সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশে একটা আশ্রয় আছে : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

Looks like you've blocked notifications!

দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন গত ৯ নভেম্বর ঢাকা লিট ফেস্টে যোগ দিতে। এর পরদিন ১০ নভেম্বর সকালে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন পার্থ সনজয়। সাক্ষাৎকারটি এখানে দেওয়া হলো।

প্রশ্ন : আপনার লেখায় একটা বেদনা, একটা বিপন্নতার প্রকাশ আছে, যেমনপার্থিব, জীবনকে আপনি কি বেদনাময় হিসেবেই দেখেন?

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় :  আমার লেখার ভেতর নানা রকম বেদনার প্রকাশ আছে। আর্তির প্রকাশ আছে। আবার আনন্দেরও প্রকাশ আছে। এইসব মিলিয়ে-মিশিয়ে আমার জীবনের চিন্তাভাবনা। আমি আমার মতো করে যে জীবন দেখেছি, যে জীবনকে যাপন করেছি, তারই বিচ্ছুরণ আমার লেখার মধ্য দিয়ে আসে। তুমি পার্থিব-এর কথা বললে বলে আমার বেশ ভালো লাগলো। কারণ, পার্থিব আমার অনেক স্বপ্নকে ধারণ করে আছে। অনেক স্বপ্ন, অনেক সংকট, স্বপ্নভঙ্গ—সবকিছুকে ধারণ করে আছে।

পার্থিব উপন্যাসটা আসলে আমার মনে যে নানা রকম বিপন্নতা, তারই প্রকাশ। এটা কৃষ্ণজীবনের মুখ দিয়ে আমি এমন কিছু বলিয়েছি যা আমার নিজের কথা। এই পৃথিবীর বিপন্নতার কথা। আমাদের অস্তিত্বের সংকটের কথা। আমাদের পরিবেশ দূষণের কথা এবং মানুষের উত্তরণের স্বপ্ন, সেটাও তার মুখ দিয়ে বারংবার প্রকাশ পেয়েছে। সভ্যতার তো অনেক বয়স হয়ে গেল, সভ্যতার নামে আমরা কীভাবে আমাদের ভোগ- সর্বস্বতাকে একটা বিশাল আকার দিয়েছি। বাড়িয়ে তুলেছি। সেটা যে আমাদের কত বড় সর্বনাশ করছে, পার্থিবের ভেতরে তারই নানা রকমের বিচ্ছুরণ রয়েছে। কৃষ্ণজীবন বলতে গেলে নায়ক। যদিও প্রোটাগনিস্ট এখানে কয়েকজনই আছেন। কৃষ্ণজীবন প্রধান। তার গুরুত্ব বেশি। তা ছাড়া অনেকগুলো চরিত্র আছে। আমি তো অনেক চরিত্র সব সময়ই লিখি। এসব চরিত্রের কথা আছে।

দেখো, আমার পার্থিব বলে নয়, যেকোনো উপন্যাসের মধ্যেই বিপন্নতার কথা থাকে। যে প্রেমের কথা শুনি এখন আমরা নরনারীর প্রেম—রোমান্টিক প্রেমের কথাই বলছি, সেটাও যে কত ঠুনকো, সেটা বারংবার আমাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এরকম নানা প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আমার লেখার মধ্যে আসে।

আমার লেখায় প্রেমটাকে বারবার পরীক্ষা করছি। যে প্রেমের কথা মানুষ বলছে, সে প্রেমটা আছে কি না? যিশুখ্রিস্ট, হজরত মুসা (আ.), বুদ্ধ এবং আমাদের বেদ, বেদান্ত, কৃষ্ণ, ভগবান, চৈতন্যদেব—সবাই প্রেমের কথাই বলেছেন। ভালোবাসার কথাই বলেছেন। সেই ভালোবাসা মানুষ কতটা ইনহেরিট  করতে পেরেছে তাদের কথা থেকে? মানুষের প্রেম সহজেই যেন ফুরিয়ে যায়। মানুষের মন এমন অগভীর হয়ে গেছে যে মানুষ এখন প্রেমকে বুঝতে পারে না। এখন যা প্রেম তা ঠুনকো। অর্থাৎ কাচের গ্লাসের মতো ভেঙে যায়। একটু আঘাত লাগলেই ভেঙে যায়, ঠিক সে রকম হয়ে গেছে। এটা হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু এখনকার মানুষের মধ্যে সেটাই হয়েছে। ধরো, আমি মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলি। তো, দেখি, চারদিকে প্রেমের গুণকীর্তন হচ্ছে। হিন্দি গান বলো, বাংলা গান বলো, ইরেজি গান বলো—সবখানে love, love, love। তোমাদের পাঁচ বছরের প্রেম বিয়ের পর পাঁচ মাস টিকল না, এটা কী রকম? এই প্রেমের এত জয়গান করছ? আজকে তোমাকে ভালো লাগছে না। কালকে আরেকজনকে ভালো লাগছে, খুব এভার চেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে।

