শামসুর রাহমান : রূপালি স্নান থেকে রক্তলাল প্রতিরোধে

Looks like you've blocked notifications!

শিশিরের জলে স্নান ক’রে মন তুমি কি জানতে

বিবর্ণ বহু দুপুরের রেখা মুছে ফেলে দিয়ে

চ’লে যায় এই পৃথিবীর কোনো রূপালি প্রান্তে?

নোনাধরা মৃত ফ্যাকাশে দেয়ালে প্রেতছায়া দেখে, আসন্ন ভোরে

দু’টুকরো রুটি

না-পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক-গা ঘুমেই বিবর্ণ হই,

কোনো একদিন গাঢ় উল্লাসে ছিঁড়ে খাবে টুঁটি

হয়তো হিংস্র নেকড়ের পাল, তবু তুলে দিয়ে দরজায় খিল

সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল।

(রূপালি স্নান)

শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র একটি কবিতা। সেই শুরু থেকে তার আরাধ্য সুন্দরকে তাড়া করে ফিরছে ভয়াল কালো হাওয়া। অবশ্য কাব্যিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর রূপ বদলেছে। প্রারম্ভমুহূর্তে অন্তর্লোকেই যেন ছিল এই খুনি বাত্যার ঝাপট, আর ক্রমে ক্রমে বহিঃপৃথিবীতে হামলে পড়া যাবতীয় জাগুয়ারের মুখোমুখি তার কবিতা। এবং এভাবেই শামসুর রাহমানের এক একটি কাব্যগ্রন্থ পরিণত হয়ে উঠেছে বাঙালির মহত্তম জয়গ্রন্থে।

শামসুর রাহমান সনাতন অনেক কিছু গুঁড়িয়ে দিয়েই তার নতুন পথ তৈরি করেছেন। একটু একটু করে পলি সঞ্চার করেছেন আমাদের কবিতাভূমিতে। শামসুর রাহমানের প্রাথমিক কাব্যভুবন এ অঞ্চলের এক দুর্লভ সাহিত্যিক সাক্ষ্য। সাতচল্লিশের দেশভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় অনেক শক্তিমান কবি যখন গড্ডলপ্রবাহে লুপ্ত (জিন্নাহ বিষয়ক কবিতাও সেসময় ব্যাপক হারে রচিত হয়েছে) তখন পুরান ঢাকার মাহুৎটুলির শামসুর রাহমান নামের জনৈক তরুণ কবি নির্জনে জন্ম দিয়ে চলেছেন বহু গোপন-গহন দুর্গগাথা :

দিনের সারথি বল্গা গুটিয়ে নিলে,

যখন রাত্রি কৃষ্ণ কবরী নেড়ে

আনে একরাশ তারা-ফুল থরথর,

দু’হাতে সরিয়ে শ্যাওলার গাঢ় জাল

চমকে তাকাই আমিও মজ্জমান।

(নির্জন দুর্গের গাথা)

শামসুর রাহমানকে বুঝতে হলে সমান্তরালে রাখতে হবে তার সময়কে। ছোট্ট ঢাকা শহরে নানান শিল্পরহিত ডামাডোলের বাইরে গিয়ে যে ঋজু-রাস্তা খুঁজে বের করেছিলেন তিনি; তাতে হয়তো বোদলেয়ার, জীবনানন্দ দাশ বা বুদ্ধদেব বসুর ছায়া ছিল। কিন্তু তা-ই আবার তাঁকে নিয়ে গেছে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক প্রেক্ষণীতে। সেখানে নীলিমা বিধ্বস্ত, করোটি রৌদ্রস্নাত। সেখানে মধ্যরাতে স্বপ্নে বাজে অশ্বক্ষুর বারবার। সেই কালো হাওয়া! যে হাওয়া তার স্নায়ুতে এক সময়ে নিয়ত কাঁপন ধরাত। সেই হাওয়াকেই এখন দেখলেন ভূমণ্ডলের টুঁটি চেপে ধরতে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন বাংলা ভাষার জন্য যারা রাজপথে রক্ত দিয়েছেন তারাই শুধু ভাষাযোদ্ধা নন; সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যেসব লেখক তাদের সৃজনরেখায় বাংলা ভাষার বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন তারাও ভাষাযোদ্ধা। এ কথা আজ আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি শামসুর রাহমান আমাদের অগ্রগণ্য ভাষাযোদ্ধা।

