বইয়ের কথা

ডানাবিহীন পাখি : নার্সিসাসে প্রজাপতি

Looks like you've blocked notifications!

মুর্তজা বশীরকে আমি চিনতাম না। কখনো তাঁকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবিনি। তাই ‘নার্সিসাসে প্রজাপ্রতি’ বইটি গভীর নির্লিপ্ততা নিয়ে পড়তে বসেছিলাম। এ বছর অমর একুশে বইমেলার দ্বিতীয় দিনে বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম আমি।

সেখানে উপস্থিত হয়ে যখন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মনসুর উল করিম, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের কণ্ঠে বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি, ঠিক তখনই ভেবেছি বইটির গভীরে একবার উঁকি দিই।

বইটি পড়তে শুরু করে বারবার গভীর থেকে গভীরতর স্তরে চলে যাচ্ছিলাম। সূচিপত্রে বিন্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে লেখকের সঙ্গে মুর্তজা বশীরের পরিচয় পর্ব থেকে সর্বমোট ১৫টি অধ্যায়ে। লেখক মিরাজুল ইসলাম সযত্নে বর্ণনা করেছেন তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের বিশদ বিবরণ মুর্তজার সচিত্র সজীব ঋদ্ধ একটি জীবনালেখ্য। এটিকে আমি জীবনালেখ্য বলব নাকি জীবনচিত্র বলব, যেটি মুর্তজা বশীরের শিল্পীজীবনকে কখনো তেলচিত্রে, কখনো বিমূর্ত বাস্তবতা, কখনো আত্মপ্রতিকৃতিতে লেখক আরো কিছু ভালোবাসার রং দিয়ে প্রকাশ করেছেন।

লেখক বুঝি তাঁকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র হিসেবে অন্য সবার থেকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যাটি জানতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাই। চলে যাই চিত্রশিল্পী, লেখন ও বহুপ্রতিভাময় মুর্তজা বশীরের বাল্যজীবন, তাঁর পিতার পরিচয়ে ছাপিয়ে ‘আমি’ হয়ে ওঠার চেতনাবোধ, অতঃপর পিতার প্রতি সর্বক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, মুর্তজার ব্যক্তিসত্তার আত্মাভিমান, ভীষণ সংগ্রামী কিন্তু সংকল্পবদ্ধ শিল্পী জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের বয়ান সব কী নিখুঁতভাবেই লেখক কালি ও কলমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। মুর্তজা বশীরকে তিনি শুধু কিছু শব্দের বিশেষণে দেখেননি; বরং মনে হয়েছে ১৯৯৯ সালে লেখকের সঙ্গে বশীরের পরিচয়ের পর থেকে প্রতিটি দিন বা প্রতিটি বছর লেখক নতুন করে আবিষ্কার করেছেন মুর্তজাকে। সত্তরে মুর্তজা, একাত্তরে মুর্তজা, ঊনসত্তরে মুর্তজা—প্রতিটি স্তরে মুর্তজাকে মিরাজুল ইসলাম ধারণ করেছেন এবং সেটি বিবৃত হয়েছে অকপটে। কখনো তিনি মুর্তজার অভিমানী মানুষকে খুঁজে নিয়েছেন ‘মুর্তজার কাছের মানুষ’ মুর্তজার বিমূর্ত প্রেম অথবা ‘মুর্তজার তুলু’ এইসব অধ্যায়ে। একজন শিল্পীর শিল্পসত্তাটি হয়তো খুব সহজেই ধারণ করা যায়; কিন্তু লেখক সযত্নে মুর্তজার ব্যক্তি মানুষকে ধারণ করেছেন এবং সেটি পাঠকের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছেন সন্তর্পণে। বইটিতে মোট ৮৮ পৃষ্ঠায় মুর্তজার জীবনের নানান বোধকে তুলে ধরা হলেও পড়ে মনে হয়েছে এটিতে বিবৃত ঘটনাবলি ৮৮ পৃষ্ঠার সীমাকে ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে বিশাল একটি আকাশে। সেখানে মুর্তজা মিরাজুল ইসলামের চোখে একটি ‘ক্লান্তিহীন পাখি’ অথবা ‘নার্সিসাস ফুলের উপর উড়ে চলা বর্ণিত প্রজাপতি’।

