মিশুক মুনীর স্মরণ

ও বন্ধু আমার

Looks like you've blocked notifications!
চারুকলা ইনষ্টিটিউটে মঞ্জুলী কাজী, মিশুক মুনীর ও সাজেদুল আউয়াল (শামীম)। ছবি: আলী মোরশেদ নোটন

প্রিয় মিশুক,

এ রকম একটি পত্র তোমাকে কোনোদিন লিখতে হবে, ভাবিনি। তবু লিখছি। উল্টোপথে হেঁটে, তোমাকে স্মরণ করতে করতে যদি আবার তোমার দেখা পাই, এই আশায়। তোমাকে প্রথম দেখার ক্ষণটি জানো, আমার আজও মনে আছে। আমি তখন তোমাদের ফুলার রোডের বাসায় থাকার জন্য কেবলই এসেছি। তোমার বড় ভাই ভাষণই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন সূর্য সেন হল থেকে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছি। ভাষণ কিছুদিন হয় ভারতের ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’ থেকে নাট্য নির্দেশনার ওপর পড়াশোনা করে ফিরে এসেছে। আমিও তখন ঢাকা থিয়েটারে কাজ করি। কেন জানি উনি আমাকে কাছে টেনে নিলেন। আমাকে বলেছিলেন- চলো, আমরা দুজনে মিলে ওলে মেয়িংকার দ্য মোয়াম্ম ডুয়েলার্স-এর রূপান্তর করি। ওই কাজ করার জন্যই তোমাদের বাসায় যাই। রাত জেগে কাজ করি- ও রকম এক রাতেই দেখি তুমি জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছো। আমার তখন মুখভরা দাড়ি। স্মিত একটি হাসি দিয়ে চলেও গেলে। ভাষণ বলল- ভাই, নটর ডেম কলেজে পড়ে। আরে, আমিও তো ওই কলেজে পড়েছি।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামনে নির্মাণাধীন ভাষ্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র কাছে আবার আমাদের দেখা হয়। তুমি তখন নানাভাবে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ও তাঁর কর্মযজ্ঞের ছবি তুলছো। প্রথম সাক্ষাতেই আমরা কাছাকাছি চলে আসি। তোমার চলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বন্ধুত্বের এ বাঁধন ছিন্ন হয়নি। যাই হোক, তখন তুমি মানে হাতে একটি ক্যামেরা আর কাঁধে একটি কালো চামড়ার বাক্স-ছবি তোলার লেন্স, নেগেটিভের রিল, ক্যামেরা মোছার কাপড় ইত্যাদি থাকত সেই বাক্সে। তখনো তুমি মুভি ক্যামেরার প্রতি এতটা দক্ষ হওনি। যদিও সুপার এইট ক্যামেরা তুমি বাসায় দেখে ফেলেছো। এই ক্যামেরা দিয়ে ভাষণ পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঘটনা-বিষয় নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে, ওর সাথে আমিও মাঝে মাঝে দৃশ্য ধারণ করতে গেছি। ওটা তোমাদের বাসায় বসে দেখেছিও, তুমিও নিশ্চয় দেখেছিলে। সেই প্রথম দেখার পর আমরা দ্রুত কাছাকাছি চলে আসি। আমাদের মধ্যে বয়সের তফাত খুব বেশি ছিল না, তুমি বছর দেড়েকের ছোট ছিলে। কিন্তু আমাকে কেন যে এত সমীহ করতে জানি না। জানো মিশুক, তোমার সঙ্গে আমার খুবই ভালো লাগত, ঠিক হরিণের যেমন কেউয়া পাতা ভালো লাগে। তোমার সঙ্গে কত জায়গায়ই না গেছি। ফুল-গাছ-পাখি, নদী-মানুষের ছবি তুলতে তুমি পছন্দ করতে।

এরই মধ্যে তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছো। ক্লাস করার চেয়ে তোমার উৎসাহ থাকত ক্যামেরা হাতে কোথাও ছবি তুলতে যাওয়া। আমিও তেমনভাবে কোনোদিনই ক্লাস করিনি। তোমার সেই টাঙ্গাইলের নলসন্ধ্যা গাঁয়ের কথা মনে পড়ে? তাঁতিদের গ্রাম-তুমি কত ছবি তুলেছিলে। আরেকবার শুধু চড়ক পনার ছবি তুলতে আমরা ময়মনসিংহের দিকে যাই। সেবার ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজেও গেলাম-তোমার নাসির কাকা তখন ওখানে পড়ান। দুটি চাচাতো বোনের সাথে তুমি কত মজা করলে। তুমি তোমার চাচাতো বোনদের খুবই প্রিয় ছিলে। সে জন্যই কি ‘কাজিন-কুজিন সমিতি’ করেছিলে? তোমার সাথে সেন্ট্রাল রোডে তোমার দাদার বাড়িতে বেশ কবার গেছি, দেখেছি তোমার কাজিনরা তোমার জন্য পাগল।

