দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

তত্ত্ব আর জীবনে আকাশ-পাতাল পার্থক্য : হাসান আজিজুল হক

Looks like you've blocked notifications!

৭৫ বছর পেরিয়ে এলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর ৭৬তম জন্মদিন। অসামান্য গল্প-উপন্যাসের লেখক হাসান লিখেছেন বহু চিন্তামূলক প্রবন্ধ ও গদ্য। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক। কিন্তু দর্শন বিষয়ে তাঁর রচনা যেমন খুব কম, তেমনি এ বিষয়ে একাডেমিক পরিসরের বাইরে কথাও বলেছেন খুব কম। তাই দর্শনকেই কেন্দ্রে রেখে কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় মিলিত হয়েছিলেন কবি ও গদ্যকার সৈকত হাবিব। এর চুম্বক অংশ প্রকাশ হলো এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য। অনুলিখন করেছেন শাশ্বতী মাথিন।

সৈকত হাবিব : একটা সময় বলা হতো জ্ঞানকাণ্ডের সব কিছুর কেন্দ্রে আছে দর্শন। বিদ্যা বলতে দর্শনকেই বলা হতো। আর আজকের দিনে দর্শনেরই অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা। সেই ক্ষেত্রে এই একুশ শতকে এসে আমরা দর্শনের সংজ্ঞা কীভাবে দিতে পারি?

হাসান আজিজুল হক : ঠিকই আছে। দর্শন এবং বিজ্ঞানকে একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হতো, তার তো উদাহরণ রয়েছে। একেবারে দর্শনের যখন সূত্রপাত হয়েছে তখন থেকে। কারণ গ্রিকরা যখন দর্শনচর্চা শুরু করেছিল, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় সপ্তম শতাব্দী থেকে বলা যেতে পারে, তখন থেকেই বিষয়টি শুরু।

প্রথম দার্শনিক যাকে বলা হয়, তাঁর নাম হচ্ছে থেলিস। থেলিসের জন্ম ৬২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। থেলিস প্রথম কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন, পৃথিবীর মৌলিক উপাদান কী, যা দিয়ে এই পৃথিবীটা তৈরি হয়েছে? মৌলিক উপাদান নানা রকমের বস্তুতে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীটা এত বিচিত্র হয়েছে। কী সেই মৌলিক পদার্থ?

আমার মনে হয়,এই প্রশ্নের সঙ্গে সত্যেন বোস বা আইনস্টাইন- এঁরা যেসব প্রশ্ন করে পৃথিবীটাকে জানার চেষ্টা করেছেন, সেসবের মিল রয়েছে। কাজেই দর্শন, দর্শন হিসেবে কোনোদিন শুরুই হয়নি। এটা হলো প্রথম যুগের দর্শনের কথা। তারপর অন্য দার্শনিকরাও ওই থেলিসের পথেই এগিয়েছেন। ওই শেষ পর্যন্ত উপাদান কী? কী দিয়ে পৃথিবী তৈরি হয়েছে- এগুলোই।

সৈকত হাবিব : তার মানে বিজ্ঞানের পূর্বসূরি হলো দর্শন?

আজিজুল হক : বিজ্ঞানের পূর্বসূরি হলো দর্শন। অথবা দর্শনের সূত্রপাতই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে নিয়ে।

সৈকত হাবিব : আজকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে দর্শনের গুরুত্ব কি এখন আগের মতোই আছে? বা এর কি কোনো দরকার আছে?

আজিজুল হক : অবশ্যই দর্শনের দরকার আছে। কারণ মানুষের একটা বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। বিজ্ঞান আমাদের সব বিষয়ে জ্ঞানদান করে। কিন্তু কোনো সমগ্রতার ধারণা দেয় না। যেমন : বোটানি বৃক্ষরাজি, গাছপালা, উদ্ভিদজগতের সংবাদ আমাদের দেয়। প্রাণিবিজ্ঞান আমাদের জীবনের সংবাদ দেয়। পদার্থ, রসায়ন এগুলো আলাদা ভাগে ভাগ করে পৃথিবীর নানা ব্যাখ্যা করেছে।  বলছিলাম, গ্রিকরা শুরুই করেছে বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন দিয়ে। যাকে বলা যায়, আদি প্রশ্ন, যে বিশ্ব কী কী দিয়ে তৈরি? তারই জবাবগুলো খুঁজেছেন অন্যরা।

থেলিস বলছেন, পানি। তারপর এনেক্সিমেন্ডার বলছেন, বায়ু। নানাজনে নানা রকমের কথা বলেছেন। তার মধ্যে পিথাগোরাস বলছেন, নাম্বার থেকে তৈরি। আরেকজন দার্শনিক বলছেন, বিইং এন্ড নট বিইং। পৃথিবী অস্তিত্ব আর অনস্তিত্ব- এই দুই ভাগে বিভক্ত। এই অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের দ্বন্দ্বের ফলেই বিইং হয়। আর বিইংয়ের কোনো পরিবর্তন নেই।

দার্শনিক জেনো বলেছেন, কচ্ছপ আর একিলিসকে যদি একসঙ্গে দৌড়াতে দেওয়া হয়, তাহলে কচ্ছপও যখন পৌঁছাবে একিলিসও তখন পৌঁছাবে। একিলিস যতই দৌড় দিক না কেন। এই সময় আমরা প্রথম দর্শনের দ্বন্দ্বমূলক বিষয়টা বুঝতে পারলাম। বিইং আর নট বিইং সম্পর্ক ভাবতে শুরু করলাম। এই করতে করতে এনাক্সোগোরাস পর্যন্ত এসছে। এরপর দর্শনের বোধটা বদলে গেল সক্রেটিসের আমলে এসে, সোফিস্টদের আমল থেকে। তারা তখন বলল, বিশ্ব সংসারের খবর নিও না, সংবাদ নাও নিজের। নিজের সংবাদ নেওয়া বড় সাংঘাতিক জিনিস। আপন সত্তার খবর নাও। এটা ছাড়া অন্য কিছুর অর্থও নাই। সমস্ত দর্শনই হচ্ছে মানুষকেন্দ্রিক। তাই মানুষের সমস্যাটাই আগে দেখো। মানুষের অস্তিত্বটা কী সেটা দেখো?

