আবু ইসহাকের কলমে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’র নির্মাণ

Looks like you've blocked notifications!

আবু ইসহাক তাঁর ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসটিতে হাত দেন দেশভাগের কালে। পেশায় তখন তিনি ছিলেন সরকারি চাকুরে, বাংলা সরকারের বেসরকারি সরবরাহ বিভাগের পরিদর্শক পদে (পাকিস্তান হলে পরে বিভাগটি বিলুপ্ত হয়ে পুলিশে আত্তীকরণ করা হয়)। সে সময় তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জে কর্মরত। সেখানে উপন্যাসটির অর্ধাংশ লেখার পর তাঁকে কাজের সুবাদে চলে যেতে হয় পাবনায়। ১৯৪৮ সালে লেখাটি শেষ হয়। লেখকের স্মৃতিকথা থেকে স্পষ্ট হয় রচনার পেছনকার তথ্য :

“১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি নারায়ণগঞ্জেই ছিলাম। তখন ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’র প্লট আমার মধ্যে শাখা বিস্তার করতে শুরু করে। এক শয্যা-বিশিষ্ট দুই কামরার একটায় থাকেন পুরনো সহকর্মী ফজলুল করিম। আমি যে কিছু লেখালেখি করি তা তিনি জানতেন। তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আপনার রুমটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আপনি যদি আমার জায়গায় আসেন, তাহলে আমার লেখালেখির কাজটা চলতে পারে।’ ...ফজলুল করিমের উদারতায় আমি সেই আশ্রয় পেয়েছিলাম। সেখানে দরজা বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে লেখালেখির সুযোগ আমি পেয়েছি। সেই নিভৃত কক্ষেই আমি ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ লেখা শুরু করি। উপন্যাসটির অর্ধেকটা ওখানেই বসেই লেখা। ... ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে আমি বদলি হয়ে যাই পাবনা। সেখানে কিছুদিন এক মেসে থেকে বুঝতে পারলাম হট্টগোলের মধ্যে লেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঠিক সেই সময়ে পাবনা শহরের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত এক প্রখ্যাত সপ্ততীর্থ পণ্ডিতের সপ্ততীর্থকুটির ভাড়া দেয়া হবে শুনে একাই সেই দোতলা বাড়িটা নিলাম মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায়। সেই বাড়ির নিভৃতে নির্জনে দোতলায় বসে ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ লেখা শেষ করি।”

(অপরিশোধ্য ঋণ/ স্মৃতি বিচিত্রা)।

এ উপন্যাস রচনার পটভূমি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন যাপিত জীবন থেকেই। তাঁর এক চিঠিতে জানা যায় তেমনই অজানা অনেক কথা। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ের চাকরি নিয়ে তাঁকে কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জে যেতে হয়। কর্ম উপলক্ষে এ সময় তিনি প্রায়ই নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতেন। ওই সময় ট্রেনে জয়গুনদের মতো অসংখ্য দুস্থ নারীকে তিনি দেখতেন। যারা ট্রেনে চড়ে ময়মনসিংহ যেত এবং সেখান থেকে সস্তায় চাল কিনে ফিরে আসত। ফতুল্লা এবং চাষাঢ়া স্টেশনে ট্রেন পৌঁছাবার আগেই চালের থলিগুলো তারা রেল রাস্তার পাশে নিক্ষেপ করত। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ঘাটে এবং রেলস্টেশনে হাসুর মতো অনেক নম্বরবিহীন কিশোর শ্রমিকও তিনি দেখেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন, প্রতিযোগিতা করে তাদের নদী সাঁতরে স্টিমারে উঠে মোট বইতে। লেখক গ্রামবাংলার ওঝা-ফকিরের ঝাড়ফুঁক ও অসহায় নারীদের দুঃসহ জীবন সংগ্রামও দেখেছেন। লেখকের বক্তব্য থেকে জানা যায়, তাঁর মামাবাড়ির পাশে একটি ছাড়া ভিটে ছিল। সেই ভিটের নাম ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’। সে বাড়িতে মানুষজন স্থায়ীভাবে বাস করতে পারত না। এ রকম একটি কিংবদন্তি তিনি তাঁর মায়ের কাছে শুনেছেন। কৈশোরের জীবনভিজ্ঞতা ও পরিণত বয়সে নারায়ণগঞ্জের রেলস্টেশনে স্টিমারঘাটে তাঁর সে বাস্তবজীবন-অভিজ্ঞতা, তারই সঙ্গে ছেলেবেলায় শোনা কিংবদন্তি একসূত্রে গ্রথিত হয়ে উঠেছে এ উপন্যাসটি। (সূত্র : ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী : রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি’, ড. আবুল আজাদ)।

