আমাকে আবিষ্কার করেন এস এম সুলতান : ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

Looks like you've blocked notifications!

বেঙ্গল গ্যালারী অব ফাইন আর্টসে গত ৭ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ৮১টি ভাস্কর্য নিয়ে ‘নামিল শ্রাবণ সন্ধ্যা’ শীর্ষক এক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি যৌথভাবে উদ্বোধন করেন পরিবেশবাদী ইনাম আল হক, আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং চিত্রশিল্পী রোকেয়া সুলতানা।

বাংলাদেশে ভাস্কর্য চর্চার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় । মাধ্যমের ব্যয়সাপেক্ষতা, সুপরিসর স্থানের অভাব, সময় ও শ্রমসাপেক্ষ চর্চা পদ্ধতির তুলনায় অনিশ্চিত বাজার ইত্যাদি কারণে ভাস্কর্য চর্চার পরিসর সময়ের সঙ্গে বিস্তৃত হয়নি । তবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী কিন্তু চর্চা করে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবেই লাভক্ষতির হিসাব আর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাবকে এক পাশে সরিয়ে রেখেই । তিনি একজন প্রকৃতির পরিব্রাজক, প্রকৃতির ভাস্কর, তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি বোধহয় অনুভূতির ভাস্কর। আমাদের চিরচেনা প্রকৃতির নানা তুচ্ছ আর প্রচ্ছন্ন অবয়বে তিনি যে বিভাসিত বিন্যাসের সন্ধান করেন এবং তারপর সেই অবয়বে নিজের বোধ আর শিল্পিত রূপকল্পের সম্মিলন ঘটিয়ে যে অমর্ত্য রূপ প্রদান করেন আর সেই রূপে যে বেগ থাকে, আবেগ থাকে, প্রণয় থাকে, মায়া থাকে, বেদনা থাকে, আলোর আলোড়ন থাকে – সেটি তো তাঁর অভ্রান্ত অনুভূতির কারণেই। প্রিয়ভাষিণীর নির্মাণশৈলী মাধ্যমে হিসেবে ভাস্কর্যকে আমাদের সামনে নতুনভাবে উপস্হাপন করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদ্যেও তিনি আশ্রয় খুঁজে পান, আশার বসতি গড়ে তোলেন, অনিঃশেষ সৃষ্টির জন্য অনিবারিত উদ্দীপনার জোগান পান। অতি তুচ্ছ বিষয়কে আশ্রয় করে তিনি যা সৃজন করেন তা শিল্পগুণে ও সৃজনধর্মীতায় হয়ে ওঠে অসামান্য ।

শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ২০১০ সালে শিল্প ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সর্ব্বোচ বেসামরিক সম্মান ‘স্বধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ করেন । তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সম্প্রতি নিজের শিল্পকর্ম ও তাঁর উপর হুমকি নিয়ে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।

প্রশ্ন : আমরা সচরাচর যে সব ভাস্কর্য দেখি তা থেকে আপনারগুলো বেশ আলাদা, আপনার প্রায় প্রতিটি ভাস্কর্যের সাথে টব সহ গাছ আবার কোন কোন ভাস্কর্যের সাথেই লতাপাতা উঠে গেছে এটার বিশেষ কোন কারণ আছে কি?

প্রিয়ভাষিণী : পরিবেশকে আমি ব্যাল্যান্স করার জন্য, এগুলো সব কিন্তু প্রকৃতি থেকে নেওয়া ন্যাচারাল পরিবেশকে আমি রাখতে চাই সব সময়, এটা আমার বিক্রির জন্য সহায়ক হোক আর না হোক যদি মনে করি যে অনেকে বলবে যে অমুক কী এক্সবিশন করেছে, বাণিজ্য ব্যাপারটাকে আমি নিজের মাথায় রাখি না, গেলে যাবে, না গেলে সব কাজ আমার ফেরত যাবে, এত মগ্নতায় করা যে কোন কাজ আমার বেঁচে থাকার জন্য আমাকে সেল করতে হয়, না হলে আমি সেল করতাম না, খুব বড়লোক হলে সেল করতাম না,  আমি একটা ভাড়া বাসায় থাকি, জায়গা দিতে পারিনা, এ কারণেই অন্যের হাতে তুলে দিতে হয়। তবে যারা নেন তারা তো আবার আদর করেই নেন, অর্থ ব্যয় করে যে আদর করে নিবেন, সেটা একটা ব্যাপার না? না আমার শর্ত ত্যাগ আছে কিন্তু যারা অর্থ ব্যয় করে নেন তাদেরও তো একটা মাহাত্ম কাজ করে, তাঁরা এই গাছটিকে কিনে নিচ্ছেন।

