মধ্যবিত্ত জীবনের অনন্য কথাকার রমাপদ চৌধুরী

Looks like you've blocked notifications!

একটা কথা প্রচলিত ছিল তাঁর সম্পর্কে, তিনি ‘না লিখেই লেখক’! আসলে খুব কম লিখতেন বলেই হয়তো এমনটা বলা হতো। লেখালেখির ব্যাপারে ছিলেন তিনি ভীষণ রকম খুঁতখুঁতে। সারা জীবনে যা লিখেছেন, তাতেই পেয়েছেন পাঠক আনুকূল্য। নিজের লেখার ব্যাপারে তাঁর খুঁতখুঁতে থাকার অন্যতম প্রমাণ মেলে, যখন তিনি রীতিমতো ঘোষণা করেই লেখা থামিয়ে দিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগেই। মানুষটির নাম রমাপদ চৌধুরী।

নিজেকে সরিয়ে রাখায়, আড়ালে রাখাতেই ছিল তাঁর আনন্দ। শুধু লিখেছেন আর সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা দপ্তরে। সভা-সমিতিতে যাননি বললেই চলে। তাঁর মুখ ক্বচিৎ খুলেছে মিডিয়ায়। প্রায় দেড়শ ছোটগল্প আর পঞ্চাশের ওপর উপন্যাসের একটি সাহিত্যসমগ্র গড়ে তুলে লেখা থেকে একরকম অবসর নিয়েছিলেন তিনি। মধ্যবিত্ত জীবনের ‘উদয়াস্তু’-এর গল্প যাঁর তিন কি চার নম্বর ছোটগল্প তিনি পরিণত বয়সে, লেখক হিসেবে যখন প্রতিষ্ঠিত তখনো ‘ঋষি, দস্যু ও এক কিশোর বালক’ নামের এক আত্মলেখনকথায় লিখেছেন, “আজ এতকাল বাদে পিছন ফিরে তাকালেই একটি গল্প আমাকে বিস্মিত করে। সে গল্পের নাম ‘উদয়াস্তু’,... সতেরো আঠারো বছর বয়সে লেখা। সেই গল্পহীন জীবনের গল্প, সেই রিক্তপ্রসাধন সহজ সরল ভাষা নিয়েই তো আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম। সেখানেই আবার পৌঁছতে চাইছি এত আঁকাবাঁকা পথ পার হয়ে এসে।”

প্রসঙ্গক্রমে ওপার বাংলার এ প্রজন্মের পাঠক-প্রিয় কথাসাহিত্যিক বিনোদ ঘোষালের একটি লেখা থেকে খানিকটা ধার দিচ্ছি : “ভাল লেখার একটা মোহ আছে! এই মোহের বশেই, অনেক সময়ে অনেক লেখক ভুলে যান, জীবনযাপনের যেমন একটা আয়ু আছে, সৃষ্টিশীলতারও একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বাঁধা রয়েছে! আর ভুলে গিয়ে, মোহাচ্ছন্ন হয়ে লিখে যেতে থাকেন! আর সেই লেখাগুলো তাঁরই একটা কদর্য রূপ হয়ে দাঁড়ায়! বিদ্রুপ করে তাঁকেই!

রমাপদ চৌধুরী জানতেন, যেমনভাবে শুরু করার একটা সময় থাকে, থামারও একটা সময় থাকে! একজন লেখকের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর যে, তিনি শেষ হয়ে গিয়েছেন! তাঁর আর নতুন কিছু দেওয়ার নেই! আর সেটা মানতে না পেরেই অপাঠ্য-কুপাঠ্য লিখে চলেন! কিন্তু এই বাস্তবটা মেনে নিতে পেরেছিলেন রমাপদ চৌধুরী!”

ওই লেখাতেই ব্যক্তি রমাপদ চৌধুরীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের খানিকটা তথ্য পাওয়া যায় : “(রমাপদ চৌধুরী) অসাধারণ সংযমী এক মানুষ! পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ! আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দয়ামায়াহীন, কোনও রসিকতা বোধ নেই! শুনেছি, তাঁর কাছে যাঁরা গল্প জমা দিতে যেতেন, অত্যন্ত নিরসভাবে বলতেন, “ওইখানে জমা দিয়ে যান!” একটার বেশি দুটো কথা নয়! খেজুরে গল্প করা তো দূরের কথা, লেখকরা তাঁর কাছে ঘেঁষতেও ভয় পেতেন। কিন্তু কোনও তরুণ লেখক ভাল লিখেছেন, অথচ তাঁর দৃষ্টি এড়িয়েছে, তিনি পড়েননি বা ছাপেননি, এমনও হয়নি। আসলে, নিজের বাইরে একটা কঠিন আবরণ দিয়ে রাখতেন যাতে তাঁর ভিতরের শক্ত জীবনদর্শন কেউ ভাঙতে না পারে, উঁকি মারতে না পারে তাঁর অন্দরে!”

