরব না। সত্যি সত্যি বিদেশে যাওযার কিছুদিন পরই আমি ছটফটিয়ে উঠেছিলাম, আমার মন টেকেনি। তখন আমার কোনো বন্ধন ছিল না। যেকোনো ছুতোনাতায় বাইরের যেকোনো দেশে পাঁচ-সাত বছর কাটিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসেই, কিন্তু বাংলা ভাষা আমার মর্মে এমন গেঁথে গেছে যে এই আবর্জনা-ভরা, শত অসুবিধেয় ভরা কলকাতা ছেড়ে কিছুতেই বেশি দিন দূরে থাকতে পারি না।’
‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’ শিরোনামের লেখায় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখাটি শুরু করেছেন এভাবে– ‘যখন এ লেখা লিখছি, তখন সুনীল বড় একা হয়ে শুয়ে আছে ঠান্ডা ঘরে, পিস হ্যাভেনে। ডোরবেল বাজিয়ে কেউ আসবে না আজ। সুনীল উঠে গিয়ে দরজা খুলে প্রসন্ন মুখে বলবে না, আরে, এসো এসো! … বেড়াতে যেতে বড় ভালোবাসত সুনীল। নতুন অচেনা কোনো জায়গায় যাওয়ার কথা শুনলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত চোখ। আজও সুনীল চলল নতুন এক দেশে।’ (‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেশ, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৩)
আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায় – ‘সুনীল খুব বড় মাপের লেখক, আবার খুব বড় মনের মানুষও বটে। ওর সমসাময়িক যাঁরা সাহিত্যিক, ও চেয়েছে তাঁদের প্রাপ্যটা যেন তাঁরা পান। ওর মধ্যে কখনো ঈর্ষা, হিংসা দেখিনি। ওর চেয়ে বয়েসে যারা ছোট, তাদের দিকে ও সবসময়ই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু যে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক, তা নয়, সংসার চালানোরও একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া! যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। এসব ব্যাপারে প্রখর নজর ছিল সুনীলের। … এখান থেকেই বলা যায়, সুনীল ভালোবাসাকেই তার ধর্ম বলে মেনে এসেছেন। ও বিশ্বাস করত, ভালোবাসার ওষুধ প্রয়োগ করে মানুষের সব অসুখ সারিয়ে তোলা যায়! ধর্মে বিশ্বাস না করুক, ঈশ্বরে বিশ্বাস না করুক, কিন্তু ভালোবাসায় বিশ্বাসী। আসলে, কবিদের কাছাকাছি পৌঁছতে হলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একটা মইয়ের প্রয়োজন হয়, নইলে নাগাল পাব না তো! … সুনীল ঘোষিত নাস্তিক। … সুনীল নাস্তিক হলেও, মানুষের কল্যাণ কামনা করত সব সময়। যদি আমরা ঈশ্বরকে মঙ্গলময় বলে ভাবি, তবে মানুষও তো সেই ঐশ্বরিক দায়িত্বটা নিতে পারে। সুনীল তো মানুষে বিশ্বাস হারায়নি কখনো, অনেক মানুষের অনেক কুকীর্তি সে প্রত্যক্ষ করেছে, তা সত্ত্বেও মানুষের প্রতি ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। সে দুঃখবাদীও নয়, হতাশাবাদীও নয়, সুনীল অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ এবং মানুষ সম্পর্কে তার আশা ভরসাকে সে শেষদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল।’ (‘কখনো মানুষে বিশ্বাস হারায়নি’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দেশ, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৮-৩০]