এখানে সক্রেটিস কিছু জিনিস বলেছেন। সক্রেটিসের তো নিজের কোনো বইটই নেই। তিনি যা কিছু বলেছেন, সেটার সবই প্লেটো লিখেছেন সক্রেটিসের জবানিতে। আবার প্লেটো নিজে যে দর্শন দিচ্ছেন সক্রেটিসকেই তিনি প্রধান ভূমিকায় দেখছেন। সে জন্য আমাদের পক্ষে ধরা দুষ্কর হয়ে গেছে, কোনটা সক্রেটিসের নিজের কথা, আর কোনটা সক্রেটিসের জবানিতে প্লেটোর কথা। এটা আমরা এখন পর্যন্ত ভালো করে বুঝতে পারি না। এরাই মানবকেন্দ্রিক বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করলেন।

সোফিস্টদের কথাও বলা যায় এখানে। পৃথিবীতে মানুষ তো বাঁচতে এসেছে। যে কোনোভাবেই মানুষের বাঁচাটা হলো আসল কথা। কাজেই ম্যান ইজ দ্য মিরর অব অল থিংস। মানে মানুষই সব কিছুর পরিমাপক। এটা বলে তারা একটা নৈরাজ্যবাদ সৃষ্টি করলেন। ওদের অনুসারীরা বলল যে, মানুষ যা কিছু বলে বা ভাবে সেটাকেই ধরতে হবে। সেটাই চূড়ান্ত। অতএব একটা সোফিস্ট গোষ্ঠীও তৈরি হলো। তার্কিক গোষ্ঠী। এরা নানাভাবে তর্ক-বিতর্ক করে। প্রায় আমাদের আধুনিককালের আইনজীবীদের মতো। তারা নানা যুক্তি দিত। সবশেষ যুক্তি হলো প্রহারেও ধনঞ্জয়। লাগাও মার।

এই যে সোফিস্টরা এলো, এরা প্রথমেই দর্শনকে বিজ্ঞানের প্রশ্নগুলো থেকে একটু সরিয়ে নিয়ে এলো। সরিয়ে নিয়ে এলো মানুষকে। সক্রেটিস বললেন যে, পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র আমাকে একটুও টানে না। এখান থেকে আমার শেখার কিছু নেই। আমার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ। এই যা কিছু আছে, আমি বলব মানুষ আর তার জ্ঞানকে। আত্মজ্ঞানকে বলব। জীবনযাপনের সত্যকে বলব। কী হওয়া উচিত? কেবলই প্রশ্ন করে যাওয়া, ন্যায় কী? অন্যায় কী? কেবলই্ প্রশ্ন করে যাব নাগরিক অধিকার কী ইত্যাদি যে বিষয়গুলো মনুষ্যসমাজ সম্পর্কিত, ব্যক্তি মনুষ্যসংক্রান্ত।

এখন থেকে দর্শনের তিন-চারটা মৌলিক পরিবর্তন হলো মনুষ্য সম্পর্ক। এটা গ্রিকদের দর্শনের দ্বিতীয় ভাগ থেকে শুরু হয়েছে। এর প্রবর্তক সক্রেটিস। যদিও তিনি একটি বাক্য লিখে যাননি। তাঁর সমস্ত কথা আমরা পাই বিভিন্ন উৎস থেকে। সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে প্লেটো। এ ছাড়া আরো দু-একজন লেখক আছেন। এরিস্টোফেনিস বলে একজন নাট্যকার ছিলেন তিনি উল্লেখ করেছেন। আরো দু-একজন সক্রেটিস সম্বন্ধে কথা বলেছেন। তাঁদের ছাড়া সক্রেটিস সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতে পারতাম না।

সৈকত হাবিব : এই যে মানুষকে কেন্দ্রে রেখে দর্শনের যে নতুন বিজ্ঞান- এই বিষয়টি দর্শনের জন্য বা মানুষের জন্য কতটা কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হয়েছে?

আজিজুল হক : কল্যাণ-অকল্যাণের চেয়ে বড় বিষয় হলো, মানুষের জীবনে তো সব নেই। কাজেই দর্শন এটাও জিজ্ঞেস করে কল্যাণ বলতে কী বুঝবে? আর অকল্যাণ বলতেই বা কী বুঝবে? আগে কল্যাণ-অকল্যাণ ঠিক করো, তার পরে তো এর প্রয়োজন আছে কী নেই, সেটি নিয়ে ভাববে। এটা তো ঠিকই করা হয় নাই। কাজেই এটাও তো দর্শনে একটা মৌলিক প্রশ্ন হিসেবে রয়েছে। কল্যাণ কী? অকল্যাণ কী? কারণ একটু প্রশ্ন করলেই বোঝা যাবে কল্যাণ কার কথা বলছে। কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলছে। আমরা প্রায়ই একটি কথা ব্যবহার করি, যার কোনো অর্থ নেই। এটি হলো, ‘আমরা নষ্ট হয়ে গেছি’। আরে বাবা তুই নষ্ট হয়েছিস, না কি কেউ নষ্ট হয়েছে সেটা বল। আমরা নষ্ট হয়েছি মানে কী? এই ব্যাপারে চেতনা আরো জাগ্রত হওয়া উচিত। এই সমস্ত কথা যারা বলে তারা বোঝেও না এই কথাগুলোতে কী বোঝাচ্ছে। এই কথাগুলোর কোনো অর্থই নেই। আমাদের আরো সচেতন হতে হবে- এই বাক্যগুলো রাজনৈতিক নেতাদের মুখে লেগেই আছে। এই আপ্তবাক্যগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করার চেষ্টাটা দর্শন করবে। নিরন্তর প্রশ্নের সম্মুখে রাখতে হবে। এবং তা থেকে জ্ঞানলাভ করতে হবে।

এরিস্টটলের মতো মানুষ পৃথিবীতে কীভাবে জন্মালো সেটি এখনো পর্যন্ত বিস্ময়ের হয়ে রয়েছে। আড়াই হাজার বছর আগের এই লোকটা আমাদের চিন্তাজগৎকে এখনো ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। এখনো আমরা তাঁর চিন্তাজগতের আওতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।

