নয় বছর ধরে 'ব্রাইট লাইন্স' লিখেছি : তন্বী নন্দিনী ইসলাম

Looks like you've blocked notifications!
ব্রাইট লাইন্স উপন্যাসের লেখিকা তন্বী নন্দিনী ইসলাম। ছবি : এনবিসি

নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের একটি ছোটখাটো ফার্মেসি দোকানের মালিক একজন মধ্যবয়সী লোক, তাঁর ১৮ বছর বয়সী মেয়ে চারু, যে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, মূলত হিজাবের ডিজাইন করে সে।  ফার্মেসি মালিকের ভাতিজি এল্লা (Ella), তাঁর বাবা-মায়ের মৃত্যুর যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে, স্থানীয় ইসলামিক নেতার মেয়ে মায়া। চারুর বন্ধুর সঙ্গে এল্লার প্রেম- মূলত এসব চরিত্র এবং তাদের গল্প নিয়েই সাজানো হয়েছে ‘ব্রাইট লাইন্স’ উপন্যাসের গল্প।

উপন্যাসটি লিখেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখিকা তন্বী নন্দিনী ইসলাম (Tanwi Nandini Islam)। এটি তাঁর প্রথম উপন্যাস, গত মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট বইটি প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন বুকস। বইটি এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে বেশ আলোচিত হয়েছে। 

মার্কিনি উপন্যাসগুলোতে দক্ষিণ এশীয়দের সাধারণত যেভাবে তুলে ধরা হয় তা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষণ রয়েছে তন্বীর এই নতুন উপন্যাসে। গল্পের পটভূমি ২০০৪ সালের ব্রুকলিন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে ব্রুকলিনের যে বৈচিত্র্যতা সেটাও তুলে আনা হয়েছে উপন্যাসটিতে। 

তন্বীর বয়স যখন ১০ তখন তাঁর বাবা-মা নিউ ইয়র্কে স্থায়ী হন। এর আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে আমেরিকার দক্ষিণ এবং মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে শৈশব কাটিয়েছেন তিনি। কুইন্সে নিজের পরিবার এবং নিজের শৈশবকে বেশি করে খুঁজে পান এই লেখিকা। ২০০৪ সাল থেকে ব্রুকলিনে রয়েছেন তন্বী। আর সে সময় থেকেই নিউ ইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে তাঁর মেলামেশা শুরু এবং তাদের বুঝতে শেখা। 

নিজের প্রথম উপন্যাস ‘ব্রাইট লাইন্স’ লেখার জন্য প্রায় এক দশক সময় নিয়েছেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার এসেছেন তিনি বাংলাদেশিদের আরো ভালো করে বোঝার জন্য। বাঙালি সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ এগুলো ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। 

‘ব্রাইট লাইন্স’-এর পর নিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য রিভার্স’-এর কাজ শুরু করেছেন তন্বী, এর পাশাপাশি লিখছেন এল, ফ্যাশনিস্তা এবং গকারসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। নিউইয়র্কভিত্তিক গণমাধ্যম এনবিসি নিউজকে ই-মেইলে একটি লিখিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। 

প্রশ্ন : ‘ব্রাইট লাইন্স’ দিয়ে আপনি কী বক্তব্য উপস্থাপন করতে চেয়েছেন? আপনার পাঠকরা উপন্যাসটি থেকে কী পাবেন?

তন্বী : ‘ব্রাইট লাইন্স’ পরিবারকে অনুসন্ধানের গল্প, এতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের জগৎ রয়েছে, যৌনতা রয়েছে, রয়েছে বিশ্বাস। দক্ষিণ এশিয়ার বিচারে বাংলাদেশিরা প্রায়ই উহ্য থেকে যান কিন্তু নিউইয়র্ক শহরে তাঁদের উপস্থিতি বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। আমার উপন্যাসটি দাঁড়িয়েছে এদের ভেতর থেকে নেওয়া চরিত্রগুলোর মাধ্যমে। জাতি, লিঙ্গ, জাত এবং যৌনতার মিশেলে ডায়াসপোরিক  আইডেন্টিটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বের মতো দামি ব্যাপারগুলো রয়েছে। মুসলিমদের কাছে অসংখ্য ধরনের অর্থ (মিনিংস) রয়েছে এবং এগুলো বেশ জটিল। বইটিতে মানুষের ইচ্ছাবিলাসের গল্প রয়েছে, জীবনের বিয়োগান্তক মুহূর্তগুলোর বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তববাদ মানে শুধু নারীদের কষ্ট আর মৃত্যু কিংবা উৎকট মানুষের গল্প নয়, এখানে আনন্দও রয়েছে। 

প্রশ্ন : পারিবারিকভাবে ওষুধের ব্যবসা করে এমন একজন লোককে মূল চরিত্র ধরে আপনার গল্প এগিয়েছে। এই চরিত্রের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন আপনি?

