সেলিম আল দীন স্মরণ

‘সেড’ স্যারের ‘ডেড’ ডিপার্টমেন্ট

Looks like you've blocked notifications!

 

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমদের পরিচয় ও এক সঙ্গে কাজ করার স্মৃতি ৩০ বছরের। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শিক্ষকতা জীবনের বেশ সময় কাটিয়েছেন তিনি । একই সাথে কাজ করেছেন বিভিন্ন থিয়েটারে। নাটকে।

এসব স্মৃতি নিয়েই ৫ আগস্ট কথা হয়েছিল তাঁর সাথে। তাঁর বলা স্মৃতিগুলো পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

সেলিম আল দীন শিক্ষক হিসেবে যেমন ছিলেন

তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। প্রথম বর্ষেই আমরা স্যারের ক্লাস পেয়েছি। তাঁর ক্লাস ছিল অন্যরকম। প্রতি মুহূর্তের চিন্তা তিনি জানাতেন। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন যে, ক্লাসের বাইরেও ভালো কিছু শেখানো যায়। ক্লাসের সেলিম আল দীন আর বাইরের সেলিম আল দীন ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন।

স্যার ক্লাসেই পড়া মুখস্ত করতে দিতেন। একবার আমরা এর প্রতিবাদ করলাম। আমরা কি প্রাইমারির স্টুডেন্ট যে, আমাদের ক্লাসে পড়া মুখস্ত করতে হবে। কিন্তু কেউই স্যারকে এসব বলার সাহস পায়নি।

আমাদের বন্ধু ছিল সুহৃদ চাকমা। আমরা সবাই মিলে তাকে বললাম- বন্ধু তুই পারবি। তুই স্যারকে বলবি, ‘স্যার আমরা পড়া মুখস্ত করতে পারব না।’ সুহৃদ নেতৃত্ব পেয়ে খুব খুশি। স্যার যথারীতি ক্লাসে এলেন। পড়া মুখস্ত করতে দিলেন। সুহৃদ দাঁড়াল। বলল- স্যার আমরা কি ক্লাস টুয়ের ছাত্র যে পড়া মুখস্ত করব? স্যার বললেন ও আচ্ছা, তুমি বস।

এবার স্যার অন্য সবাইকে একে একে পড়া বলতে বললেন। সবাই ওই কথা বলতে সাহস পেল না। সবাই পড়া বলল। এবার সুহৃদ দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার আমার কিছু কথা আছে।’ স্যার বললেন- ‘বলো।’ সুহৃদ বলল, ‘স্যার আমার কী দোষ ওরাইতো আমাকে বলতে বলল...।’

স্যার ক্লাসে ছাত্রদের পেটাতেন। বেশ পেটাতেন। ক্লাস করতে করতে স্যারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি হতে থাকে।

সেলিম আল দীন স্যারের আসল নাম

প্রথম বর্ষের কথাই বলছি। আমাদের রুটিনে দেওয়া  আছে মইনুদ্দিন আহমেদ স্যারের ক্লাস। আমরা মইনুদ্দিন স্যারকে খুঁজছি। কোথাও মইনুদ্দিন স্যার নামে কোনো স্যারকে পেলাম না। পরে জানতে পারলাম সেলিম আল দীন স্যারের আসল নাম মইনুদ্দিন আহমেদ।

থিয়েটারের স্মৃতি ও বালিশ দেওয়া না দেওয়া

সবে মাত্র ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটারের সাথে যুক্ত হই। তখন ক্লাসরুমের সেলিম আল দীন আর বাইরের সেলিম আল দীনকে ভিন্নভাবে দেখেছি। তখন ছাত্র-শিক্ষক পরিচয় ছিল না। তাঁর সাথে হেঁটে, বাসে, ট্রাকে, নৌকায় করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গেছি।

স্যার পথ চলতে চলতে শেখাতেন রবীন্দ্রনাথকে-মধুসূদনকে। বিভিন্ন বিদেশি লেখকদের। জামালপুরের মেলান্দহের দেউলাবাড়ি গ্রামের ধানক্ষেতের আইল দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় স্যার বললেন, ‘এই পাকা ধানের রঙ, চারপাশের ঘাসের রঙ, আকাশের রঙ মিলে  যে  রঙের মিথষ্ক্রিয়া হয়, তা বই পড়ে পাওয়া যায় না। এটি বাইরে এসে চলতে চলতে শিখতে হয়।’

একবার মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা নদী দিয়ে আমাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম। তখন আমি সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি। আমরা বন্ধুরা মিলে নৌকা দোলাতে লাগলাম। স্যারকে ভয় দেখানোর জন্য।  স্যার খুব ভয় পেয়ে গেলেন- ‘এই নৌকা ডুবে যাইব রে, নৌকা দুলাইওনো।’ আর গান গাইতে লাগলেন,  ‘ছাড়ল খেয়া ওপার হতে, দুলছে তরী ...।’  