এরিস্টটল বলেছেন, পলিটি কী? গোড়া থেকে দেখো। সবচেয়ে ভালোভাবে কীভাবে একটা রাষ্ট্র চলতে পারে, সেটা খুঁজে বার করো? তিনি তাঁর উত্তর দিয়েছেন, ভাগ করছেন। তখনকার যত সিটি স্টেট ছিল সবগুলোর শাসনতন্ত্র সাংবিধানিকভাবে আলাদা ছিল। উনি ৩২টি নগররাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র সংরক্ষণ করেছিলেন। পাশাপাশি তাদের বিচার করেছিলেন। করে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, শাসনতন্ত্রটাই হচ্ছে রাষ্ট্র। একটা রাষ্ট্র কেমন সেটি বুঝতে গেলে শাসনতন্ত্রটা বুঝতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে সবচেয়ে ভালো শাসন কী হতে পারে? তখন উনি অনেক ভাগ করেছিলেন। মনার্কি, এরিস্টোক্রেসি, রুল অব দ্য ফিউ- তিনটি জায়গা বলেছেন তিনি। একটা তাঁর প্রকৃত রূপ, আরেকটি তাঁর বিকৃত রূপ।

এরিস্টোক্রাসি ভালো, বিপরীত রূপ হলো অটোক্রেসি। এরপর হলো ডেমোক্রেসি তার উল্টো হচ্ছে মনোক্রেসি। সবচেয়ে ভালো হলো কনস্টিটিউশনাল রুল। অথবা আইনের শাসন। এটা নৈর্ব্যক্তিক। আইনটাকে প্রয়োগ করলে রাষ্ট্র ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে উনি একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন। সেই জন্য নাম দেওয়া ছিল কোয়ালিটি।

আমরা এখন পর্যন্ত আউড়ে চলি। আমরা যারা ভণ্ড আছি, তারাও আউড়ে চলি, যারা সৎভাবে চাই তারাও আউড়ে চলি। এই কোয়ালিটি মানেই গণতন্ত্র, মানে ডেমোক্রেসি।

সৈকত হাবিব : প্লেটোকে বলা হয় ভাববাদী। তবে নারী বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিটা খুব আধুনিক। তিনি বলেছিলেন, নারী-পুরুষের মধ্যে শারীরিক পার্থক্য ছাড়া তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এই যে তার চিন্তা, এটা কি অনেক অগ্রসর চিন্তা নয়?

আজিজুল হক : একে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সব গ্রিকই নারীকে মানবেতর জায়গায় জায়গা দিয়েছে। তাদের গণ্যই করেনি। এমনকি প্রজননের জন্য তাদের দরকার এটা পর্যন্ত মানার চেষ্টা করেনি। কারণ এথেনার জন্ম হচ্ছে জিওসের মাথা থেকে। এর জন্য কোনো যোনি দরকার হয়নি। তারা এ কথাও বলেছে, মানুষের স্বাভাবিক সঙ্গী হচ্ছে আরেকজন মানুষ। সে জন্য তৎকালীন গ্রিসে যে পরিমাণ সমকামিতা পুরুষদের মধ্যে ছিল, নারী-পুরুষের মিলন তার তুলনায় খুবই কম ছিল।

তাহলে প্লেটো যে কথাটি বলেছিলেন, যেহেতু কোনো পার্থক্য নেই, তাদের যদি একই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে তারা একই রকম প্রশিক্ষণ নেবে। তাই উনি বলেছিলেন কুকুর ও কুকুরীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই যদি শাসনের কাজ বলো, এটাতে কোনো কিছুই আসে যায় না, যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাই গ্রিকদের কাছে সাধারণভাবে নারীদের আসন অনেক নিচে। তাদের দোষ অনেক বলতে পারো। আবার তাদের অংশগ্রহণও অনেক বলতে পারো।

সৈকত হাবিব : দর্শন থেকেই জ্ঞানের উৎস বলা যেতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে প্রতিটি নিয়মেই দর্শন আছে। যেমন আমরা পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। পরিবেশ দর্শন। আমরা মন নিয়ে কাজ করছি মনোদর্শন। এইভাবে একেবারে নতুন যে নিয়মগুলো সেগুলোরও দর্শন হচ্ছে। এই যে প্রতিটি নিয়মের সঙ্গে দর্শন বলতে আরেকটি যে নতুন স্তর বা উপবিভাগটি থাকছে, এটি আসলে কী ব্যাখ্যা দেয়?

আজিজুল হক : এখন পৃথিবীতে কেউ কেউ এটা করছে। কিন্তু কথাটি হচ্ছে এই যে এই দর্শনের যে মূল জায়গাটি সেটা এখন করা হচ্ছে বলে নয়, চিরকালই ছিল। মূল জায়গাটা, মানে বিজ্ঞান দর্শন থেকেই এসেছে। এ কথা আমরা বলতে পারি। দেকার্ত সম্বন্ধে বলতে পারি। তিনি যেভাবে দর্শনটা এনেছেন, আমাদের সামনে তাতে করে বোঝা যায়, তিনি বাস্তব পৃথিবীকে বাস্তব হিসেবেই বলেছেন। এবং বাস্তবের ডায়নামিক বিষয়টিই তার আবিষ্কারের বিষয় ছিল। কারণ সাবসটেন্টকে তিনি দুটো ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে মেটার, আরেকটি হচ্ছে মাইন। এর মানে মাইনকে তিনি আলাদা করে ফেলেছেন। মানে, অনর্থক বিশ্বের কাজকারবারের সঙ্গে ঈশ্বরকে আর ঢুকিও না। একরকম নিরিশ্বরবাদী। কাজেই তখন, ওই সময় কেবল যন্ত্র পৃথিবীর তৈরি হলো সেটাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য উনি মেটার (মেটেরিয়াল)-এর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কাজেই দেকার্ত আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মদাতা। 

সৈকত হাবিব : একটু অন্য দিকে যাই, মোটা দাগে আমরা যদি পাশ্চাত্য, প্রাচ্যে দর্শনের একটি বিভাজন দেখি, এটা আসলে কী বা এর মৌলিক পার্থক্য কোথায়?

