‘সিনেমাওয়ালা’র সঙ্গে কিছুক্ষণ

Looks like you've blocked notifications!

কৌশিক গাঙ্গুলীর ছবি ‘সিনেমাওয়ালা’ একই সঙ্গে তিনটি দ্বন্দ্বের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের : ১. সেলুলয়েড/ডিজিটাল; ২. মতাদর্শ/মতাদর্শহীনতা; ৩. প্রাচীন/নবীন।

যাঁরা নির্মেদ, ঋজু এই ছবিটিকে সেলুলয়েডের ফেলে আসা দিনগুলির প্রতি একটা ট্রিবিউট বলে ধরে নিচ্ছেন, তাঁরা সিনেমায় উন্মোচিত প্রথম দ্বন্দ্বটিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু আসলে প্রথমটি সূত্রমাত্র, যা ধরে আমরা পৌঁছে যাব দ্বিতীয় ও তৃতীয় দ্বন্দ্বে।

একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হল এবং তার মালিকের প্রায় কর্মহীন জীবনকে দৈনন্দিনতার আতসকাচে ফেলে কৌশিক আসলে একধরনের সোশ্যাল কমেন্টারি রচনা করে ফেলেন। কমেন্টারি হলেও সাম্প্রতিক বাংলার প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবির চিত্রভাষ্যে কমেন্ট বা মন্তব্য কম, বরং প্রশ্ন বেশি থাকে।

কী হয় যখন—মনোরঞ্জন নয়, মনোবর্ধন : এই আদর্শে বিশ্বাসী—এলিটিস্ট সংস্কৃতি পরাজিত হয় সবকিছুকে ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলা এক অদ্ভুত আঁধারের কাছে? কী হয় যখন অপত্য তার স্রষ্টাকেই অস্বীকার করে বসে? কী হয় যখন দেয়ালে ঝোলানো কার্ল মার্কসের ছবি এ ছবিতে এক অনির্বচনীয় আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা তৈরি করে ফেলে?

শ্রমিকের শ্রম চুরি করে মালিক তাঁর মুনাফা বাড়ান, মার্কসের সৌজন্যে, আমরা জানি, কিন্তু উৎপাদিত পণ্যই যখন চুরি হয়ে যায় পাইরেসির মার্কেটে, তখন মুনাফা তো দূর অস্ত, লগ্নিই ফিরে আসে না মালিকের ঘরে। ফলত নৈরাজ্য গ্রাস করে চরাচর। কারখানা/স্টুডিয়ো ঝাঁপ বন্ধ করে, অভিনেতা সিরিয়ালে নাম লেখায়, হলমালিক লোডশেডিংয়ের মধ্যে ফাঁকা অফিসঘরে বসে থাকে আর জেনারেটর সশব্দে চলা শুরু করলে মেলায় ডিজিটালি প্রজেকটেড বেআইনি সিনেমার মোচ্ছব ফের শুরু হয়ে যায়।

এক অদ্ভুত সমাপতনে কৌশিকের সিনেমায় হলমালিকের ছেলেই এই লুম্পেন সংস্কৃতির শিকার, কতকাংশে ছোটমোটো কুশীলবও। আসলে এ-ও এক প্রতীক নির্মাণ। সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক ব্যর্থতার দায় তো পিতাদের ওপরেই বর্তায়, তাই না? প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে না-পারলে আঁধার ঘনিয়ে আসে, আগুনও।

ঘনসংবদ্ধ যে চিত্রনাট্য কৌশিক রচনা করেছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। এই সিনেমার চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, সংগীত আয়োজন, শব্দ সংযোজন—সবই আন্তর্জাতিক মানের। মুখ্য ভূমিকায় পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের চমৎকৃত করেন তাঁর অভিনয়কৌশলের সংবৃত প্রয়োগে। নিম্নগ্রামে কথা বলতে বলতে হঠাৎ—এটা সিনেমা! এটা বিগ স্ক্রিন!—বলে তাঁর চেঁচিয়ে ওঠা হয়তো বা আন্তর্জাতিক সিনেমার স্মরণীয়তম দৃশ্যগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠার দাবি রাখবে।

পুত্রের ভূমিকায় পরাণকে যোগ্য সংগত করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। পুত্রবধূর চরিত্রে সোহিনী সরকার যথাযথ। একটি ছোট্ট চরিত্রে—ড-কে দ বলা—লামা আমাদের অবাক করে দেন। তেমনই হৃদয়গ্রাহী প্রোজেকশনিস্টের ভূমিকায় অরুণ গুহঠাকুরতার অভিনয়।

প্রাচীন পৃথিবীর অবসান, নবীন পৃথিবীর উত্থান—এক বিরল যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী এই সিনেমা। তোফা অবস্থায় থাকলেও বিক্রি করে দিতে হচ্ছে—বহু মহানায়কীয় ছবি পর্দায় ফেলে অন্ধকার হলে ম্যাজিক তৈরি করা—ফিল্ম প্রজেক্টর, জাল সিডি-র চাকতির প্রতিফলনে মাত্রা পাচ্ছে জাল নয় এমন এক দাম্পত্যপ্রেম, রক্তচাপ ক্রমশ বাড়িয়ে নির্বাচন এগিয়ে আসছে, পিতার অধীত জ্ঞান ও দর্শনকে তীব্র ঘৃণায় বাতিল করে দিচ্ছে পুত্র, মফস্বলি মেলায় তীব্র গতিতে ঘুরছে ইলেক্ট্রিকের নাগরদোলা—অদ্ভুত এক ক্লাইম্যাক্টিক শীর্ষের দিকে যাত্রা করছে উন্নয়নের নয়া বয়ান।

সিনেমার অন্তিম দৃশ্য অনেক দর্শক-সমালোচককেই অখুশি করেছে। কিন্তু চিত্রনির্মাতা হিসেবে ঠিক সেখানেই সফল কৌশিক। পণ্যায়িত সংস্কৃতির আত্মধ্বংসী রমরমার যুগে বাতিল হয়ে যাওয়া মতাদর্শ নিয়েই তাঁর সিনেমাওয়ালা হাঁটতে থাকেন খাড়াই বেয়ে—গন্তব্য ততদূর, যতদূর যাওয়া যায়।