একবার আমরা নারায়গঞ্জের লাঙ্গলবন্ধে গেলাম, তুমি পুণ্যার্থীদের স্নানের ছবি তুললে। সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি তোমার কেমন জানি একটা দুর্বলতা ছিল। ওদের ছবিই বেশি তুলেছিলে। মনে পড়ে, আমরা ব্রহ্মপুত্র নদ ছেড়ে আসতেই চাইনি। শুধু ছবি তোলা নয়, মিষ্টি খেতেও তুমি পছন্দ করতে। কতবার আমরা শুধু মিষ্টি খাওয়ার জন্য সাভারে গেছি। এখন ভাবলে কেমন  লাগে। আসলে আমাদের যৌবনই ছিল ও রকম রোমাঞ্চে ভরা। নইলে ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য কেন আমি হেঁটে হেঁটে আগরতলা যাব। স্থিরচিত্র তুলতে তুলতে তুমি মুভিং পিকচার তোলার ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে ওঠো। কিছু কাজও করো। আমরা তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠি। এর মধ্যে আমি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এস এম সুলতানের ওপর একটা স্ক্রিপ্টও লিখে ফেলি। নাম দিয়েছিলাম ‘দি ইনসাইডার’। তখন ঢাকা থিয়েটার থেকে আমার লেখা কাব্য নাটক ‘ফনিমনামা’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। সেই নাটকের কিছু অংশ স্ক্রিপ্টে রেখেছিলাম। তোমাকে সূর্য সেন হলের ৪১৬ নম্বর রুমে রাতে স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাই। তুমি-আমি মিলে রাতে পাক করে খাই। সে কী উৎসাহ আমাদের। তুমি ১৬ মি.মি. ক্যামেরায় দৃশ্যধারণ করার প্রস্তাব করলে আমি রাজি হয়ে যাই। শীতকালে আমরা শুটিং করব বলে ঠিক করলাম। আমি সুলতান ভাইয়ের ওখানে মানে নড়াইলে কিছুদিন থেকে সব গুছিয়েও এলাম। কিন্তু ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর আমার মা মারা যাওয়ার পর শুটিংয়ের কথা ভুলে গেলাম। চল্লিশ দিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় এসে শুনলাম তারেক সুলতান ভাইকে নিয়ে কাজ করবে-তোমাকে ক্যামেরায় রেখেছে। মনটা আমার নিম ফলের মতো তিতা হয়ে যায়। যাই হোক, তারপরও তোমাকে নিয়েই অন্য ফিল্ম করবো বলে স্থির করি। ১৯৯৯-এ এসে আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়। তুমি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে ক্যামেরা চালালে। সে কথায় পরে আসছি।

মিশুক, বন্ধু আমার- তুমি যে কত গুণের মানুষ ছিলে তা আমরা যারা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি তারা ছাড়া অন্যেরা কি সবটা জানে, বলো? ১৯৮২-এর দিকে তুমি জাতীয় জাদুঘরে চাকরি নিলে। তোমার ওপর ভার পড়ল অডিও ভিজুয়েল শাখাটি গড়ে তোলার। তুমি পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সব ধরনের যন্ত্রপাতি স্থাপনার কাজটিও করলে। সবাই ভাবত আমিও বুঝি ওখানে যোগ দিয়েছি। কারণ আমি যে সময় পেলেই তোমার ওখানে চলে আসতাম। তখন দেখেছি তুমি ম্যানুয়েল দেখে দেখে নিজেই সবকিছু স্থাপন করছো। কোনো কিছু বিগড়ে গেলে তা মেরামত করতেও তুমি খুব পছন্দ করতে। তোমার ওখানে যাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল ১৯৮৫ সালে আমি ‘ছিটকিনি’ বলে যে স্ক্রিপ্টটা করেছিলাম, সেটা কীভাবে আমরা করব তা নিয়ে শলা-পরামর্শ করা। ‘ছিটকিনি’ নিয়ে তোমার অনেক আবেগ ছিল- গল্পটা তোমার খুবই ভালো লেগেছিল। এ কথা লিখতে বেশ কষ্ট হচ্ছে যে, সেই ফিল্মের চিত্রায়ণ তোমাকে ছাড়াই গত বছর করতে হয়েছে। পঞ্চগড় রেলস্টেশনের সেই নির্জন রেললাইনের ওপর প্রথম সেদিন ক্যামেরা বসাই, সেদিন তোমার মুখ বারবার স্মরণ হচ্ছিল। তোমার অনুপস্থিতি সরোদের টেশির মতো বেজেছিল বুকে তখন।