আজিজুল হক : এটা ঠিক যে পার্থক্যটা করা হয়ে থাকে। এবং পার্থক্যটা খানিকটা আছেও। ইউরোপিয়ান জীবনযাপনটা এ দেশের জীবনযাপনের চেয়ে অনেক কঠিন ছিল। অনেক সংগ্রাম করতে হতো মানুষকে। আবহাওয়া বিরূপ ছিল। ফলে তাদের দর্শনটা বাস্তবকেন্দ্রিক। তাদের যতটা তর্কের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে, আমাদের এখানে তার দরকার সেই অর্থে ছিল না।

আমাদের এখানে, তপোবনে জীবন। রাজা গিয়ে ঋষিকে বলে, ‌‘আপনার কিছু লাগবে?’ ঋষি বলে, লাগবে না। রাজা বলে, ‌‘কোনো কিছুর অসুবিধা নেই?’ বলে, না নেই। কারণ, আমি বনের মধ্যে থাকি, তো পাশেই একটা তেঁতুলগাছ আছে। গৃহিণী সেটা নিয়ে এসে ঝোল করে রান্না করেন। আর পাশে একটি জায়গা আছে সেখানে ধান লাগান। কাজেই বেশ তো। আমার ধান থেকে চাল হয়ে যাচ্ছে, আর তেঁতুলগাছ থেকে তরকারি। কাজেই আমার জীবন বেশ ভালো চলে যাচ্ছে। আই ডোন্ট নিড এনিথিং। এটি একটি মৌলিক পার্থক্য ভারতের জন্য।

তবে ইউরোপিয়ানদের জন্য জীবন ছিল অনেক স্ট্রাগলিং। বাঁচতে হবে; কোনো উপায় নেই। বিরূপ পৃথিবী। পাথর নিয়ে আয়। নিয়ে নিশ্ছিদ্র করে ঘর তৈরি করা। তাতেও বাঁচতে পারছে না। আগুন জ্বালিয়ে দেয় ভেতরে। এই কঠিন জীবনটা তাদের অনেক বেশি তার্কিক করে তুলেছে। বাস্তববাদী করে তুলেছে। খুব বেশি তর্কের মধ্য দিয়ে গেছে তারা। তাদের দর্শনের মধ্যে সেটা প্রকাশ পেয়েছে।

ভারতীয় দর্শনের মধ্য দিয়ে এলে অনেক শান্তি। বৌদ্ধদর্শনে যেমন নির্বাণ লাভ। সমস্ত কামনা থেকে তুমি মুক্ত হও, তোমার নির্বাণ হবে। তোমার পুনর্জন্ম হওয়ার আর দরকার নেই। মানুষ এই জন্মে কিছু ভালো কাজ, মন্দ কাজ করো। এই মন্দ কাজ তোমাকে আরেক জন্মে নিয়ে যাচ্ছে। তাই শুদ্ধ হতে হবে। শুদ্ধ হতে হতে সম্পূর্ণ যখন শুদ্ধ হবে তখন আর পুনর্জন্ম হবে না। ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। আবার নিরীশ্বরবাদীও নয়। তোমার আর জন্মই হবে না। তোমার মোক্ষ লাভ হয়ে যাবে। মোক্ষ লাভ হওয়ার পর তোমার আইডেনটিটি থাকবে কি থাকবে না, সে নিয়ে বৌদ্ধরা নানা ভাগে বিভক্ত।

সৈকত হাবিব : যদি বলি আমাদের এই এলাকায়, এমনকি যদি পশ্চিম এশিয়াতেও যাই বা পূর্ব এশিয়া, আর ভারত তো আছেই, তাহলে এখানে দর্শন কি কেবল ধর্মকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছে?

আজিজুল হক : তাহলে ধর্মকে একটু ব্যাখ্যা করতে হবে। ধর্ম হচ্ছে সেই সমস্ত মূল্যবোধ, যা মানুষকে একসঙ্গে ধরে রেখে দেয়, ধারণ করে; তাকে ধর্ম বলে। আমি যখন বলব আমি মুসলমান, একটি বোধ, একটি ধারণার মধ্যে আমি ঢুকে যাচ্ছি। তার মধ্যে ঢোকা মানে আমরা যে একই গোত্র, গা ঘষাঘষি, এই জিনিস তখন এসে যায়। তার পরেই হলো আমরা ধৃত হই একসঙ্গে।

আর বাকি যেটা আছে একে বলা যায় নাজিল হওয়া ধর্ম। যেগুলো আবার আরো অনেক কঠিন শর্ত দেয়। সেখানে ইসলামের মধ্যে আবার অনেক রকম ব্যাপার আছে। খ্রিস্টান-ইহুদিদের মধ্যে অনেক অন্য রকম ব্যাপার আছে। ভাগ হয়ে গেছে। কাজেই ধর্মের প্রধান যেই জিনিসটা, সেটা খুব ভালো জিনিস। মানবসমাজকে যা এক জায়গায় করে রাখে। এটা যদি ধর্ম মনে করো তাহলে তো আমি মনে করি, পাশ্চাত্যের যে ধর্মবোধ, আর আমাদের যে ধর্মবোধ- এর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। ওই পার্থক্যটুকু খালি রয়ে গেছে। এই যে নিশ্ছিদ্রতা এটা ওদের মধ্যে নেই। রিনানসিয়েশন বলতে কোনো জিনিস ওদের মধ্যে সেভাবে কাজ করেনি।

সৈকত হাবিব : যেমন ঋষি রাজাকে ফেরত দিয়েছে, ‘আমার কিছু লাগবে না’। এই বোধটা বা এই আত্মদর্শন- একে কি আমরা ধর্ম-উদ্ভূত বলব, আমাদের ক্ষেত্রে?