মুর্তজার সঙ্গে লেখকের পরিচয়ের পর্বটি যদিও বা ব্যক্তিগত; কিন্তু সেখানেও আমি খুঁজে পেয়েছি অন্য একটি গল্প। কীভাবে একজন নামী শিল্পীর সংস্পর্শে লেখক হতে চেয়েছেন অন্য এক মানুষ। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন কবি স্বপন দত্ত ও সত্যজিৎ গবেষক আনোয়ার হোসেন পিন্টুকে, যাদের মাধ্যমে তাঁর মুর্তজার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। বইটি দেখেই মন ভালো হয়ে যাবে রাসেল কান্তি দাসের করা মুর্তজার পোর্ট্রেটটির দিকে তাকালে। বইটিতে মুর্তজার আত্মপ্রতিকৃতি (তেলরং ২০০৩) ছাড়াও স্থান পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে ধারণকৃত মুর্তজার অমূল্য কিছু ছবি ও স্মারক সংগ্রহ এবং তাঁর আঁকা বিভিন্ন সময়ের ছবি যেমন, আমার পিতা (১৯৬৯), আমার মা (১৯৯২), যুই (১৯৭৫), ব্যালকনিতে দুই তরুণী (১৯৫৮), সিটিং ন্যুড (১৯৫৮) ইত্যাদি। লেখকের সঙ্গে সুদীর্ঘ ২০ বছরের পরিচয়ে কতটা সুগভীর ও স্মৃতিময় বইটি পড়লে যেকোনো পাঠক আশা করি অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। শিল্পী মুর্তজার জীবনের গল্পগুলো যেন বর্ণিল প্রজাপতির পাখার মতো, লেখককে ধন্যবাদ আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের তিনি নিয়ে গেছেন মুর্তজার জীবনের মোহময়তার কাছে। তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নানান রূপের কাছে। এমনকি প্রবাস জীবনে মুর্তজার নারীবন্ধু আকিলা কিংবা মারিয়া সবাইকে ছাড়িয়ে স্নেহশীল একজন বন্ধুসম স্বামী যার জীবনের একমাত্র ধ্রুবতারা ছিলেন স্ত্রী তুলু, লেখকের ভাষায় ‘মুর্তজার তুলু’। জানতে পেরেছি মুর্তজার কাছের মানুষ ড. আনিসুজ্জামান কিংবা মতিউর রহমান, অথবা মুর্তজার মূর্ত-বিমূর্ত ব্যাখ্যায় গর্বিত আরো অনেক গুণীজনের নানান স্মৃতিচারণ।

আমি বেশ চমৎকৃত হয়েছি যখন লেখক বশীরের গানের শুটিংয়ের দৃশ্যায়নটি তুলে ধরেছেন ‘মুর্তজার কালি ও কলম’ অংশে।

লেখক সবকিছু ছাপিয়ে যেন এক অন্য মুর্তজাকে ধরতে চেয়েছেন। যেই মুর্তজা ‘মানুষকে ঘৃণা করেন, ঘৃণা করেন বলেই, হয়ত তাদেরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেও জানেন’ (নার্সিসাসে প্রজাপতি, পৃষ্ঠা-৬৪)।

কী অদ্ভুত বৈপরীত্য, বারবার লেখক এই বৈপরীত্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন তার বইয়ের প্রতিটি ছত্রে। অবশেষে তিনি মুর্তজাকে পরিণত করেছেন এক জীবন্ত পাখিতে। যে পাখির ডানা নেই। তবুও যে পাখি তার কল্পনায় ওড়ে, অনেক বিস্তীর্ণ এক বর্ণিল আকাশে আর মুক্তির আস্বাদনে বারবার রং হাতে তুলে নেয়। এই পাখির ডানাগুলো তিনি ‘নার্সিসাসে প্রজাপতি’ বইয়ে এত সুন্দর করে এঁকেছেন বলে মিরাজুল ইসলামকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বইটি প্রকাশ করেছে অবসর প্রকাশনা। মূল্য ২০০ টাকা।