যুদ্ধ ও শান্তি : তলস্তয়ের উপসংহার

Looks like you've blocked notifications!

[এই রচনাটি প্রথম দফা প্রকাশিত হইয়াছিল দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ‘শান্তি’ শীর্ষনামক একটি  বিশেষ (১২ এপ্রিল ২০০৪) সংখ্যায়। এখানে লেব তলস্তয়ের ‘হাজী মুরাদ’ কাহিনীর অল্পবিস্তর একটু উল্লেখ আছে। হাজী মুরাদ প্রসঙ্গে ইহার দুই মাসের মাথায় আমি মহাত্মা তলস্তয়ের ‘হাজী মুরাদ’ কাহিনী প্রসঙ্গে আরেকটা নিবন্ধও লিখিয়াছিলাম। কবুল করিতে হইবে, দুই নিবন্ধের মধ্যে একটু পুনরাবৃত্তি দোষ ঘটিয়াছে। বর্তমান প্রবন্ধের গদ্যরীতিও—বলা বাহুল্য—যেমন ছিল তেমনই রাখিয়া দিয়াছি। তবে স্থানে স্থানে পরিমার্জনার সুযোগটা গ্রহণ করাই বিধেয় মনে হওয়ায় তাহা করিতে কসুর করি নাই।—২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ]

‘শান্তি’ বিষয়ে কোন কাগজের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ সত্যই সুখের বিষয়। পত্রপত্রিকার সামান্য সংখ্যা সচরাচর—দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করা দরকার—যুদ্ধ, নৈরাজ্য আর অশান্তি নিয়েই ব্যাপ্ত। ‘শান্তি’ সকলেই চায়, অন্তত কথায় কথায়। কিন্তু কে জানে ‘শান্তি’ কোথায় পাওয়া যায়! এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়। সান্ত্বনার একমাত্র কথা সম্ভবত এই—শান্তিরও একটা চাহিদা আছে। অন্তত আজ পর্যন্ত এই চাহিদা ষোল আনা ফুরায় নাই। এই হক কথাটা ধরেই আমি এগুতে চাই।

এয়ুনানের বিখ্যাত মনীষী আফলাতুন তাঁর অতি বিখ্যাত ‘রাষ্ট্র’ (ওরফে ‘রিপাবলিক’) নামক কেতাবে জাহির করেছেন এই দুনিয়ায় মানুষের জগতে অশান্তির প্রধান কারণ ক্ষুধা নয়, বিলাসিতা। তাঁর বিচার মোতাবেক যে দেশে দশের নিত্যচাহিদা বা প্রয়োজন মেটানোর পর বাড়তি কোন ধনদৌলত জমা থাকে না সে দেশে যুদ্ধ—অন্তত যুদ্ধের কারণ—থাকে না। যখনই ধনদৌলতের প্রাচুর্য বা বিলাসদ্রব্যের চাহিদা দেখা দেয়—যে দ্রব্যাদি যা নিজ দেশে তৈরি করা সম্ভব নয়—তখনই আশপাশের দেশে—অর্থাৎ পরের জায়গা পরের জমিনে—চোখ যায়। যখন পরদেশি মজুর ধরে বা ডেকে আনতে হয় তখনই যুদ্ধের কারণ দেখা দেয়।

আর কে না জানে যুদ্ধ ও শান্তি একে অপরের বিপরীত ধর্ম? আপনি অবশ্য বলতে পারেন যুদ্ধ তো শান্তির দোসরই। এক অর্থে আপনার কথাটা ব্যর্থ নয়। একমাত্র যুদ্ধই কায়েম করতে পারে শান্তি। সওয়াল করা চলে, তো সে শান্তি স্থায়ী হয় না কেন? এখানেই জন্ম হয় আরেকটি সওয়ালের: ন্যায় কিংবা ইনসাফ কি বস্তু? যুদ্ধ যদি সত্যই শান্তির জননী হয়, তো পালা করে বলতে হয় যুদ্ধের জনকও শান্তিই। বাদ ও প্রতিবাদ, প্রতিবাদ ও বাদ ক্রমে গড়ায়, গড়াতে থাকে। এই চক্রাবর্তের একটা মীমাংসা চাই। এই মীমাংসার ওয়াস্তেই গ্রিক দার্শনিক আফলাতুন ন্যায়ের কথা তুলেছিলেন। অন্যায় আর শান্তি একে অপরের সতীন তারা এক ঘরে এক দেশে বাস করতে পারে না—এই তাঁর রায়।