আজিজুল হক : তা হয়তো বলতে পারা যায়। তবে তা ঠিক এই লোকটি যে বলছে, এটা তো সমগ্র মনুষ্যসমাজের জন্য একটা আদর্শও স্থাপন করছে। শেষ পর্যন্ত মনুষ্যধর্ম সব ধর্মেই অভিন্ন। কিন্তু মুশকিল হয় কি, মানুষ এগুলোকে সব দেয়ালের মতো করে তৈরি করে। করে এক-একটা বৃত্ত তৈরি করে। এই দেয়াল আর পার হতে দেয় না। সেটা আমাদের দোষ। এতে ধর্মের কোনো দোষ নেই। এমনকি কার্ল মার্কসের মতো নাস্তিক মানুষও ধর্ম স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, ধর্ম যদি না থাকত তাহলে দরিদ্র কী করে বাঁচত? তার সান্ত্বনা কী করে মিলত? তার একটা বিশ্বাসের জায়গা থাকার ফলে সে বেঁচে থাকে। নয়তো সে উবে যাবে, থাকবে না।

সৈকত হাবিব : বাঙালির দর্শন আমরা অনেকেই বলি। এই জিনিসটি আসলে কী? বাঙালির নিজস্ব বা মৌলিক কোনো দর্শন কি আছে আদৌ?

আজিজুল হক : আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি এটি নিয়ে কাজ করতে। বাংলা দর্শন যদি নাও থাকে, তবে দেওয়া দরকার। এটা আবিষ্কার করতে পারলে আমারও প্রবর্তক হিসেবে নাম হয়ে যাবে! হা হা হা...

আমার এখন মনে হয় কি, এই মুহূর্তে গোটা বাঙালি সমাজ, পশ্চিম এবং পূর্ব মিলিয়ে অধরা সংস্কৃতির মোচন। আমার এই সম্বন্ধে অনেক লেখা আছে। ‘আমি  কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে’। এও তো একটা ধর্ম। যেমন : বৃহস্পতিবারে লাউ খেতে নেই। এটা হিন্দুদের একটা সংস্কার। এরপর স্বামী মরে গেলে একাদশের দিন উপবাস করতে হবে। কে এগুলো দিয়েছে? এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আন্দোলনও হয়েছে। পাঁচ বছরে বিয়ে দিয়েছে। ছয় বছর বয়স হতেই স্বামী মারা গেছে। এখন সেই ছয় বছরের শিশুটিকে সারা দিন না খেয়ে উপবাস করতে হবে। সে কি সেটা সইতে পারবে? এর জন্য বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন চালু করলেন বিদ্যাসাগর। উনি এক দিক থেকে কঠিন ছিলেন, এক দিক থেকে নরম। তাঁর গুরু ভাজস্পতি, তাঁকে ডেকেছেন তুই একদিন আসিস। তোর নতুন গুরুপত্নীকে দেখে যাস। খাওয়ার সময় গুরুবৌদি যখন এলো বিদ্যাসাগরের সামনে তখন তিনি দেখলেন যে ছয় বছরের একটি মেয়ে। আর গুরুর বয়স বোধ হয় প্রায় ষাট। উনি খাওয়াদাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। গুরু বললেন, কাঁদিসনে, কাঁদিসনে অমঙ্গল হবে। তিনি বললেন, ‘অমঙ্গলের আর বাকি কী মাস্টারমশাই। আপনার এখানে আমি অন্ন গ্রহণ করব না। কী করছেন আপনি এটা!’

সৈকত হাবিব : প্রচলিত একটি কথা রয়েছে চৈতন্য থেকে শুরু করে আমাদের যে বাউল ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম বা ধরুন আমাদের যে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন– এই সমস্ত গেঁজিয়েই কি বাঙালির দর্শন?

আজিজুল হক : যদি বলো গেঁজিয়ে, গেঁজালে কিন্তু তৈরি হবে মূত্র। অন্য কিছু করা যাবে না। তাহলে তোমার কথাটি কিন্তু ঠিক নয়। বাঙালির সেই প্রাণের কথাটা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এসেছে। রবীন্দ্রনাথও বোধহয় সেটিকেই তাঁর ধর্ম বলে মেনেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’ পড়ে দেখো, তাইলে বুঝতে পারবে। এটা কোনো রকম ঈশ্বরবিশ্বাস নয়, ও রকম প্রথা-বিশ্বাস নয়, পুজো-আর্চা এসব কিছু নয়। সেটা হচ্ছে, এক কথায় ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে অনুভব করা। পারলে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। তাঁকেই মনের মানুষ বলতে হবে। আমার মনের মানুষ যেরে, আমি কোথায় পাব তারে- গগন হরকরা বলেছেন। আর লালনের কথা, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?

এই যে কথাটা বলতে পারা, আমার মনে হয় বাঙালির মর্মগতভাবে বিষয়টি আছেই। কিন্তু এখান থেকে এখন বাঙালি, ওই বাঙালি, এই বাঙালি, যাকে বলা যায় এত বেশি পরিমাণে নানা জিনিস খেয়েছে এখন সে নিজেকে আর শনাক্ত করতেই পারে না। সে কে? সে কি ইউরোপের বাইপ্রোডাক্ট, না কি মিডেলিস্টের বাইপ্রোডাক্ট, কী সে? সে নিজেকে চিনতে পারে না। এখন আমি বলছি, বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালির ধর্মটাকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করো না।

আমি তো মনে করি বাঙালি এখন তার নিজস্ব পরিচয়টা প্রকাশ করে না। যেটা করতে চায়, সেটা খুব মিশ্রিত জিনিস। এতে ইউরোপ আছে, যুক্তরাষ্ট্র আছে, কিছু প্রাচ্য দেশ আছ, সব মিলিয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত বাঙালি তো। শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব সে হৃদয়কেই দেয়। বাঙালি হয়তো কখনো কখনো স্বধর্মচ্যুত হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু তো নিজেদের আছেই।

সৈকত হাবিব : জাতিসত্তা নিয়ে বাঙালির আত্মগর্বিতা, কখনো ছিল না। এটাও বোধ হয় তার দর্শন। তার নিজের ব্যাপারে উচ্চ কোনো স্বর নেই...

