রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের পেছনের গল্প

Looks like you've blocked notifications!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষায় ছোটগল্প প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনিই। তাঁর দেখানো পথেই হেঁটেছেন পরবর্তী লেখকেরা কিংবা হাঁটার চেষ্টা করে গেছেন নিয়ত। এ লেখাটির মূল প্রতিপাদ্য হলো, তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত ছোটগল্প রচনার পেছনের গল্প বা প্রেক্ষাপট তুলে ধরা। নিজের গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতেন রবীন্দ্রনাথ। কখনও তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন গল্প লেখায়। 

পোস্টমাস্টার 
প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ একজন কবি হলেও জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব থেকে রেহাই পাননি তিনি- এ কথা সবারই জানা। তারই সূত্রে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে একটি কাচারি বাড়ি ছিল তাঁর। ওই বাড়িতে বসেই তিনি জমিদারি দেখাশোনা করতেন। সেই কাচারি বাড়ির এক তলাতে ছিল একটি পোস্ট অফিস। সেখানকার পোস্টমাস্টারের সঙ্গে তাঁর দেখা হতো প্রায় প্রতিদিন। তাঁর সঙ্গে অনেক কথাবার্তা, গল্প হতো। রবীন্দ্রনাথ সাধারণত দিনের বা রাতের কোনো একটা সময় পোস্টমাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে কাটাতেন। মূলত এই পোস্টমাস্টারের জীবনের নানা কাহিনি অবলম্বনেই তিনি লেখেন বিখ্যাত ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি। 

ছুটি 
এ গল্পটিও শাহজাদপুরে কাচারি বাড়িতে বসে লেখা। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। তিনিও নৌকাযোগেই তাঁর কাচারি বাড়িতে তাঁর জমিদারি দেখাশুনা করতে আসতেন। এমনই একদিন ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছেন তিনি। নদীর তীরে গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে খেলা করতে আসে। তাদের মধ্যে সর্দার গোছের একটি ছেলে ছিল। অনেক ডানপিটে স্বভাবের ছিল সে। তার কাজই হলো, এ-নৌকা ও-নৌকা করে বেড়ানো, মাঝিদের কাজ দেখা, মাস্তলের পাল গোটানো দেখা ইত্যাদি। তীরে গাদা-করা অবস্থায় ছিল অনেকগুলো গুড়িকাঠ। মাঝে ছেলেটি হঠাৎ করে নৌকা থেকে এই কাঠগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে নদীতে ফেলতে আরম্ভ করে। কিন্তু একটা বিঘ্ন এসে উপস্থিত হলো তার আমোদের পথে। একটি ছোট মেয়ে এসে গুড়ি চেপে বসে। ছেলেটি তাকে উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটি তা গ্রাহ্যও করে না। ছেলেটি তখন তাকে সুদ্ধই গুড়িটি উল্টে দেয়। মেয়েটি পড়ে গিয়ে ভীষণ কান্না জুড়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে উঠেই কষে এক চড় লাগায় ছেলেটিকে। এই ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হলো অন্যতম সেরা গল্প ‘ছুটি’ । 

সমাপ্তি
শাহজাদপুরে বসে লেখা রবীন্দ্রনাথের আরও একটি অনবদ্য সৃষ্টি এ গল্প। একদিন তাঁর কাচারি বাড়ির ঘাটে একটি নৌকা ভেড়ে। সেটির মুখে ভিড় করে দাঁড়ায় সেখানকার ‘জনপদবধু’রা । বোধহয় কাউকে বিদায় দিতে আসে সবাই। কিন্তু ওদের মধ্যে একটা মেয়ে থাকে, যার প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনোযোগ আকৃষ্ট হয় সবচেয়ে বেশি। বার-তেরো বছরের কালো অথচ লাবণ্যময়ী, ছেলেদের মতো চুল ছাঁটা, স্বপ্রতিভ ও সরল ভাবের একটি মেয়ে। কোলে তার ছোট্ট একটি ছেলে। নিঃসংকোচে কৌতূহলের সঙ্গে সে চেয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের দিকে। মেয়েটিকে ডেকে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু কী ভেবে আর করলেন না। মেয়েটি মাঝে-মধ্যেই আসত ঘাটে। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, বধূবেশে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে সেই মেয়েটি। সেই ঘাটে নৌকা বাঁধা। কী তার কান্না! অন্য মেয়েদের বলাবলি কানে এলো রবীন্দ্রনাথের- “যা দুরন্ত মেয়ে! কী হবে এর শ্বশুরবাড়িতে!” এ দৃশ্য দেখে ভারি দুঃখ হলো রবীন্দ্রনাথের। চঞ্চলা হরিণীকে বন্দি করবে সংসার। ওই মেয়েটির কথা মনে করেই লিখে ফেলেন বিখ্যাত ‘সমাপ্তি’ গল্পটি। 

ক্ষুধিত পাষাণ

রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য, ‘ক্ষুধিত পাষাণের কল্পনা কল্পলোক থেকে আমদানি’। তবে তাঁর এই কল্পনার পেছনেও একটি গল্প আছে। বিলেত যাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেঝদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল আহমেদাবাদ গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় প্রথম আইসিএস এবং কর্মজীবনে আহমেদাবাদের জেলা জজ। তাঁর বাসাটি ছিল শাহিবাগে, বাদশাহী আমলের রাজবাড়ি। দিনের বেলায় তাঁর মেঝদা চলে যেতেন কাজে। তখন তাঁর মনে হতো, বড় বড় ফাঁকা ঘর হাঁ হাঁ করছে। সমস্ত দিন ভূতে পাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড চাতাল। সেখান থেকে দেখা যেত সাবরমতি নদী (গল্পের ‘শুস্তা’ নদী, সংস্কৃত ‘স্বচ্ছতোয়া’র অপভ্রংশ)। রবীন্দ্রনাথের মতে, কলকাতার মানুষ হিসেবে ইতিহাসের মাথা তোলা চেহারা কোথাও দেখেননি তিনি। আহমেদাবাদ এসে তিনি প্রথম দেখলেন চলতি ইতিহাস থেমে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে তার পিছন-ফেরা বড়োঘরোআনা। তার সাবেক দিনগুলো যেন যক্ষের ধনের মতো মাটির নীচে পোঁতা। 