হেকিম আফলাতুন নিজেও স্বীকার করেছিলেন বিলাসী চাহিদার দেশ কোনদিন আদিম সাম্যের জগতে ফেরত যাবে না। অতয়েব একমাত্র উপায় ন্যায়ের কথাটা পাড়া। শান্তির প্রধান পাণ্ডা ন্যায়। ন্যায় পদার্থটা নাই বলেই ‘অশান্তির রাজা’র শাসনে মানুস বসবাস করে। এক্ষণে প্রশ্ন দাঁড়ায়—ন্যায় কোথায় পাই। উত্তরে বলতে হয়—যেখানে দেখিবে ছাই। যেমন এই বাক্যেও ‘ন্যায়’ পাবেন: ‘আমি দেখতে বাবার ন্যায়’।

কথিত আছে মানুষই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। প্রাচীন ধর্মের বিধানেও মানুষের নামে এই দাবিটা জাহির করা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে ‘শ্রেষ্ঠ’ মানে কি? এর মানে ‘নিকৃষ্ট’ও করা চলে? ভারতবর্ষের পুরানা ঋষিরা বলেছিলেন, প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট কোনটাই নয়, সবচেয়ে বেশি ‘বিস্ময়কর’ জীব সে। মানুষ মাত্রই জানে সে মরবে। এই তার ‘জ্ঞান’। কিন্তু মানুষ মাত্রেই এমন ভাবে চলে—কাজ করে—যেন কোনদিন সে মরবে না। মানুষ পদার্থের এই ‘অজ্ঞান’ ভাবকেই খুব সম্ভব হিন্দুস্তানের বড় কবিরা—যেমন মহাভারতের মহামনীষীরা—‘মানুষ’ পদে বরণ করেছিলেন। সেই সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর জীব। আমার সন্দেহ হয়, মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ আর শান্তির সম্পর্ক বিষয়েও একই অনুমান করা চলবে।

মানুষ শান্তির কথা বলবে কিন্তু করবে যুদ্ধ। মানুষ ন্যায়ের কথা বলে, কিন্তু করে অন্যায়। শুদ্ধ মানুষজাতির কথা বললে হয়ত এই গোলকধাঁধার কুলকিনারা পাওয়া যাবে না। যদি বা আলাদা আলাদা মানুষের কথাও পাড়ি সমস্যার সুরাহা হবে না। কারণ যে মানুষ আজ শান্তির কথা বলছে সেই কাল আবার অশান্তি বাধাচ্ছে। যে অন্যায় করে সেও চিরদিন অন্যায় করে না। আমরা এখন ‘বিশেষ’ মানুষের কথা বলছি না। আমরা সামান্য মানুষ, তাহলে দাঁড়াই কোথা?

শান্তি কি পদার্থ তা কিন্তু আমরা এখনও বলিনি। বিশেষ বিশেষ মানুষের দল কি বলে আমরা তা পরে দেখব, কিন্তু সামান্য মানুষ বলে, যুদ্ধ মানেই অশান্তি। সুতরাং শান্তি মানে অযুদ্ধ বা যুদ্ধের অভাব। একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, শান্তির এই সংজ্ঞাটাও বা যুক্তিসই পদার্থ নয়। যুদ্ধ বাধার পূর্বক্ষণের কথাটা ধরা যাক। যাকে বলে সশস্ত্র শান্তি ওরফে (ইংরেজি ভাষায়) ‘আর্মড পিস’। যুদ্ধ বাধার পূর্বক্ষণে শান্তি আছে তবে সে শান্তি স্থায়ী নয়। স্থায়ী শান্তির স্বপ্ন ও ন্যায়বিচারে যোগাযোগ কোথায়? এই সওয়ালটা এক্ষণে বিবেচনা করা যায়।