তবে লেখাই তো শেষ কথা নয়। প্রয়োজন এর যথাযথ প্রকাশনা। এ উপন্যাসটি প্রকাশ করতে লেখককে পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। নানাজনের কাছে ধরনা দিয়েও উপন্যাসটি প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি। বড় বড় লেখকের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি শোনাতে গিয়ে হয়েছেন উপেক্ষিত। এর ফলে লেখক দারুণ মনঃকষ্টে ভোগেন। তারপর ১৯৫১-৫২ সালে কবি গোলাম মোস্তাফা সম্পাদিত মাসিক ‘নওবাহার’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এটি। তবুও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। উপন্যাসটি রচনার সাত বছর পর ১৯৫৫ সালে কলকাতার ‘নবযুগ প্রকাশনী’ থেকে এটি প্রথম পুস্তাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আলোচনা হলে পরে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। নানা মহলে সৃষ্টি হয় এ বইটিকে ঘিরে আলোড়ন। রাতারাতি পাল্টে যায় দৃশ্যপট। চারিদিকে ছড়াতে থাকে আবু ইসহাকের নাম। লেখকের কথায় : “ঢাকা ও কলকাতার অনেক প্রকাশকের দ্বারে ধরনা দিয়েও উপন্যাসটি প্রকাশের ব্যবস্থা করতে পারিনি।”

একদিন ঘটনাক্রমে কবি জসীমউদদীনের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায় তাঁর। তৎকালীন তেজগাঁও থানার দাঙ্গা-পরিস্থিতি সম্পর্কিত ও কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার এক ফাঁকে লেখক সসংকোচে কবিকে বলেন— ‘আমার কিছু গল্প সওগাত, আজান পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।’ জসীমউদদীন তাঁর দিকে বিস্ময়ভরে তাকিয়ে বলেন— ‘তাই! তাই তো আপনার বক্তৃতার ভাষা এত সুন্দর। পুলিশের লোক সাহিত্য-সাধনা করে, এতো ভাবাই যায় না।’ তারপর লেখক অত্যন্ত কুণ্ঠার সাথে বলেন— ‘আমি একটা উপন্যাস লিখেছি। কিন্তু কোনো প্রকাশক পাচ্ছি না।...আমার কথা শুনে তিনি (জসীমউদদীন) কিছুটা অবাক হলেন। তবে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলো না। বললেন, লিখতে থাকুন, লিখতে লিখতে হাত পাকা হবে। লেখা ভালো হলে অবশ্যই প্রকাশক পাবেন।’

‘আমি কি একদিন পাণ্ডুলিপি নিয়ে আপনার বাসায় যাব? আপনি একটু দেখবেন?’

‘তা আসুন একদিন। যখন আসবেন, রবিবার ছুটির দিন নয়টা-দশটার দিকে আসবেন।’

‘নানা কাজের ঝামেলায় কবি সাহেবের বাসায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে তিন মাস পেরিয়ে গেছে।’ আবু ইসহাক লিখছেন, ‘অবশেষে এক রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তখনকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনের কাছে কবির বাসা ‘ফুলবাড়ি’ গিয়ে হাজির হলাম ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’র পাণ্ডুলিপি নিয়ে। পাণ্ডুলিপি হাতে দিতেই তিনি বললেন, আমি তো খুব ব্যস্ত মানুষ। তুমি পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু পড়ে শোনাও।... সেদিন উপন্যাসের দুটো অধ্যায় কবি শুনেছিলেন। তিনি বললেন, তোমার লেখার হাত তো খুব ভালো।’

সেদিনের সেই অধ্যায় এখানেই শেষ হয়েও হলো না শেষ। উপন্যাসটি প্রকাশের কিছুদিন পর আবু ইসহাক বদলি হয়ে যান করাচিতে। এর মধ্যে আর দেখা হয়নি কবি জসীমউদদীনের সঙ্গে। অবশেষে ১৯৬১ সালে দেখা হয় দুজনার। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের অনেক কবি-সাহিত্যিকদের সাথে জসীমউদদীন রাইটার্স গিল্ড-এর সম্মেলনে যোগ দিতে করাচিতে যান। সেই জায়গায় জসীমউদদীন লেখককে বলেন—‘ভাই ইসহাক, আমি তোমার ওপর সুবিচার করি নি। তোমার উপন্যাসের কিছুটা পড়ে শুনিয়েছিলে। অতটুকু শুনে তখন উপন্যাসটি মূল্যায়ন করতে পারিনি। এজন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইব কি, আমি নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।’ আবু ইসহাক আরো লিখেছেন : “১৯৬২ সালে তিনি একবার আমার বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘তোমার সূর্য-দীঘল বাড়ী’ চেক ভাষায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ডক্টর দুসন একদিন এসে আমাকে বললেন, ‘উপন্যাসে যেসব জায়গার উল্লেখ আছে সেসব জায়গায় তাকে নিয়ে যেতে হবে। তাকে নিয়ে দুদিনে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার স্টেশন, রেলস্টেশন, রেলওয়ে ওভারব্রিজ, নম্বরী কুলি, খুদে কুলি, ফতুল্লা স্টেশন ইত্যাদি সব ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছি। লোকটার নিষ্ঠা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি’ (অম্লান স্মৃতি/স্মৃতি-বিচিত্রা)।”