আজিজুল হক : বলতে গেলে, এই বিষয়টি কোনো জাতিরই নেই। জাতিত্ববোধ ওইভাবে কারো মধ্যে নেই। সামগ্রিকভাবে বুঝতে পারা যায় সেটা। পোশাকে-আশাকে নানা জায়গার। তবে জোরে ঘষা দিলে বোঝা যাবে যে গায়ের রংটা কালো। মানে আমি বলতে চাইছি যতই আমরা সিংহের চামড়া পরি না কেন, যতই ময়ূরের পেখম লাগাই না কেন সেগুলো মূলত ইউরোপ থেকে আমদানি। আর যুক্তরাষ্ট্রের যেই কদর্য জিনিসগুলো। অর্থাৎ মূল্যবোধের দরকার নেই। দর্শনের দরকার নাই। ভাবনার দরকার নেই, জ্ঞানের দরকার নেই। যা কাজে দেয় তাই গ্রহণ করো। এটাকেও দর্শন হিসেবে একটা নাম দেওয়া হয়েছে, প্রাগমেটিক দর্শন। ওরা এ জন্য কোনো রকম বুদ্ধিবাদ সমর্থন করে না।

হেমিংওয়ে বলতেন, আমি ভায়োলেন্সের পক্ষে। আমার মধ্যে কোনো রকম সফট কর্নার, মানবিক বোধ কাজ করে না। প্রেমও একটা ভায়োলেন্স, তার নরম জিনিস যেটা আছে সেও একধরনের ভায়োলেন্সের প্রতারণার রূপ। আবার অন্য দিকে দেখো, বিশাল পৃথিবী, বিশাল সমুদ্র। একজনই মানুষ লড়াই করছে, থামছে না। তাহলে মানুষ এক দিক থেকে লড়াই করে যাচ্ছে। এটাও একটা দৃষ্টিভঙ্গি বটে। সংগ্রামও আমাদের জীবনে একটা প্রধান অঙ্গ। সংগ্রাম করতেই হবে। আপসও করতে হবে। সংগ্রামও করতে হবে। সুচিন্তিত করে পারা যাবে না। একদিক থেকে বলতে পারো হৃদয়টা তার প্রধান বিষয়ও বটে।

বুদ্ধি নয়, হৃদয়টা বড় বিষয়। প্রায়ই সেটা আবার কুপ্রবৃত্তির দিকে নেমে যায়। কিন্তু সুপ্রবৃত্তির চর্চা, বুদ্ধির চর্চা অতটা না করে, বাঙালি বোধ হয় সেটাই করে থাকে আর কি। সে খুব আবেগ, কল্পনা, উপলব্ধির ওপর জোর দেয়। এটার ওপর সে বিশ্বাসও করে। আর যে কোনো জিনিস অতিশয় কঠিন সে মানতে চায় না।

তুমি বাংলা সিনেমাগুলো দেখো, যত ঝামেলাই হচ্ছে মিলনটাই শেষ। বাঙালি এতেই স্বস্তি পায়। তার আপাদমস্তক ট্র্যাজেডি দিয়ে ভরা। তার জীবন ট্র্যাজেডিময়, তবে ট্র্যাজেডিকে সে গ্রহণ করতে চায় না। সুখেই থাকতে চায়। তার দুঃখ নিয়ে সে সুখে থাকতে চায়। বিষয়টি মন্দ নয়! আমি বাঙালি হিসেবে নিজেকে খুব গর্বিত মনে করি। আমার মধ্যে অনেক রক্তের ভেরাইটি আছে। তুমিও যদি বলো তোমার মধ্যেও আছে। বেশ তো! অনেকের ভেতরে মিশিয়ে আমি আমার অস্তিত্ব বোঝাতে পারছি। আমি একে খুব খারাপ বলে দেখি না।

সৈকত হাবিব : বর্তমানে বাংলাদেশে এই যে নৈরাজ্য, ভোগবাদ, দুর্নীতি অর্থাৎ যত নেতিবাচক উপকরণ আছে, মানুষের মধ্যে তারই একটা প্রাবল্য চলছে। এরপর অনৈতিকতা, অন্যায় করা, আইনকে না মানা- এটাকে কি অন্য অর্থে আমাদের দর্শনের দারিদ্র্য বলতে পারি?

আজিজুল হক : দর্শনের দারিদ্র্য তো বটেই। অর্থনৈতিক জীবন তো আমাদের প্রত্যেককেই কাটাতে হবে। কিন্তু খুব ভোগবাদীকেন্দ্রিকতায় ধরেছে আমাদের। এই বিষয়টা আগে বাঙালিদের ছিল না। বহুদিন ধরে যদি আফিম খাওয়া হয়, একসময় জ্ঞান লোপ পাবে। এগুলো তারই ফল। এখন পণ্য আমাদের ভীষণভাবে গ্রাস করেছে। পণ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য কিন্তু এই বাজার প্রক্রিয়াতেই চালু করা। এটা না করলে পণ্য তৈরি হবে না। কাজেই এটা সৃষ্টি করা একটা কাম্যতা। পণ্যের জন্য যে কাম্যতা। এই কাম্যতাটা তৈরি করা হয়েছে। তৈরি না করলে পণ্যর প্রতি আমার অত প্রীতি থাকার কথা না। কিন্তু এখন সবকিছুই পণ্যের ভেতর পাওয়া যায়। যা চাই তা পাই। এটা এখন আমাদের পেতে হবে। এই যে পণ্যসংস্কৃতি সেটা আগে ছিল না। এবং এই পণ্যসংস্কৃতি থাকার ফলে মানুষ সব দিক থেকেই নষ্ট হয়েছে।

যারা পণ্যসংস্কৃতি বোঝে না, তারাও একটি জিনিস ঠিক করে নিয়েছে, কোনো জিনিস খুব সুন্দর করে তৈরি করবে, খুব আকর্ষণীয় করে তৈরি করবে, তবে তার স্থায়িত্ব যেন বেশি দিন না হয় এমন করে তৈরি করবে। যাতে করে আবার রিপ্লেস করতে হয়।

সৈকত হাবিব : ওই প্রসঙ্গেই রাষ্ট্রদর্শনের কথা আসছে। তার মানে রাষ্ট্রের দর্শনও এখানে খুব উল্লেখযোগ্য একটা বিষয়...