রুশ মনীষী লেব তলস্তয় শুনেছি তাঁর গদ্য মহাকাব্য ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ বইটির অন্য একটা নামও রেখেছিলেন একবার। সে নাম বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ—‘সব ভাল তার শেষ ভাল যার’। ঐ বইয়ে মহাত্মা তলস্তয় যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল নিয়ে তদন্ত আর বিচার দুটাই অনেকদূর করেছিলেন। তলস্তয়ের যুক্তি মতে, যুদ্ধের পক্ষে কোন যুক্তিই নাই। তবু নাপোলেয়ঁর মতন বড় যোদ্ধারা কত যুক্তির মোড়কেই না যুদ্ধের অযুক্তিটা পেশ করেছিলেন। কোন প্রকার যুক্তির তোয়াক্কা না করেই যে কাজটা করা হয় তার পক্ষে যুক্তির সমর্থন যোগাড় করার চেষ্টাকেই তলস্তয় বলতেন, পরম বিস্ময়ের বস্তু। মনে হতে পারে আবারও সেই জ্ঞান ও অজ্ঞানের খেলা।

মানুষের এই যুদ্ধ বিলাসিতার সত্য ব্যাখ্যা তলস্তয়ও খুঁজে পাননি। তলস্তয় ভেবেছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ, তাঁর আপন ভাষায় চাষীসমাজই, সভ্য সমাজের চালিকাশক্তি। অতয়েব তাদের কায়দা-আকিদা ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যেই মানব জাতির বিকাশের নিয়ম। যুদ্ধবিগ্রহও তার অন্তর্গত নিয়মেই চলে। বড় বড় যোদ্ধা সেনাপতি, আর রাজা-মহারাজারাও ইতিহাসের নিয়ামক নন, ক্রীড়নক মাত্র।  ফলে নতুন নতুন প্রশ্ন জাগে: ইতিহাসের নিয়ামক কে বা কোন বস্তু?এই নিয়ামক শক্তির মুখপাত্রস্বরূপ যাঁরা ইতিহাসে প্রকাশিত তাঁরাই নিয়ামক। এটুকুই আমরা ধরে নিই। শেষ বয়সে লেখা ‘হাজী মুরাদ’ উপন্যাসে এই সত্য প্রচারের একটা চেষ্টা করেছিলেন তলস্তয়। এই উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন শেষ বয়সে—‘যুদ্ধ ও শান্তি’র মতো ঠিক ভরাযৌবনে নয়। বর্তমানে যে সকল যুদ্ধকে আমরা বলি ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ সেই সব নতুন যুদ্ধ ঘটা করে শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার ওলন্দাজ বসতির বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকারের যে যুদ্ধকে এ যুগের বইপত্রে ‘বুয়র যুদ্ধ’ বলা হয় শুদ্ধমাত্র তা মহরতের খবর পাওয়ার পরই তলস্তয় ‘হাজী মুরাদ’ লেখা শুরু করেন।

জানা গিয়াছে, ‘হাজী মুরাদ’ বইয়ের আরও দুটি খসড়া নাম রেখেছিলেন তলস্তয় ‘কাঁটা’ এবং ‘জেহাদ’। তলস্তয়ের মতে, চাষী-সমাজ জমির অধিকার লাভের জন্য যে যুদ্ধ করে তাকেই ‘জেহাদ’ বলে। রুশ সাম্রাজ্যের অধিকার ভুক্ত চেচনিয়ার চাষীরা লড়ছিল নিজেদের দেশের জমির ওপর নিজেদের অধিকার বজায় রাখতে। কাউকে কর-খাজনা না দিয়ে নিজ বাসভূমে বসবাস করতে এবং নিজেদের জমির ফলানো ফসল নিজেরাই ভোগদখল করতে। চেচনিয়ার কৃষক-সমাজ রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সারা উনিশ ঈসায়ী শতক জুড়ে লড়াই করেছে। তাদেরই তৎকালীন এক যোদ্ধা নেতার নাম হাজী মুরাদ। তলস্তয় এই ভদ্রলোকের জীবন ও আদর্শের আশ্চর্য দরদি বর্ণনা পেশ করেছেন। চেচনিয়ার যুদ্ধকে তলস্তয় ‘ধর্মযুদ্ধ’ বলে মহীয়ান করেননি, বলেছেন এ লড়াই ‘চাষীর লড়াই’। জেহাদের সাথে যুক্ত ধর্মযুদ্ধ নয়, কৃষক যুদ্ধ। তলস্তয়ের এই অন্তর্দৃষ্টি কম সমীহ জাগানোর মত নয়।