এবার তিনি অভিনয় করে দেখাতে লাগলেন, তিনি মরে গেলে কে কীভাবে স্মৃতিচারণা করবে। আমি কীভাবে করব, সুনিল স্যার কীভাবে করবেন, সৈয়দ আলী আহসান স্যার কী  বলবেন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ কী  বলবেন ইত্যাদি।

নাটকের কাজে টাঙ্গাইলে গেলাম সালাম সাকলাইন ভাইয়ের বাড়িতে। সঙ্গে স্যার, হুমায়ুন ফরীদিসহ অনেকে। প্রচণ্ড শীত। এত লোক রাতে থাকতে তো বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। পাটখড়ির বেড়া। প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস আসছে। স্যার বললেন, ‘তুই ওখানটায় ঘুমাবি। তাইলে আমার গায় বাতাস লাগবে না।’ স্যারের কথা না মেনে উপায় নেই। এবার স্যার আমার বালিশটাও নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার দুই বালিশ ছাড়া ঘুম আসে না। তুই বালিশ ছাড়া ঘুমা।’ আমিতো রেগে আগুন। এদিকে স্যার লেপের অর্ধেকটা পিঠের নিচে দিয়ে বাকিটা গায়ে দিয়েছেন। তাই আমি  সামান্য একটু লেপ পেলাম। একদিকে লেপ ছাড়া কষ্ট, অন্যদিকে বেড়া দিয়ে কনকনে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে, তারওপর বালিশ নাই। ক্ষোভে হাতের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি আমার মাথার নিচে বালিশ আছে। স্যার যত্ন করে আমার মাথার নিচে বালিশ দিয়েছেন। তখন স্যারের প্রতি শ্রদ্ধায় বুকটা ভরে গেল। বুঝতে পারলাম স্যার ঘুমানোর আগে যা করেছেন সবই মজা করেছেন।

নানা ডাকতাম

স্যার আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছিলেন। বেড়িয়েছিলেন। আমার মাকে মা ডাকতেন। আর আমাকে বলতেন এই তুই আমারে নানা ডাকবি। তাই তারে আমি নানা ডাকতাম। সেখান থেকেই আমি মিসেস সেলিমকে নানি ডাকি। এখনো ডাকছি।

স্যার ছিলেন  ভোজন বিলাসি

স্যার খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন। তিনি মাছ কিনতে নওয়ার হাট  ও ইসলামপুরে যেতেন। সেখানে তাজা মাছ পাওয়া যেত। এখনো পাওয়া যায়। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, তিনি মাছের কান ধরে নাকের কাছে নিয়ে আসতেন। ঘ্রাণ শুকেই বলতে পারতেন এটা বিলের মাছ নাকি পুকুরের। নাকি অন্য কোনো জায়গার। স্যার বাজারে গেলে পুরো বাজারের জেলেদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। তারা সবাই বড় বড় মাছ নিয়ে স্যারের কাছে চলে আসতেন।একবার স্যার বাজারে গেলেন কিন্তু পকেটে টাকা ছিল না। তিনি মাছ ও জেলেকে নিজের গাড়িতে করে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। এই ছিল তাঁর মাছপ্রীতি। একবার স্যার অনেক বড় একটা মাছ আনলেন। অনেক কষ্ট করে কুড়াল দিয়ে মাছটা কাটলেন। এবার তিনি আমার বাসায় মাথাটা পাঠিয়ে দিলেন। আমি বললাম স্যার আমার কাছে কুড়াল নেই। আমি এ মাথা কাটতে পারব না। তখন তিনি বললেন আরে না  তোর কাটতে হবে না। এখন তুই মাথাটা দেখ । কত বড় মাছ। পরে তো মাছ খেতে আসবিই। আগে মাথা দেখে মন সুখ কর। বেশ রসিক লোক ছিলেন। স্যার কোনো জায়গায় নাটক মঞ্চস্থর জন্য গেলে আগেই খাবার ম্যেনু পাঠিয়ে দিতেন। খাবার ম্যেনুর হেরফের হলে খুব মাইন্ড করতেন।

তোর কাছে ৬৩টাকা পাই

আমি তখন নতুন শিক্ষক। যা বেতন পেতাম তা মাস শেষের আগেই শেষ হয়ে যেত। স্যার আমায় বললেন তোর হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। তোকে ভালো মাছ খেতে হবে। ভালো খাবার খেতে হবে। ধর ৬৩ টাকা নে। জানি তোর কাছে টাকা নেই। আমি কতবার যে টাকাটা দেওয়ার জন্য চেষ্টা করলাম। তিনি নিলেন না। কিন্তু সুযোগ পেলে তিনি সবার সামনেই বলতেন এই আমি তোর কাছে ৬৩ টাকা পাই। তুই কি আমার টাকা দিবি না। তিনি এভাবেই আমার সাথে মজা করে গেছেন।