বায়ান্নর রক্ত ও অশ্রুরঞ্জিত বাংলা ভাষাকে বর্ম করে তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। জীবনঝড়ের ক্ষুব্ধ ঘূর্ণি তুলে শামসুর রাহমানই যেমন অবাক বাংলাদেশ তেমনি তার প্রতিটি উল্লেখযোগ্য কবিতাই বাংলা ভাষার অপরিহার্য প্রসাধন। বাংলা ভাষার লাবণী-অস্ত্র উঁচিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন দুঃসময়ের মুখোমুখি। নেকড়ের উদ্যত থাবা থেকে তিনি আফ্রোদিতি-উদ্ধারে ব্রতী। একশীর্ষ-বহুশীর্ষ নাগের মুখে তিনি ছুড়ে দিয়েছেন তার কবিতার অব্যর্থ মন্ত্র।

যেকোনো ভাষার বড় কবির কুললক্ষণ হচ্ছে তার কাব্যিক বৈচিত্র্য। শামসুর রাহমানে ভ্রমণ আমাদের তার বিচিত্রমুখীন কাব্যিক গতিবিধি সম্পর্কে জানান দেয়। বিস্ময়ে দেখি নানা রং জলের এক অভিনতুন ফোয়ারার উত্থান। এই বৈচিত্র্যের সাক্ষাৎ পাব তার মিথলিপ্ততায়, তার নিরর্থবাদিতায়, তার প্রেমী-বিরহী সত্তায়, তার রাজনীতিক নিনাদে।

রাহমানীয় বিচিত্রিতা বিষয়ের মতো বিন্যাসেও ব্যাপ্ত। শামসুর রাহমানের গুরুত্বপূর্ণ কবিতাকাজ মেঘলোকে মনোজ নিবাস। এ বইয়ের কবিতামালায় দিনানুদৈনিকের ঘটনাসকল যেভাবে টানাগদ্যের ফ্রেমে বন্দি করেছেন তা এখনকার যেকোনো তরুণ কবিকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেয়। একটি কবিতায় এমন দৃশ্য পাই যে পাস্তারনাকের হিমার্ত কাব্যগ্রন্থের তলায় চাপা পড়েছে মাসের উত্তপ্ত ইলেকট্রিক বিল। এভাবে বিপরীত বাস্তবতা মূর্ততা পায় শামসুর রাহমানের গদ্যচালে। মেঘলোকে মনোজ নিবাস প্রমাণ করে প্রথাসিদ্ধ তিনটি ছন্দেই বাংলা কবিতার সম্ভাবনা নিঃশেষ হতে পারে না।

পুরাণের পুনর্জন্ম ঘটেছে রাহমানের কবিতায়। গ্রিক পুরাণকে তিনি তাঁর কবিতায় যেভাবে প্রতিস্থাপিত করেছেন তা বাংলা কবিতার সাহসের সীমানা প্রসারিত করেছে বললে অত্যুক্তি হয় না। ‘ইকারুসের আকাশ’ কবিতায় গ্রিক-বীরের সমান্তরালে বাংলার পিতা শহীদ শেখ মুজিবকে যেভাবে বাঙ্ময় করেন তা শুধু তার নিষ্ঠুর হননের স্মৃতিই রোমন্থন করায় না বরং সঙ্গে সঙ্গে জাজ্বল্য হয় শেখ মুজিবের মতোই বাংলার কবরদশা : ‘নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।’ তবে এ্যাগামেমনন’র প্রতীকে শামসুর রাহমানের কবিতা আমাদের দেয় সামনে বিছানো রক্তাক্ত রাজপথে চলার বরাভয় :

যে যেমন খুশি যখন তখন বাজাবে আমাকে

নানা ঘটনায় ষড়জে নিখাদে, আমি কি তেমন বাঁশি?

