সাক্ষাৎকার

বঙ্গবন্ধুই সাহসের উৎস: নির্মলেন্দু গুণ

Looks like you've blocked notifications!

২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু স্মারক পুরস্কার গ্রহণের জন্য কলকাতা গেলে সাংবাদিক শ্রীশুভাশিস চক্রবর্তী নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ১৫ আগস্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে ছাপা হলো। পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক হওয়ার কারণে এখানে কবির ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটিও জুড়ে দেওয়া হলো।

প্রশ্ন : আপনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, লিখেছিলেন আগ্নেয়াস্ত্রের মতো কবিতা। আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যার পর আপনিই প্রথম সে সম্পর্কে প্রতিক্রিতয়া জানিয়েছিলেন। এমনকি আপনার এই সাহসকে বাহবা দিয়ে শামসুর রাহমান ‘দুর্লভ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আপনার এই এত প্রাণশক্তি, এত সাহসের উৎস কী?

গুণ : ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। ৬ দফায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। ৬ দফায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ভিন্ন মুদ্রা প্রচলের ব্যবস্থার কথা ছিল, আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন রাখার ব্যবস্থা ছিল। ওই ৬ দফা কর্মসূচির একটা প্রবল প্রভাব পড়ে আমার ওপর। তখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিই করা হয়েছিল; কিন্তু তার ভেতরে স্বাধিকারের ভাবনাটাও ছিল। আমি দেখলাম, এই ৬ দফা কর্মসূচি যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে পাকিস্তানের যে পাঁচটি প্রদেশ আছে, সেই প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয়ভাবে আর শোষণ করতে পারবে না। তবে এ অবস্থাটা পাকিস্তানিরা মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধু যে কর্মসূচিটি দিয়েছিলেন এর ভেতরে প্রকারান্তর স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হওয়ারই একটা প্রচেষ্টা ছিল। ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্যের দিকে এগোনো যাবে এ রকম একটা বিশ্বাস আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচির সমর্থনে আমি কবিতা লিখতে শুরু করি সেই ১৯৬৬ সাল থেকে। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার যে উন্মেষ ঘটে তার ভেতর দিয়ে আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় স্বাধিকার বা স্বাধীনতা চেতনার বোধ, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার বোধ। শোষণমুক্ত পূর্ব বাংলা গঠনের যে স্বপ্ন তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন, সেই ৬ দফার কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারির পুনর্জন্ম হয়। মাঝখানে কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির স্রোত একটু শ্লথ হয়ে আসছিল। ৬ দফা কর্মসূচিটি ঘোষিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়, আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেসব ইতিহাস আমার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার কণ্ঠস্বর’ বইতে লিখেছি; এই বইটি পড়লে ষাট দশকে শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে কীভাবে আমরা ধাপে ধাপে স্বাধীনতার দিকে এগোলাম সেই ইতিহাসটি পাওয়া যাবে। সাহসের উৎস যদি বলতে হয়, তাহলে বলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন আমাদের সকল সাহসের উৎস।

প্রশ্ন : তাই তাঁর মৃত্যুর পর কবি হিসেবে আপনিই প্রথম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন?

গুণ : এর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। ১৯৬৭ সালে তাঁকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখি, তিনি তখন কারাগারে ছিলেন। কারাগারে ওই কবিতাটি তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি কবিতাটি পড়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, তিনি আমার কবিতা লেখার সাহসের উৎস; এমনকি আমার কবিতার নায়কও তিনি। পাকিস্তানের মতো একটি ধর্মকেন্দ্রিক, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকে ভেঙে নতুন রাষ্ট্র তৈরির যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা আমার প্রধান প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা শেখ মুজিবের খুব প্রিয় ছিল, বক্তৃতায় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলতেন। ১৯৬৮ সালে যখন পাকিস্তান সরকার রেডিও এবং টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করে, তিনি তখন তার বিরোধিতা করেন। ১৯৬৪ সালে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলো, তখন তিনি তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। পাকিস্তানের অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর যে দৃঢ় অবস্থান, এই অবস্থানকে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে, আমি প্রাণ থেকে তাঁকে সমর্থন করেছিলাম। তখন সংখ্যালঘু হিসেবে আমি তো রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার ছিলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে মুক্তির সন্ধান পেয়েছি, তাঁকে আশ্রয় করে আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করেছি। একটা বিকল্প ছিল পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে আসা। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, অনেকেই জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলেন। কিন্তু আমি ভেবেছি, এটা সমাধান নয়। এখানে থাকার মতো একটি দেশ আমাদের তৈরি করতে হবে।