গুরু-শিশ্য শিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন

স্যার চার দেয়ালের ক্লাস রুমের পাঠদান ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি গুরু-শিষ্য শিক্ষায় বিশ্বাস করতেন। যার ওপর করে গড়ে ওঠেছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।

তখন পুরাতন কলার পিছনে গ্রাম ছিল না। এদিকটায় বেশ কিছু শিমুলগাছ ছিল। একবার তিনি আমায় বললেন, যা শিমুল ফুল পেড়ে নিয়ে আয়। আমি বললাম, আমি কীভাবে গাছে উঠব? গাছ তো কাটায় ভরা। তিনি বললেন, আমি কি তোমার গুরু নই? গুরুর কথার ওপর কথা বলতে নেই। গুরু যা বলেছে শিষ্যের কাজ হলো তা পালন করা। উপায় না পেয়ে ভয়ে ভয়ে শিমুল ফুল পাড়তে গেলাম। এমন সময় স্যার বললেন, থাক ফুল পাড়া লাগবে না। আমি ফুল পাইছি।

তখন আমি স্যারকে বললাম, তাহলে কেন আপনি আমায় এ পরীক্ষার মধ্যে ফেললেন? তখন তিনি বললেন, শিষ্যের কাজ হলো গুরুর কথা প্রশ্নাতীত ভাবে মানা আর গুরুর কাজ হলো কোনটা শিষ্যের জন্য ভালো বা মন্দ তা দেখা।

 সেড স্যারের ডেড ডিপার্টমেন্ট

তখনো বাংলাদেশের কোথাও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাটক বিভাগ খোলা হয়নি। নাটক যে ক্লাসে পড়ানো যায় তা কারো কল্পনায় আসেনি। সেলিম আল দীন স্যার ও আমি মিলে ১৯৮৬ সালে প্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগ খুলি। স্যার বিভাগটির নাম রাখলেন ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ’। তিনি এটিকে সংক্ষেপে বলতেন ‘নাওনা’। বিভাগটির ইংরেজি নাম ‘ড্রামা অ্যান্ড ড্রামাটিকস’ সংক্ষেপে ‘ডেড’। আমরা মজা করে স্যারের নামও সংক্ষিপ্ত করে ফেলি। সেলিম আল দীনকে সংক্ষেপে বলতে থাকি ‘সেড’। সবাই মজা করে বলতাম ‘সেড’ স্যারের ‘ডেড’ ডিপার্টমেন্ট।

স্যারের সাথে শেষ দেখা

স্যারকে দেখতে বার্ডেম হাসপাতালে গেলাম। স্যার আমাকে দেখে বললেন, আমার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। তখন আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। স্যার আমায় আবার বললেন, ‘তুই তো সিগারেট ছেড়ে বেঁচে গেছিস আর আমি তো টেসে গেলাম।’ স্যার তখন আর সিগারেট খেলেন না।

তারপরই ডাক্তাররা বলল, তাঁকে ল্যাবএইডে নিয়ে যেতে হবে। তাই করা হলো। আইসিউতে নেওয়ার সময় আমার দিকে বিদায়সূচক হাত নাড়লেন। সেই শেষ দেখা। তারপর তো আইসিউ হতে নিথর সেলিম আল দীন বের হয়ে এলো।

খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে হাসপাতালের আশপাশে ৩০-৪০ হাজার লোক জড়ো হলো। হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। শহীদ মিনারে নেওয়া হলো। লোকের ঢল নেমে এলো। ক্যাম্পাসে নিয়ে এলাম। বিভাগে নিলাম। মুক্তমঞ্চে নিলাম। জানাজায় মানুষের ঢল। এমএইচ হলের দক্ষিণ পাশের মাঠ পুরোটা ভরে গেল। তাকেঁ কবর দেওয়া হলো মসজিদের পাশে। নিম গাছের নিচে। গাছটা আগে থেকেই ওখানে ছিল। ওখানকার মাটিটা লাল।

এখন বুঝতে পারছি ‘সৃজনশীল মানুষ হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পান।’ তিনি অনার্সে পড়াকালীন ‘মনা বাউল’ নামে একটা নাটক লিখেন। আর এই মনা বাউলের বিলীন হয়ে যাওয়া ছিল লাল মাটির কবরে, নীম গাছের নিচে, মনার মাংসগুলো পিপড়া খুটে খুটে খাচ্ছে। হয়তো স্যারই নিজেকে সেই মনা বাউল হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। তাঁর কবরটা দেখলে আমার তাই মনে হয়।

আমি বিশ্বাস করি সেলিম আল দীন মরে যাননি। তিনি আমার সাথে সব সময় বহমান। তাঁর স্মৃতি নিয়ে লিখতে শুরু করেছি।