উপন্যাস (ষষ্ঠ কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

Looks like you've blocked notifications!

 

তেরোশো তিরিশ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের দিন। দেওভোগ গ্রামে সকল সময়ই চৈত্র মাসের গোড়ার দিকে গরমটা থাকে মিঠা মিঠা। কোনো বাড়িতেই গাছ-গরানের কোনো কমতি নাই। তার ছায়ায় ছায়ায় চৈত্র মাসের প্রথমটা সুভালাভালিই যায়। তখন লোকে আরামে দিন পার করে, আর ক্ষণে ক্ষণে বলতে থাকে, যাইতাছে গা সুখের দিন! কোন ঠাঠাপোড়া রইদ না জানি এইবার আহে!

এই সব  আগাম আশংকা, আহা তাহা  নিয়া চৈত মাইস্যা শান্তির দিন কয়টা শেষ হয়ে যায় পলকটা না ফেলতেই। প্রতিবারই চৈত মাসের ১০ দিন পার হয়েও সারে না, আসমান-জমিন হয়ে ওঠে য্যান দগদগা  তাওয়া। আসমানে এক পোচ কালা মেঘ দেখার জন্য সকলের পরান তড়পানি দিতে থাকে। এট্টু তুফানও যুদি আইতো, তাইলেও তো কয়ফোঁটা বিষ্টির মুখ দেখতাম! লোকে অন্য সময় তুফানরে ডরায়, কিন্তু চৈত মাইস্যা তাতানির দিনে কালবৈশাখী তুফানরেও বড়ো শান্তির জিনিস মনে হতে থাকে সকলের।

দেওভোগ গ্রামে তখন রোদের তেজে একদিকে পায়ের তলের মাটি হয়ে থাকে খনখনা, আরেক দিকে আসমান হয়ে থাকে গনগনা,। বাড়িতে বাড়িতে গাছের ছায়া থাকে; কিন্তু তপ্ত–পোড়া, তাপোড়া তাপোড়া বাতাস সেই ছায়ারে মোটের ওপর  শীতল থাকতে দেয় না। সকাল বাড়ে কি বাড়ে না, রোদের তাতে গাছেরা সুদ্ধা ছনছনাতে থাকে। রোদের তাপে, খরখরা মাটির ভাপে আর গরম-বাতাসের হলকায়  পুরা দেওভোগ গ্রামখান গরমে থমথম করতে থাকে সর্বক্ষণ। তারমধ্যেই নিত্যির রান্ধন-খাওন, কর্ম-কাজ, আনা-যানা-বাপ দাদার আমলের মতোই নিত্যির নিয়মে করে যায় গ্রামের মানুষে।

তবে গরমে তারা দাপায় ঠিক, কিন্তু একটু পরপর বাতাসের ঝাপটাটাও পায়। তাপোড়া বাতাসের ঝাপট। সেই দাপানির কালে, খলখলা গরম হাওয়ার ঝাপটরেও ক্রমে বড়ো মোলায়েম, বড়ো শান্তির মনে হতে থাকে। সকলের মনে হতে থাকে যে, না! তারা একেবারে খরাপ নাই! গরম যেমুন তেমুন; বাতাস তো আছে! শইল  তো জুড়ানি পাইতাছে! বিষ্টি আইতাছে না ঠিক, কিন্তু আইয়া পড়ব। এইভাবে নানান আশা দিয়া, নিজেদের নানান ভাবে বুঝ দিয়া তারা তাদের আসল কষ্টটা থেকে নিজেদের ভুলানি দিয়া রাখে।

আসল কষ্টখান অতি গুরুতর। সেই কষ্টটা সওন যায় না, আবার তার হাত থেকে লোকে নিস্তার পায়, তারও কোনো উপায় কারো হাতে নাই। চৈত মাইস্যা দিনে খাওনের পানি নিয়া বড়ো কষ্টে থাকে তারা। বড়োই কষ্ট! দাদা পরদাদার আমলেও যেমন সীমাছাড়া কষ্ট ছিল, নাতি-নাতকুড়ের আমলেও যেমনকার তুফান কষ্ট, তেমন তুফান পরিমাণই আছে। এই দিনে গেরামের কোনো পুষ্কুনির পানিই আর  পানি থাকে না। পানি শুকাইতে শুকাইতে পুষ্কুনির তলায় গিয়াই খালি ঠেকে না, সেইটা একেবারে ঘোলা প্যাক হইয়া শ্যাষ!

