আমাদের ভাষা ও সাহিত্য দুটোই সমৃদ্ধ : ড. মাহবুবুল হক

Looks like you've blocked notifications!

ড. মাহবুবুল হক একজন গবেষক, ভাষাবিদ ও অধ্যাপক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ এবং পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতায় অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা, অনুবাদ ও পাঠ্যবই রচনা করে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন দেশে ও দেশের বাইরে। বাংলাদেশ, ভারত ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়েছে চল্লিশটির বেশি বই। ড. মাহবুবুল হক বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ নানা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তাঁর। পেয়েছেন নজরুল পদক, মধুসূদন পদকসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। আগামীকাল ৩ নভেম্বর ড. মাহবুবুল হক পূর্ণ করবেন ৬৯ বছর। এ উপলক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ সনজয়। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ নিচে দেওয়া হলো। 

দীর্ঘ জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি...

প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে আমি কখনো ভাবি নাই। আমি ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশ, যে সংস্কৃতি, যে সংগ্রামশীলতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি, তাতে সব সময় আমার ভেতর একটা মানবিকবোধ কাজ করেছে। এই বোধ মানুষকে ভালোবাসার, দেশকে ভালোবাসার, সেই সঙ্গে বিশ্বকে ভালোবাসার। আমার জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা সাধনা-আমার সব কাজের পেছনে রয়েছে মানুষের জন্য ভালোবাসা, দেশের জন্য ভালোবাসা, বিশ্বের জন্য ভালোবাসা।

এভাবেই আমি দেখেছি এবং আমার মনে হয়েছে, আমি দীর্ঘ জীবন পেয়েছি। এই দীর্ঘ জীবনে যতটা সাধ্য প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। নিজেকে গড়ে তোলা, আমার ছাত্রদের জন্য পাঠদান করা। এর বাইরে লেখালেখি করা। সব ক্ষেত্রেই আমি চেষ্টা করেছি আন্তরিকভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে, সচেতনতার সঙ্গে কাজ করার। আমার মনে হয়, আমার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এবং যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকি হয়তো আরো কিছু কাজ করার চিন্তা আমার আছে।

আরো সহজ বাংলা ব্যাকরণ কিংবা একটা স্মৃতিকথার হা-পিত্যেশ
ভেবেছিলাম, অবসরের পর একটা স্মৃতিকথা লিখব। আমার ছেলেবেলা নিয়ে, আমার শিক্ষাজীবন নিয়ে, আমার রাজনৈতিক সংগ্রাম, ছাত্রজীবন, শিক্ষকতা এবং নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে। যুক্ত করব দেশে-বিদেশে বিচরণ অভিজ্ঞতা। 

সেইসব কথা আমি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব নেওয়ার পর তাতে ব্যাঘাত ঘটে। এরপর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি আশা করি, যদি আবার সুস্থতার মধ্যে থাকি, তাহলে সেই স্মৃতিকথা লেখার চেষ্টা করব। 

একটা ছোট চিন্তা ছিল, সেটা কিন্তু ক্রমে বড় চিন্তার দিকে এগোচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বাংলা ভাষায় প্রকৃত ব্যাকরণ লেখা হয়নি। বাংলা ভাষায় প্রকৃত ব্যাকরণ লেখার জন্য এক শতক ধরে তেমন কোনো বড় কাজ হয়নি। বাংলা একাডেমি একটা উদ্যোগ নিয়ে দুই বাংলার পণ্ডিতদের নিয়ে একটা বড় কাজ করার চেষ্টা করেছে। তারপরও মনে হয়, আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আরো সহজবোধ্য, আর ব্যবহারোপযোগী ব্যাকরণ রচনা করতে চাই। তার জন্য কিছু কাজকর্ম করেছি। আমি জানি না সেটা সম্পূর্ণ হবে কি না!

বাংলা বানান হবে বাংলা ভাষার নিজস্ব ধ্বনিপদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ
বাংলা বানানের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি, অসংগতি, মতপার্থক্যগুলো শিক্ষকতা জীবনের শুরু থেকেই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এবং পরে ঘটনাচক্রে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে আশির দশকে বাংলা বানানের সমতা বিধানের একটা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এটা খুবই ইতিবাচক উদ্যোগ ছিল। স্কুলের বইতে শিশু শিক্ষার্থীরা একেকটি শব্দের  বানান একেক রকম পড়ছে একেক বইতে। এটা দূর করার জন্য তারা সমতা বিধানের উদ্যোগ নিল। এবং এ উদ্যোগের ফলে বাংলা ভাষার হরফের স্বচ্ছতা, বাংলা বানানের সমতা বিধান এবং বাংলা বানানের একটা শৃঙ্খলা নতুনভাবে তৈরি করার একটা উদ্যোগ আমাদের দেশে তৈরি হয়। এরপর নব্বইয়ের দশকে পশ্চিম বাংলার বাংলা একাডেমি এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। 