আজিজুল হক : অবশ্যই আছে। রাষ্ট্রেরও তো চরিত্র আছে। রাষ্ট্রেরও তো মালিকানার বিষয় আছে। কোনো জিনিস বেওয়ারিশ পড়ে থাকতে পারে না। একবার চিন্তা করো, বাংলাদেশের মালিক কে? তখন বলবে আগে খেয়াল করিনি তো? তখন হয়তো বলবে, জনগণই তো মালিক। আমি বলব আসলেই কি তাই? তুমি বলবে, কেন পার্লামেন্টারি শাষণ হচ্ছে। তখনো আমি বলব, আসলেই কি তাই?

পার্লামেন্ট হচ্ছে, কারা ভোট দিচ্ছে? পশ্চাৎদেশ মুক্ত যাদের তারা। যোগ্য নাগরিক হলে তবেই যোগ্য রাষ্ট্র তৈরি হবে। এটা তো আগে বিশ্বাস করতে হবে। এবং এই যোগ্য নাগরিক আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ যাদের হাতে ছিল, সবকিছু গিয়ে তাদের ওপর বর্তায়। কেন এই ৪৫ বছরে যোগ্য নাগরিক হলো না? কারণ, এই ৪৫ বছরে বাংলাদেশকে জনগণের জন্য তুলে দেওয়া হয়নি। তাদের স্লোগানে আঁকা হয়েছে, তারাই সব কিছুর মালিক- এটা বলা হয়েছে। তবে প্রায়ই সেটা ভণ্ডামির মতো করে বলা হয়েছে। জনগণ সবকিছু পারে।

তবে এক অর্থে জনগণ কোনো কিছুরই মালিক নয়। জনগণ শিক্ষার মালিক নয়, সংস্কৃতির মালিক নয়। বলছে হয়তো, শিক্ষা সবাইকে দেবে। কতটুকু দেবে? কারো কি বুকের পাটা আছে যে বলবে, বাংলাদেশের সমস্ত শিশুকে উচ্চশিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেব। ওই ধরনের নৈতিক বা দার্শনিক কোনো অবস্থা নেই।

রাষ্ট্রের তো একটা দর্শন, একটা লক্ষ্য থাকে। সে লক্ষ্যের মধ্যেও তো এটা নাই। লক্ষ্য ওই পর্যন্ত তো, সবাই স্কুলে যাক। কোনো রকম কমিউনিকেট যেন করতে পারে। যারাই এই দেশের শাসনে এসেছে তারা এটা করেছে।

সৈকত হাবিব : আপনি একটু আগে যে ভোগবাদ বা বাজার পৃথিবীর কথা বললেন, সারা পৃথিবীতে বণিকদের একটি আধিপত্য চলছে। বণিকদের রাজত্ব চলছে। এটা নিয়ে বলুন...

আজিজুল হক : বণিক বললে ছোট করা হবে। এটা বণিকতন্ত্রও ঠিক নয়। বাংলাদেশের তৈরি শার্ট যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায়। এগুলো আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। আমাদের জিনিস চীনে পাওয়া যাবে। ওরা যেটা করেছে সেটা হলো নেতৃত্ব তৈরি করেছে। যেখানে সত্যিকারের লাভজনক বিষয় রয়েছে। এগুলো হলো অস্ত্র নির্মাণ, যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ, বিমান নির্মাণ। এই সব কাজগুলো ওরা করেছে। কিংবা কোটি কোটি ডলার সাহায্য দিচ্ছে-এভাবে ওরা করছে।

ছোটখাটো পণ্য ওরা এখন আর নিজেরা তৈরি করছে না। এগুলো এরা অন্য দেশগুলোকে পাঠিয়ে দিচ্ছে, কিংবা পুঁজিটা সেখানে ঢালছে। এরপর তারও পুঁজিবাদী কৌশলকে বদলে দিচ্ছে। পণ্য দর্শনকে ওরা বদলে দিচ্ছে।

সৈকত হাবিব : এর গন্তব্য কোথায়?

আজিজুল হক : গন্তব্য হচ্ছে নিশ্চিত অন্ধকার সভ্যতার দিকে।

সৈকত হাবিব : দর্শন পৃথিবীতে কল্যাণ-অকল্যাণ অনেক মতবাদই তৈরি করেছে। দর্শনের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ বিষয়টি নিয়ে কিছু বলুন।

আজিজুল হক : চোরা কবে ধর্মের কাহিনী শোনে? হা হা হা.... । কিছু ভালো লোক আছে তারা বড় বড় কথা বলে দেয়। তারা যে কথা বলে সে কথা শুনলে পৃথিবীটা স্বর্গ হয়ে যেত। ওই আচরণ তুমি অন্যের প্রতি করবে না যেই আচরণ তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো না। একজন বলছেন, মিথ্যা বললে যদি লাভ হয়, সত্য বলব কেন? তবে সত্য কেন বলতে হয় এর উপলব্ধিটা আসতে হবে। এর উত্তর স্তরে স্তরে যেতে যেতে একসময় দেখবে উপলব্ধি হবেই। সত্য ছাড়া পথ নেই।

সৈকত হাবিব : আপনি নিজে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে দর্শনের অধ্যাপনা করেছেন এবং আপনি যখন কথা বলেন, তখন আপনার দার্শনিক জায়গা আমরা প্রবলভাবে পাই। কিন্তু আপনার লেখার মধ্যে এর খুব অভাব। দর্শনভিত্তিক লেখা নাই বললেই চলে। এটা কেন?

আজিজুল হক : কত লিখব? অত আর পারব না। সক্রেটিস লিখেছি। মার্ক্সীয় দর্শন লিখেছি। আগ্রহ জেগেছে, তবে ততধিক প্রয়োজন বোধ করেছি সৃষ্টিশীল লেখার।

সৈকত হাবিব : ওই অর্থে একাডেমিক লেখা যাকে বলে সেটা কি আপনি ইচ্ছে করেই করেননি? আপনার কি মনে হয়েছে এসব সৃষ্টিশীল লেখাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে?

আজিজুল হক : ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। সময়কে নষ্ট করবে। কারণ সময় তো কম, জীবন ছোট।

সৈকত হাবিব : একজন লেখক হিসেবে আপনার নিজের দর্শন কী?