তন্বী : নিউ ইয়র্ক শহরে বাংলাদেশি অভিবাসীদের অসম্ভব ব্যস্ত জীবন আমার খুব পছন্দের। বিভিন্ন ধরনের বাঙালি উদ্যোক্তা রয়েছেন নিউ ইয়র্কে। এর মধ্যে আমার সঙ্গে আটলান্টিক অ্যাভিনিউয়ের দোকানমালিকদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে। মিসরীয় মুখোশ এবং চন্দন তেল ব্যবহারের বিষয়টা আমার কাছে একসময় নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। যেগুলো সাধারণত ফুটপাতে বিক্রি হতে দেখা যায়। এবং এখান থেকে সব শ্রেণীর মানুষই কেনাকাটা করেন। আমি এ ধরনের উদ্যোক্তাদের জন্য জায়গা (স্পেস) তৈরি করতে চেয়েছি, যারা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করতে পারেন।

প্রশ্ন : ‘ব্রাইট লাইন্স’ লিখতে আপনার কতদিন লেগেছে?

তন্বী : সব মিলিয়ে নয় বছর। ২০০৬ সালে আমি উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়ের একটা খসড়া করি। আমি সে সময়ে নয়াদিল্লিতে থাকতাম। তখন খুব অল্প সময়ের জন্য কাশ্মীরে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম। ছুটি কাটাতে গিয়ে বেশ জ্বরে ভুগেছিলাম, জ্বরের ঘোরেই উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়টা লিখি আমি। বোধ হয় জ্বরের কারণে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। ওই প্রথম অধ্যায়ের জন্যই ব্রুকলিন কলেজে চারুকলায় মাস্টার্স করার সুযোগ পাই আমি। বইটা লেখার জন্য আমি নিজে থেকে সময় বের করে নিয়েছিলাম। এমনকি তখন মনে হতো উপন্যাসটি লেখার জন্য কারো কাছ থেকে যদি বাড়তি সময় কিনে নেওয়া যেত!  টানা দুই বছর এলোমেলোভাবে আমি বেশ কিছু অধ্যায়ের কাজ শেষ করি। ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরায় থাকার সময় আমি উপন্যাসটির প্রথম খসড়া শেষ করি। সে সময়ে আমি ধনী ইউরোপীয়দের কাছে শাল বিক্রির কাজ করতাম, দিনে ১২ ঘণ্টার শিফট ছিল তখন। কাজের বাইরে আমার যেটুকু বাড়তি সময় বা ছুটির দিন ছিল পুরোটাই আমি বই লেখার কাজে খরচ করেছি। ২০১০ সালের দিকে আমার মাস্টার্সের প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছিল। সে সময়েই আমার এজেন্ট রেবেকা ফ্রিডম্যানের সঙ্গে দেখা হয় আমার। আমরা দুজন মিলে উপন্যাসটাকে সাজিয়ে তুলে প্রকাশকদের কাছে পাঠানোর উপযোগী করে তুলি। আমার মনে আছে লিপ ডে তে রেবেকার জন্মদিন ছিল, সেদিন প্রকাশকদের কাছে বইটি পাঠিয়েছিলাম আমরা। আর এর এক মাস পরেই বইটি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। 

প্রশ্ন : লেখালেখি করা বা উদ্যোক্তা হওয়া- সাধারণত দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের এ ধরনের ক্যারিয়ার বেছে নিতে দেখা যায় না। আপনি যখন লেখালেখি করতে চাইলেন, তখন আপনার পরিবার কি আপনাকে সহযোগিতা করেছে? নাকি তারা আপনাকে অন্য কোনো কাজ করতে বলেছিল?