কণ্টকময় রক্তপিপাসু পথে হাঁটি একা;

আমার গ্রীবায় এবং কণ্ঠে আগামীর নিশ্বাস।

তার কবিতা যেমন আমাদের যাবতীয় দুঃখের নিদান, আমাদের উজ্জীবনের শস্ত্র তেমনি অসুখী আত্মার গানও তিনি তারে তুলেছেন। পাংশুটে পরিপার্শ্বে নিরর্থতার উপলব্ধিকে তিনি আড়াল করেননি, রাখেননি কোনো আবডাল :

শয্যাত্যাগ, প্রাতরাশ, বাস, ছ’ঘণ্টার কাজ, আড্ডা

খাদ্য, প্রেম, ঘুম, জাগরণ; সোমবার এবং মঙ্গলবার

বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি আর রবিবার একই

বৃত্তে আবর্তিত আর আকাশ তো মস্ত একটা গর্ত—

সেখানে ঢুকবো নেংটি ইঁদুরের মতো...

(আত্মহত্যার আগে)

গণ্ডার শুধু গণ্ডারে আজ সব একাকার,

খণ্ডিত তুমি নিরুপায় শোনো ধ্বংসের রোল;

তোমার বিলয়ে ফলবে অন্য কারুর শস্য।

(গণ্ডার গণ্ডার)

কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি;

খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দু’বেলা

পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনী কথা শুনছি

ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি

(দুঃস্বপ্নে একদিন)

মনে হবে যেন পড়ে যাচ্ছি কাফকার পেনাল কলোনির বিরান প্রান্তর। তারও চেয়ে বিরান মনোভূমি। অপুষ্ট বৃক্ষ, সুরহারা বিহঙ্গ, পচা জলের সরোবর। আধুনিক ব্যক্তির অন্তর্গত পোড়োজমি শামসুর রাহমানের আরও এমন কিছু কবিতায় ভাস্বর; যদিও তা তার মৌলস্বর নয়। ‘সে, একটি ব্লেড এবং সুরভি’ শীর্ষক তার একটি গল্পেও এমন মনোপরিস্থিতির দেখা মেলে।

ভালোবাসা তুমি ক্ষত-চিহ্নিত,

পাতাহারা আজ, তোমার কী দোষ বলো?

ব্যাপক খরায় বহুদিন আমি

ঢালিনি শিকড়ে একটি বিন্দু জল’ত

(ভালোবাসা তুমি)

তুমি যে আমার অলংকৃত কারাগার

(হে সুদীপ্তা মোহিনী আমার)

শামসুর রাহমান প্রেমিক কবি। প্রেমের শতধা ধ্বনিচিত্র তার রুপালি আঙুল থেকে ঝরনাধারার মতো উৎসারিত। তিনি দয়িতাকে ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হতে পারেন। কখনো অন্ধ সুন্দরীর কান্নাকে করেন বাঙ্ময়। ‘সায়োনারা’ বলে বিদায় জানান জাপানি মানসপ্রতিমাকে। আর শামসুর রাহমান কখনোবা প্রেমের কবিতাকে উত্তীর্ণ করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নতর নন্দনে :

আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো

          মিলি রাতের গভীর যামে,

তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,

          পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে!

