হাতি খেদা বিদ্রোহ

যে কারণে দুর্গাপুরে হাজংদের বসতি

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : সংগৃহীত

গারো পাহাড় অঞ্চলটি ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে অবস্থিত। এ পাহাড়ের নিচে সমতলভূমিতে বাস করত হাজং আদিবাসীরা। ময়মনসিংহ জেলা গেজেটিয়ারের তথ্য থেকে জানা যায়, এই মঙ্গোলীয় জাতিটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুদূর অঞ্চল থেকে এসে ব্রহ্মদেশ হয়ে ভারতের আসাম অঞ্চলে অবস্থান নেয়। পরবর্তী সময়ে সুসং রাজ্যের গোড়াপত্তন হলে এরা আসামের কামরূপ জেলা থেকে জীবিকার সন্ধানে ময়মনসিংহের গারো পাহাড় অঞ্চলে এসে বসতি গড়ে। হাজংরা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কামাখ্যা এদের জাগ্রত দেবতা। এরা যেমন সৎ ও পরিশ্রমী, তেমনি দুর্ধর্ষ সাহসী।

অনেক বছর আগের কথা। কিংবদন্তি আছে, একদল সাধু গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হয় অতিদরিদ্র একদল লোক। সাধুদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন প্রবীণ সাধু। সবাই তাঁর কাছে গিয়ে জানায়, পাহাড় থেকে নেমে এসে একদল গারো আদিবাসী তাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এর প্রতিকারে সাধুদের কাছে তারা সাহায্য প্রার্থনা করে।

সাধুদের সঙ্গে ছিল এক ব্রাহ্মণ যুবক। নাম সোমনাথ পাঠক। তিনি তখনো সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেনি। প্রবীণ সাধু তাঁকে পাঠান ওই লোকদের সাহায্যের জন্য। সোমনাথ স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে গারোদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। অতঃপর তাদের পরাস্ত করে গারো পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ এবং সমতলভূমির বিরাট অঞ্চল নিয়ে সামন্তরাজ্য স্থাপন করেন। সোমনাথ এর নাম দেন সু-সংগ, অর্থাৎ ভালো সঙ্গ। পাশে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীটির নাম দেওয়া হয় সোমেশ্বরী। পরবর্তী সময়ে সোমনাথ পাঠকের উত্তরাধিকারীরা অনেক উপাধি বদলিয়ে সব শেষে সিংহ উপাধি গ্রহণ করেন।

গারো পাহাড়ের অরণ্যই ছিল সুসংরাজদের আয়ের মূল উৎস। প্রায় তিনশ বছর তারা ওই অঞ্চলে স্বাধীনভাবে বসবাস করে। অতঃপর উত্তরে প্রাগ জ্যোতিস্পুর (আসাম) ও দক্ষিণে ঈশা খাঁর সঙ্গে বিবাদ বেধে যায়। এই দুই দিক থেকে চাপ সৃষ্টির ফলে এই বংশের তৎকালীন রাজা রঘু কোনো উপায় না পেয়ে মানসিংহের মাধ্যমে বাদশা আকবরের শরণাপন্ন হন। বাদশাকে উপহার দেওয়ার জন্য তিনি সঙ্গে নেন ঐন্দ্রজালিক সুগন্ধি কাঠ আগর, যা ছিল গারো পাহাড়ের অতি মূল্যবান কাঠ। ওই সুগন্ধি কাঠ আকবরের হেরেমে যাওয়ার পর অন্য রকম ঘটনা ঘটে। আগরের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যায় সবাই। বাদশাহ আকবরও রাজা রঘুর ওপর খুশি হন। অতঃপর তাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় এক চুক্তি হয়। রাজা প্রতিবছর আগর কাঠ পাঠাবেন। তার বিনিময়ে বাদশাহ আকবর রাজা রঘুকে সব আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন। এ চুক্তির ফলে রাজা রঘুকে মানসিংহের পক্ষে, চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করতে হয়। এতে চাঁদ রায় ও কেদার রায় পরাজিত হলে ওখান থেকে রাজা রঘু একটি অষ্টধাতুর দুর্গা প্রতিমা সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি সেটি প্রতিষ্ঠিত করেন সুসং-এ। সেই থেকে সুসং-এর সঙ্গে দুর্গাপুর যোগ করে অঞ্চলটির নাম হয় সুসং-দুর্গাপুর। সুসং ছিল একটি পরগনা আর দুর্গাপুর জমিদারদের বাসস্থান এলাকার নাম।

একসময় সুসং রাজা বা জমিদাররা ছিল গারো পাহাড়ের বিপুল অরণ্য সম্পদের মালিক। এ থেকে তাদের প্রচুর আয় হতো। এ ছাড়া তাদের আরেকটি আয়ের পথ ছিল হাতির ব্যবসা। ওই সময়ে হাতির ছিল অভাবনীয় কদর। হাতি ছাড়া সামন্ত প্রথা ছিল অচল। এ ছাড়া সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের কাছে হাতিই ছিল ঐশ্বর্যের একমাত্র মাপকাঠি।

গারো পাহাড়ে দলে দলে হাতি স্বাধীনভাবে বিচরণ করত। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই বন্য হাতিদের ধরবার ব্যবস্থা করা হতো। প্রচলিত ভাষায় এর নাম ছিল হাতি-খেদা। ওই সময় শত শত লোককে অনেক দূর থেকে হাতির দলকে ঘেরাও করে, উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে এবং নানা রকম বিকট আওয়াজ তুলে তাদের তাড়া করে নিয়ে আসতে হতো।

হাতি ধরাতে পারদর্শী ছিল হাজং আদিবাসীরা। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের কথা। সুসংরাজ বংশের তৎকালীন রাজা কিশোর হাতি ধরার জন্য অনেক হাজং পরিবারকে দুর্গাপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে এনে বসতি গড়ে দেন। এই হাজংরাই তখন নিজেদের চাষবাস বন্ধ রেখে জীবন বিপন্ন করে রাজার বা জমিদারের হুকুমে হাতিখেদা পেতে বন্য হাতি ধরে দিত।

(চলবে)