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলে। সেখানেও তুমি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যন্ত্রপাতি বসানোর যাবতীয় কাজ একাই সম্পন্ন করলে। জাদুঘরে কাজ করার অভিজ্ঞতা তোমাকে সাহায্য করেছিল। আমি তখনো তোমার সঙ্গী হয়েছি। ছবিঘরে তুমি মঞ্জুলীর প্রেমে পড়েছিলে। আমরা তখন সন্ধ্যা হলে শাহবাগে ‘রেখায়ন’-এ আড্ডা জমাই। ওখানেই মঞ্জুলীর সাথে তোমার প্রথম দেখা হয়। পরে তো ১৯৮৫ সালে তোমাদের বিয়েই হয়। বিয়ের আগে তোমার সঙ্গে গোপীবাগে মঞ্জুলীদের বাসায়ও গিয়েছি। পুরোনো বাড়ি- সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠানামা মনে পড়ে। জাদুঘরে চাকরি করার সময় তুমি কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে ক্যামেরা চালিয়েছো। এর মধ্যে ‘চাক্কি’, ‘ঢাকা টোকাই’ ও ‘ঢাকা রিকশা’-র কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে তোমার তোলা ছবি নিয়ে অনুষ্ঠিত ছুটি প্রদর্শনীর কথাও। কত বিচিত্র বিষয়েরই ছবি না তুমি তুলেছো। নদী-নৌকা-মাঝি-বিস্তৃর্ণ জলাভূমি-রাস্তায় বসে থাকা অসহায় মানুষ, সুলতান ভাই, খসরু ভাই, খালেদ ভাই, তারেক, নোটন, পিয়াল, ভাষণ, মঞ্জুলী, সুহৃদ, শিউলী ভাবী, তন্ময়, অর্পণ-সবাই তোমার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। আমার কিছু ছবি তুমি তুলেছিলে। সে সব ছবি দেখলে তোমার মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। লম্বা, একহারা গড়নের মিশুক পায়ে ভারী জুতা, গায়ে গেঞ্জি, পড়নে পকেটওয়ালা প্যান্ট।

শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তুমি তোমার বিভাগে নবযুগের জন্য মানানসই করে গড়ে তুলেছিলে। ফটোজা মালিজম, টেলিভিশন হানালিজম, কম্পিউটার বেইজড প্রকাশনা প্রকল্প প্রভৃতি তুমি নিজের হাতে দাঁড় করিয়েছিলে। আমার ধারণা, এই কাজগুলোই তোমার পরবর্তী জীবনের রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল। এই সময় তুমি বেসরকারি সাহিত্য সংস্থার জন্য কিছু কাহিনীধর্মী বক্তব্য প্রদান স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ও নির্মাণ করেছিলে। হুমায়ূন আহমেদকে দিয়ে ‘জননী’ বলে একটা স্ক্রিপ্ট করিয়েছিলে সেভ দ্য চিলড্রেন-ইউএসএ এর জন্য। নওয়াজেশ আলী খান ছিলেন পরিচালক আর আমাকে করেছিলে সহকারী পরিচালক। আশ্চর্যের ব্যাপার যে তুমি নিজে ক্যামেরা চালাওনি। সম্ভবত সব কাজ যেন সুচারুভাবে হয় সেজন্যই নিজে ক্যামেরা-সঞ্চালনের ভার নাওনি।

এরপর একটি কাজ করেছিলে শুটিংয়ের জন্য, আমার বাসা পুরোটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেবার তুমি নিজে ক্যামেরা চালিয়েছো। দুটি কাজই ১৯৯২-৯৩ সালে করেছিলে। মিশুক তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, এই সময়ই গৌতম ঘোষ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ করার জন্য ঢাকায় আসে। ঠিক হলো তুমি খুব ভোরে আমার বাসায় আসবে এবং আমরা দুজন সাটুরিয়া যাব। ওখানেই গৌতম শুটিং করছে। তুমি পুরান ঢাকা থেকে বাখরখানি নিয়ে এলে। যাওয়ার পথে আমরা মিষ্টি কিনে সাটুরিয়ার ডাকবাংলোয় যাই। গৌতম ও অন্যরা মজা করে তোমার বাখরখানি খেল। গৌতম আমাদের তাঁর বোটে করে শুটিং স্পটে নিয়ে যায়। তুমি অনেক ছবি তুললে।