তা দিয়ে গোসলই-বা করে কেমনে লোকে, খায়ই-বা তারে কোন পরানে! সেই দুষ্কালের দিনে এই গ্রামের লোকের ভরসা বলতে অই ঠাকুর-বাড়ির পুষ্কুনির পানি! সকল তল্লাটের সকল পুষ্কুনির পানি যখন তল-ঠেকা, ঘোলা ঘোলা কাদা; তখনও ঠাকুর-বাড়ির পুষ্কুনি- যেমন ভরার তেমন ভরা। টলটলা শীতল। চৈত মাস তারে কাহিল করার সুযোগ পায় না। খাওনের পানির দরকারটা অই পুষ্কুনি থেকে এমনে-সেমনে কোনো রকমে মিটায় দেওভোগ গ্রামের লোকে। যুগ-জনম ভরে অইই তো করে আসছে। কিন্তু তোলা দুধেনি পোলা বাঁচে! এত দূর থেকা আনা পানি দিয়া কোনোমতে তিয়াসটা মিটান যায়, কিন্তুক চিত্তি কি ভরে? ভরে না।

আগের আমলে বাড়ির বৌ-ঝিরা চুপচাপ পায়ে, ভোর-বিহানে গিয়া কলসি কলসি পানি নিয়া আসত। জমিদার-মায়ের অমনই হুকুম ছিল। ‘যত দরকার পানি নিবা, কিন্তু একটা আওয়াজ য্যান শোনা না যায় উত্তর সীমানার পুষ্কুনির পাড় থেকে! বেয়াদ্দবি য্যান না হয়!’

রায়ত মা-বৌয়েরা তখনকার দিনে পানি আনতে গিয়া, সেই পুষ্কুনির আসল ঘাটলায় কোনোদিনও পাও দেয় নাই। একে ছিল নিজেদের অন্তরে ডর। রায়ত হইয়া জমিদারগো অন্দর-বাড়ির ঘাটলায় পাও দিব কোন কইলজায়! আর, সেই সুযোগটাও বা তারা পাবে কেমনে!

তখন রায়ত বৌ-ঝিদের জন্য আলাদা করে ঘাটলা পাতা হতো, পুষ্কুনির অন্য পাড়ে। পাড়ের কিনার ঘেঁষে, কোনোমতে পাতা থাকত এক চিলতা তক্তা। তাতে কোনোরকমে পায়ের পাতাখান ফেলে ঝুম আলগোচ্ছে ঠিল্লা ভরতো রায়ত মা-বৌরা। লড়তো চড়তো য্যান ছায়া!  

দেওভোগ গ্রামের  বুড়ার-বুড়া নানীর-নানীরা তাদের শোনা কথা স্মরণ করে বলে যে, সেই অকালইল্যা দিনে প্রতি বচ্ছর, রায়তগো জল-দানের ব্রত্ত পালনি করতো জমিদার-মায়ে। চৈত বৈশাখ জষ্ঠি –এই তিন মাস আছিলো তার ব্রত্তের কাল। লোকের খাওয়ার পানিটার ঝামেলা এমনে এমনে মিটতো তখন। সেইসব দিন কবে গত হয়ে গেছে। হয়ে গেছে পরস্তাব-কথার দিন। কিন্তু পানির কষ্ট যেমন তাগড়া আছিলো, তেমন তাগড়ই আছে। বেশ-কম কিছুই হয় নাই।

