একগুচ্ছ কবিতা

Looks like you've blocked notifications!

নন্দিনী, ময়নামতি তোমার কথা বলে!!

ময়নামতির সন্ধ্যা!
ঢেউ তোলা চাঁদের নিচে একা আমি। 
আকাশজুড়ে নিস্তব্ধতার কোলাহল,
চারিদিকে ফিসফাস, খয়রঙা ইট 
পুরানো ঘাসের খোলস থেকে কোনো এক প্রারমিতা
ডেকে নিল গভীরে, নিরিবিলি আলিঙ্গনে।
নন্দিনী,
পতিত ইটের ভাণ্ডারে তোমাকে পেলাম আমি
তোমার নাম ধরে কে যেন দিল ডাক, দিল কি?
নামের সংকেতে ফিরে তাকাতেই দেখি
গৌতম বুদ্ধের অঙুলি নির্দেশ।
নন্দিনী,
এ কোন নগর, যার দ্বারে দাঁড়িয়ে স্বয়ং তথাগত!
এ কোন কুটির যার ছায়ায় বিদগ্ধ যুবকের আনাগোনা!
দুঃখের নির্বাণ নিয়ে রাতদিনের বিশাখা যজ্ঞ?
নন্দিনী,
আলোতে শরীর ধুয়ে মৈত্রী সংঘের বাণীতে 
আমরা সুর তুলি
বুদ্ধের দয়া মাগি।
জেগে ওঠে প্রাচীন নগর-
দেখি তোমার নাম ধরে ডাকছে তিষ্য রাজকুমার
তোমার গুণগান করছে বিদুষী জিতসোমা
এ প্রাচীন নগরে এসে কোশলপতি
তোমার রূপের কথাই বলেছে আমাকে।
নন্দিনী,
এ নগরে শালবন এখন স্নিগ্ধ অন্ধকার 
জাতকের গল্প রঙ ছড়িয়ে হয়েছে সবুজ ঘোড়া। 
এ নগরে,
তোমাকে দেখছি হেঁটে যাচ্ছ পুথিশালার পাশ দিয়ে
তোমাকে দেখছি আচার্যের সামনে দাঁড়িয়ে জোড়হাতে
মন্দিরের আঙিনায় বসে মুগ্ধ চোখে দেখচ্ছ করুণা বৃষ্টি 
তোমাকে দেখছি গেরুয়া চরণ ছুঁয়ে নত মস্তকে
তপস্যার জপমালা তোমার নীলাঞ্জল।
নন্দিনী, ময়নামতি তোমারই কথা বলে…।

৪/৩/২০১৭
 

ময়নামতির বৌদ্ধমন্দিরের দুপুর!!

রোদ ঝলমলে ভিড় 
অথচ তুমি ছাড়া কি ভয়ঙ্কর শূন্য।
ক্রমশ বিকাল গড়িয়ে নরম হয় মাটি
রাতের বাতাসে চোখ মেলে ভালোবাসার জল 
ঠিক তখন রহস্য এক ডাকে জেগে উঠলে তুমি।
হাত ধরে নিয়ে গেলে বোধিকুমারের পর্ণ কুটিরে|
নন্দিনী,
তোমার নগর, তোমার দুপুর, তোমার আলোভরা রাত
জীবন এখানে শতমুখী বৃক্ষ
জীবন এখানে একমুঠো সুখ
হাঁটুগেড়ে বসে থাকি সেই জীবনের সামনে।
রাত বাড়ে, সুজাতা এসে ডেকে নেন ভোজনশালায়
তথাগত বলেন বনচ্ছায়ে তোমার হারিয়ে যাবার গল্প।
নন্দিনী,
এ বৌদ্ধবিহারে, এ প্রাচীন শালবনে
চারিদিকে তুমি আর তুমি 
আকাশ-বাতাসে মেঘমল্লারে
ফুলে ঢাকা পাখির কলতানে।
তবু নীল, তামাটে আর লাল দিগন্তে
ধুলো আর সমুদ্র ঘিরে
রঙ ছুঁয়ে, অসীম প্রান্তর পেরিয়ে
খুঁজে ফেরা তোমাকেই। 
ময়নামতি, ময়নামতি আমার
বারবার তোমারই ঘরে-
ঘুরেফিরে আসব আমি-
চিরকালের নন্দিনী ছায়ায় ।

৪-৩-২০১৭

 

নন্দিনী, টেকনাফ রোডে হাঁটছি আমি প্রতিদিন

 

নন্দিনী, তুমি দেখে নিও, আমি রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে ঠিকই পার হবো নৌকো

দেখো তুমি, করুণামদির মাতার দেহে জন্মের আগেই যারা ক্ষত-বিক্ষত

সে সব অভাজনের পাশে থাকব আমি চিরসকাল।

শাহ পরী দ্বীপের পারাপারের কিনারায় যদিও একা।

তুমি ভাবছ তোমাকে ছাড়া আমি পারব না থাকতে-

এই পাল তোলা, হাল ভাঙা প্রান্তরে কখনও!

তুমি দেখে নিও-

আমি ঠিকই পৌঁছে যাব অন্য এক দিনে।

যখন তুমি বসে থাকবে নাফ নদের অচেনা ঘাটে।

দূর থেকে ছুঁড়ে মারা খাবারের সামনে বসে থাকা যন্ত্রণায় পাবে আমাকে!

জানি তুমি ভাববে তুমি ছাড়া আমার জীবন বৃথা, ভাববে কি?

