গল্প

রেলইয়ার্ডে হানিমুন

Looks like you've blocked notifications!

সুমন যে টাকাসুদ্ধ সাইডব্যাগটা রেলের টয়লেটে টাঙিয়ে চলে এসেছে, তা মনে পড়ল যেই না রিকশাটা বিচের দিকে মুখ ঘুরিয়েছে। এর চেয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া ভালো ছিল। এমন বিপদেও পড়ে মানুষ? সে নতুন বউকে নিয়ে হানিমুনে এসেছে, কিন্তু এ মুহূর্তে তার সঙ্গে শ পাঁচেক টাকা। এবং তার এটিএম কার্ড নেই।

সে কি পিউকে কথাটা বলবে? যদি রেগে যায় ও? ওদের সম্বন্ধ করে বিয়ে। প্রথম রাতে যখন চেনাশোনার পালা চলছে, তখনই সে জানিয়েছিল স্বামী কেয়ারিং না হলে গোটা জীবন বরবাদ। সে কথা শোনার পর দু সপ্তাহও পেরোয়নি, তার মধ্যেই এই চূড়ান্ত কেলো? হে ভগবান। মনে মনে সে জগন্নাথদেবের মুখটা মনে করে তাঁকে এসএমএস পাঠায়। সেখানে সে লেখে, খুব বিপদ। রক্ষা কোরো জগতের নাথ।

ইয়ে একটা ব্যাপার হয়েছে। সুমন অবাক। সে তো কথাটা বলছে না। তবে তার শরীরের ভেতর থেকে কথাটা কে বলল? তবে কি বাবা জগন্নাথদেব? তিনি কি ফ্রন্টে নামলেন তবে? কে জানে! পিউ তার অপরূপ ভ্রূ ভঙ্গি করে তাকায় তার দিকে। ভোরের সাগরের বাতাস তাকে এলোমেলো করে দিতে চাইছে। সুমনের মনে হলো আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে গভীর কালো মেঘে। যদিও সমুদ্রের ভেতর সদ্য ওঠা সূর্যের ছবি ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে তোলপাড় হচ্ছে। এবং পিউয়ের মুখেও সূর্যের আলো পড়ে তাকে আরো জেল্লাদার করে তুলেছে। কিন্তু সুমনের চোখে কে যেন কালো কাচের চশমা পরিয়ে দিয়েছে।

পিউ তার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বলছ? সুমন মুখ বন্ধ করে রাখতে চাইল। কিন্তু সেই ভেতরে থাকা বদমাশটা দিল সব ফাঁস করে।

পিউ রিকশাওয়ালার পিঠে হাত দিয়ে থামতে বলতেই লোকটা ‘কনো হেল্বা’ বলে দাঁড়িয়ে পড়ে। সুমনের খুব ভয় করে। ঠিক ঠিকভাবে তাকে সে চেনেও না। ওর মেজাজ-মর্জি কেমন, তাও তার জানা নেই। যদি সে রাগ করে বাড়ি ফিরে যেতে চায়? যদি তাকে অপমান করে? ছিঃ। সে কেয়ারলেস আছে একটু। তাই বলে টাকা ফেলে আসবে রেলের টয়লেটে ? এর ক্ষমা হয়?

পিউ রিকশাটা ঘুরিয়ে দিয়েছে।

কোথায় চললে? এবার নিজের গলা বেজেছে।

স্টেশন।

বাড়ি ফিরে যাবে?

পিউ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, টাকাটা না খুঁজে আমি ছাড়ব না। যদি না পাই তখন দেখা যাবে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে সারাটা জীবন তোমার সঙ্গে থাকব কীভাবে! হানিমুন করতে বেরিয়েছ, টাকাটা ফেলে দিয়ে এলে? আইনস্টাইনও এমন কাণ্ড করেছিলেন বলে তো পড়িনি কোথাও!

পুরী স্টেশনে ঢুকতেই সাগরের তুলকালাম ঢেউয়ের মতো হাহাকার আছড়ে পড়ে বুকের বালিয়াড়িতে। খালি হওয়ার পর জগন্নাথ এক্সপ্রেস চলে গেছে ধোলাই মোছাই হতে। প্ল্যাটফর্মে একজন টিকেটবাবুকে পাওয়া গেল।

তিনি হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বললেন, পাঁচ মিনিট আগে ওটাকে সরানো হয়েছে।

তাহলে? সুমন পিউকে জিজ্ঞাসা করে।

এখান থেকে ইয়ার্ড কতদূর হবে?

