সাক্ষাৎকার

হুমায়ূন আহমেদ এখানে ‘ক্রেজ’ : বিতান সিকদার

Looks like you've blocked notifications!

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন লেখক-চিত্রশিল্পী-চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। চারিদিকে পড়ে গেল হাহাকার। কিশোর বিতানের মনে সংশয়-তবে কি তোপসে আর কিছু লিখবে না? কী করা যায়, ভেবে পায় না সে। এরপর চিন্তা করে বের করে, তাকেই হাল ধরতে হবে। তাকেই লিখতে হবে ফেলুদা। মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা মা, আমি যদি ফেলুদা লিখি, তাহলে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের লোকজন আবার কিছু মনে করবে না তো?’ মা হেসে বললেন, ‘নাহ্‌, ওঁনারা ভালো লোক। আমি বুঝিয়ে বলে দেব। তুমি লেখো।’ শুরু হলো লেখালেখি। সেই কিশোর বিতান, মানে বিতান সিকদার আজ পশ্চিমবঙ্গের একজন উদীয়মান গল্পকার। দেশ পত্রিকা যাঁরা নিয়মিত পড়েন, তাঁদের কাছে বিতান সিকদার নামটি নতুন নয়। এমনকি আনন্দমেলা, উনিশ-কুড়ি পত্রিকার শিশু-কিশোর পাঠকের কাছেও এ নামটি বড় প্রিয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার বাংলা প্রকাশনা ‘উদিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘একদিন এক দুপুরে...’। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষে তিনি নিযুক্ত আছেন সাংবাদিকতা পেশায়। কাজ করেছেন ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘ইকো অব ইন্ডিয়া’, টাইমস অব ইন্ডিয়ায়। বর্তমানে কর্মরত আছেন দ্য টেলিগ্রাফে। শক্তিমান এ গল্পকারের সঙ্গে একান্ত আলাপনে বসেন অঞ্জন আচার্য। কথোপকথনে উঠে আসে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের টুকিটাকি থেকে শুরু করে সাহিত্য-অনুরাগ, সাহিত্য-ভাবনা, সাহিত্য-চর্চা এবং বিদেশি সাহিত্যের পাশাপাশি দুই বাংলার সাহিত্যের গতিধারা।

অঞ্জন আচার্য : কেমন আছেন?

বিতান সিকদার : ঠাকুর বলেছিলেন, ‘রাখিস মা রসেবশে!’ পুরোটা না হলেও কিছুটা তেমনই থাকার চেষ্টা করছি।

অঞ্জন : আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে হলো, একটু বলবেন?

বিতান : আমাদের সবকিছুরই শুরুটা জুড়ে ছিল আশির দশক– আমাদের চোখ দিয়ে দেখলে বলা যায়, সুস্থির পৃথিবীর শেষ সময়। সেই সময় উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের যে গতানুগতিক দিনযাপন, আমরা তার মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি। কিন্তু কোথাও এই গতানুগতিকতা আমায় ব্যক্তিগতভাবে ভারি অস্থির করে তুলত। ফলত স্কুলের টাইমটা বাদ দিয়ে, বাকি বাড়িতে থাকার সময়ের অনেকটাই আমার ঢিপির মাঠে, পার্কের পুকুরের ধারে, রেললাইনের পাশে ঘুরে বেড়িয়ে কাটত। কখনো ইচিং-বিচিং খেলছি, কখনো পাড়াজুড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি, কখনো মাঠে ব্যাট-বল, কখনো গোল্লাচোর আবার কখনো বা সাইকেল নিয়ে এ-গলি সে-গলি। মা এত দুরন্তপনা সহ্য করতেন না (এখনো করেন না)। ওদিকে বাড়িতে এই নিয়ে নিত্য অশান্তি। দিন দিন বাঁদর হচ্ছি। এমন সময় বাবা একদিন বোঝালেন, ‘দ্যাখো, সারাক্ষণ বাইরে টইটই করাটাই খেলা নয়। ঘরে বসেও খেলবার মতো অনেক কিছু আছে।’

