ভিএস নাইপল : সাহিত্যাকাশে এক তারার প্রস্থান

Looks like you've blocked notifications!

আজ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের আকাশে অন্যতম উজ্জ্বল তারাটি—সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক স্যার ভিএস (বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ) নাইপল। ৮৫ বছর বয়সে লন্ডনে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ৩০টির বেশি বই লিখেছেন। বছরজুড়ে আলোচনায় থেকেছেন কখনো কর্মে, কখনো বা তির্যক বক্তব্যে।

‘এমন কিছু করো, যেন লোকে তোমাকে নিয়ে লেখে; অথবা নিজেই নিজেকে নিয়ে লেখ!’ নাইপল দুটোই করেছেন। সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে একইসঙ্গে প্রশংসিত এবং সমালোচিত লেখক ছিলেন তিনি। এই কারণে ২০০১ সালে নাইপলের সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ বিশ্ব মিডিয়ায় উঠে আসে এভাবে--V.S. Naipaul, a master of prose and controversial interpreter of the developing world, won the centenary Nobel Prize for literature. (লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, ১২ অক্টোবর ২০০১)।

নাইপল প্রশংসিত তাঁর অসাধারণ সব সাহিত্য সৃষ্টির জন্য। পাঠকমাত্রই তাঁর সরল দ্যুতিময় গদ্যের দ্বারা চমৎকৃত হন। সাহিত্য-সমালোচক ইভলিন মন্তব্য করেছেন এই বলে, ‘নাইপলের গদ্য তাঁর সমসাময়িক ব্রিটিশ লেখকদের লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।’ সেন্ট লুসিয়ার কবি, আরেক নোবেলজয়ী ডেরেক ওয়ালকট ‘neo-colonial apologist’ বলে নাইপলের সমালোচনা করলেও তাঁর গদ্যের উৎকর্ষ স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, ‘Our finest writer of the English sentence’. ভাষার সঙ্গে সঙ্গে নাইপলের সাহিত্য-জাদুটা মিশে আছে তাঁর আখ্যান-কৌশলে ও আঙ্গিকে। গল্প বলার মিহিস্বরে। কোথাও কোনো উচ্ছ্বাস নেই গদ্যে, অথচ একটা অব্যক্ত উত্তেজনা পাঠককে আক্রান্ত করে রাখে শেষ পর্যন্ত। ভাষা ও বর্ণনাকৌশলের মিথস্ক্রিয়ায় এই রসায়নটা তৈরি হয়। উপহাস, তিরস্কার, রুক্ষতা ও স্বচ্ছতা তাঁর গদ্যের প্রধান অস্ত্র। তিনি দৃশ্যত বাস্তবতার আড়ালের বাস্তবতা তুলে ধরেন নির্দয়ভাবে। এই কারণে ইতিহাসের বিকল্প বক্তা হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়।

নাইপলের সাহিত্যে মানুষ এক ধরনের হতাশাবাদের ভেতর দিয়ে গন্তব্যপথে যাত্রা করে। ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-উত্তরকালে মানুষের জীবন মোটেও সুখকর ছিল না। নাইপল নিজেই ‘কলোনিয়াল প্রডাক্ট’। তাঁর দাদা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারত থেকে শ্রমিক হিসেবে রপ্তানি হয়ে আরেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ত্রিনিদাদে চলে আসেন। নাইপলের জন্ম সেখানেই। তিনি মিগুয়েল স্ট্রিটে হিন্দু সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠলেও মিশেছেন, পড়াশোনা করেছেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ভেতরে। এরপর অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে থেকে যান। নাইপল তাঁর নিজের এই ‘Many-Sided Background’-এর কারণে উপনিবেশের প্রভাব ও মানুষের স্থানচ্যুত হওয়ার বিষয়টিকে ভালোমতোই বোঝেন। এই বোঝাপড়া তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যচেতনাকে ভিন্নভাবে দাঁড় করিয়েছে। তিনি প্রচলিত দৃষ্টির বাইরে থেকে মানুষকে দেখতে শিখেছেন। এই বিকল্প দৃষ্টির কারণেই নাইপল আজ ব্যক্তি-বীক্ষণে অনন্য, ইতিহাস অনুসন্ধানে অপরিহার্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।

কথাসাহিত্যে নাইপলের এই মুনশিয়ানা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন বিশ্বের অনেক শক্তিশালী লেখক ও সাহিত্য-সমালোচক। লেখকজীবনের শুরুর দিকে নিজের ওপর নাইপলের প্রভাব স্বীকার করে ভারতের প্রখ্যাত কথাশিল্পী অমিতাভ ঘোষ ‘Naipaul and the Nobel’ শীর্ষক গদ্যে লিখেছেন, ‘It was Naipaul who first made it possible for me to think of myself as a writer, working in English...I read him with that intimate, appalled attention which one reserves for one’s most skillful interlocutors.’