এই সময়টায় মানে ১৯৯২ সালের দিকে তুমি মাঝে মাঝে হাওয়া হয়ে যেতে। পরে তোমার কাছে শুনেছি যে তুমি বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের জন্য ক্যামেরা চালাও। তুমি আসলে শিক্ষকতার চাইতে এই ধরনের সৃষ্টিশীল কাজই বেশি পছন্দ করতে। তুমি চাইতে হাতেকলমে প্রাকটিক্যাল কাজ করার দিকেই তোমার উৎসাহ ছিল বেশি।

এসব কারণেই ১৯৯৯ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে ইটিভিতে যোগ দিলে। সায়মন ড্রিং-এর নাম এ সময় তোমার মুখে প্রথম শুনি। সংবাদ-কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে তাঁর অনেক দক্ষতা। ইটিভিতে যোগ দেওয়ার সময় তুমি মিটিং নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ওই সময় ইউনেসকোর জন্য আমি ‘নিবানা’ নামে স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর তুমি ইটিভির সংবাদ কার্যক্রমের পরিচালক হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছো। এর মধ্যেই আমরা ইউনিট নিয়ে তিতাস নদীর পাড়, নদী ও নাসিরনগরের হরিপুর জমিদারবাড়িতে শুটিং করে আসি। শুটিংয়ের প্রয়োজনে তুমি নদীর কোমরজল পর্যন্ত নেমে যেতে। সবাই বলত-আরে, উনি তো ডুবে যাবেন। কিন্তু তুমি ওই অবস্থাতেই ট্রাইপড ছাড়া ক্যামেরা হাতে-কাঁধে নিয়ে দৃশ্যধারণ করেছো। এসব স্মৃতি আমি কীভাবে ভুলি বলো?

মিশুক, তুমি আসলে চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতে। যে কোনো সমস্যা-প্রয়োজন মোকাবিলা করার ক্ষমতা তোমার ছিল। তাই তো তুমি ২০০১ সালে নিজের হাতে গড়া ইটিভি ছেড়ে কানাডা প্রবাসী হলে। আমি বিষয়টি মানতে পারিনি-তুমি বললে পারিবারিক কারণে আমাকে যেতে হবে। কারণটি ভেঙেও বললে। অগত্যা হার মানলাম। আমি হারালাম আমার প্রিয় বন্ধুকে। তবে একেবারে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকিনি আমরা। মাঝে মাঝে রাত-বিরাতে ফোন করতে, আমাদের মিস করছো, বলতে। ওখানে গিয়ে যে ফ্রিন্যান্স চিত্রগ্রাহকের কাজ করছো, বলতে। বলতে ডিসকভারি চ্যানেলে কাজ করার কথা। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে অনলাইন টেলিভিশন মাধ্যম ‘দ্য রিয়াল নিউজ নেটওয়ার্ক’-এর সংবাদ কার্যক্রমের পরিচালক হিসেবে ওটি গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় যে নিজেকে যুক্ত করেছো, সেসব তথ্যও দিতে। পরে জেনেছি এখানে তুমি দীর্ঘ ছয় বছর (২০০৪-২০১০) কাজ করেছো। তুমি আসলে তোমার উৎসাহের আঙিনা থেকে কখনোই সরে যাওনি। সারা জীবনই তুমি ‘সংবাদ’ নিয়ে ছিলে। পড়াশোনাও করেছিলে এ বিষয়েই। কানাডা গিয়েও তুমি সৃষ্টিশীল কাজ করতে চেয়েছো। একবার তারেক ফোন করে বলল-শুনেছো, মিশুক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কীভাবে? ও বললে আফগানিস্তানে একটি ছবির শুটিং করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পেয়েছে। হেলিকপ্টার দিয়ে ঝুলে শট নিতে গিয়ে হাড় ভেঙেছে। বললাম এই তো মিশুক ঝুঁকি নিতে জানে, চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। পরে জেনেছি ২০০৩-এ রিটার্ন টু কান্দাহার ছবির চিত্রধারণের সময় ঘটনাটি ঘটেছে। এর মাঝে তুমি অবশ্য ঢাকা এসেছো। তারেকের নরসুন্দর ও রানওয়ে ছবিতে চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছো। তোমার সঙ্গে কয়েকবার দেখাও হয়েছে। ‘নরসুন্দর’ করার সময় বললে, চুল কাটার দোকানে বাড়তি আয়না বসিয়ে শুটিং করবে। অন্য রকম একটা ইফেক্ট আনতে চাইছো তুমি। ‘রানওয়ে’ ছবির কাজ শেষ করে ফিরে একবার মধ্য রাতে ফোন করে বললে একটা স্ক্রিপ্ট যেন পাঠাই। ওখানকার একটা ফান্ডিং অর্গানাইজেশনে প্রতিযোগিতার জন্য জমা দেবে। আমি একটি স্ক্রিপ্ট পাঠালাম। ওরা শেষ পর্যন্ত ফান্ড জোগাড় করতে না পারায় ফিল্মটা আর করতে পারিনি। যাই হোক, তুমি স্ক্রিপ্ট পড়ে বললে, না এটা না। তুমি ছিটকিনি পাঠাও। ওটা আর পাঠানো হয়নি। যে স্ক্রিপ্ট তোমাকে পাঠিয়েছিলাম তার সাথে একটি চিঠিও দিয়েছিলাম। এ কথা সে কথার পর লিখেছিলাম শুধু টেলিফোনে কথা বলে মন ভরে না। পাল্টা চিঠিতে তুমি লিখেছিলে-শামীম তুমি আমাকে এত ভালোবাসো? সত্যি তুমি অন্যরকম।