এদিকে, আমি ক্যারম থেকে শুরু করে লুডু-দাবায় হাত পাকিয়ে, বাগাডুলি-চায়নিজ চেকারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ভাবছি, আর এমন কী খেলা থাকতে পারে। তখন বাবাই একদিন বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন, ‘তুমি কি জানো, গল্প লেখাটাও একটা খেলা?’ বোঝালেন, ‘ধরো তুমি একটা লাইন লিখলে, পরের লাইনটা রাজা লিখল, তার পরেরটা সন্তু লিখল, তার পরের লাইন বাবান লিখল... আগের লাইনের খেই ধরে পরের লাইন লিখতে লিখতে দেখবে একটা সময় একটা গল্প দাঁড়িয়ে গেছে।’ ব্যাপারটা বেশ মনে ধরল। ক্রমে ক্রমে রাজা, সন্তু, বাবান রণে ভঙ্গ দিলেও আমি বেশ কিছু মাস ব্যাপারটা নিয়ে মজে রইলাম। ছোটদের আরব্যরজনী, নন্টে-ফন্টে, টিভিতে দেখা হিন্দি সিনেমা, এর-ওর কাছ থেকে শোনা ভূতের গল্প– সমস্ত মিলিয়ে জগাখিচুড়ি সব গপ্পো তৈরি হতে লাগল। প্রকৃত অর্থে লেখালেখির শুরু বলতে এটাই...

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ বুঝলাম, ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে। ফলে কাগজ-কলম ছেড়ে একটা সময় আবার মাঠ-ঘাট।

তারপর সেই বিশেষ দিন এলেঅ, ১৯৯২ সাল, ২৩ এপ্রিল। সত্যজিৎবাবু চলে গেলেন। আমাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। আর তোপসে কিছু লিখবে না। কী করি, কী করি... ভেবে দেখলাম, আমাকেই হাল ধরতে হবে। আমিই ফেলুদা লিখব। মাকে বললাম, ‘আমি লিখলে আবার সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের লোকজন কিছু মনে করবে না তো?’ মা হেসে বললেন, “নাহ্‌, ওঁনারা ভালো লোক। আমি বুঝিয়ে বলে দেব। তুমি লেখো।’ দ্বিতীয় দফা লেখালেখির শুরু এটা। বলা বাহুল্য, কিছু মাস পর সেটাও টেকেনি।

এরপর আস্তে আস্তে বড় হতে হতে আরো পড়াশোনা বাড়তে লাগল, বাড়িতে ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা আসত– সেগুলোর প্রতি একটা টান অনুভব করলাম। কীভাবে শব্দের মাধ্যমে বড় বড় সব লেখক নিমেষে আমাদের কত কিছু ভাবিয়ে তুলতে পারেন, সেটা ভেবে অবাক হতে শুরু করলাম। শেষে স্কুল ছাড়ার সময় মোক্ষম যুক্তিটি কানে বাঁধল, ‘সহিত-এর সঙ্গে ষ্ণ্য প্রত্যয় যুক্ত করে তবে সাহিত্য। সঙ্গে চলে যা, তাই সাহিত্য।’

সেই থেকে সঙ্গে চলার শুরু, আর আমার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও মৌলিক ছোটগল্পটি কলেজে উঠে লেখা।

অঞ্জন : আপনার বেড়ে ওঠার গল্পটি শুনতে চাই...