কিন্তু দেখে নিও, কোথাও, অন্য জায়গায়-

শেষ ধোঁয়া ওঠা রাখাইন স্টেটের পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে আমি।

তুমি ভেবেছ এতিম শিশুদের মুখে পারব না ফোটাতে হাসি?

তুমি তো জান আমি একাই হাঁটছি কুতুপালং ক্যাম্পের পলিথিনের গাছের ভেতরে।

তুমি আমার বিশ্বাস ভাঙতে পারবে না নন্দিনী-

তুমি ভালোবাসার লাল গালিচা দুমড়ে-মুচড়ে পারবে না নিতে ।

তুমি দেখছ- আমার তো নেই নিজের ঘর।

তুমি দেখছ কাউকে তোয়াক্কা না করে সীমান্তে পাতা মাইনের কাছে আছি বসে।

তুমি কি সত্যিই ভেবেছ- তোমার কাছে সময় চেয়ে কাতর থাকব মশাল জ্বালা ফ্যাকাসে সন্ধ্যায়?

নন্দিনী,

তুমি কতই না বলেছ, খুব কঠিন তুমি, কোনো ব্যাপার না ভালোবাসা ভুলে থাকা ।

বরং আমি দুর্বল হৃদয় নিয়ে ঘুরি পথে পথে, যাচনা করি তোমার করুণা ভিক্ষা।

কিন্তু জানো না তুমি-

হেঁটে আসা রাখাইন জনতাকে দেখে আমি সব ভুলে গেছি।

আমি শক্ত হয়ে উঠেছি আমার নিজের দীর্ঘশ্বাস হলকায়।

চিন্তা করো না-

আমি ঠিকই অক্সিজেন নেব তোমার পৃথিবীর।

আমি জানি, দরকার নেই সময় নেবার তোমার কাছ থেকে -

আমার সময়টুকু এখন থেকে আমার নিজের-

নিতে পারবে না কেউ কেড়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে-

কারণ টেকনাফ সড়কের পুরোটা জুড়ে আমি হাঁটব ।

আমি ভালোবেসেছি নুয়ে পড়া গৃহহীন শিশুদের-

আমি ভালোবেসেছি দুঃখ জড়িয়ে যে মানুষ হেঁটে চলেছে নদীর বাঁক ধরে-

আমি দেখেছি ঠাঁই পাবে বলে মেরিন ড্রাইভ সড়কে বসে থাকা শোকের মানুষগুলোকে।

নন্দিনী,

যদি তুমি তাদের ভালোবাস তাহলে আমাকে পাবে দেখতে-

যদি তুমি নাফ নদের রক্তে ধুয়ে যাওয়া মানুষের মুখের হাসি হও-

যদি তুমি কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকো তাহলে-

ফিরে পাবে আমাকে আবার ।

কেঁদো না তুমি-

তোমার চোখের জল আর ঘরহারা হাজার শিশুর কান্না পথে নিয়েছে তো আমাকে।

৩-১০-২০১৭

 

নন্দিনীর ট্রেন যাত্রা!!

নন্দিনী, তখনও ভোরের আলো হেসে কথা বলেনি

তখনও মেঘের কোলে বাঁকা চাঁদের ধূসর হাসি

রাত পেরিয়ে মানুষের কোলাহল জাগছে তখন ধীরে

আর আমরা চলেছি ট্রেনের খোঁজে, স্টেশনের দিকে।

নন্দিনী,

সোনার বাংলা ট্রেনের চকমকি তালে সবুজ জীবন জেগে উঠেছে

ধানের বোঝা নিয়ে গরুর গাড়ি ধুলিপথে গন্তব্যে পৌঁছেছে

আমরা দুজন ক্রমশ দূরে চলে যাওয়া দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে

জলের রেখায় এঁকেছি সকালের অলসতা, দেখেছি কোলাহল দুপুরের।

ট্রেন ছুটে চলে পাহাড়ের পাশ দিয়ে

ট্রেন ছুটে চলে নীল বাগানের ঢেউ ছুঁয়ে

নতুন বৌকে অবাক করে ট্রেন ছুটে চলে গ্রাম উজিয়ে।

আর আমরা দুজন দেখছি-

যারা নাচতে নাচতে সমুদ্রের দিকে চলে গেল

ফিরে এলো অন্য দল নদীর কিনারায়।

টেলিফোন লাইনের তারে বসা ফিঙে লেজ নেড়ে উড়াল দিল।

এক ঝাক শালিখের নেই অবসর ট্রেন দেখার

তবু বালি হাঁস মাথা তুলে এদো ডোবায় জল ছিটাল।

নন্দিনী,

তোমার জীবনের প্রথম ট্রেন যাত্রা

তোমার স্বপ্নের ছুটে চলা

সুন্দর হলো তোমার মুখরতা

গান গাইল তোমার হৃদয়।

তুমি আমার হাতে হাত রেখে বললে

ট্রেনের মতো জীবনকে ছুটাতে চাও!

ট্রেনের মতো মুক্ত হোক চলার গতি

ট্রেনের মতো সুরময় হোক জীবন।

নন্দিনী,

তোমার সেই ট্রেন যাত্রা এখনো থামেনি

কারণ আমরা হাঁটছি ট্রেন ছেড়ে কঠিন চিকন পথে।

আমরা হাঁটছি বিলাসী জীবন ছেড়ে পাথুরে জলের কিনারে।

৭-৩-২০১৭