প্রশ্ন : আপনার এই কাজগুলো করতে কেমন সময় লেগেছে?

প্রিয়ভাষিণী : তা তো অনেক সময় লেগেছে, আমি প্রতি প্রদর্শনীতে নতুন নতুন কাজ দেবার চেষ্টা করি। আমার মাধ্যম চেঞ্জ করতে বলেছেন অনেকে, আমি সেই মাধ্যম চেঞ্জ করিনা, কারণ আমি সেই একই মাধ্যমে থাকতে চাই কিন্তু আমার অনেক ধরনের ফর্ম পরিবর্তন হতে পারে।

প্রশ্ন : একটা ব্যাপার জানতে চাই, আপনার প্রায় প্রত্যেকটা কাজ যেমন- ‘৭১-এর যাত্রী’ মিছিল, শ্যামল প্রকৃতি, শ্রমিকের ছন্দ, প্রাচীন বাড়ি, এইরকম কাজ ও নামকরণের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রাণ প্রকৃতির একটা খণ্ডচিত্র দেখতে পাই এর পিছনে কী কাজ করে? 

প্রিয়ভাষিণী : (হাসি) এটুকো বুঝেছো তো আমি অতি মাত্রায় প্রেমিকমনা, আমি কিন্তু যেকোন একটা স্কাল্পচার হুট করে তৈরি করিনা। ওটাকে নিয়ে ভাবতে হয়, অনেক বেশি অবজারভেশনে রাখতে হয়, ইনার এক্সপ্রেশন আনতে হয়, চট করে কাটলাম, একটা মানুষ বানালাম, ব্যাপারটা তেমন নয়।
 
আমি অনেক সময় অনেক কাজ দেখতে পাই যে মানুষের মত দেখা যাচ্ছে, আমি কখনো সেটা শিল্পে রূপ দেবোনা যতক্ষণ না তাঁর ইনার এক্সপ্রেশনটাকে বের করে নিয়ে আসতে পারছি। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে আছি, তোমার বের করতে হবে আমি কিভাবে কী চিন্তা করে তাকাচ্ছি সেটা। ভিতরের ব্যাপারটা উঠে আসতে হবে, সেটার জন্য আমি অপেক্ষা করি । কাজটা নির্বাচন করতে আমার সময় লাগে ।
 
প্রতিটা কাজের সাথে আমার রাতের পর রাত নির্ঘুমে কেটে যায়, যতক্ষণ না আমি খুঁজে পাচ্ছি ওর এক্সপ্রেশনটা, ওর চাহনির মধ্যে কী আছে, ওর বসে থাকার মধ্যে কী আছে, আমাকে চিন্তা করতে হয়, তারপর সবচেয়ে যেটা আমার ভালো লাগে সেটা আমি করি ।

প্রশ্ন : আমরা যে সকল বিমূর্ত ভাস্কর্য দেখি- অনেকটাই বুঝে উঠতে পারিনা, এটা কী, কিন্তু আপনার প্রায় প্রত্যেকটা কাজ বিমূর্তার মধ্যে মূর্ত প্রতীক ও তাঁর বক্তব্য ফুটে উঠেছে তা যে কেউই মোটামোটি বলে দিতে পারবে, আপনি কি সেই ভাবনাটা মাথায় রেখেই করেন?
 
