মুক্তগদ্য

মিথ্যে কথা ফেয়ার করতে বসে

Looks like you've blocked notifications!

ছেলেবেলায় একবার ‘ঘোড়ার ডিম’ দেখার শখ বাবাকে জানিয়েছিলাম। বাবা বাজার থেকে সেদিনই একটা কুমড়ো কিনেছিল। বলেছিল, ঘোড়ার ডিমটা নাকি সেই কুমড়োর মধ্যেই আছে। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, কই আগে তো কোনো কুমড়োতে দেখিনি। বাবা বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে বলেছিলেন, সব কুমুড়োতে থাকে না রে। সেদিনভর কত কতবার যে কুমড়োটা কাটতে তাগাদা দিয়েছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত কুমড়োটা কাটেনি, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোড়ার ডিমের সাইজ, রং ও তার অবাক আমার ভেতর আনন্দময় ভাবনায় ছিল। সত্যিটা দেখার পরে ভাবনারা স্থির হলো... বেকুফ হলো... বোবা হলো।

আসলে সত্যির কোনো বানানো ব্যাপার নেই, যেমন খুশি সাজো নেই, রোদ বা রঙের চড়ে বসা নেই, কাসুন্দি নেই, কুয়াশা মাখানো নেই, পরিণামহীনতা নেই। কিন্তু মিথ্যের এসব আছে। মিথ্যে তাই সত্যির মতো একঘেয়ে নয়।

জীবনে যা হতে চেয়েও, বোঝাতে চেয়েও পারিনি, সেই সব হোঁচট খাওয়াদের মিথ্যে এসে একলহমায় জিতিয়ে দিল। এখান থেকে এখনো দিব্বি দেখা যাচ্ছে, সুখেনের বৌকে কেউ বোঝাতে পারছে না এক পাড়াভর্তি সংশয়, তার শাখা-সিঁদুর সুখেনের পাঁচ বছরের অনুপস্থিতিকে মিথ্যেই প্রতিরাতে সান্ত্বনা দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

মিথ্যের অভ্যাস একটা গোটা মানুষকে খেয়ে ফেলে, গোটা রাষ্ট্রকে খেয়ে ফেলে। যেভাবে জেহাদের নামে দক্ষিণী দুনিয়াকে তিলেতিলে খেয়ে ফেলেছে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী সম্প্রদায়। যে মানুষটা রাষ্ট্রীয়/ধর্মীয়/আর্থিক ক্ষমতায় সমৃদ্ধ, তিনি মিথ্যেয় জড়ালে তার মিথ্যেরা নাদুস-নুদুস সেই কালোমিথ্যে, যার কখনো সখনো অমরত্বও জুটে যায়। যেভাবে যুধিষ্ঠিরের মুখে ‘অশ্বত্থামা হত’ অমরত্ব পেয়েছে, মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাও পিছিয়ে নেই।

তেমনি আবার যে ম্যাজিশিয়ান নিছক আনন্দদানেই মিথ্যে খরচ করে চলেছেন নিয়ত, তার মিথ্যেকে আমি সাদামিথ্যে বলব। কেননা এই মিথ্যে কারো ক্ষতিসাধন তো করে না। আমি তাই সেই ম্যাজিশিয়ান সেজে চারপাশের হাসিগুলোকে আরও চওড়া দেখতে চাই, দুঃখগুলোয় মিথ্যে মাখিয়ে দুঃখের ওজন কমাতে চাই। শান্তির বাবা মরে যাওয়ার পরও বিদেশের শান্তি মণ্ডলকে ফোন করে জানাই, তার বাবা অসুস্থ খুব, সে যেনও যত দ্রুত সম্ভব চলে আসে। আমি কোনোমতেই চাই না, সত্যিকথা শান্তির ঘরে ফেরার জার্নির ব্রেকফেল করুক। চাই না, শান্তি জীবন্ত লাশ হয়ে ঘরে ফিরুক।

সত্যি স্থির হলে যদি মানুষ লাশ হয়, মিথ্যে স্থির হলে সেই মিথ্যেটা ধীরে ধীরে সত্যি হয়ে ওঠে। কলেজে এ ওর ডাকনাম জানতে চাইলে নিজেই নিজের একটা ডাকনাম দিয়েছিলাম। কত্তদিন কলেজ ছেড়েছি। অথচ কলেজের সেই সময়কার বন্ধুদের বা স্যারদের সাথে দেখা হলেই সেই নাম ফিরে আসে। এমনকি ওই ডাকনামের অন্য কেউকে শোনার পরিধির মধ্য থেকে কেউ একজন ডাকলেই আমারও সারা দেওয়ার প্রবণতায় মুখ ফিরে যায়।

ডাকতে ডাকতেই একলব্য একদিন মিথ্যের মধ্যে সত্যিকে সাধনায় পেয়েছিল। সেই মিথ্যের দোহাইয়ে নিজের বুড়ো আঙুল খসিয়ে হাসতে হাসতে দ্রোণাচার্যের চাহিদাও মিটিয়েছিল। দ্রোণাচার্যের ছল একলব্যকে মহৎ করেছে। কিন্তু অর্জুনকে কি খাটো করেনি একটুও? সেই ছলচাতুরীই কি যুধিষ্ঠির মাধ্যমে কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দ্রোণাচার্যের সম্মুখে ফিরে এসেছিল? এই যে সমর্থন খুঁজতে, মিল খুঁজতে বসে গেলাম। মনের সমর্থনে মিলেও গেলাম বন্ধু যত। আবার মিল ভাঙিয়ে ছেড়েও গেলাম অনেকে। অথচ তাদের তো শেকড়ওয়ালা বন্ধু ভাবতাম, যাদের সাথে কতদিনকার কত কত সত্যি-যাপন। সেসব সম্পর্ক একলহমায় মিথ্যে হয়ে গেল! তাহলে কি অনেকগুলো সত্যি দিয়ে একটা মিথ্যে রচিত হলো? অথবা, মিথ্যের এতটাই জোড় যে জোরালো সত্যিদের খাটো করে দিল নিমেষে!