এখন দেখো সেই রাজ-রাজড়া-জমিদারের বাড়ি ,হয়ে আছে পুরা এক ছাড়া বাড়ি।  এখন তুমি যত ইচ্ছা সেই বাড়িতে নড়ো-চড়ো, যখন খুশি তখন যাও, নিষেধ করে এমন কেউ নাই। এখন ঠাকুর-বাড়ির যেখানে ইচ্ছা যাও, যেই ঘাটলায় ইচ্ছা পা রাখ কি গোসল করো- তোমারে নিয়ম মানার হুঁকুমটা দেয়, তেমন জনপ্রাণীটাও নাই। বহু বহু কাল সেই বাড়িতে একখান সন্ধ্যাবাতিও জ্বলে নাই। সেই বাড়ি এখন তার ঠাকুর-দালান, দুই মহলা বসতবাড়ি, লাল পাত্থরের রান্ধন-ঘর, শান-বান্ধানো মস্তো উঠান, লাল ঘাটলা-সিঁড়ি নিয়ে পড়ে থাকে শূন্য, হা হা!

তার দোতলা-কোঠার জানালায় জানালায় ছিল নীল, বেগুনি, হলুদ কাচ;  তার বেশিটাই এখন আধা ভাঙ্গা, এক-দুইখানা আস্তা। কোনো কোনো জানালা কাচশূন্য-খা খা। সেদিকে চোখ গেলে কেনো জানি পরানটা ধক করে ওঠে। মনে হওয়া ধরে যে, কোনো এক অচিন সর্বনাশ য্যান গুঁড়ি গুঁড়ি কদমে আগাচ্ছে নিজেদের বাড়ির ঘাটার দিকে। কি জানি ডরের একটা কিছু ঘটবে- এমন মনে হতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। অন্তর অকারণেই কেঁপে ওঠে।  

সেই নিয়ম-ব্রতপালন- বিধিভরা জমিদার বাড়ি এখন হুমহুমা, খালি, সুনসান। তার দিকে তাকালেই পরান হায় হায় করতে থাকে। লোকে পারতে সেই বাড়িতে পা দিতে যায় না। তবে আজব কারবার, ছাড়া-বাড়িখানের সবটা- হিম, হা হা, স্তব্দ, ফাঁকা; কিন্তু তার পুষ্কুনি দুইখান কানায় কানায় জলভরা। সেই আগের আমলে যেমন টইটুম্বুর, টলমল, ভরাপুরা ছিল ; এখনো এই কালেও তেমনই আছে। সদাসর্বদা ভরা থইথই।  

আকালপড়া, শুকনার দিনে দেওভোগ গ্রামের মা-বৌরা সংসারের কাজকাম শেষ করার পরে যেদিন সময় করতে পারে, সেদিন একসঙ্গে সকলে সেই ছাড়াবাড়ির উত্তরের পুকুরে যায় গাও-গোসল সারতে। বহুজনে যদি একসঙ্গে যাওয়ার জন্য জোটে তো তাদের যাওয়া হয়। নইলে দুই-পাঁচজন জুটলেও যায় না, একা যাওয়া তো চিন্তার বাইরে।

তখন, গা ধোয়ার নিত্যিকর্ম কোনো মতে নিজেদের ঘোলা-প্যাঁক পানিতেই সারে। সেই পানিরে শরীরে তোলার উপযুক্ত রাখার কায়দা তো তারা পালন করে আসছে জনম জনম ভরে। তারা করে কী, ঘোলা-প্যাঁক পানিরে একদম থির রেখে দেয়, পানিরে একটা ঝাপটা পর্যন্ত দেয় না পোলাপানে সুদ্ধা। তখন আপনা আপনি পানির প্যাঁক গিয়া থাকে তলায়, আর উপরে কোনোরকম একটু ফর্সা পানি ভাসান দিয়া থাকে। সেই পানি আলগোচ্ছে, কয় লোটা তুলে শরীররে দেয় লোকে। দিয়া কোনো মতে শরীরের তাতানিরে সামালায়। কিন্তু তাও দল-ছাড়া হয়ে, একলা কোনোজনে  গোসল করতে যায় না ঠাকুর-বাড়ির পুষ্কুনির দিকে। যায়-ই না।