অন্যদিকে নাইপল বিতর্কিত তাঁর ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য। অনেক অপ্রীতিকর-স্পর্শকাতর সত্য তিনি অকপটে উচ্চারণ করেন। হুটহাট করে ‘আপত্তিকর’ কথা বলাতেও পটু তিনি। ভারত এবং মুসলিমবিশ্ব সম্পর্কে নাইপলের যে পর্যবেক্ষণ, তা যেমন সত্য, তেমনই ভ্রান্তও। ব্যক্তিজীবনে অসংখ্য নারীঘটিত বিষয় ছাড়াও নাইপল তাঁর অগ্রজ কিংবা সমসাময়িক অনেক সাহিত্যিককে নিয়ে ‘উলটাপালটা’ কথাবার্তা বলেও প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন।

তিনবার নিজের পূর্বপুরুষের দেশ ভারত-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন তিনটি বই : অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস (১৯৬৪), ইন্ডিয়া : অ্যান উনডেড সিভিলাইজেশন (১৯৭৭) এবং ইন্ডিয়া : আ মিলিয়ন মিউটিনিজ নাউ (১৯৯০)। বইগুলোর শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভারতীয়দের জন্য খুব সুখকর কিছু লেখেননি তিনি। তিনি লিখেছেন : ‘ভারতে লোকে সর্বত্র মলত্যাগ করে। রেললাইনের ধারে, মাঠের ধারে, রাস্তার ধারে, নদীর ধারে, সমুদ্রতীরে কোথাও হাগতে বাকি রাখে না।’

ভারত বহুভাষী মানুষের দেশ। সব ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে বিশদ না জেনেই মন্তব্য করেছেন : ‘ইংরেজি ছাড়া অন্য ভারতীয় ভাষায় এখন কোনো লেখালেখি হচ্ছে না।’ ভারতীয় বাঙালিদের সম্পর্কেও তাঁর মন্তব্য যথেষ্ট নেতিবাচক। এক জায়গায় লিখেছেন : ‘লোকটা খারাপ। শুধু বাঙালি আর অপরাধীদের সঙ্গে মেশে।’

মুসলিমবিশ্বে সমালোচিত হয়েছেন অ্যামাং দ্য বিলিভার’স : অ্যান ইসলামিক জার্নি (১৯৮১) এবং বিয়ন্ড বিলিফ : ইসলামিক এক্সকারশনস অ্যামাং দ্য কনভার্টেড পিপলস (১৯৯৮) গ্রন্থ দুটির কারণে। ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন, ইসলাম প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিকতার চেয়েও খারাপ। ইসলাম সম্পর্কে নাইপল আরো বলেন, ‘It (Islam) has had a calamitous effect on converted peoples. To be converted you have to destroy your past, destroy your history. You have to stamp on it, you have to say Ômy ancestral culture does not exist, it doesn’t matter.’

আফ্রিকার উগান্ডা সফরকালে তিনি বলেন, ‘আফ্রিকানদের খালি লাথি মারা দরকার। লাথির ভাষাটাই কেবল তারা বোঝে।’ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নাইপলকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আফ্রিকার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’ ত্রিনিদাদ সম্পর্কে বলেন, ত্রিনিদাদ হলো ‘unimportant, uncreative, cynical, a dot on the map.’

কেবল ভারত কিংবা মুসলিমবিশ্ব নয়, সামগ্রিকভাবে নাইপল গোটা বিশ্ব নিয়েই চরমভাবে হতাশ একজন মানুষ। তাঁর প্রমাণ আমরা পাই মার্কিন ভ্রমণলেখক ও কথাসাহিত্যিক পল থেরোক্সকে যখন তিনি বলেন, ‘The melancholy thing about the world is that it is full of stupid people; and the world is run for the benefit of the stupid and common.’

নাইপলকে নিয়ে এখানেই সমালোচনার শেষ নয়। তিনি অগ্রজ এবং সমসাময়িক অনেক লেখককে নিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা একজন লেখকের করা উচিত নয়। যেমন তিনি মার্কিন বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক হেনরি জেমস সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বাজে লেখক।’ আবার নোবেলজয়ী মার্কিন কথাশিল্পী হেমিংওয়ে সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘তিনি (হেমিংওয়ে) সবসময় একজন আমেরিকান হিসেবে নিজেকে জাহির করায় ব্যস্ত ছিলেন।’

১৯৮৬ সালে নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক ওলে সোয়িংকা সাহিত্যে নোবেল পেলে নাইপল বলেছিলেন, তিনি (ওলে সোয়িংকা) আসলেই কি কিছু লিখেছেন! এরপর নাইপল যা বলেছিলেন, তা আরো বাজে, ‘নোবেল কমিটি অনেক উচ্চতা থেকে মাঝেমধ্যে হিসু করে।’ ই এম ফর্স্টার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘Forster of course has his own purposes in India. He is a homosexual and he has his time in India... He just knew the court and a few middle-class Indians and a few garden boys whom he wished to seduce.’