আসা যাক, রমাপদের বেড়ে উঠার প্রসঙ্গে। ১৯২২ সালের ২৮ ডিসেম্বরে মেদিনীপুরের খড়্গপুরে তাঁর জন্ম। কৈশোর কেটেছে তাঁর ওখানেই। তবে বাবার চাকরিসূত্রে স্কুলজীবনেই ঘুরে বেড়াতে হয়েছে প্রায় ‘পুরো ভারত’।  সেই অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে বন্ধুদের তাগিদে প্রথম লেখাটি লিখে ফেলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তটি ঘটেছিল ওয়াইএমসিএর পাবলিক রেস্তোরাঁয়। চার পাতার ছোট সে গল্পের নাম ‘ট্র্যাজেডি’। তারপরে বনপলাশীর পদাবলী, লালবাঈ, দরবারী, লাটুয়া ওঝার কাহিনী কিংবা দ্বীপের নাম টিয়ারং-এর মতো অনন্যসাধারণ সব সৃষ্টি। লেখায় বৈচিত্র্য সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে কলকাতার গল্পই লিখেছেন তিনি, বলেছেন মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প। আর তাই ১৯৭০-এর দশকে নতুন রাজনৈতিক দর্শনের মুখোমুখি বাঙালি সমাজজীবন নিয়ে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রের আখ্যানকার হয়ে ওঠেন রমাপদ। যেমন : মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ কিংবা ‘একদিন অচানক’।

রমাপদের লেখালেখির শুরু অল্প বয়স থেকেই। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি এমএ করেন ইংরেজি সাহিত্যে। এরপরে যুক্ত হন আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে। ছিলেন সেই পত্রিকার রবিবাসরীয়র বিভাগের সম্পাদক। ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রহার উপন্যাসের মাধ্যমে রমাপদর সাহিত্য প্রতিভা সকলের নজরে আসে। ১৯৬০ সালে তাঁর আরেক সাহিত্যকর্ম ‘বনপলাশীর পদাবলী’ পাঠকমহলে তুমুল প্রশংসিত হয়। ১৯৬৯ সালে ‘এখনই’, ‘খারিজ’ও বহুল প্রশংসা লাভ করে। টেস্টটিউব বেবির জনক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনী অবলম্বনে ১৯৮২ সালে লিখেন ‘অভিমন্যু’। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রকার তপন সিনহা এই কাহিনী নিয়ে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করেন ‘এক ডক্টর কি মওত’ (১৯৯২) নামে সিনেমা। এ কাহিনী সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি এবং তাঁর মর্মান্তিক পরিণতিকে তুলে আনে সকলের সামনে। এ ছাড়া  তাঁর আরো কিছু উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩), এখনই (১৯৭০), পিকনিক (১৯৭২), বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), যে যেখানে দাঁড়িয়ে (১৯৭৪০)-এর মতো আলোচিত ছবি।

রমাপদ চৌধুরীর শেষ লেখা ‘হারানো কথা’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। সাহিত্যকৃতির জন্য পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তাঁর ‘বাড়ি বদলে যায়’ উপন্যাসের জন্য। আকাদেমি পুরস্কার ছাড়াও তিনি পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৭১, এখনই উপন্যাসের জন্য), আনন্দ পুরস্কার (১৯৬৩), এবং ২০১১ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মারক আন্তর্জাতিক পুরস্কার চালু করলে প্রথম বছর ‘বনপলাশী পদাবলী’ উপন্যাসের জন্য রমাপদ তাঁকে ওই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

পঁচিশ বছর বয়স থেকেই সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও শারদীয় আনন্দবাজারের গুরুত্বপূর্ণ লেখক হয়ে ওঠেন রমাপদ চৌধুরী। চল্লিশের দশকটি ছিল সাহিত্যিক রমাপদের উন্মেষকাল। এ ছাড়া ‘ইদানীং’ এবং পরে ‘রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা’ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন ভয়াবহতা, দাঙ্গা, যুদ্ধের পর মানুষের বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়া, দেশভাগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মন্বন্তর— এসবের অমানবিক দুঃসহ অভিজ্ঞতালব্ধ ছিল তাঁর হৃদয়। তিনি দেখেছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির উচ্ছ্বাস, অসারতা, জনতার রোষ, গণ-আন্দোলন, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, বামপন্থী রাজনীতির উত্থান, মধ্যবিত্তের বিকাশ। কলকাতার সমাজে দেখা দেয় মধ্যবিত্তের মানসিকতার প্রভাব—দোলাচল, অনিশ্চয়তা, হতাশা, প্রতারণা ইত্যাদি। এ সবকিছু গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্যের ভাষা ও বিষয়বস্তু তৈরি করেছিল নিশ্চয়ই। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসে এসব এসেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি, কখনো প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তাঁর লেখা গল্পে একটি যুগযন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে। সে কারণে তিনি বিভিন্নভাবে সমাজের এসব কপটতায় আঘাত করেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন সেভাবেই।