প্রিয়ভাষিণী : হ্যাঁ অনেক বেশি, অনেক বেশি ভাবি, গাড়িতে যাচ্ছি বা ফিরে আসছি ঐ চেহারাটা মনে পরছে বাসায় গিয়ে আবার ওটা নিয়ে বসবো, কী মনে হচ্ছে শতবার সহস্রবার দেখি যতক্ষণ না আমার সন্তুষ্টির মধ্যে না আসে ততক্ষণ ছাড়ি না ওকে ।

প্রশ্ন : মূলত ফিগারেটিভ কাজ এখন বেশি কেউ করে না, হয়তো বাজারও একটা কারণ, আপনার এই প্রদর্শনীতেও অনেক ফিগারেটিভ কাজ আছে, আপনি কি সেগুলোতে সমসাময়িক সামাজিক রাজনৈতিক এক্সপ্রেশন দেয়ার চেষ্টা করেছেন?

প্রিয়ভাষিণী : তোমরা আমার মিছিলের কাজটা দেখেছো তো, অনেকগুলো ব্যাপার ছিলো, আমি সেটা ফুটাতে চেয়েছিলাম কিন্তু অনেকগুলো কাজ আমি দিতে পারিনি, জায়গা আমাকে পারমিট করেনি, তারমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের একটা খুব সুন্দর কাজ ছিলো। পরে গিয়েছে গুলি খেয়ে, সত্যিই গুলি খেয়ে পরেছে, আমি কেটে কেটে বানাইনি, গুলি খাওয়ার মত করে একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধ শিবিরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে নদীর ঘাটে, এরকম ভালো ভালো কিছু কাজ তারপরে ‘৭১ এর যাত্রী’ এখানে একটা কাজ আছে, এরকম কিছু কিছু কাজ থাকে কিন্তু জোর করে একটা মুক্তিযুদ্ধ বানাবো যদি আমার শিকড়ে না আসে, আমি তাকে জোর করে একটা শিকড় বানাবো যে একাত্তরের সেই দুঃখের দিনগুলোর মতো যদি সত্যি সেটা দুঃখ বয়ে আনে- আমি সেটা নির্বাচন করবো, আমি সেই সততার সাথে থাকতে চাই, কাজটা আমার বিক্রি না হোক, কারন বিষণ্ণতা অনেকে বিক্রি করে না, অনেকে কিনতে চায় না, বিষণ্ণতাকে অশুভ মনে করে, আমি জানি এটা বিক্রি হবে না। এটা বিক্রি হওয়ার ব্যাপার না, মানুষের মনে প্রবেশের ব্যাপার।
 
প্রশ্ন : আচ্ছা গতকালের ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে? আপনাকে যে হুমকি দেওয়া হয়েছে টেলিফোনে?

প্রিয়ভাষিণী : আসলে আমাকে মানুষে মন্দ বলছে কারণ এ কথার সদোত্তর আমি দিতে পারছি না, কারণ আমার মাথায় আসেনি। এগুলো আমার কাছে ধূলোর মতো, আমি একাত্তরের মত অত বড় কালরাত্রি পাড় করে এসে- এসব হুমকিতে ভয় পাবো? তুচ্ছ ব্যাপার এটা, এটা এই ধুলো পা দিয়ে ডোলে ফেলে দিতে হবে। এই যে জনকণ্ঠ পত্রিকা লিখেছে প্রিয়ভাষিণী প্রোটেকশন চেয়েছেন, আমি কিন্তু চাইনি কোনো প্রোটেকশন, কখনো প্রোটেকশন চাইনি। তবে যদি রাষ্ট্র মনে করে, আমাকে প্রোটেকশন দিতেই হবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমি প্রোটেকশন চাইনি।
 
প্রশ্ন : আমরা জানি যে আপনি ভাস্কর্যচর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেননি, কিন্তু বাংলাদেশে যে কজন ভাস্করের নাম আসে তাঁদের মধ্যে আপনি অন্যতম।

প্রিয়ভাষিণী : (হাসি)আমি সন্মানিত বোধ করলাম।

প্রশ্ন : আপনি কবে থেকে ভাস্কর্যচর্চা শুরু করেন?