এরপর তো দেশেই চলে এলে। এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সম্পাদক হিসেবে। ২০১০ সালের শেষের দিকে যোগ দিলে। কী যে খুশি হয়েছিলাম। তবে যখনই ফোন করি তুমি ব্যস্ত থাকো। বনানীতে মায়ের সাথে। শেষবার ফোনে বললে ফুরসত পেলেই ফোন করব, একসঙ্গে খাব, আর কানাডার আলাপ করব। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। সেই ফুরসত তোমার আর হলো না। ২০১১-এর ১৩ আগস্ট বিধান রিবেরু ফোন করে বলে সাড়ে ১২টার দিকে লোকেশন থেকে ফেরার পথে তারেক মাসুদের মাইক্রোবাস অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তারেক ভাই সম্ভবত বেঁচে নেই। এর বেশি বিধান আর কিছু বলেনি। আমি কাঁটাবনে একটা কাজে ছিলাম। কাজ ফেলে বাসার পথে ছুট দেই। দুদিন আগেই তারেকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। ভীষণ ব্যস্ত সে। বলল কাগজের ফুলের শুটিং শুরু করবে, তোমাকে পেয়েছে এখনই সময় ইত্যাদি ইত্যাদি। বাসার পথে হাঁটতে হাঁটতে মোরশেদুল ইসলামকে ফোন দিই। ফোন ধরে তাঁর সহকারী। তখন সে তারেকের সাথে সাথে তোমার কথাও বলে। আমি বিশ্বাস করিনি। আমি তোমার নাম্বারে ফোন করি, ফোন বন্ধ। বাসায় পৌঁছার পথে অনেকের সাথে কথা হয়। বুঝতে পারি তোমরা নেই। বাসায় এসে আবু সাঈদকে ফোন দিই। তিনি বললেন, তিনি যাচ্ছেন আমি যাব কি না। আমি তাঁকে আসতে বলি। আমরা একসঙ্গে মানিকগঞ্জের জোখা গ্রামের দিকে রওনা দিই। যেতে যেতে কত কথা, কত স্মৃতি মনে আসে। সাভার পার হওয়ার পরেই দেখি তোমাদের লাশবাহী গাড়ি ঢাকার দিকে সাইরেন বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে। আমরাও গাড়ি ঘুরিয়ে তোমাদের পিছু নিই। একসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে তোমাদের গাড়ি থামে। অনেক মানুষের ভিড়। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সব তদারক করছেন। তুমি কোথায় খোঁজ নেই। দেখি আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা তুমি- লম্বমান- পাশে বসে আছে মুন্নি সাহা। গাড়ির জানালা দিয়ে তোমার দিকে তাকাই। মনে মনে তোমার নাম ধরে ডাকি মিশুক। কোনো সাড়া নেই। তোমার আর তারেকের স্মরণে তোমরা চলে যাওয়া পর একটি পদ্য লিখেছিলাম। তার থেকে একটা অংশ তুলে দিয়ে এ পত্র শেষ করছি।

 

সাড়া নাই সাড়া নাই ঘুমাতেছে তারা

আমি শুধু জেগে স্মৃতি দিতেছি পাহারা

দিবস রজনী ঘিরে

স্মৃতি শুধু কড়া নাড়ে

দ্বার খুলে দেখি ফিরে

নেই তাহারা-

পথ চেয়ে বসে আছি হয়ে দিশেহারা।

 

ইতি তোমারই শামীম।