আজিজুল হক : দর্শন বলতে বললে বলব, পরকাল নয়, পুনর্জন্মও নয়। এই দুনিয়াতে আমরা যে কংক্রিট লাইফটা পাচ্ছি সেটাই সবচেয়ে নগদ বলে ধরে নাও। এবং এটাকে সত্যি বলে যত রকমভাবে বিকাশ করতে পারো, ভোগ করতে পারো সেটা করো। জীবনটা নিস্পৃহভাবে কাটিও না। কারণ তোমার প্রাপ্য হয়েছে নগদ। জন্মের পর কী হবে জানো না। মৃত্যুর পর কী হবে যতই আন্দাজ করো না কেন, জানো না। কাজেই মাঝখানটা হচ্ছে একমাত্র জীবন। কারণ মানুষের জীবন হচ্ছে একমাত্র অধ্যায়ন এবং চর্চার বিষয়। এবং সেই জীবনটা নানা পরিস্থিতির।

জীবনের ক্ষয়ক্ষতিগুলোর কারণে যে সমাজ পরিপ্রেক্ষিত গড়ে উঠেছে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাহলে একটা বদলের দরকার। এই কথাগুলোই আমার লেখায় পাবে।

সৈকত হাবিব : আপনি সচেতনভাবে আপনার রচনায় দর্শনের কোনো তাত্ত্বিক প্রয়োগ করেছেন কি? আপনি দর্শনের ছাত্র, দর্শনের অধ্যাপক। কখনো কি এমন মনে হয়েছে যে, এই বা ওই দর্শনটা আমার এইভাবে প্রয়োগ করা দরকার। লেখার মধ্যে এটা আসুক?

আজিজুল হক : লেখার মধ্যে মানবিক ব্যাপার উঠেছে। মানবিকের মধ্যেই থাকুক। সেখান থেকে যদি কোনো দর্শন উঠে আসে তাহলে বলতে পারো এই লোকটি মানবদর্শনে বিশ্বাস করেছে।

সৈকত হাবিব : আপনার যে চিন্তামূলক লেখা সেটার মধ্যে আমরা সব সময় কিছু না কিছু পাচ্ছি। সেটাকে দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যাও করা যায়। কিন্তু সেটা কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্ব ধারণ করে না...

আজিজুল হক : আমি তো তত্ত্বের পক্ষপাতী নই। তত্ত্ব আর জীবনে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই যে এত তত্ত্ব দিয়ে গেল দেকার্ত, তাকে জীবনযাপনের জন্য চাকরি নিতে হলো সুইডেনে? একজন রানিকে পড়াতে হবে। সে রানির অভ্যেস ছিল ভোর তিনটের সময় উঠা। ওই সময় তার পাঠ গ্রহণের সময়। আর দেকার্তের ছিল বুকের অসুবিধা। কাজেই ওই ভোরে এভাবে যেতে যেতে একসময় মাত্র ৫০ বছর বয়সে মারা গেলেন তিনি। দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটানো আর কি। সবারই এক। প্রত্যেকেরই তাই। কেউই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি। কান্ট বলেছেন, আমি বিয়ে করতে পারলাম না। বিয়ে করতে আমার ইচ্ছাই হয়নি। একটা মেয়ের সঙ্গে প্রায় ঠিকই হয়ে গিয়েছিল বিয়ে। পরে আমি দেখলাম যে একজন মহিলাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসে তার যে ভরণপোষণের সঙ্গতি দরকার, সেটা জোগাড় করতে পারব না। কাজেই বিয়ে করাটা আর হলো না। তিনি নিজের চিকিৎসা নিজে করতেন।

সৈকত হাবিব : বর্তমান পৃথিবীতে ভাষাদর্শনের ব্যাপক জোয়ার চলছে। ভাষাকেন্দ্রিক দর্শনের এই আধিপত্যের কারণ কী?

আজিজুল হক : আমাদের দেশে একটি কথা আছে, নাই কাজ তো খই ভাজ। ওদের হয়েছে তাই। সামাজিক প্রয়োজন তেমন কিছু নাই। করারও তেমন কিছু নাই। কী করবে বলো। এখন ওরা আর বিপ্লব করব, দারিদ্র্য দূর করব বলতে পারে না। কিন্তু সেই চিন্তাশীল মানুষ তো আছে। কাজেই সেই চিন্তাশীল মানুষ প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। বসে আছিস কেন, কিছু একটা ভাব। যারা প্রকৃত ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছে একে পরবর্তীকালে ভাষাদর্শন বলেছে। এবং নানা তত্ত্ব এনেছে।

পোস্ট মডার্নিজম, পোস্ট কলোনিয়ালিজম...। এতে করে সত্যি সত্যি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি হচ্ছে কি না তা বলতে পারছি না। ক্রিটিসিজম বলে কিছু নাই। চিরকাল টেক্সট থাকবে। অর্থের নাম থাকবে না।

সৈকত হাবিব : পৃথিবীর একমাত্র প্রায়োগিক দর্শন মার্ক্সীয় দর্শন। এটা অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গাতেই কমিউনিজমের নতুন জাগরণ বা পঠন-পাঠন দেখতে পাচ্ছি, এটা কি নতুন কোনো পৃথিবীর দিকে ইঙ্গিত বহন করছে?

আজিজুল হক : আমি কোনো দিনই মার্কস আওড়াইনি। আমি বলেছি দেখো, সমাজে ধনবৈষম্য যত কাল আছে, তখন সমাজে একটা অন্তনির্হিত দ্বন্দ্ব থাকবে। সেই দ্বন্দ্বগুলো কাজ করবে। করতে করতে কোনো একদিন আসতে পারে একটা ভয়ংকর রকমের উত্থান। তাতে হয়তো সেই বৈষম্য অনেকটা লোপ পাবে। সুতরাং আমি বারবার বলি, যদি বাঁচতে চান, বৈষম্য এত বেশি রাখবেন না। এটি কমিয়ে নিয়ে এলে বিপ্লবের আশঙ্কা কমবে। আর বিপ্লব হতে চাইবে না।

সৈকত হাবিব : শেষ একটা প্রশ্ন, ধরুন আপনাকে প্লেটো কথিত দার্শনিক রাজা করে দেওয়া হলো, কী করবেন?

আজিজুল হক : আমি এটা গ্রহণই করব না। রাজা তো হতেই চাইব না, পারলে এমনকি প্রজাও হব না। হা হা হা...