আগেই বলেছি, গল্প দিয়েই লেখক রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্যযাত্রা শুরু। পরবর্তী সময়ে সার্থক উপন্যাস রচনা করেন একাধিক। উপন্যাস ও গল্পের বিষয়বস্তুও আলাদা। খুব সচেতনভাবেই এর প্রকরণ করেছেন তিনি। ঔপন্যাসিকের কাছে গল্পকারের দৃষ্টিভঙ্গির কৃতিত্ব কোথায়, তাও নির্ণয় করেছেন। একটি মহাযুদ্ধের দৃশ্যকল্প সামনে এনে বুঝিয়ে দেন সেই কৃতিত্ব। যুদ্ধের বিশাল আয়োজনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা ঔপন্যাসিকের কাজ। এখানে গল্পকারের কৃতিত্ব কোথায়? রমাপদ চৌধুরী তাঁর গল্পসমগ্র-এর ভূমিকায় লিখেছেন, “হঠাৎ তিনি ছোটগল্প লেখককে দেখতে পাবেন বনের ধারে, একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে। এ কোন উন্নাসিক লেখক? মনে মনে ভাবলেন ঔপন্যাসিক। কোনো মিনারের চূড়ায় উঠল না দেখল না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিল না, এ কেমন ধারার সাহিত্যিক! হয়তো এমন কথা বলবেনও ছোটগল্প লেখককে। আর তখন, অত্যন্ত দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখে চেয়ে তাকাবেন ছোটগল্পের লেখক, বলবেন হয়তো, না বন্ধু! এসব কিছুই আমি দেখিনি। কিছুই আমার দেখার নেই। শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। বনের ওপারে কোনো গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করবেন তিনি। সেখানে একটি নারীর শঙ্কাকাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্ন তন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে, চোখের কোণে যার হতাশার বিন্দু ফুটে উঠেছে— কে যেন ফেরেনি, কে একজন ফেরেনি। ছোটগল্পের লেখক সেই ব্যথাবিন্দুর, চোখের টলমলা অশ্রুর ভেতর সমগ্র যুদ্ধের ছবি দেখতে পাবেন, বলবেন হয়তো, বন্ধু হে! ওই অশ্রুবিন্দুর মধ্যেই আমার অনন্ত সিন্ধু।”

তাঁর লেখা ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি বাংলা ছোটগল্পের এক অমোঘ মাইলফলক হয়ে আছে আজও। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কীভাবে একটি অঞ্চলের সর্বস্ব শুষে নেয়, মানুষগুলোকে মেধা-মননে পঙ্গু করে দেয়, তার এক নির্মম আখ্যান এই গল্পটি। এটি যেন ব্রিটিশদের কাছে অবিভক্ত ভারতবাসীর নৈতিক স্খলনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। গল্পের পটভূমি মাহাতো গ্রামের হতদরিদ্র অথচ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বাবলম্বী, পরিশ্রমী বাসিন্দারা কীভাবে আমেরিকান সৈন্যদের ছুড়ে দেওয়া পয়সায় একে একে ভিখারিতে পরিণত হয়ে পড়ে তা পড়ে শিউরে উঠতে হয়। এমনকি একমাত্র প্রতিবাদীকণ্ঠ মাহাতো বুড়োকেও শেষে দেখা যায় সাদা চামড়ার সৈন্যদের কাছে হাত পেতে ‘সাব বকশিস-বকশিস’ বলে চিৎকার করতে। গল্পটির শেষ লাইনগুলো মনে রাখার মতো, “...আমেরিকান সৈন্যদের সেই ট্রেনটা অন্যদিনের মতো এবারে আর আন্ডাহল্টে এসে থামল না। প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলোর মতোই আন্ডাহল্টকে উপেক্ষা করে হুস করে চলে গেল। আমরা জানতাম ট্রেন আর থামবে না। ট্রেনটা চলে গেল। কিন্তু মাহাতো গাঁয়ের সবাই ভিখিরি হয়ে গেল। ক্ষেতিতে চাষ করা মানুষগুলো সব-সব ভিখিরি হয়ে গেল।”

এ প্রজন্মের তরুণ কবি শ্রীজাতর ‘বাড়ি’ নামে একটি এলিজি-কবিতা দিয়ে বরং শেষ করা যাক লেখাটি :

এমন গম্ভীর লোক, সই নিতে সাহস করিনি।

দেখেছি ভাস্কর্য ভেবে, নতমুখ, দূরের টেবিলে...

কিছু মগ্ন কাটাকুটি, কিছু বা হয়তো উদাসীনই

ধুতি-পাঞ্জাবির রোদ উপচে ওঠে সোজা হাঁটা দিলে।

এমন গম্ভীর লোক, কী করে যে লেখেন ওরকম!

আমরা, পাঠকগুচ্ছ, শব্দে করি জীবন আদায়—

উপন্যাস শেষ হয়নি। শ্বাস ছেড়ে জিরোচ্ছে কলম।

পাতা মুড়ে রাখি আমরা, সেই ফাঁকে বাড়ি বদলে যায়...