তলস্তয় রচিত হাজী মুরাদের চোখে ইসলাম এই রকম : ‘... প্রথমে ছিলেন মোল্লা মোহাম্মদ। তাঁকে আমি চোখে দেখি নাই। তিনি পাক মানুষ। তিনি বলতেন ‘হে আমার জাতি, আমরা মুসলমানও নই, খ্রিষ্টানও নই, আমরা মূর্তিপূজাও করি না। ইসলামের সত্য আইন এই রকম: কোন মুসলমান জাতির ওপর অমুসলমানের রাজত্ব চলে না। কোন মুসলমান অন্য কোন মানুষের গোলাম হতে পারবে না। মুসলমান কাউকে কর দেয় না, এমনকি অন্য কোন মুসলমানকেও সে কর দেয় না।’ তলস্তয়ের এই বড় চোখেও হাজী মুরাদ একসময় ‘মৌলবাদী’ বলে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু তলস্তয় জানতেন, মুরাদের লড়াই চেচেন চাষীদের মুক্তির লড়াই। আমরা একপ্রকার আবিষ্কার করি শেষ পর্যন্ত মুরাদকে রুশ মনীষীও ভালবেসেছিলেন।

হাজী মুরাদের ট্রাজেডি আর সাধারণ কৃষকের ট্রাজেডি আদতে এক জিনিশই—এই প্রতিজ্ঞাটা প্রমাণ করার জন্য তলস্তয় দেখান কৃষক মুক্তি সংগ্রামের সার্বিক ও প্রধান সমস্যাটা কোন জায়গায়। হাজী মুরাদের পথ দুদিক থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। সে যদি চেচেনদের রাজা শামিলের দলে যোগ দেয়, তো তার ইজ্জত-গৌরব হবে কিন্তু চেচেন কৃষক, তার আপন জাতির মানুষ তো যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাবে। জালেমি শাসনের অবসান হবে না। অপরপক্ষে সে যদি শাদা জার অর্থাৎ রুশ সম্রাটের কাছে আত্মসমর্পণ করে তো তার টাকাপয়সা হবে, নামধাম চারদিকে ছড়াবে, কিন্তু চেচেন চাষীর জমি রুশ সৈন্যসামন্ত, উপনিবেশবাদের পায়ের তলায় আরো দেবে যাবে। জার এক নম্বর নিকোলাস যে কিসিমের শয়তান, চেচেনদের নেতা শামিলও সেই গোছেরই শয়তান আর সেই কারণেই হাজী মুরাদ ঐ মুহূর্তে শামিলের বাহুডোর থেকে জারের আলিঙ্গনে ধরা দিতে ঘোড়া ছোটান। পথে যেতে যেতে তিনি দেখেন একটি ছুটকা রুশ সৈন্য জারের সেনাবাহিনী ছেড়ে পালাচ্ছে। সে সৈন্যটিও রেহাই পায় নাই। রুশ সেনাবাহিনীর বুলেটে নয় চেচেন যোদ্ধাদের গুলিতেই সে মারা পড়ে। বিশ্বাসহন্তার কলঙ্ক তাকে ছোঁবার সুযোগ পায় না।

‘হাজী মুরাদ’ উপন্যাসে তলস্তয় দেখাচ্ছেন, চেচেনিয়ার চাষী আর রুশিয়ার চাষী দুজনারই দুশমন এক ও অভিন্ন একজনই—রুশ স্বৈরতন্ত্র। এই স্বৈরতন্ত্র চেচেন চাষীর যব, ভুট্টাদি ফসল কাটতে বাধা দেয়। একই স্বৈরতন্ত্র রুশ চাষীর হাতে তলোয়ার, আর কাঁধে-পিঠে বন্দুক দিয়ে ককেসাস জয় করতে পাঠায়। জারের বিরুদ্ধে হাজী মুরাদের শেষ যুদ্ধ—তলস্তয় দেখাচ্ছেন—রুশের বিরুদ্ধে চেচেনের যুদ্ধ নয়। হাজী মুরাদের দুশমনরাও দেখা গেল জাতে চেচেনই—রুশ সরকারের হয়ে সেই রাজাকার চেচেনরাই তাঁর প্রাণ নিয়েছে। তলস্তয়ের মতে রুশ জারের বিরুদ্ধে চেচেন মুরাদের যুদ্ধ, রুশের বিরুদ্ধে অতি রুশের, চেচেনের বিরুদ্ধে অতি চেচেনের যুদ্ধ—অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায় ও বিচারের যুদ্ধ। গোলামের শান্তির চেয়ে এই ধরনের যুদ্ধ ভালো নয়—বেহতর—কি? মনে হয়—এই প্রশ্নটাই তলস্তয়কে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।

