অনুরাগ কশ্যপ কেন ভারতের তারান্তিনো
কোয়েন্তিন তারান্তিনো। সিনেমার দুনিয়ায় অনেক আগেই তাঁর নাম উল্কার বেগে ছড়িয়ে পড়েছে। যখনই কোনো ছবিতে হাত দিয়েছেন উপহার দিয়েছেন নতুন কিছু। বাউণ্ডুলে স্বভাবের হলিউডের এই নির্মাতা ও চিত্রনাট্য রচয়িতার ‘পাল্প ফিকশন’ (১৯৯৪) চলচ্চিত্রটি এখন নিউ ক্লাসিকের ক্লাবে ঢুকে গেছে। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড ও বিএএফটিএ অ্যাওয়ার্ড- সবই রয়েছে এই প্রভাবশালী নির্মাতার ঝুলিতে। তারান্তিনোর প্রভাব পড়েছে ভারতীয় চিত্রপরিচালক অনুরাগ কশ্যপের ওপরও। ‘দেব ডি’ থেকে ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ দেখলে মনে হবে বলিউডেই ছবি বানাতে শুরু করেছেন তারান্তিনো। অতএব উল্টো করে বললে অনুরাগকে তো ভারতের তারান্তিনো বলাই যায়! এই বলার পেছনে দশ কারণের কথা টপ ইয়াপসে তুলে ধরেছেন নবনীতা ধর। সেটাই হাজির করছি আপনাদের সামনে।
১০. গল্পটা বলতে পারেন জমিয়ে
তারান্তিনোর মতো অনুরাগও রুপালি পর্দায় গল্প বলায় ওস্তাদ। শুধু আবেগ নয় বুদ্ধিও যোগ হয় তাঁদের চিত্রনাট্যে। পুরনো কিছুকে নতুন করে উপস্থাপন করার দক্ষতা যেমন আছে তেমনি আছে নিজেদের কাজকে মাস্টারপিস বানিয়ে ফেলার ক্ষমতা। নগ্ন সত্য ও বিতর্কিত বিষয়কে উপজীব্য করার কারণে নানা সমালোচনার মুখে পড়লেও সর্বশক্তি দিয়ে গল্প বলার কাজটা তাঁরা করে যান। সেখানে তাঁরা মনোযোগ হারান না।
৯. সত্য বলতে লজ্জা কি
‘জ্যাংগো আনচেইনড’ (২০১২) ছবি যারা দেখেছেন তারা জানেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ ও দাসত্বের বিষয়টি তারান্তিনো তুলে এনেছেন রাখঢাক না রেখেই। ঐতিহাসিক সত্যকে নগ্নভাবেই উপস্থান করা হয়েছে এই ছবিতে। একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল এই চলচ্চিত্র। একই রকম ঝোঁক দেখা যায় অনুরাগের কাজেও। ভারতের গলিঘুপচি, সেখানকার ময়লা ও নোংরা এবং এর পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি তুলে ধরতে কোনো ধরনের প্রলেপ ব্যবহার করেন না ভারতের তারান্তিনো।
৮. যে চরিত্র ভোলা যায় না
তারান্তিনোর ‘পাল্প ফিকশন’ কিংবা ‘খেসোভোয়া ডগস’ ছবির অনেক চরিত্রই বহু দর্শকের মনে দাগ কেটে গেছে। অনুরাগের বেলাতেও এই সত্য খাটে। ভাবুন তো ‘ব্লাক ফ্রাইডে’ কি ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ ছবির কথা? এসব ছবির চরিত্রগুলো যেন মগজ থেকে বেরুতেই চায় না। দুই নির্মাতার চরিত্রদের মধ্যেই একটা লুকায়িত হাস্যরস থাকে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ডার্ক কমিকেল এলিমেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি খুবই সাধারণ আটপৌরে জিনিস তাদের কাজে হয়ে ওঠে অসাধারণ।
৭. বাণিজ্যেও আছি, প্রশংসাতেও
দুজনের ছবিই সমালোচকদের যেমন প্রশংসা কুড়ায় তেমনি বক্সঅফিস থেকে কুড়িয়ে নেয় কাড়িকাড়ি অর্থ। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর এমন দ্বৈত আগমন বিরলই বটে। কিন্তু তারান্তিনো ও অনুরাগের বেলায় দেখা যায় বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি বোদ্ধা ও সমালোচক মহলেও ইতিবাচক সাড়া জাগায় তাদের ছবি। হলিউড ও বলিউডে এই রকম নজির নেই বললেই চলে।
৬. প্রত্যেক ছবিতেই নতুন স্টাইল