বিতান : আমার বেড়ে ওঠার পেছনে প্রথম ও প্রধান অবদান আমার মায়ের। আমার মুগ্ধ জননী আমায় বাঙালি করার চেয়ে বেশি মানুষ করে তোলায় মনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। আজ আমি যতটুকু হয়েছি, সেই নিরন্তর শাসনের জন্যই হয়েছি।

উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ায় আমাদের বাড়ি। আমরা বাড়িওয়ালা, আমাদের চোদ্দ-ঘর ভাড়াটে। আমার বেড়ে ওঠা পাড়া কালচারে। ঘন ঘন লোডশেডিং, গর্তে ভরা রাস্তা, দোতলা বাস, শহরজুড়ে মিটিং-মিছিল, সূর্যগ্রহণের সময় চোখের ওপর ক্যামেরার ফিল্ম নিয়ে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা– এই ছিল আমাদের ছোটবেলা।

পাড়ার পূজোয় খেলনা বন্দুকে ক্যাপ ফাটাতে ফাটাতে আমরা বড় হয়েছি। মহালয়ার ভোরে বাপির সাইকেলের দোকানে মাইকে মহিষাসুরমর্দিনী চালানো হতো। বীরেন ভদ্রর পাঠ শুনতে শুনতে আমরা সেই আধো আলোয় পাড়াময় লুকোচুরি খেলতাম– আমি এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে বড় হয়েছি।

আমার বাবার নাটক নিয়ে একটা প্যাশন ছিল। বাবা পাড়ায় আর নিজের অফিসে নাটক করতেন ফি বছর। আমি সেগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। প্রতি রোববার সকালে টিভিতে রামায়ণ-মহাভারত গোগ্রাসে গিলতে গিলতে আমি বড় হয়েছি।

যিনি অঙ্ক করাতেন, তিনিই ইতিহাস পড়াতেন– এমন ধুতি পরা মাস্টারমশাইয়ের হাতে বেতের বাড়ি খেয়ে আমি বড় হয়েছি।

আমার মায়ের যিনি মাস্টারমশাই ছিলেন, সেই বিভূতিবাবুর বাবা প্রমোদবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমি ইংরেজি আর অঙ্ক শিখতে যেতাম। তখন তিনি বৃদ্ধ-অশক্ত, চোখে ভালো দেখেন না। আতশ কাচ দিয়ে দেখে দেখে টেক্সট বই পড়াতেন আমায়। ইংরেজি কী করে লিখতে হয়, শেখাতেন। আমি সেই পড়াশোনাকে সম্বল করে বড় হয়েছি।

পরে মাধ্যমিকে স্টার পেয়ে পাস করি। স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হই। সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হই। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করি।

এখানে বলা যায়, পরীক্ষার পড়াশোনা করতে ভালো লাগত না বলে গ্র্যাজুয়েশনের পর ভেবেছিলাম এবার যতি টানব– গ্র্যাজুয়েট ছেলের ভাতের অভাব হবে না। মা রেজাল্ট বেরোবার পর আমায় টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দিলেন। সেদিন রাগ হয়েছিল। আজ বুঝি, ওই ডিগ্রিটা আমার প্রফেশনাল জায়গায় কী অপরিসীম ওজন বয়ে বেড়াচ্ছে।

মোটামুটি এই...

অঞ্জন : বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ কোথা থেকে পেলেন?

বিতান : আমার সাহিত্যের প্রতি প্রথম আগ্রহ জন্মায় শিক্ষাবিদ যোগেশরঞ্জন পাঠকের ক্লাস করে। স্কুলে আমাদের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। আমি বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র। ইংরেজি পড়াতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ওনার ক্লাসগুলো যখন করতাম, তখন থেকে ইংরেজির ভাষার একটা টান অনুভব করতে থাকি। পরে সিটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাছে দুই বছর পড়েছি। প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক। উনি শিখিয়েছিলেন কীভাবে ভাষাকে সরল ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলা যায়।

এ গেল তালিমের কথা। এ ছাড়া বলতে হয় আমার পরিবারের কথা। আমার বাবা সাহিত্যের ছাত্র। মা বিজ্ঞানের। আমাদের বাড়িতে পড়ার জিনিসের অভাব কোনোকালে ছিল না। যেমন ফেলুদা আসত, তেমনই কালকূটও আসত। যেমন টিনটিন কিনে দেওয়া হতো আমায়, তেমনই দেশ পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনও রাখা হতো। পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার ফলে বিভিন্ন লেখা আমায় পড়তে হয়েছে। এই বাংলা-ইংরেজি একসঙ্গে পড়তে পড়তেই আস্তে আস্তে ভালোলাগার জন্ম।