সক্রেটিসের সমাজে, গ্যালিলিওর সমাজে উভয়ে মিথ্যে ছিল। মানবধর্মের চোখে জাতপাত, বর্ণভেদ, শুচিবাই মিথ্যে। অপির চোখে আমি মিথ্যে। আমার চোখে অনুপম মিথ্যে। অনুপমের চোখে মলিনা মিথ্যে। মলিনার চোখে অতনু মিথ্যে। অতনুর চোখে ভূত মিথ্যে। কিন্তু এক পূর্ণিমার মধ্যরাতে দূর গ্রাম থেকে ফেরার পথে মাঠের আলের পাশের গাছে একটা গোটা শরীরকে ঝুলতে দেখে অতনুরও ভূত খেয়ালে এসেছিল। ঝুলন্ত শরীরটা যখন কেঁপে কেঁপে উঠছিল দূর থেকে ভূত ভাবনারা সত্যি হয়েছিল। অতনুর একার তখন সাহস ছিল না। আমরা সঙ্গে থাকায় সত্যি-মিথ্যে যাচাই জোট বেঁধেছিল। তাই গাছটির কাছাকাছি যেতেই বোঝা গেল, নাদুসনুদুস একটা কলাগাছ। যার একটা শুকনো পাতা ডগা মচকে ঝুলে আছে। জ্যোৎস্না যাকে সাদা কাপড়ে জড়িয়েছে। আর হাওয়া এসে দোলাচ্ছে জ্যোৎস্নার সেই ছলনা।

সুন্দরী ছলনা জানে। সুন্দর সে ছলনা ধুমধাম পালন করে। আলোবাজিসহ কেক কাটে। আমিও তার দেখাদেখি দোকান থেকে কয়েক ছটাক মিথ্যে কিনে আনি। সতেজ গুচ্ছ ফুলের ভেতর প্লাস্টিকের ফুল গুঁজে এনে সে তোড়া প্রিয়জনের হাতে তুলে দিয়ে বলি, এই সমস্ত ফুলের শেষ ফুলটা যতদিন না শুকোবে ঠিক তত দিন পর্যন্ত সঙ্গে থাকব। প্লাস্টিক, যা ফুলের স্বভাবধর্মের মিথ্যে। আর এই মিথ্যের কোনো শুকিয়ে যাওয়া নেই। আর শুকিয়ে যাওয়া নেই বলেই পপ গায়িকা বিটনিস্পিয়ারের চিবোনো চিকলেট নিলামে বিক্রি হয়। অদ্ভুত! মিথ্যে সান্ত্বনায় মিছিমিছি কত খরচ! মিথ্যে সান্ত্বনায় আমিও মূল্যবান খরচ ভেবে নেটডেটা রিচার্জ করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে মুখ গুঁজছি... প্লাস্টিকের ফুলে মুখ গুঁজছি। বাবা বলেন, ‘এসব আসলে মনে মনে কথা বলার সময় ও সুযোগগুলোকে হরণ করেছে। আগে তোর মাকে কত দীর্ঘ অদর্শনের ফাঁকফোকরে পথে-ঘাটে, চিঠিতে সত্যি-মিথ্যের জাল বুনতাম, আর এখন...’

আমার দাদুকে মনে রাখার মতো বয়সে কখনও মুখোমুখি দেখিনি। কিন্তু বাবাকে লেখা তাঁর সেই চিঠি দেখেছি, যেখানে ছোট্ট আমাকে নিয়ে কয়েক লাইন লেখাছিল। সেই যাপনের বড় পুরস্কার, স্পর্শ অর্জন, যার কলম বদলালেও, রিফিল বদলালেও হাতের লেখার স্পর্শরা একটুও বদলায়নি... বদলায় না। অথচ আমার চারপাশ আমাকে নিয়ে কত্ত বদলেছে! তোমার সঙ্গে মনে মনে কথা বলায় তোমার উত্তরদেরও ইচ্ছেখুশি ভেবে নেওয়া আর যাচ্ছে না। তাই ভিড় বাসেও তোমার থেকে বিদায় নেবার পরেও তোমার কণ্ঠের অনুযোগ, হাসিতে মনটাকে ফোনে তুলে রাখি। তুমি সত্যি-মিথ্যে যাই বোঝাও, আমি সত্যি-মিথ্যে যাই বোঝাই অবিশ্বাসের আর কোনো উপায় দেখতে পাই না। দেখতে পাই সুমিতেশ দা’র সেই কবিতাটিকে,

আজ এমন একটা মিথ্যের শহরে ঢুকে পড়ছি

যেখানে গাছপালা, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট

মিল্কবুথ, পেট্রলপাম্প, রেস্তোরাঁ... জাগতিক সমস্ত কিছুই মিথ্যে :

তো এমন একটা মিথ্যের শহরে

আমার মতো এক মিথ্যে বিকেলের সাথে

তোমার মতো এক মিথ্যে সন্ধ্যার দেখা হলে

আমরা যে সেইসব মিথ্যে কথাই বলব

        এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।