প্রিয়ভাষিণী : আমি যখন সিলেট শহরে ছিলাম, আমার বাচ্চা কোলে একটা আর একটা হাত ধরতো এই নিয়ে আমার কোন জীবন ছিলোনা, সংসারে কাজ করতে করতে আমার জীবন যেতো, আমার হাসবেন্ড আবার এসব ব্যাপারে খুব সহমর্মিতা দেখাতো, উনি অফিসে চলে যেতেন, আমি হাপিয়ে উঠতাম একা বাসার মধ্যে, আমি বসে বসে দেখতাম কী...

প্রশ্ন : এটা কত সালের দিকে?

প্রিয়ভাষিণী : এটা ১৯৭৪ কিংবা ৭৫-এর দিকে হবে। আমার ডাইনিং টেবিল থেকে চেরাপুঞ্জি পাহাড়টা রঙ বদলাচ্ছে, কখনো ওপারে আধা ঘন্টা বেশি তো, এপারে আধা ঘন্টা কম, দেখতাম কী চেরাপুঞ্জি রঙ বদলাতে বদলাতে সোনালী একটা পারের মত তৈরি হইছে সূর্যের আলো পরে, আর নেভি-ব্লু কালারে একটা পাহাড় আমি ভাবতাম কি আমি যেন এখানে বসে খেতে খেতে আমার জীবনটা চলে যায়, এই দৃশ্য থেকে যেন আমাকে ছেড়ে সরে পরতে না হয়। তবে সিলেটের অনেক ভালো ভালো জায়গা আছে, যেখানে গেলে আমার হাসবেন্ড আমাকে কখনো রেখে যেতো না, মাধবকুন্ড, বড়লেখা, জাফ্লং, সমস্ত চা বাগানে- সব জায়গাতে উনি আমাকে নিয়ে যেতো, এটা উনার খুব ভালো গুন ছিলো। সে বেড়াতে ভালোবাসতো, সে কোথায় আমাকে ছাড়া যেতেন না, আমিও উনার সাথে বেড়াতাম, সংসার খুব মন দিয়ে করেছি আমি, সবচেয়ে ভালোবাসি ঘরে থাকতে, সবচেয়ে মন ভালো করার জায়গা ঘর, আমি আমার গাছ দেখি, আমাকে কেউ দাওয়াত করলে মনে মনে বিব্রত হই- যেতে দুঘন্টা, সেখানে থাকতে হবে দুঘন্টা, আবার আসতে হবে, এই চার পাচ ঘন্টা আমি আমার গাছ দেখবো না, ঘর দেখবো না, আসলে একটা টান আছে বুঝেছো? 

প্রশ্ন : তাহলে সেই সত্তরের দশক থেকেই কি আপনার কাজ শুরু?

প্রিয়ভাষিণী : হ্যাঁ ঐ ১৯৭৪ সাল থেকে- অবশ্য তখন বুঝতাম না খুব বেশি, তখন পেপার কেটে কেটে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ এগুলো করতাম, ওটা ভালো লাগতো, তারপর দেখি যে শুকনো পাতার সাথে একটু সবুজ পাতা রাখি, কেমন লাগে দেখি, ঘর সাজাতাম- গৃহশৈলী। তারপর শিল্পী এস এম সুলতান আমাকে আবিস্কার করলেন, উনি জিজ্ঞেস করেন, এগুলো কী? আমি বলি এগুলো...

প্রশ্ন : শিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গে আপনার দেখা কত সালের দিকে?