তারপর একদিন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘বর্ষায়’ বলে একটা লেখা পড়লাম। তাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘কবি বিধাতার ভ্রান্তিই।’ তা, কবি ভ্রান্তিই হোন বা অন্যকিছু। এই যে বিধাতার সঙ্গে কবিকে মিলিয়ে দেওয়া, এ ব্যাপারটা আমার বড় ভালো লেগেছিল। জয় গোস্বামী ব্যাপারটাকে আরো এনডোর্স করলেন। লিখলেন, ‘কবিই পারেন মিলিয়ে দিতে, দীপের পাশে অঞ্জনাকে...’। এই কবিকে আমি তামাম সাহিত্যিকের প্রতিভূ হিসেবে গণ্য করি। শেষে এলেন নজরুল। দিলেন আহুতি, ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে...!’ ব্যস! ধরে নিলাম সৃষ্টি এভাবেও করা যায়। সাহিত্যই স্রষ্টা বানাতে পারে। ভালোলাগা জাঁকিয়ে বসে গেল।

পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটলের ‘পোয়েটিক্স’ আমায় সাহিত্য অনুরাগী করে তুলেছে। এই যে যেটা ঘটেছে, সেটা বাস্তব বা ইতিহাস, কিন্তু সেটা থেকে যেটা ঘটতে পারত সেটা সাহিত্য– এই ‘থিয়োরি অব নেসেসিটি অ্যান্ড প্রব্যাবিলিটি’– এই ঘটিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমায় সাহিত্যের দিকে টেনে এনেছে, সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে।

অঞ্জন : লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন কোন লেখক আপনার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে? বা এখনো করে যাচ্ছে?

বিতান : লেখালেখি করব– এই প্রেরণা প্রথম পাই বঙ্কিমবাবুর লেখা পড়ে। ওনার লোকোহিত গ্রন্থের ‘বাবু’ প্রবন্ধটি পড়ে মনে হয়েছিল, একজন মানুষ মাত্র কিছুমাত্র শব্দ ব্যবহার করে কী অপরূপ সাবলীলতায় একটা বিষয়কে অসম্ভব হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন! শুরুতে রবীন্দ্রনাথ একেবারেই টানেননি। ক্লাস ওয়ান-এও ‘সহজ পাঠ’, ক্লাস ফোর-এও ‘সহজ পাঠ’। এতই সহজ তো পিছু ছাড়ছে না কেন। বড় হওয়ার পর বুঝলাম, এখন রবিঠাকুর পিছু ছাড়তে চাইলেও আমি আর ওনাকে ছাড়তে পারব না। এ ছাড়া শরৎবাবুর বর্ণনার মুনশিয়ানা প্রেরণা দিয়েছে। পরশুরাম অনবদ্য। কালকূট-এর কিছু রচনা লেখার তাগিদ হিসেবে কাজ করেছে। বনফুলের ছোটগল্প অসামান্য মনে হয়। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘পাঞ্চজন্য’ নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা– উনি না লিখলে, আমার কাছে সাহিত্যের মোড়কটাই খুলত না।