২০০১ সালে এক সাক্ষাৎকারে নাইপলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি তাঁর তুল্য বিশ্বসাহিত্যে কোনো নারী সাহিত্যিক আছে বলে মনে করেন কি না। উত্তরে তিনি সরাসরি বলে দিয়েছিলেন, ‘না। নেই।’ এরপর তিনি জেন অস্টেন, ভার্জিনিয়া উলফের মতো প্রথিতযশা নারী সাহিত্যিকদের উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি একটি প্যারা পড়েই বলে দিতে পারি, লেখক নারী না পুরুষ। কারণ নারীরা ভীষণ আবেগী হন। বিশ্ব সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই সংকীর্ণ। নিশ্চিত করেই নারীরা তার গৃহের একক কর্তা নন, এই বিষয়টা তাদের লেখালেখিতে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে।’ নাইপলের এই মন্তব্যের কারণে বিশ্বে নারীবাদীরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। এমনিতেই নাইপলের ব্যক্তিজীবন থেকে সাহিত্যে নারীদের উপস্থাপনা নিয়ে নানা সময়ে নারীবাদীরা সমালোচনা করেছেন।

এভাবেই বিশ্বসাহিত্যে স্বকালে তর্কে-বিতর্কে এবং শ্রেষ্ঠত্বে টিকে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই লেখক। কিন্তু মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তিনি আজ বিশ্বসাহিত্যের পরম্পরায় অমরত্বের পথে চলে গেলেন। এখন আর তিনি তাঁর তির্যক বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় থাকবেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর সাহিত্যমানে উৎকৃষ্ট সৃষ্টিকর্মের ভেতর দিয়ে থেকে যাবেন আজকের এবং অনাগত পাঠকদের হৃদয়ে। ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস, ‘ইন এ ফ্রি স্টেট, ‘হাফ এ লাইফ’, ‘মিগুয়েল স্ট্রিট’, ‘দ্য মিসটিক মসিউর’-এর মতো অসাধারণ সব উপন্যাস টিকে থাকবে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে।

একনজরে নাইপল : বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, ভ্রমণলেখক এবং প্রাবন্ধিক ভিএস নাইপলের জন্ম ত্রিনিদাদের চাগুয়ানাস শহরে, ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট। শৈশব কেটেছে হিন্দু-সংস্কৃতির মধ্যে; পড়াশোনা করেছেন ব্রিটিশ পাবলিক স্কুলে। ১৯৫০ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ড। সেখানে অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যয়ন করেন। প্রবেশ করেন লেখালেখির জগতে। উপনিবেশ এবং নির্বাসন তাঁর সাহিত্যের প্রধান বিষয়। দীর্ঘ ৫০ বছরের সমৃদ্ধ সাহিত্যজীবনে ৩০টিরও অধিক উপন্যাস এবং অন্যান্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘এ হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস’ (১৯৬১) লিখে প্রথম আলোচনায় উঠে আসেন। উপন্যাসটি বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ শত উপন্যাসের তালিকায় স্থান পেয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের শতবছরের শীর্ষ-১০০ উপন্যাসের তালিকাতেও আছে। এ ছাড়া ‘দ্য মিমিক ম্যান’ (১৯৬৭), ‘ইন এ ফ্রি স্টেইট্ (১৯৭১), ‘এ বেন্ড ইন দ্য রিভার’ (১৯৭৯), ‘এ ওয়ে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৯৯৪), ‘হাফ এ লাইফ’ (২০০১), ‘ম্যাজিক সিডস্’(২০০৪) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘ইন এ ফ্রি স্টেইট্’ উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৭১ সালে ‘ম্যান বুকার’পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কার (২০০১) অর্জন করেন।

১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার নাইপলকে ‘নাইট’ উপাধি প্রদান করে। এ ছাড়া, তিনি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি এবং নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানিত ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে নাইপল প্যাট্রিশিয়া হেইলের সঙ্গে ৪১ বছর বিবাহিত ছিলেন। এই নারীর সঙ্গে বিবাহিত থাকা অবস্থায় নাইপল মার্গারেট মারি বলে বিবাহিতা আরেক অ্যাংলো-আর্জেন্টিনিয়ান নারীর সঙ্গে তাঁর পরকীয়ায় জড়ান। ক্যানসারে প্যাট্রিশিয়া হেইলের মৃত্যুর দুই মাস পর নাইপল পাকিস্তানি সাংবাদিক নাদিরা খানুম আলভিকে বিয়ে করেন।