প্রিয়ভাষিণী : সাতাত্তরের দিকে হবে, সুলতান ভাই খুব বড় অনুপ্রেরণা, আমাকে নিয়ে  উনি একজন কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার মত ঘুরতেন, সুবীর তখন সুবীর দা শিল্পকলাতে, উনি তাকে বলতেন, এই মেয়েটিকে দেখো, এ কিন্তু একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে, তোমরা বুঝতে পারছো না, একে একটু দেখো, তখন কেউ দেখতো না আমাকে (হাসি)। তারপর আরো একটা বড় অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন আমাকে ফয়েজ ভাই। আমার একটু শিশুবৃত্তি ছিলো, মনের মধ্যে পোর্টফলিও তৈরি করে করে সব জায়গায় যেতাম- ‘আমার একটা এক্সিবিশন করে দিবেন’ এরকম বলতাম, ফয়েজ ভাই তখন প্রথম গ্যালারী করলেন শিল্পাঙ্গন। তখন সবাই বলল, আপনি ফয়েজ ভাইয়ের কাছে যান। অনেক ঘুরতাম একটু দেখা পাওয়ার জন্য। একদিন সন্ধ্যায় সময় দিলেন। আমার কাজ দেখে-টেকে আমাকে অনেক কাপ চাও খাওলানে। প্রায় তিন কাপ চা শেষ করলাম, তো লোকজন আসছে চলে যাচ্ছে, তারপর উনি বললেন, একটা কথা বলবো, ইউ আর টু জুনিয়র একটা এক্সিবিশন করার জন্য। 

তখন এই কথাটা শুনে আমার মনে হলো, আমি অনেক কাজ করবো তারপর নিজের যোগ্যতায় একটা জায়গায় পৌঁছুবো। এরপর আমি দাঁত চেপে কাজ শুরু করলাম। আজকে পর্যন্ত, ১৯৭৫ থেকে, আমার ছুরি কাঁচি থামে নাই, কোনোদিন আপনি যদি যান, দেখবেন আমি আমার বারান্দায় এলোমেলো করে কাজ করছি, এই অবস্থায় আমাকে সবাই দেখেছে। 

প্রশ্ন : আগামী দিনে নতুন যারা ভাস্কর্যচর্চা করবে তাদের উদ্দেশ্য কোন উপদেশ বা কিছু বলবেন?

প্রিয়ভাষিণী : একটা কথা কী আমি উপদেশ দিতে চাই না। উপদেশ নিতে পছন্দ করি, আমি সবার থেকে ছোট হয়ে থাকতে চাই, যাতে তরুণ সমাজ- তাদের কাছ থেকেও আমি শিখতে পারি, আমি মনে করি যে, কোন কাজের প্রতি- কাজ করতে গেলে যে সততা দরকার, আপনি যদি চোর হতে চান- তাহলে আপনাকে ডিক্লার দিয়ে চোর হতে হবে। আমি একটু চুরি করতে চাচ্ছি, আপনি একটু সরে যান আপনাকে এটা বলে করতে হবে। এটা না বলে আপনি করবেন না, কিন্তু ভনিতা ঠিক না, আমি অনেক এই চরিত্র দেখেছি। আমি একজন ভদ্রলোককে চিনতাম, তিনি বনসাই চুরি করতেন, তো শিল্পী এস এম সুলতান বেঙ্গল গ্যালারীর প্রথম এক্সিবিশন এখানে হয়, তখন গ্যালারী হয় নি। একটানা দুই-তিনটা রুম ছিলো, এখানে সৈয়দ শামসুল হক, কবি সুফিয়া কামাল খালাম্মা, এক জনের কথা মনে পড়লো আবুল খায়ের লিটুর নামটা সহজে আসেনা, উনি খুবই পিছনে থাকেন, উনি আমার বাসায় একদিন এলেন। এসে দেখেটেখে বললেন, ফেরদৌসী আপা আমি আপনার একটা এক্সবিশন করে দেই, আমি তো মাথায় হাত দেই, এত বড় একটা এ্যামাউন্ট দিলেন আমাকে, যা দিয়ে এখনকার সময় দুই দিনের বা তিনদিনের বাজার করা যায়। কিন্তু সেই সময় এই এ্যামাউন্ট অনেক বড় ছিলো, চুরানব্বই সালের দিকে, আমি আপনাকে একটা এক্সিবিশন করে দেই, আপনার পিছনে তাকাতে হবে না, সেই এক্সবিশনে শিল্পী এস এম সুলতান, কবি সুফিয়া কামাল, সৈয়দ শামসুল হক সঞ্চালক ছিলেন। এই দুজন বর্ষীয়ান মানুষকে আমি একত্রিত করেছিলাম এবং সৈয়দ শামসুল হক, উনি সঞ্চালনা করেছিলেন। সুলতান ভাই, আমাদের তখন এত সুবিধা ছিলো না ধারণ করে রাখার।  সুলতান ভাইয়ের ঐ বক্তব্য শুনলে বুঝতেন- প্রিয়ভাষিণীকে তিনি কতটা, পক্ষপাতিত্ব না করে, কাজের মূল্যায়ন করেছিলেন। উনি যেসব বর্ণনা দিয়েছিলেন সেটা খুবই সাংঘাতিক ছিলো। 