আমি শুধু নর-নারীর ভালোবাসার কথা বলছি না। দস্তয়ভস্কির একটা উপন্যাস ছিল, তার মধ্যে একজন বলছে, আমি খ্রিস্টকে ভেবে এক কুষ্ঠ রোগীর সেবা করতে গেছি, আমি পারিনি। কেন আমি পারলাম না? সে প্রশ্ন করছে। এই যে মানুষের ব্যর্থতা, নানান ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা—এটা হচ্ছে একটা কারণ। মানুষ ইউনিভার্সালি কিছু ভাবতে পারে না। তাদের মন তো খুব ছোট।

কেউ কেউ ভেবেছিল, এটাই আমাদের সান্ত্বনার কথা। যিশুখ্রিস্ট ভেবেছিল, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ভেবেছিলেন। কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো? রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না!

প্রশ্ন : পাঠকের এত ভালোবাসা পেয়েছেন। তবু অন্য অনেক লেখকের মতো আপনি ঠিক অতটা লাউড নন। কেন?

শীর্ষেন্দু : আমি এমনিতে খুব লাজুক মানুষ। চট করে লোকের সামনে কথা বলতে পারি না। পারতাম না। এখন পারি একটু আধটু। আগে একেবারে পারতাম না। বলতে পারি না বলে হয়তো লেখার চেষ্টা করেছিলাম। তাই লেখার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু প্রকাশ করছি। সোচ্চার হয়ে চিৎকার করে কিছু বলতে পারিনি। মিছিলে নেমে স্লোগান দিতে পারি নি। তাই নীরবে ঘরে বসে লিখেছি। যে, আমার কথা তোমরা শুনতে কি পাও? আমি শোনাতে চাইছি যে, আমার এই বেদনার কথা। আমার এই আর্তির কথা। আমি প্রতিবাদী মানুষ নই। মানে হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা, আমি করতে পারি না। কিন্তু নিঃশব্দে আমার বেদনাকে আমি নিবেদন করি মানুষের কাছে। বলি, সাড়া দাও। আমি চাইছি তোমরা আমাকে উত্তর দাও। তোমার কাছ থেকে প্রতিধ্বনি আসুক। প্রতিধ্বনি করো। প্রতিধ্বনি করো। আমার কথা কি তোমার কানে যাচ্ছে? তুমি কি বুঝতে পারছ? উপলব্ধি করছ? তাহলে, সাড়া দাও। আমি পাঠক চাই না। সাড়াশীল মানুষ চাই।

প্রশ্ন : আবারও ঢাকায় এলেন, কেমন লাগছে?

শীর্ষেন্দু : ঢাকা তো আমার দেশ। এখানে আমাকে অতিথি হয়ে আসতে হয়, এটাই দুঃখের বিষয়। আমার দেশ তো ঢাকা। আমি বাঙাল। এখনো আমাদের বাড়িতে বাঙাল ভাষায় কথা হয়। আমার স্ত্রীর সাথে, ছেলের সাথে—একেবারে বাঙাল ভাষায় কথা বলি। সুতরাং এখনো  আমার ভেতরে বাংলাদেশ।

তোমরা যাকে বাংলাদেশ বলো, সেই বাংলা ঢুকে আছে। এখনো মনে হয়, এটাই আমার দেশ। বিদেশে এসেছি তো মনে হয় না। মনে হয় হোম কামিং। এখন তো সেই হোম নেই। কিছুই তো নেই এখন আর। তবু মনে করি, বাংলাদেশে একটা আশ্রয় আছে। অন্তত ঘর বাড়ি না থাক। আমার মানসিক আশ্রয় তো আছে।