শিশুসাহিত্যের দিক দিয়ে দেখতে গেলে সুকুমার রায়ের ছোটগল্পগুলো আমার লেখার অনুপ্রেরণা। লীলা মজুমদারের লেখা পড়ে শিখেছি কীভাবে পাঠক-পাঠিকার সঙ্গে একাত্ম হতে হয়। আর অবশ্যই সত্যজিৎ রায়। কি ফেলুদা, কি শঙ্কু, কি তারিণীখুড়ো, কি ওনার লেখা ছোটগল্প– ওগুলো না পড়লে কোনোদিনও লেখার কথা ভাবতেও পারতাম না। এ ছাড়া আমি যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম, সেই ভাষা নিয়েও কিছু পড়াশোনা করতে হয়েছে। মিডল এইজে লেখা চসারের সাবলীল গল্প বলার ভঙ্গি ভালো লেগেছিল। তারপর রেনেসাঁসের সময় উইলিয়াম শেকসপিয়র, খ্রিস্টোফার মার্লো। শেকসপিয়র নিয়ে কিছু বলতে চাই না– যোগ্যতা নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, দুটো লোকের লেখা পড়ে আজও অবাক হই; এক রবীন্দ্রনাথ, আর দুই শেকসপিয়র। এ ছাড়া মিল্টনের স্যামসন অ্যাগনিস্টিস লেখার ধাঁচ নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। পরবর্তীকালে পোপের লেখা ভালো লেগেছে। কীটস্‌-কোলরিজের লেখার মধ্যে প্যাশনকে কীভাবে রচনায় বন্দি করতে হয়, সেটা বুঝতে শিখেছি। আরো পরবর্তী সময় জয়েস, বার্নার্ড শ– তারপর ইন্ডিয়ান ইংলিশে আর কে নারায়ণ– এঁদের লেখা পড়ে ভালো লেগেছে।

আর এক কবির নাম করতেই হবে, যিনি বিশেষভাবে আমার লেখার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে চলেছেন আজও। কালিদাস। আমি সংস্কৃত খুব একটা না বুঝলেও ওনার লেখা পড়ে বুদ্ধদেব বসুর কথা মনে পড়ে যায়, ‘কবিতা বোঝার নয়, বাজার জিনিস।’

অঞ্জন : আপনার লেখাগুলোর রসদ আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? এসব লেখায় ব্যক্তি আপনি কতখানি উপস্থিত আছেন? কোন লেখাটায় আপনার উপস্থিতি বেশি?

বিতান : খুব সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, আমার লেখার রসদ তিনটি বিষয়ে আবদ্ধ– মানুষ, অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি।

আমি খুব সচেতনভাবে ব্যক্তি আমিকে আমার লেখা থেকে দূরে রাখতে চাই। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে জোসেফ অ্যাডিসন আর রিচার্ড স্টিল নামে দুই ভদ্রলোক স্পেকটেটর বলে কিছু ছোট ছোট লেখা লিখেছিলেন। সেসব রচনায় একজন স্পেকটেটর কীভাবে নিজেকে বিষয়বস্তু থেকে একটা সুনির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে তৎকালীন সমাজ ও সমসাময়িক পরিস্থিতিকে হাস্যরসের মাধ্যমে পরিবেশন করছে– এটা শিক্ষণীয় ব্যাপার। ঠিক তেমনই, আমার লেখাগুলোতেও ব্যক্তি আমিকে, লেখক আমি সব সময় দূরেই রাখতে চেয়েছি। তবে আমার দেখা চরিত্র, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা আর আমার উপলব্ধি অবশ্যই আমার লেখার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে।

আর এই ‘অবজেক্টিভ পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকে একটা বিষয়কে দেখা– সাংবাদিকতা করতে করতে এ ব্যাপারটা এতদিনে কিছুটা তো আয়ত্ত হয়েছে...

অঞ্জন : পত্রিকায় কবে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে? শুরুটা জানতে চাই।

বিতান : আমার লেখা ছোটগল্প প্রথম টাইমস অব ইন্ডিয়ার বাংলা প্রকাশনা ‘উদিতা’ বলে একটি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। গল্পটির নাম ‘একদিন এক দুপুরে...’। সময়টা ছিল ২০০৯ সালের অক্টোবর মাস।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পরপরই আমি ‘ইকো অব ইন্ডিয়া’ বলে একটি ইংরেজি খবরের কাগজে সাব-এডিটর হিসেবে জয়েন করি। সেখান থেকে একটা ই-পাবলিশিং কোম্পানি, সেখান থেকে টাইমস অব ইন্ডিয়া, এরপর সেখান থেকে এখন দ্য টেলিগ্রাফ।