তন্বী :  না, আমাকে দিয়ে জোর করে অন্য কোনো কাজ করানো সম্ভব ছিল না। তবে আমার বাবা-মা সেটা কিঞ্চিৎ চেষ্টা করেছিলেন, যখন আমি কলেজে পড়ি তখন। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। যখন আমি ভাসার কলেজে উইমেন্স স্টাডিজ নিয়ে লেখাপড়া করি, তখন থেকেই মনে হয় তারা বুঝতে পেরেছিল যে আমার সিদ্ধান্তের বাইরে আমাকে দিয়ে কিছু করানো যাবে না। যে কোনো জিনিস আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে আমি বেশ ক্ষুব্ধ হতাম, সেটা ছোটবেলা থেকেই। তার মানে হলো যখন বড় হয়ে গেলাম তখন আমার নিজস্বতা, আধ্যাত্মিকতা এবং আমার কাজের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডি ছিল না। আমার বাবা-মা সব সময় আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। তখনই আমি বুঝেছিলাম নিজের কাজের ক্ষেত্রে আমি ভালো বা খারাপ যাই করি সেটা আমাকেই বহন করতে হবে। আমার বাবা-মা শুধু চেয়েছিলেন আমি যা করতে চাই বা যা করার জন্য মনস্থির করেছি, সেটার প্রতি যেন নিজে সৎ থাকি। অন্যের চাকরি করার চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়া ভালো, সেটা আমি ব্রুকলিনে নিজের কমিউনিটির মানুষকে বুঝিয়েছি। আপনি যেখানে বা যে বিষয় নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন আপনার সেটাই করা উচিত, তাহলে আপনি নিজের রাস্তা তৈরি করতে পারবেন। যখন আপনি লেখক বা ছোটখাটো ব্যবসার উদ্যোক্তা হতে চান, তখন আপনার সামনে এমন কিছুর প্রলোভন থাকে না, যা আপনাকে সারা জীবনের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু তারপরও আমি এমন কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি যা আমাকে লেখালেখি নিয়ে থাকতেই উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি আর আমার বন্ধুরা প্রায়ই মজা করে একটা কথা বলি, আপনি যদি চান আপনার বাচ্চারা চালাক হবে, তাহলে তাদের চালাকির কারণে মাঝে মাঝে আপনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন, সেটাও আপনাকে মেনে নিতে হবে। 

প্রশ্ন : বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখকদের সংখ্যা খুব কম। যাঁরা আছেন, তাঁদেরও আবার ভুল করে ভারতীয় বা পাকিস্তানি ভেবে বসেন পাঠকরা। এমন কোনো বাংলাদেশি লেখক রয়েছেন, যাঁর লেখা দ্বারা আপনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন?

তন্বী : যখনই কোনো নতুন বাংলাদেশি লেখিকার বই প্রকাশ হয়, আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করি। ইন্টারনেটের কল্যাণে কবি তারিফা ফায়জুল্লাহর সঙ্গে আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে, তার জন্য নিজেকে আমি সৌভাগ্যবতী মনে করি। ওর ‘ঢাকা নকট্রান’ কবিতাটা আমার উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বেশ আলোড়িত করেছে। আমার বান্ধবী ফারিবা সালমা আলম বাংলাদেশি-আমেরিকান শিল্পী। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় ওর কিছু কাজ রয়েছে যা আমি যে ধরনের কাজ করতে পছন্দ করি তার সঙ্গে পুরো মিলে যায়। এরা একরোখা, খেয়ালি এবং কিছু কিছু বিষয়ে তাদের অশ্রদ্ধা রয়েছে। এগুলোই আমাদের কাজের প্রেরণা।   

প্রশ্ন : উঠতি লেখকদের জন্য আপনার কি উপদেশ থাকবে? বিশেষ করে যারা এশীয় কমিউনিটি থেকে উঠে আসছে?

তন্বী : একটা নতুন উপন্যাস আমাদের তখনই আলোড়িত করে, যখন আমরা ওই গল্পতে নিজেদের খুঁজে পাই এবং একই সঙ্গে মনে হয় যে এ ধরনের গল্প আগে কখনো পড়িনি। আমার মনে হয়, এশিয়ান বংশোদ্ভূত লেখক এবং শিল্পীরা এই সুন্দর এবং কখনো না শোনা গল্পগুলো সহজেই বলতে পারেন। আমাদের গল্পগুলো প্রয়োজনীয়, এগুলো আমাদের প্রতিদিনকার গল্প। এসব গল্প আমাদের একলা চলতে উদ্বুদ্ধ করে। যখন আমাদের একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রয়োজন পড়ে, নিজেদের জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে না ভেবে তখন আমরা একটু নিরিবিলি থাকতে চাই। আমি যখন প্রথম লেখা শুরু করি, তার তুলনায় আমি এখন অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারি। আমাদের নিজেদের চাওয়া থেকে খানিকটা সরে আসা উচিত এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় নষ্ট না করে নিজেদের কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যাতে নিজেরা কিছু সৃষ্টি করতে পারি।