(প্রেমের কবিতা)

ভাষিক বৈচিত্র্যেও শামসুর রাহমানের অনন্যতা। ‘এই মাতোয়ালা রাইতে’র মতো কবিতা কোনো আকস্মিকের খেলা নয়, বরং বলা চলে সুদীর্ঘ কবিতাজীবনে রাহমান ভাষাগত ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে থেকেছেন। ইংরেজি-আরবি-ফারসি থেকে ঢাকাইয়া কুট্টিদের প্রাত্যহিক বোলচালও তার কবিতার সূত্রে হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতার ঘরের জিনিস। খান সারওয়ার মুরশিদের পর্যবেক্ষণ তাৎপর্যপূর্ণ :

“তাঁর কবিতা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার খুব কাছাকাছি: এ ভাষা থেকে শিক্ষিতজন, কুলীনজন কিংবা ব্রাত্যজনের বোল বাদ পড়েনি। তিনি কাব্যের ভাষাকে এমন নমনীয়তা দিয়েছেন যে তা গদ্যের খুব কাছাকাছি এসেও একটুখানিক অনুপ্রাণিত উষ্ণতার চাপে কবিতা হয়ে ওঠে। এ ভাষায় তিনি অনাটকীয় দৈনন্দিনতার বিবরণ দেন সেই সঙ্গে জীবনের সাধারণত্বকে মর্যাদা দেন।”

(শামসুর রাহমান রচনাবলির ভূমিকা থেকে)

আর তার রাজনৈতিক কবিতা যেন রক্তাক্ত শিল্পকলা। খুব কম কবিই পারেন সমকালের অমাবাস্তবতা এমন কাব্যিক সিদ্ধিতে পরিস্ফুট করতে । শামসুর রাহমান আধুনিক কবি। আধুনিক বলেই রাজনৈতিক। নারীবাদী তাত্ত্বিক কেইট মিলেট মনে করেন এ যুগে এমনকি যৌনতাও রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। আত্মগততার বৃত্ত ছিঁড়ে রাহমান রাজনীতিকে অন্বিত করে নিলেন কবিতাশরীরে। এবং তা তার স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট করেনি বরং করেছে সমুজ্জ্বল। খুপরির ঘেরাটোপ থেকে বৃহৎ বাংলায় প্রবেশ করে কবি দেখলেন চারদিকে খুলির ভোজ, বাগান উজাড়। শুধু কবরে আছে কিছু দুর্বিনীত ফুল। ধ্বংসের কিনারে বসে দেখছেন গোরস্তানে আর্ত কোকিল আর প্রিয় নীলিমায় ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে। কিন্তু তিনি তো চান ভস্মভেদী গোলাপের হাসি। আর রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যারাত। তাই তাকে পক্ষ নিতে হয়। নামতে হয় লড়াইয়ের সুকঠিন ময়দানে। তাঁর কবিতাকে ছেড়ে আসতে হয় নিরঞ্জন স্যানাটোরিয়াম।

আমার কবিতা করে বসবাস বস্তি ও শ্মশানে

চাঁড়ালের পাতে খায় সূর্যাস্তের রঙলাগা ভাত,

কখনো পাপিষ্ঠ কোন মুমূর্ষু রোগীকে কাঁধে বয়ে

দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় আরোগ্যশালায়।

(নিজের কবিতা বিষয়ে কবিতা)

খোন্দকার আশরাফ হোসেন ‘রাহমানের চিড়িয়াখানা’ প্রবন্ধে তালিকা করে দেখিয়েছেন শামসুর রাহমানের কবিতার ভূভাগ জুড়ে জন্তু-সমাবেশ। অজস্র জন্তু ছাপিয়ে যে নেকড়ে বারবার ঘাড় উঁচায় তার কবিতায় তা আসলে তারই প্রতিপক্ষ। সোজা কথায় তার প্রিয় মাটি ও মানুষের প্রতিপক্ষ। গণশত্রু। এরা ছিল বায়ান্নোতে। বাংলা ভাষার পাপড়ি ছিঁড়তে চেয়েছিল। এরা ছিল একাত্তরে— বাংলাভূমির বিরুদ্ধে। ছিল এরা মধ্য পঁচাত্তরে। কেউটের মতো ছোবল মেরেছিল বাঙালির স্বপ্নপ্রতীক শেখ মুজিবের বুকে। ইত্যাকার নেকড়েপ্রতিম শত্রুদের মোকাবিলায় শামসুর রাহমান তার ষাটের অধিক কবিতাগ্রন্থকে ভিত্তিভূমে রেখে লড়াইরত ছিলেন। শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কাক্সক্ষাই ছিল নেকড়ের বিরুদ্ধে স্বর্ণচাঁপার জয়। যে নেকড়ের হিংস্র থাবায় আফ্রোদিতি পর্যন্ত বিপন্ন তাকে রাহমান বিন্দুবৎ ছাড় দিতে চাননি। তার কাব্যিক অর্জনও এই প্রেক্ষিতে বিচার করা জরুরি।