নিজের লেখা গল্প প্রকাশ করব, এমন চিন্তাভাবনা জাঁকিয়ে বসেছিল টাইমসে কাজ করার সময়। প্রসঙ্গত, টাইমস রেসপন্সের এডিটর বব রয়ের কথা এখানে না বললেই নয়। অত ব্যস্ততার মধ্যেও বব সময় বের করে আমার লেখা গল্পটি পড়ে সেটাকে ‘উদিতা’র জন্য মনোনীত করেছিলেন– এটা আমায় খুব অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

আর পরবর্তীকালে লেখা প্রকাশ পেতে থাকে, যখন আনন্দবাজার গ্রুপে জয়েন করি। এ ক্ষেত্রেও এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের কথা না বললে এ সাক্ষাৎকার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি দেশ পত্রিকার যুধাজিৎ দাশগুপ্ত। প্রবীণ সাংবাদিক অথচ আমার মতো নবীনের সঙ্গে অক্লেশে মেশেন। শুধু তাই নয়– আজ যদি আমি বিন্দুমাত্র লিখতে পারি বলে কোনো পাঠক বা পাঠিকা মনে করেন– সেটা সম্ভব হয়েছে যুধাজিৎদার জন্য।

অদ্ভুত শেখানোর ক্ষমতা ওনার। কখনই বলবেন না, কীভাবে গল্প লিখতে হয়। অথচ এটা বলবেন যে উনি একজন পাঠক হিসেবে কী ধাঁচের লেখা পছন্দ করেন। কীভাবে একটা লেখাকে সমৃদ্ধ করা যায়, কীভাবে পাঠক-পাঠিকার সাইকোলজি কাজ করে, কীভাবে প্রকাশ হৃদয়গ্রাহী হতে পারে, একটা বিষয়কে কত রকম আঙ্গিক থেকে ভাবা যেতে পারে– এ সমস্ত কিছু আমি যতটুকু শিখেছি, ওনার কাছ থেকেই শিখেছি।

আমার লেখালেখির শুরুটা জুড়ে যুধাজিৎদার অবদান। আশা রাখি, ভবিষ্যতেও উনি এভাবেই আমায় শেখাতে থাকবেন।

অঞ্জন : বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুনদের মধ্যে কাদের লেখা আপনার পছন্দ?

বিতান : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সর্বকালীন। তেমনই সত্যজিৎ রায়। তাঁরা আমার অতীত, বর্তমান জুড়ে আছেন আর ভবিষ্যতেও থাকবেন। এ ছাড়া এখনকার লেখকদের মধ্যে স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, উল্লাস মল্লিক ও আরো বেশ কয়েকজন রয়েছেন, যাঁদের বিভিন্ন সময়কার বিভিন্ন রচনা বেশ হৃদয়গ্রাহী।

অঞ্জন : বাংলাদেশের কবিতা-গল্প-উপন্যাস সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? কার কার লেখা ভালো লাগে?

বিতান : দেখুন, নজরুল আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন। আমি রবীন্দ্রনাথের মতোই ওনাকে কোনো দেশের গণ্ডিতে আটকাতে পারব না। উনি ইউনিভার্সাল। অমন কবিতাও আমি আর কোথাও পড়িনি, আর অমন গানও আমি আর কোথাও শুনিনি। এ ছাড়া গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, সেলিনা হোসেন, শওকত ওসমান রয়েছেন– যাঁদের শব্দচয়ন, প্রকাশ আমার ভালো লাগে, যদিও আমি তাঁদের কিছু কিছু লেখাই পড়েছি মাত্র। হুমায়ূন আহমেদ তো আমাদের এখানে ‘ক্রেজ’– উনি অসামান্য অভিব্যক্তির অধিকারী ছিলেন; শব্দ নিয়ে খেলা করতে জানতেন।