তা ছাড়া উর্দু ভাষায়ও এ উপন্যাসটির অনুবাদ হয়েছে ‘আসেবি ঘর’ নামে, যা ১৯৬৯ সালে হাবিব ব্যাংক সাহিত্য-পদক লাভ করে। বাংলাদেশ সরকারের সর্বপ্রথম অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’। আবু ইসহাকের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারসহ ৭টি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৫টি পুরস্কার অর্জন করে। ব্যক্তিজীবনে প্রচারবিমুখ এ মানুষটি সম্পর্কে জানা যায় প্রাবন্ধিক তিতাশ চৌধুরী’র ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’র পটভূমি ও আবু ইসহাক’ শিরোনামের লেখাটির মধ্য দিয়ে। তিনি সে লেখায় উল্লেখ করেন :

“এই আবু ইসহাকের সঙ্গেই আমার পরিচয় ঘটেছিল ১৯৯৮ সালের কোনো এক সময় অলক্ত সাহিত্য পুরস্কারকে কেন্দ্র করে। এর আগে তাঁর সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। শুধু কিছু লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিল। তিনি যে অমায়িক, বন্ধুবৎসল, বিনয়ী, ভদ্র, সংবেদনশীল, মার্জিত ও সজ্জন ব্যক্তি—তা পরিচয়ের পরই জানা গেল। আবু ইসহাক খুব উচ্চঃস্বরে কথা বলতেন না। তিনি হইচইপ্রবণও ছিলেন না। তিনি ধীরস্থির আস্তে আস্তে কথা বলতেন। হেমন্তের নমিত শব্দের মতো। তাঁর হাঁটাচলার মধ্যেও একটি সারল্য আমরা লক্ষ করি। তিনি সহজ, সরল। তিনি কথাবার্তায়/ পোশাকে-আশাকেও ছিলেন আদর্শের প্রতীক। জাঁকজমক কিংবা চাকচিক্য তাঁর পছন্দ ছিল না। তিনি সাদাসিধে জীবনই বেছে নিয়েছিলেন এবং সে জীবনকেই তিনি গভীর ভালোবেসেছিলেন। তাঁর উপন্যাসের অনেক চরিত্রের মতোই ছিল তাঁর দিনযাপন পদ্ধতি।”

তিতাশ চৌধুরীর লেখা থেকে আমরা আরো জানতে পারি, “তিনি বাস্তব সত্য থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তিনি জীবনে যা ভালো, যা শুভ এবং কল্যাণকর মনে করতেন— তা করতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। নিজের মানসিক দৃঢ়তার মতো করেই তিনি তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো সাজিয়েছেন। চরিত্রচিত্রণে কোথাও তিনি গোঁজামিলের আশ্রয় নেননি। না জয়গুন না জরিনা— উভয় চরিত্রই একটা বাস্তব আদর্শের ওপর উপস্থাপন করেছিলেন। ফলে দুই উপন্যাসে দুটো চরিত্রই সবার আকর্ষণের কারণ ঘটিয়েছে। তিনি চরিত্র নির্মাণেও প্রযত্নশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আবু ইসহাকের অহংবোধ ছিল, কিন্তু অহংকার বোধ ছিল না। আবার জীবনে সবকিছু তিনি সহজে মেনেও নেননি। তাঁর খুঁতখুঁতে একটি স্বভাব ছিল— রবীন্দ্রনাথের মতো। তিনি যখন মঞ্চে বক্তৃতা দিতেন সেখানে তাঁর গলার স্বর চড়া ছিল না। তিনি বক্তৃতায় কথামালা সৃষ্টি করতেন। তা দিয়েই তিনি শ্রোতা-দর্শকদের মুগ্ধ করতেন। তাঁর প্রত্যুপন্নমতিত্ব, বিচারবুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাঁকে এক অন্য মানুষে রূপান্তর করতো তখন। তিনি তখন সবার প্রিয় ভাষকে পরিণত হতেন।”

আবু ইসহাকের জন্ম ১৯২৬ সালের ১ নভেম্বর, তৎকালের মাদারীপুরে, যা বর্তমান শরীয়তপুর নামে পরিচিত, সেখানকার নড়িয়া থানাধীন শিরঙ্গল গ্রামে। শক্তিমান এই লেখকের মৃত্যু হয় ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি।