আইনস্টাইনের ১৩৫তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণ

রবীন্দ্রনাথের সাথে আইনস্টাইনের সাক্ষাৎ

Looks like you've blocked notifications!
বার্লিনে দেখা হয়েছিল আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের। ছবি : ব্রেইন পিকিংস

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। দুনিয়ার অনেক বিষয়েই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। নতুন সব আঙ্গিক থেকে বিজ্ঞানকে বিশ্লেষণ করেছেন। দিয়েছেন নতুন দর্শন। আজ ১৪ মার্চ দার্শনিক এই বিজ্ঞানীর জন্মদিন। 

১৮৭৯ সালের আজকের দিনে জার্মানিতে জন্ম নিয়েছিলেন আইনস্টাইন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলা সাহিত্যের মহীরূহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ এবং কথোপকথন পর্ব তুলে ধরা হলো। 

১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই জার্মানির বার্লিনে দেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আলবার্ট আইনস্টাইনের। নানা বিষয় নিয়ে সেই সময় আলাপ করেছিলেন এই দুই মহাত্মা। তবে এই আলাপে ঘুরেফিরেই এসেছে মানব, মানবতা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিশ্ব ও সত্য। মানুষের অস্তিত্ব নিরপেক্ষ সত্য বিরাজ করে কি না অথবা সৌন্দর্য মানুষের চিন্তা ব্যতিরেকে সুন্দর হয়ে উঠতে পারে কি না - এমন সব দার্শনিক বিষয় নিয়ে তর্কে মশগুল হয়ে যান এই দুই বিশ্বমানব। সেই আলাপেরই কিছু অংশ ব্রেইন পিকিংস থেকে ভাবানুবাদ করে তুলে ধরা হলো এখানে।  
 
আইনস্টাইন : আপনি কি পৃথিবীর ঐশ্বরিক ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করেন?

রবীন্দ্রনাথ : আমার মনে হয় ব্যাপারগুলো পৃথিবী থেকে ঠিক বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। মানুষের ব্যক্তিত্ব কিন্তু অমর। মানুষ মরে গেলেও তার স্মৃতি এবং কাজ থেকে যায়। এই মহাবিশ্বের মূল সত্যি হচ্ছে মানুষ। ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করার জন্য আমি একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। ব্যাপারটা হলো প্রোটন এবং ইলেকট্রনের মিশ্রণের মতো। এদের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটা থাকে সেটা কিন্তু বিষয়টাকে খাঁটি করে তোলে। সেভাবেই মানবতা আসলে আলাদা আলাদা মানুষের সংমিশ্রণ। মানুষের সাথে মানুষের আন্তসম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে মানুষ বেঁচে থাকার জোরটা পায়, আনন্দ পায়। আমি এই চিন্তাটাই সব সময় ধারণ করেছি আমার শিল্প, সাহিত্য এবং ধর্মীয় সচেতনতার ক্ষেত্রেও। 

আইনস্টাইন : মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে দুটি আলাদা ধারণা চালু রয়েছে : (১) একক বিশ্ব নির্ভর করছে মানবতার ওপর, (২) বাস্তবতার বিচারে বিশ্ব মানবিক বিষয়াদির ওপর নির্ভরশীল নয়।

রবীন্দ্রনাথ : যখন মানুষের সাথে মহাবিশ্বের একটি তুলনা চলে আসে, তখন আমরা সত্যটা বুঝতে পারি এবং সত্যই আসলে সুন্দর। 

আইনস্টাইন : এটাই আসলে মহাবিশ্বের মূল ধারণা। 

রবীন্দ্রনাথ : অন্য ধারণাও রয়েছে। বিশ্বটা আসলেই মানুষের। মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ধারণাটাও মানবিক বিজ্ঞানের। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শাশ্বত মানবগুণাবলিই ধারণের চেষ্টা করি। 

আইনস্টাইন : এই ধারণাটা মানবসত্তার।
 
রবীন্দ্রনাথ : হ্যাঁ, শাশ্বত সত্তার। এই বিষয়গুলো আমরা অনুভব করি আমাদের আবেগ এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আমরা একজন মানুষকে কখন ক্ষমতাধর মনে করি। যখন সে আমাদের ক্ষমতার বাইরেও কাজ করার দ্ক্ষতা বা যোগ্যতা অর্জন করে। বিজ্ঞান সে বিষয়গুলোকেই বিশ্লেষণ করে যেগুলো মানুষ আগে থেকে জানে না বা ধারণা করতে পারে না। এগুলো মানব সত্যের নৈর্ব্যক্তিক বিষয়। ধর্ম এই বিষয়গুলোকে অনুভব করতে শেখায় এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে একে মিলিয়ে বুঝতে শেখায়। ফলে আপনি আরো গভীরে গিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার আগ্রহ বোধ করেন। সত্যের মাধ্যমে ধর্ম একটা মূল্যবোধ তৈরি করে। আর ধর্মের মাধ্যমে সত্যের সাথে আমাদের যোগাযোগ তৈরি হয়। 