এদিকে খাওয়ার পানি আনাটা সবকিছুর থেকে বড়ো এক ঠেকার কর্ম। কিন্তু সেই বিষম ঠেকার কর্মখানও কেউ একলা করতে যায় না। যায় তারা একসঙ্গে।এমনে-ওমনে বহুজনে। সকালে, রোদ চড়া দিয়া ওঠার আগে একে অন্যরে ডাকাডাকি দিয়া একলগে হয় তারা। তারপর  সকলে চলে পানি আনার কর্মখান সারতে।  

আকাইল্লা দিনে দেওভোগ গ্রামের সকলে মানে যে, এহন সংসারের আর সব কাজ পরে, আগে দরকার বড়ো ঠেকার কাজখান সারা। খাওনের পানি নাই তো সংসার অচল। কিন্তু সেই কাজেও তাগো যাইতে হয় বহুজনে মিলে। বহুজন নাই তো, বৌ-ঝিগো পানি আনতে যাওনও নাই। আগু পিছু করে করে, একসঙ্গে হাঁটা দেয় সকলে- পানি আনার জন্য। কিন্তু কেউ কোনোদিন একা একলা ভুলেও অই বাড়ির দিকে পাও বাড়ায় না। কেনো!

তাদের বড়ো ডর করে অই সুনসান, থোমধরা বাড়িতে পা দিতে! কোনো কারণ নাই ডরানোর, তবুও ডরে তাদের শরীর কাঁপে। যদিও, জিন্দিগিতেও কেউ কোনোদিন কোনো অশৈলী কারবার ঘটতে দেখে নাই কিছু অই বাড়িতে, কেউ কোনোদিনও কোনো মন্দ বাতাসের আলামত পায় নাই; কিছুর মধ্যে কিছু না; তাও লোকে ডরায়, ডরাতে থাকে। অন্তরে শরীরে কাঁপুনি দিয়া ওঠে তাদের। ভয় লাগে। খুব ভয়। সেই কারণে একা একলা কেউ, অই ঘুটঘু্ট্টি ছাড়া-বাড়িতে পাও দিতে যাওয়া তো দূর, যাওয়ার চিন্তাটাও মনে আনে না।

কালে কালে দেওভোগ গ্রামের বসতকারী যত কমেছে, লোকের ঠাকুর-বাড়ি নিয়া ডর ততো বেড়েছে। এখনকার কালে এমন অবস্থা যে, পারতে কোনোজনে ঠাকুর-বাড়িরে স্মরণেও আনে না। সেই বাড়ির দিকে ফিরাও চায় না। আছে ছাড়াবাড়ি, থাকুক পইড়া তার মতোন- এই মনে নিয়া সকলে ঠাকুর-বাড়িরে চক্ষের সামনে রেখেও, তারে দেখতে পায় না।

ঠাকুর-বাড়ি নিয়া এমন যখন অবস্থা, দেওভোগ গ্রামের বেটা-মাতারি সকলের পরানে যখন এমন ডর-ভয়ের লড়ালড়ি, সেই সময়েই সেই আচরিত বৃত্তান্তটা ঘটে।

তেরোশো তিরিশ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের মাঝামাঝি। দুপুর বেলা। তখন কিনা গ্রামের সকলের চেয়ে ঢক-চেহারার মেয়েখান একা একলা যায় সেই ঠাকুর-বাড়ির পুকুরে গোসল করতে! এমন না যে, অই বাড়ি নিয়া- গ্রামের সকলের ডরানের কথাখান কোনোদিন শোনে নাই সে! এমন না যে, তার মায়ে তারে আগুন-পানি, বান-বাতাস, ভয়-তরাসের বিষয়ে তন্ন তন্ন করে জানানি দিতে কোনো রকম ফাঁকফোঁকড় রেখেছে! রাখে নাই। সব জানে সে। তাও সে যায় একলা একলা সেই পুষ্কুনিতে।

ক্যান গেল সেয়! দিনে –দোপোরে কী সেই কন্যা নিশির ডাক শুনলো!

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন ( পঞ্চম কিস্তি )
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)