বৃত্তের বাইরে কিছু করার জন্য যেন মুখিয়ে থাকেন দুজনেই। মূল ধারায় থেকেই প্রথা ভাঙেন তাঁরা। তাঁদের ছবি হলিউড বা বলিউড দুই জায়গাতেই নতুন কিছুর স্বাদ দিয়েছে প্রতিবার। সে হোক ক্যামেরা পরিচালনা কিংবা শব্দের ব্যবহার। চলচ্চিত্রের প্রত্যেক স্তরেই নতুন কিছু করার চেষ্টা তাঁদের মধ্যে দেখা যায়।
৫. ডার্ক হিউমার
সমাজে নিষিদ্ধ ও গোপন বিষয়াদি নিয়ে মশকরা করা দুই পরিচালকেরই এক অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে দুজনই বেশ কৌশলে ছবির সহিংস কিংবা ঘনিষ্ঠ কোনো দৃশ্যে হাস্যরস আমদানি করেন। কশ্যপের পুরস্কারবিজয়ী ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ ছবিতে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি।
৪. বৈশিষ্ট্যের নাম নিও নোয়া
ফরাসি এই নিও নোয়া শব্দ দুটির অর্থ নতুন কালো। চলিচ্চত্রে নোয়া মানে কালো বলে এক ধরনের জঁরা আগেই ছিল। জনজীবনের অন্ধকার জীবন ও রাতই প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে এসব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে। তো তারান্তিনো ও অনুরাগের কাজে ক্রাইম ড্রামা বা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপস্থাপিত হয় আধুনিক বিষয় ও আধুনিক ভিজুয়াল এলিমেন্টের মাধ্যমে। প্রথাবিরুদ্ধ ক্যামেরার ব্যবহার, আলো আঁধারির ব্যবহারে ব্যতিক্রমী চেষ্টা এঁদের আলাদা করে ফেলে অন্যদের চেয়ে।
৩. গল্প এক রৈখিক নয়
নন লিনিয়ার স্টোরি লাইনের জন্য তারান্তিনো বিখ্যাত। ঘটনার ক্রম একভাবে প্রবাহিত না হয়ে গল্পের ভেতর গল্প অথবা ফ্লাশব্যাক নানাভাবে গল্প বলতে পছন্দ করেন তারান্তিনো। ‘পাল্প ফিকশন’ বোধহয় তারান্তিনোর নন লিনিয়ার গল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আর অনুরাগের বেলা বলা যায় ‘গুলাল’ ছবির কথা।
২. ব্যঙ্গ
সমাজের নানা অসঙ্গতি বা ব্যক্তির নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যঙ্গ করার বিষয়টি প্রায়ই দেখা যায় তারান্তিনোর কাজে। অনুরাগও পিছিয়ে নেই এতে। তিনিও ঘটনা বা সংলাপের মাঝে মিশিয়ে দেন ব্যঙ্গ। তারান্তিনোর সঙ্গে অনুরাগের সমান্তরাল এই চলনই অনুরাগকে করে তুলেছে ভারতের তারান্তিনো।
১. নান্দনিক সহিংসতা
চলচ্চিত্রে রক্ত আর সহিংসতা ব্যবহারে দুই পরিচালকই সিদ্ধহস্ত তবে অন্যদের চেয়ে এঁরা যে জায়গায় আলাদা সেটা হলো নান্দনিকতায়। অর্থাৎ রক্তারক্তির ঘটনাকে উপস্থাপন ভঙ্গির মাধ্যমে এমন একপর্যায়ে নিয়ে যান এই দুজন, যে দেখলে মনে হয় রক্তক্ষয়ী ঘটনা ক্যানভাসে তুলে ধরছেন কোনো শিল্পী। ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’ বলি অথবা ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, আমরা দেখি ফাইটিং দৃশ্যে গানের ব্যবহার, ক্যামেরার স্লো মোশন ইত্যাদি। ‘কিল বিল ভলিউম ওয়ান’ ছবির কথা না বললেই নয়, এ রকম সহিংস ছবি খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তারপরও তারান্তিনো এই ছবিকে করে তুলেছেন নান্দনিক, চলচ্চিত্রের নানা কৌশল ব্যবহার করে।
শেষকথা
ভারতে নাচেগানে ভরপুর যে ফর্মুলা ছবি রাজত্ব করছিল সেই রাজত্ব বা একঘেয়েমির বাইরে অনুরাগ কশ্যপ বা ভারতের তারান্তিনো যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা হিন্দি ছবির দর্শকদের জন্য এক অন্য অভিজ্ঞতা বটে।