সাম্প্রদায়িক কারণে আমাদের সাতপুরুষের ভিটে ফেলে এসে ভারতের গলগ্রহ হবো, এটা আমার কাম্য ছিল না। ১৯৭১ সালেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি কবিতা লিখেছি। আমার ‘হুলিয়া’ কবিতার মধ্যে আমাদের সকল সুস্বপ্নের বিপরীতে তিনিই হয়েছেন আমাদের সকল স্বপ্নের নায়ক। মুক্তির মোহনায় তিনিই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি কবিতা লিখলাম এবং লিখলাম না শুধু, ১৯৭৭ সালে একুশের ভোরে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সেটি পাঠ করে শোনালামও। ঘটনাটিকে সেদিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। ওটা হঠাৎ করে একটা কবিতা লিখে ফেলার মতো বিচ্ছিন্ন আবেগের ব্যাপার ছিল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যা ঘটেছে, এ রকম বর্বর ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। এটি দেশে এমন একটি শোকের এবং ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যে, মুজিবের নাম নেওয়া যাবে না- এ রকম কোনো সামরিক নির্দেশ না থাকার পরও শেখ মুজিবের নাম দীর্ঘদিন বাংলাদেশে উচ্চারিত হয়নি। তাঁকে হত্যা করার পর খুনিরা যখন উল্লাসের সঙ্গে বেতারে প্রচার করছিল, ‘আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি, তখন মানুষের মধ্যে এমন একটা অবিশ্বাস্য ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, যা অবর্ণনীয়। কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর অনুগত চার জাতীয় নেতা, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেমন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান- এই চারজন সেই মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি যা খুনিদের সঙ্গে আপস করে মোস্তাকের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। তাঁদের জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একটি পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের পটুভূমিতে নভেম্বরের ৩ তারিখ ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে ঢুকে এই চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাগুলো পরপর ঘটতে থাকে। সেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আমিই প্রথম তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতাটি প্রকাশ্যে পড়ি। কবিতাটি লিখেছিলাম আগেই। কিন্তু সেটি পড়ার কোনো সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিবেশে আমি একুশে ফেব্রুয়ারিকে বেছে নিয়েছিলাম শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা কবিতাটি পাঠ করার জন্য।

‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, এই কবিতাটি পাঠ করলাম, ‘শহীদ মিনার থেকে খসেপড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। / আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’

এরপর অবশ্য আমাকে কিছু ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল, তবে সামরিক বাহিনীর ভেতরেই একটা পক্ষ ছিল যারা মুজিবুরের হত্যাকাণ্ডে ভালোবাসা থেকে কবিতা রচনা করে। ফলে আমি বেঁচে গেলাম। আমি শুনেছি, এর পেছনে জেনারেল মঞ্জুরের সমর্থন ছিল আমার প্রতি। কিন্তু ১৯৮১ সালে জেনারেল মঞ্জুর সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।

প্রশ্ন : যে স্বপ্ন নিয়ে, আশা নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বপ্নের বাংলাদেশে কী পেলেন শেষ পর্যন্ত? বিশেষত পরবর্তী সময়ের ইতিহাস এবং বিগত ফেব্রুয়ারিতে সিপাহিদের বিদ্রোহের কথা মাথায় রেখে এর উত্তর চাইছি আমি।

গুণ : শেষপর্যন্ত তো শেষ বলে কিছু হয় না; শেষ কথা কে বলবে? একটা চলমান প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, অনেক আঁকাবাঁকা পথের মধ্য দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি এগিয়ে যেতে। শুধু বঙ্গবন্ধুকেই তো হত্যা করা হয়নি, এখানে যেমন মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে বা ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের হত্যার ভেতর দিয়ে সংবিধানের পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবারের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি আসন নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার, জেলের ভেতরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার বিচার- এই বিচারগুলো এখন ক্রমান্বয়ে হবে- এ রকম একটা বাস্তবতা এখন বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে।

তথ্যসূত্র : মূল্যায়ন, ১৫ আগস্ট ২০১৪ থেকে সংগৃহীত। 
সম্পাদক : অমিত চৌধুরী
কক্সবাজার, চট্টগ্রাম।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি
(বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশ্যে কবিতা পাঠ)
নির্মলেন্দু গুণ

সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শহীদ মিনার থেকে খসেপড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি,  ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো স্বাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুস্ক-ভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জুরীগুলো
কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যায় এই কালো কোকিলটি জেনে যাক-
আমার পায়ের তলার পুণ্য মাটি ছুঁয়ে আমি আজ সেই
গোলাপের কথা রাখলাম, আমি আজ সেই
পলাশের কথা রাখলাম, আমি আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।