তিন কিলোমিটারের মতো। তবে ওখানে ঢোকার পারমিশন পাওয়া যাবে না। এন্ট্রি স্ট্রিক্টলি রেসট্রিকটেড।

ওরা মালপত্রসমেত আবার রিকশায়। রিকশাওয়ালাকে সব বলার পর তার মনেও দয়া বা মায়া যা হোক, কিছু একটা হয়ে থাকবে। সে জায়গাটা চেনে এবং একটু পরেই তারা পৌঁছে যায়। সুমন ভাবল, পুরী কত কোটি মানুষ আজ অবধি এসেছে। কিন্তু তাদের মতো ধুলো পায়ে দেব দর্শন না করে ইয়ার্ড দর্শন বোধ হয় এর আগে কেউ করেনি। ফের নিজেকে ডাক ছেড়ে গালাগালি করতে ইচ্ছে করে। লাইনের ওপর কয়েকটা ট্রেন দাঁড়িয়ে। সব শাটারগুলো ফেলা। সুমন দূর থেকে গাড়িগুলোর নাম পড়তে চেষ্টা করল।

একটু পরেই রিকশাওলা একটা বন্ধ লোহার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। পিউ রিকশাতেই বসে রইল। সুমনকে বলল, দারোয়ান-টারোয়ান থাকলে কথা বলে ভেতরে ঢোকার পারমিশনটা নেওয়ার চেষ্টা করো। সুমনের ব্যক্তিত্ব বলে আর কিছু থাকছে না। নতুন বউয়ের সামনেই লোকে হিরো হওয়ার সুযোগ খোঁজে, কিন্তু তার জীবনে ঘটছে উল্টো কেস। কথা বলে জানা গেল, এই ইয়ার্ডের সর্বময় কর্তা একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি এখনো আফিসে আসেননি। সাড়ে ১০টা নাগাদ আসবেন। তার আগে কিছুই করা যাবে না। কিন্তু যদি তার আগে কেউ গাড়িতে উঠে পড়ে পরিষ্কার করতে? দারোয়ান বলল, উনি অর্ডার সই করলে তবেই কেউ গাড়িতে উঠতে পারবে। সুমন বলল, নয়া শাদি কিয়া হ্যায় ভাইয়া। পুরা রুপিয়ে উঁহা রহ গিয়া আউর ম্যায় মেরা বিবিকো সাথ ভিখারি বন গিয়া। জরা উও বাথরুমমে দেখনে তো দিজিয়ে।

হিন্দিভাষী দারোয়ানের তবু মন গলে না। সুমন ফের এসএমএস পাঠায় পুরীর সর্বময় কর্তাকে। প্রভু কিছু একটা করো। টাকাটা পেলে পুজো তো দেবই সারা জীবন তোমার মহিমা কীর্তন করব।

ওদের দেখে (কিংবা সুন্দরীকে চোখে পড়ে) দুজন ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এসে সব শোনে। তারপর মোবাইল বার করে কাকে যেন ফোন করে একটু আড়ালে গিয়ে। কথা শেষ করে সুমনকে একজন বলল, বাবু একটা অ্যাপ্লিকেশন দিন। তাতে টিকেট নম্বর, কোচ নম্বর সব লিখবেন। আসুন, আপনারা ভেতরে আসুন।

ওরা যখন শ্রী জগন্নাথ এক্সপ্রেসের পাশে এসে সত্যিই দাঁড়াল, তখন রেলগাড়ি ভোঁস ভোঁস করে ক্লান্তির ঘুম দিচ্ছে। দুজন লোক ছিল সঙ্গে তাদের একজনের হাতে চাবি। বি-১ কোচের তালাটা খুলে সে আগে উঠে পড়ে কামরায়। সুমনের বুকে তখন নানা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হচ্ছে। লম্বা কোচ জনপ্রাণীশূন্য। বদ্ধ বাতাসে থম মেরে নেমে যাওয়া যাত্রীদের গায়ের গন্ধের স্মৃতি। লোকটা টয়লেটের দরজাটা খুলেই ভেতরে ঢুকে পড়েছে। পেছন পেছন লাফিয়ে সুমন। এবং দরজার পেছনে ঝুলন্ত ব্যাগ। লোকটা বলল, দেখুন সব ঠিক আছে কি না। দু হাতে ছোটখাটো ব্যাগটা চেপে ধরতেই তার চটকা ভাঙে এবং সুমনকে বলে, তুমি আচ্ছা আহাম্মক তো। নতুন বউকে নিয়ে বেরিয়ে আমাকে ফেলে গেলে এখানে?

বুকটা ধকধক করে। ভেতরে খচমচ করে টাকার প্যাকেট বলে এই কে রে?

বাইরের পৃথিবী আবার সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল। পিউ জোর করে পাঁচশ টাকা দিল ইয়ার্ডের লোকেদের। বলল, মিষ্টি খাবেন। বাইরে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালা। সে জিজ্ঞাসা করল, টঙ্কা মিলিল কী? সুমন আবার বসেছে পিউয়ের পাশে। হারানো টাকা ফেরত এসে জীবন আবার ছন্দময়। পিউ বলল, তোমার আজকে মোটা ফাইন হবে। এমন অমার্জনীয় ক্যালাসনেসের জন্য। সুমন হেসে বলল, টাকার পুরো ব্যাগটাই ধরে দিচ্ছি ফাইন হিসেবে। পিউ চোখ মেরে বলল, টাকা ফাকা নয়, অন্য কিছু ভাবছি। সুমন খুব স্মার্টনেস দেখিয়ে বলল, যা বলবে তাতেই রাজি আমি। তবে হোটেলে ঢোকার আগে চলো মন্দিরটা ঘুরে নিই। একটা কথা রাখার ব্যাপার আছে।

পিউ বলল, সবাইকে আমি কিন্তু বলব। আমাদের হানিমুন হয়েছে পুরীতে নয়, পুরীর রেলইয়ার্ডে।

তা আর বলতে! সুমন হেসে বলল।