আশির দশকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলা বানান সম্পর্কে আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। পরে জামিল চৌধুরী বাংলা একাডেমিতে একটা বাংলা বানানের নিয়মের বই রচনা করেন। তিনি সেই কাজের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করেছিলেন। আমি নিজে ’৯১ সালে বাংলা বানানের নিয়ম নামে একটা বই লিখি। এই বইটা একসঙ্গে ঢাকা এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে এটি আলোড়ন তৈরি করে। এ রকম বানানের নিয়ম এর আগে কেউ লেখেননি। পরে বাংলা একাডেমির বানান কমিটির সঙ্গে আমি যুক্ত হই। আমার মতে, বাংলা বানান হবে বাংলা ভাষার নিজস্ব যে ধ্বনিপদ্ধতি তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সবাই সেটা ভাবেন না। অনেকে সংস্কৃত বানানের দ্বারা প্রভাবিত। অনেকে প্রচলিত বানান দ্বারা প্রভাবিত। অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল বানান লেখেন। সে জায়গায় একটা সমতার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি অগ্রসর ভূমিকা নিয়েছিল। এবং শিক্ষা বোর্ড তা গ্রহণ করেছিল।

বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যই শক্তি
বাংলা ভাষার চর্চার ব্যাপারে আমাদের দেশে অনেক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। যখনই বিতর্ক হয়, যখনই কোনো প্রশ্ন ওঠে, তখনই মনে হয় দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ভাষা সম্পর্কে এই যে দৃষ্টি আকর্ষণ এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সবার মধ্যে বানান সম্পর্কে, ভাষা সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। ভাষার মধ্যে যখন বাইরের শব্দ অনেক বেশি করে ঢুকে পড়ার চেষ্টা চলে, কখনো কেউ চেষ্টা করে, কখনো স্বাভাবিকভাবে ঢুকে পড়ে, তখন আমরা সচেতন হয়ে উঠি। যখন বাংলা ভাষার উচ্চারণ নিয়ে বিকৃতি ঘটে রেডিও-টেলিভিশনে তখন আমরা সচেতন হয়ে উঠি। আমরা ভাবি, এই বিকৃতি কতটা গ্রহণযোগ্য, কতটা সংগতিপূর্ণ, এটি বাংলা ভাষার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে বিনষ্ট করবে কি না?

আসলে ভাষা পরিবর্তনশীল, ভাষার কিছু কিছু পরিবর্তন হবে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সংস্কৃতির উন্নয়নের সঙ্গে, বিশ্বায়নের সঙ্গে। ভাষার পরিবর্তন আসবে। নতুন নতুন শব্দ আসবে। নতুন ভাবধারণা আসবে। তার সঙ্গে শব্দ ঢুকে পড়বে। এটা স্বাভাবিক। সেগুলো আমরা গ্রহণ করব। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায়, ভাষার মধ্যে প্রকাশ করার মতো সুন্দর শব্দ থাকার পরও আমরা তা বাদ দিয়ে জোর করে বিদেশি শব্দ ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এটি জোর করা। এটি ধার করা। এটা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ভাষা যখন ঢুকে পড়ে তাতে আমি দুঃখ পাই না। আমাদের ভাষার এত বৈচিত্র্য যে আমরা বহু রকম ভাব, অনেক সূক্ষ্ম ভাব প্রকাশ করতে পারি। প্রচুর শব্দভাণ্ডার, সম্ভার রয়েছে বলেই পারি।

দরকার বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের প্রতি মমতা
আমি ভাষা নিয়ে কাজ করছি। সাহিত্য নিয়ে কাজ করছি। আসলে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য-দুটোই সমৃদ্ধ। যদিও বাংলা ভাষায় রচিত আন্তর্জাতিক মানে অনুবাদে সাহিত্য প্রকাশিত হয় নি। সেজন্য এর যে গুরুত্ব, এই ভান্ডারের যে বিশালত্ব, সৃজনশীলতার যে অভিনবত্ব তা পৃথিবীর কাছে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের এত এত সাহিত্যিক। তারা যে সৃষ্টিকর্ম তৈরি করেছেন সেগুলো কিছু চলচ্চিত্র, কিছু অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। 

আরেকটি বিষয়, সাহিত্যের প্রতি মমতা। এটি তৈরি করা খুব দরকার। বিশেষ করে যখন বিশ্বায়ন হচ্ছে। এই বিশ্বায়নে নানাভাবে বাংলা ভাষার ওপর অন্য ভাষার আধিপত্য তৈরির চেষ্টা চলছে। বাংলা সাহিত্যের ওপর আধিপত্যের একটা প্রবণতা আমি লক্ষ করছি। আমাদের সাহিত্যের যে ঐতিহ্য আছে তার প্রতি মমতা যদি তৈরি না করতে পারি, তাহলে আমাদের এই সাহিত্য ভাণ্ডার আস্তে আস্তে মূল্যহীন এবং দুর্বল হয়ে পড়বে। এবং এর যে মহিমা, সেই মহিমার মূল্য আমাদের কাছে ছোট হয়ে যাবে।