রবীন্দ্রনাথের মনের মধ্যে প্রথম আভাস দিয়েছিল, “ক্ষুধিত পাষাণের গল্পের– সে আজ কত শত বৎসরের কথা। নহবতখানায় বাজছে রোশনচৌকি দিনরাত্রে অষ্টপ্রহরের রাগিণীতে, রাস্তায় তালে তালে ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠছে, ঘোড়সওয়ার তুর্কি ফৌজের চলছে কুচকাওয়াজ, তাদের বর্শার ফলায় রোদ উঠছে ঝক্ঝকিয়ে। বাদশাহি দরবারের চার দিকে চলেছে সর্বনেশে কানাকানি ফুস্ফাস্। অন্দরমহলে খোলা তলোয়ার হাতে হাবসি খোজারা পাহারা দিচ্ছে। বেগমদের হামামে ছুটছে গোলাপজলের ফোয়ারা, উঠছে বাজুবন্ধ-ক'কনের ঝন্ঝনি।” 

জীবিত ও মৃত
ভোররাতে উঠে অন্ধকার ছাদে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের। তেমনই একদিন রাতে ঘুম ভেঙে যেতেই তিনি উঠে পড়লেন। ভেবেছিলেন উঠার সময় হয়েছে। আসলে তখন গভীর রাত। অভ্যাশবসত তিনি হাঁটতে লাগলেন। সব ঘরের দরজা বন্ধ। চারিদিক একেবারে নীরব, নিস্তব্ধ। খানিক পড়েই ঢং ঢং করে দু’টা বাজার ঘণ্টা পড়ল। তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অনুধাবন করলেন- গভীর রাতে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। হঠাৎ তাঁর মনে হলো তিনি যেন প্রেতাত্মা, বাড়িটি তিনি বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। মনে হলো তাঁর, তিনি যেন মোটেই তিনি নন, তাঁর রূপ ধরে বেড়াচ্ছেন মাত্র। এই ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসে- যেন একজন জীবিত মানুষ সত্যিই নিজেকে মৃত বলে মনে করছে। এভাবেই অনবদ্য গল্প ‘জীবিত ও মৃত’-এর জন্ম। 

কংকাল 
ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ যে ঘরে শুতেন সেখানে একটা মেয়ে মানুষের কংকাল ঝুলানো ছিল। সেসময় সেটি দেখে তাঁর তেমন একটা ভয় করত না। পরিণত বয়সে একদিন বাড়িতে অতিথি সমাগম হওয়ায় রবীন্দ্রনাথকে বাইরে শোওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অনেকদিন পরে সেই ঘরে তিনি আবার ঘুমাতে যান। কিন্তু শুয়ে তাঁর মনে হতে লাগে, শেজের আলোটা ক্রমে কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল। আরও মনে হতে লাগল, কে যেন মশারির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলছে ‘আমার কংকালটা কোথায় গেল’, ‘আমার কংকালটা কোথায় গেল’? ক্রমশ মনে হতে লাগল সেটি দেয়াল হাতড়ে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখিত হলো ‘কংকাল’ গল্পটি। 

গিনি 
গল্পটিতে অনেকখানি সত্যতা আছে। এটি রবীন্দ্রনাথের নর্মাল স্কুলের স্মৃতি থেকে লিখিত। সেই স্কুলে এক পণ্ডিত ছিলেন যিনি ক্লাসের ছেলেদের অদ্ভুত নামকরণ করে বেশ লজ্জা দিতেন। তাঁর ভাষা এত কুৎসিত ছিল যে, তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাবশত কেউই কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতো না। যেমন : একটি ছেলেকে তিনি ভেটকি বলে ডাকতেন, কারণ তার গ্রীবার অংশটা কিছুটা প্রশস্ত ছিল। 

কাবুলিওয়ালা 
গল্পটি বাস্তব কোনো ঘটনা অবলম্বনে লিখিত নয়। গল্পের মিনি রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে মাধুরীলতা দেবীকে (বেলা) মাথায় নিয়ে লেখা। 

স্ত্রীর পত্র ও বদনাম 
রবীন্দ্রনাথের মুখেই শোনা যাক লেখাটির পটভূমি:  ‘প্রথমে মেয়েদের পক্ষ নিয়ে ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে বলি। কেউ কেউ তার প্রতিবাদ করে, কিন্তু পারবেন কেন? তার পরে আমি যখনই সুবিধা পেয়েছি বলেছি। এবারেও সুবিধে পেলুম, ছাড়ব কেন, সদুর মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলুম।’ মানে স্ত্রীর পত্র ও বদনাম দুটো গল্পই নারীদের পক্ষে লেখা। 

তথ্যসূত্র 
১. রবিজীবনী; প্রশান্তকুমার পাল; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৯। প্রথম খণ্ড থেকে নবম খণ্ড।
২. রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক; প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়; বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, কলকাতা। প্রথম খণ্ড থেকে চতুর্থ খণ্ড।
৩. গল্পগুচ্ছ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, কলকাতা।