আপনার প্রশ্নে ‘মূল্যায়ন’ শব্দটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। আমি কোনোরকম বিনয় না করে বলতে চাই, আমি এখনো পর্যন্ত অতটা বোদ্ধা হয়ে উঠতে পারিনি, যাতে করে এই লেখক-কবিদের ‘মূল্যায়ন’ করতে পারি। আমি একজন সামান্য সাংবাদিক এবং কখনো সখনো ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করি– এই মাত্র। এই মূলধন নিয়ে মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

অঞ্জন : পশ্চিমবঙ্গের যে পরিমাণ বই বাংলাদেশে পাওয়া যায়, সে তুলনায় বাংলাদেশের বই পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায় না। এতে করে বাংলাদেশের অনেক শক্তিশালী লেখকদের লেখাও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। অনেক পাঠক বাংলাদেশি অনেক বড় বড় লেখকের নাম পর্যন্ত শোনেননি। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হতে পারে বলে আপনার অভিমত?

বিতান : মাঝে মাঝেই শুনি, এখন নাকি পাঠক-পাঠিকার সংখ্যা কমে আসছে। সেদিক থেকে বিচার করলে কী বলা উচিত– বই পাওয়া যাচ্ছে না, না বই পড়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না? ঠিক জানি না।

আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে মনে হয়, এ দেশে এখনো এমন বহু পাঠক-পাঠিকা আছেন, যাঁরা বাংলাদেশীয় সাহিত্য নিয়ে রীতিমতো খোঁজখবর রাখেন। দেশ পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে ওপার বাংলার বহু সাহিত্যিকের লেখা ছাপা হয়েছে। একাত্তরে শওকত ওসমানের উপন্যাস ছাপা হয়েছে। সেলিনা হোসেনের বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়েছে। এসব লেখক-লেখিকার বিভিন্ন বইও এখানকার বহু প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। তবে এটা ঠিক যে, আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। সেভাবে পড়ার চাহিদা যদি জন্মায়, তাহলে বই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। আর এখন ইন্টারনেটের যুগে, কোনো লেখক বা লেখিকার চাহিদা তৈরি হওয়ার জন্য মনে হয় না শুধুমাত্র বইই একমাত্র মাধ্যম।

অঞ্জন : অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের অনেক নবীন-প্রবীণ লেখকের ভালো ভালো লেখা পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা শারদীয় সংখ্যা তো দূরে থাক, সাধারণ সাহিত্য পাতায়ও প্রকাশিত হওয়ার জন্য মনোনীত হয় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ পত্রিকার সাহিত্য পাতা তো বটেই, ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যায় (ঈদ সংখ্যা) পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সবিশেষ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ বৈষম্য কেন বলে মনে হয়? এটা কি বাণিজ্যিক, নাকি রাজনৈতিক?

বিতান : যদি কোনো ভালো লেখা শুধুমাত্র তার লেখক বা লেখিকা বাংলাদেশীয় হওয়ার জন্য মনোনীত না হয়, তাহলে যাঁরা মনোনয়ন করছেন না, দুর্ভাগ্য তাঁদের। সাহিত্যের ইতিহাস এঁদের ক্ষমা করবে না।

তবে এ ক্ষেত্রেও বলব– আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, এর পেছনে প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে।

আমি আরো একটি কথা জোর গলায় বলতে চাই যে, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ববঙ্গের পাঠকসংখ্যা যে বেশি এবং ওপার বাংলার লোকদের মধ্যে সাহিত্য পড়ার চল যে এপার বাংলার লোকদের চেয়ে অনেকগুণ অধিক– এ সহজ সত্যটি সম্পর্কে এখানকার অনেকেই অবহিত। কয়েক মাস আগেই সমরেশ মজুমদার আনন্দবাজারে একটা লেখা লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। সেখানে খুব প্রাঞ্জল ভাষায় এ সত্যটি উঠে এসেছিল।