ন্যায় সততই সুন্দর এবং ন্যায়ই শেষ বিচারে সত্য। হাজী মুরাদের ছবি এই সত্য ও সুন্দর দিয়ে রাঙ্গা করেছেন তলস্তয়। হাজী মুরাদের মৃত্যুর একটুক্ষণ মাত্র আগে তার মনে পড়ে এইরকম ফাঁড়ায় পড়েই পূর্বসূরী এক যোদ্ধা হামজাও মারা গিয়েছিল। তলস্তয় সে কাহিনী ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতে স্মরণ করেছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হবার পূর্বক্ষণে ততক্ষণে গভীর ভোর হয়েছে—যাকে বলে সুবেহ সাদেক তার আলো ফুটেছে। হামজার নজর যায় কয়েকটা পাখির দিকে: ‘পাখিরে পাখি, পথিক পাখি, যাও পাখি গিয়ে বলো, আমাদের মা-বোন, আমাদের মেয়েছেলেদের গিয়ে বলো, আমরা সকলেই প্রাণ দিয়েছি জিহাদে, ন্যায় যুদ্ধে। ওদের বলো আমাদের লাশ কবরে পড়ে থাকবে না। আমাদের হাড্ডি খুলে চেটে চেটে খাবে লোলুপ নেকড়ে বাঘে, আর আমাদের চোখ উপড়ে ঠুকরে খাবে কালো কালো কাউয়ায়।’

তলস্তয়ের বাড়িতে—ইয়াসনায়া পলিয়ানা ওরফে উজ্জ্বলাবাদে—একটা পাঠশালা ছিল। শোনা যায় ওই পাঠশালার ছাত্রছাত্রীরা—এরা সকলেই ছিল চাষা পরিবারের—একবার পথে হাঁটতে হাঁটতে তলস্তয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল: ‘মানুষ গান গায় কেন?’ উত্তরে মহাত্মা তলস্তয় ঠিক কি বলেছিলেন জানা যায়নি। কিন্তু হাজী মুরাদ বইয়ে নাকি সেই প্রশ্নের উত্তরটাই লেখা হয়েছে। ‘মানুষ গান গায়, কারণ গান মানুষকে শেখায় মানুষের মত বাঁচতে, গোলাম না বনতে। গান শেখায় লড়াই করতে, লড়াই চালিয়ে যেতে, শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে। এমন কি সঙ্গের শেষ সঙ্গী যোদ্ধাটিরও যখন পতন হয় তখনও লড়াইটা না থামাতে। শুদ্ধ এই লড়াইয়ের মধ্যেই শান্তি আছে।’

হাজী মুরাদও শেষ পর্যন্ত লড়াই থামান নাই। তাই ন্যায় যুদ্ধের উদ্দেশ্যে তলস্তয়ের শেষ প্রণামের নাম ‘হাজী মুরাদ’। সেখান থেকেই আমাদের প্রশ্নের একটা উত্তর হয়ত জোগাড় করা যায়। মানুষ গান গায় যে কারণে সে কারণে সে শান্তিও চায়। শান্তি মানে যুদ্ধের অভাব নয়। যুদ্ধের অভাব থেকে আসতে পারে আরও যুদ্ধ, আরও অশান্তি। অতয়েব শান্তির রক্ষাকবচ একমাত্র ন্যায় যুদ্ধই। হাজী মুরাদ—তলস্তয় বলেছেন—শহীদ হয়েছিলেন, কিন্তু পরাজিত হন নাই। আমাদের যুগেও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আপোসের মধ্যে শান্তি নাই—শুদ্ধমাত্র ন্যায় যুদ্ধেই শান্তি আর বিজয়ের সম্ভাবনা আছে। মাত্র এই কড়ারেই শান্তির পরাজয় নাই।

 

দোহাই

১. Victor Shklovsky, Lev Tolstoy, O. Shartse, trans. (Moscow: Progress Publishers, 1978)|

২. Plato, The Republic of Plato, A. Bloom, trans. (New York: Basic Books, 1968)|