হুমায়ুন আজাদের রাহমান- বিবেচনায় কবির পূর্ণাবয়ব প্রতিভাসিত; তার ব্যক্তিতা ও যূথতার সূত্রসার উন্মোচিত এভাবে— “তিরিশি পাঁচ মহৎ আধুনিক-উত্তর বাঙলা কবিতার প্রধান পুরুষ শামসুর রাহমান। তাঁর কবিতায় অত্যুজ্জ্বল পরিণতি লাভ করেছে রবীন্দ্রোত্তর সে কবিতাধারা, যার প্রিয় অভিধা আধুনিক কবিতা। শামসুর রাহমান বাহ্যজগৎ ও সমকাল ও অব্যবহিত প্রতিবেশকে শুষে নেন আপন অভ্যন্তরে, এবং তাঁর কবিতা ধ্যান বা স্তব-বা গান বা শাশ্বত শ্লোকের বদলে হয়ে ওঠে সমকালীন জীবনদৃষ্টি। ওই কবিতা হঠাৎ আলোর ঝলক, শান্ত স্নিগ্ধতা, প্রশান্তির বদলে সঞ্চার করে বিশশতকের দ্বিতীয়াংশে বসবাসের তাপ-জ্বালা-দাহ।”

[হুমায়ুন আজাদ; শামসুর রাহমান নিঃসঙ্গ শেরপা  (১৯৮৮)]

রাজনৈতিক তাপ রাহমানের কবিতায় কেমন মাত্রায় জারিত হয়েছে তার এলোমেলো উদাহরণমালা—

তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?

ঊনিশ শো’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি

          বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।

সে-ফুলের একটি পাঁপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে

কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।

এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি

এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!

তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,

বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।

(বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা)

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,

তোমাকে পাওয়ার জন্যে

আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?

আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

(তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা)

কোথায় পাগলাঘণ্টি বাজে

ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে। হামলাকারীরা

ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহরে ও গ্রামে

এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল।

দশদিকে কত একাডেমীতে নিশীথে

গোরখোদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত, মানুষের মুখগুলি

          অতি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জীর মুখ।

(উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)

এ পবিত্র মাটি ছেড়ে

পরাজিত সৈনিকের মতো

সুধাংশু কোথাও যাবে না।

(সুধাংশু যাবে না)

প্রতিরোধেরও একটি নন্দনতত্ত্ব আছে। শামসুর রাহমানের কবিতা পড়তে পড়তে এ কথাটিই বারবার মনে পড়ে। বাংলা কবিতাভুবনে তার যে বর্ণাঢ্য অভিযাত্রা তা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত উপার্জনের চেয়ে সমষ্টিমানুষের ভাষা হয়ে উঠেছে। তার প্রধান গুরুত্বের জায়গাও এটি।

‘শ্যামলীর গালিব’ নামে একটি কবিতা আছে তাঁর। মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিব যেমন প্রেম-বিরহের চিরায়ত কবি ঠিক তেমনি ১৮৫৭’র সিপাহি বিদ্রোহের রক্তাক্ত অভিঘাতও তিনি চারিয়ে দিয়েছেন তার অজস্র শের-শায়েরিতে। শামসুর রাহমানেরও হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ; তবে দশদিক থেকে ধেয়ে আসা কালো হাওয়াকে তার মতো করে খুব কম কবিই মোকাবিলা করেছেন।