একজন আদর্শ সম্পাদকের জায়গায় যদি নিজেকে রাখি, তাহলে সেখানে দাঁড়িয়ে বলব– হয়তো তেমন সাড়া ফেলে দেওয়ার মতো লেখা হাতে আসছে না। মনে রাখবেন, ‘লেখা হচ্ছে না’ বলছি না কিন্তু ‘লেখা হাতে আসছে না’ বলছি।

আর বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, পড়ার প্রতি এই যে একটা ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা– প্রধানত এটাই মূল কারণ যে লেখক-লেখিকাদের কাছে এ এক বড় অন্ধকার সময়। এক্ষেত্রে পাঠক-পাঠিকা ও সম্পাদকমণ্ডলী– এই দুই তরফেই তোড়জোড় নেওয়ার সময় চলে এসেছে। এই নিঃসার ও ক্রমবর্ধমান অডিওভিজ্যুয়াল এন্টারটেইনমেন্টের হাত থেকে বেরিয়ে এসে বইকে আবারও বন্ধু করে তুলতে হবে। ভাষাকে তার মর্যাদা দিতে হবে। তাতে করে প্রকাশকের বাণিজ্যও হবে, লেখক-লেখিকার আত্মপ্রকাশও হবে, আবার পাঠক-পাঠিকার মধ্যে পড়ার প্রবণতাও জন্মাবে।

অঞ্জন : দুই বাংলাকে এক করে সাহিত্যের সম্মিলন কীভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? এ ক্ষেত্রে যদিও লিটলম্যাগগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। তারপরও...

বিতান : এটা ঠিক যে, দুই বাংলার সাহিত্য সম্মেলনে লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। আবারও বলতে চাই, পড়ার চাহিদা তৈরি হলে পড়ার জিনিস এখনো অনেক রয়েছে। আগে ইচ্ছেটা জন্মাক, সাহিত্য আপসে সম্মিলিত হবে।

অঞ্জন : সাহিত্য প্রসারে ব্লগ, ‍অনলাইন পত্রিকা বা ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো কতখানি ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?

বিতান : সত্যি বলতে কি, সাহিত্যপ্রসারে ব্লগ, অনলাইন পত্রিকা বা ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো বিশেষ অবদান রাখছে। দেশ-বিদেশের বহু লেখক-লেখিকার রচনা এখন অনলাইন পড়তে পারা যায়। এটা নিঃসন্দেহে ইন্টারনেটের একটা বড় অবদান। পাশাপাশি আপনি যেটা বললেন, যে পত্রিকায় মনোনীত হচ্ছে না– এ ব্যাপারটাকেও কিন্তু ইন্টারনেট দিয়ে অনেকটাই মেরামত করা যায়। তেমন তেমন রচনা ইন্টারনেটে প্রকাশ পেয়েছে এবং তারপর তার চাহিদা তুঙ্গে পৌঁছেছে– এ ঘটনার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ফলে পরবর্তীকালে রচনাটি বই আকারে ছেপে বার হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের বিভিন্ন অনলাইন পত্রপত্রিকায় বাংলা সাহিত্যের বিস্তার আরো একটু বেশি হলে যেন ভালো হতো। ব্লগই বলুন বা ওয়েব ম্যাগাজিন– বাংলা ভাষা সেখানে এখনো বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে। তাই আরো ভালো ভালো বাংলা লেখা আন্তর্জালে ছড়িয়ে দেওয়া হোক– এই আশা রাখি। তবে কতজন পাঠক-পাঠিকা ইদানীং তথাকথিত সাহিত্য পড়বার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করেন– এ তথ্যটি আমার জানা নেই। এদিকে ঝোঁক বাড়লে বোধহয় আখেরে সাহিত্যেরই লাভ হবে।

অঞ্জন : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

বিতান : নমস্কার!