লিটু ভাই আমার এক্সিবিশন করে না দিলে, আমার পোর্টফলিও নিয়ে ঘুরতেই হতো হয়তো দ্বারে দ্বারে এবং লিটু ভাই আর জীবনে কখনো সামনে আসতে চাননি। 

আর লিটু ভাই ছাড়াও আমি যে ব্যাপারটা চিন্তা করেছি, ফয়েজ ভাই আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন- যে আপনি খুব জুনিয়র আর্টিস্ট, এত তাড়াতাড়ি আপনাকে এক্সিবিশন করতে দিবোনা আমার গ্যালারীতে। তাতে কিন্তু আমি মোটেও রাগ করিনি। আমি ভাবলাম ফয়েজ ভাই আমার চোখটাকে খুলে দিলেন। আমার ভুলটাকে ভাঙ্গিয়ে দিলেন। আমি কেন পিছেপিছে ঘুরবো? আমি ততক্ষণ কাজ করবো, যোগ্যতা আমার পিছনে ছুটবে, আমি কেন যোগ্যতার পিছনে ছুটবো? এই জেদটা আমার মধ্যে হয়েছিলো আর কী। 

তারপরের ঘটনা- ফয়েজ ভাই একদিন হেসে বললেন- প্রিয়ভাষিণী আমার সুভাষিণী, আমায় এটা ওটা বলে বললেন- আমি আপনার একটা এক্সিবিশন করতে চাই, করবেন না? আমি বলি, হ্যাঁ ফয়েজ ভাই আমি করবো, তিনবার করেছি প্রদর্শনী করেছি, উনাদের আমন্ত্রণে।আমার সিনিয়রদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো, আমার প্রিয় বন্ধু ছিলেন এস এম সুলতান। নৌকার মধ্যে বসে উনার সেই বিড়ির ধোঁয়ার গন্ধওয়ালা চা, সেই চা খুব নাক টিপে টিপে খেতাম, বলতাম, না খুব ভালো হয়েছে (হাসি)। আর বিড়ালগুলো... সুলতান ভাই বলতো, আজ কিন্তু খেয়ে যেতেই হবে, ৫৬টা বিড়াল, এতটুক এতটুক ঘোরাঘুরি করতো..., এক একটা বিড়াল ঝাকা দেয়, কি গায়ের লোম উড়ে বেরুতো, সেখানেই খেতে দিয়েছে, এরকম ছোট্ট টেবিল, সেই টেবিলে আমি, ভাস্কর শামীম শিকদার আর সুলতান ভাই বসেছি- তো বলতো তোরা উঠবি নে, উনি ভালো মানুষ উনাকে আজকে মাছের মাথাটা দেওয়া হবে, আমি টেবিলের নিচে খাবার দিতাম বিড়ালগুলো উঠতো না। উনি বলতেন দেখেছেন, কথা শুনেছে আর টেবিলে উঠছে না। ওদের অনেক রকমের নাম আছে, তো আমি বলছি ঐ বিড়াল যাও, তখন সুলতান ভাই বলতেন, না ওকে বিড়াল বলবেন না, ওর নাম আছে। মিনি, মিনিতা এইরকম নানান রকমের নাম আছে হ্যাঁ, কি সুইট তাঁর আচরণ। হা হা অনেক কথা বললাম... 

প্রশ্ন : আপনি ভালো থাকবেন।

প্রিয়ভাষিণী : তোমরাও...