আইনস্টাইন : সত্য ঠিক আছে। সৌন্দর্য কি মানবতার বাইরে স্বতন্ত্র উপাদান নয়?

রবীন্দ্রনাথ : না। 

আইনস্টাইন : ধরেন যদি পৃথিবীতে মানুষই না থাকে, তাহলে অ্যাপোলো বেলভেদেরও (পাথরে খোদাই করা বিখ্যাত ভাস্কর্য) আর সুন্দর থাকে না।

রবীন্দ্রনাথ : না, আমার তা মনে হয় না।
 
আইনস্টাইন : আপনার সৌন্দর্যের সংজ্ঞার সাথে আমি একমত কিন্তু সত্য বিষয়ে আপনার ধারণার সাথে আমি একমত নই। 

রবীন্দ্রনাথ : কেন? সত্য তো মানুষের ওপরই নির্ভর করে। 

আইনস্টাইন : আমি হয়তো যুক্তি দিয়ে আমার দাবি প্রমাণ করতে পারব না। কিন্তু এটা আমার বিশ্বাস।   

রবীন্দ্রনাথ : পৃথিবীর সৃষ্টি এবং বিবর্তনের মধ্যেই এর সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। আর জাগতিক চিন্তাভাবনার মূলে রয়েছে সত্য। আমরা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের ভুল এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিখি। সেই সাথে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতাও কাজ করে। আমরা চারপাশ দেখে সত্য সম্পর্কে ধারণা নেই। না হলে আমরা কীভাবে সত্য বুঝতে পারি?

আইনস্টাইন : আমি আমার বিশ্বাসের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না। সত্য হচ্ছে মানবতার এক আলাদা সত্তা- আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমি মনে করি জ্যামিতিতে পিথাগোরাসের সূত্র হচ্ছে সত্য। মানুষের স্বাধীন সত্তার যদি আলাদা কোনো বাস্তবতা থাকে, তাহলে তার আলাদা একটি সত্য রয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ : সত্য হচ্ছে বৈশ্বিক বিষয়। সত্যিকারের মানুষ হতে গেলে সত্যের সাথে পরিচিত হতে হবে। তা না হলে আমরা একেকজন যদি আলাদা আলাদাভাবে সত্যের সংজ্ঞা দিই তাহলে কি সেটা বিশ্বাসযোগ্য কিছু হবে? সবার কাছে সত্যের ব্যাখ্যাটা তখন আলাদা হবে। সত্যকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর সেটা করা যাবে যুক্তি দিয়ে। আর চিন্তাভাবনা করার মতো সামর্থ্য তো মানুষের রয়েছেই। মানুষ তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কাজে লাগিয়ে চিন্তা করে। ভারতীয় দর্শনে ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণ হচ্ছে পরম সত্য। সেটা ধর্ম, জাতি বা বর্ণ ভেদে আলাদা হবে না। মানুষের মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, সেটাই সবার কাছে সত্য হবে। মানুষের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, মানুষ সেই সত্যগুলো বিশ্বাস করবে। এটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো খুব মুশকিল। এটা আসলে বিশ্বাসের ব্যাপার। মানুষ যেটা দেখে আসছে সেটাই তার কাছে সত্য আর বাকিটা মায়া বা ঘোর বলতে পারেন। 

আইনস্টাইন : মানে আপনি বলতে চাইছেন যে, আপনার কথাটা হয়তো ভারতীয় ধারণা থেকে এসেছে যে, মানুষের নিজস্ব ভ্রম বলে কিছু নেই, এটা আসলে পুরো মানবতারই একটা ঘোর বা মায়া? 

রবীন্দ্রনাথ : বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীরাও কিন্তু নিজেদের জাতের বা দলের প্রতিনিধিত্ব করে। তারাও কিন্তু মানবতার অংশ। এদের ছাড়া মানবসভ্যতা গড়ে উঠতে পারত না। এই সবকিছুকে নিয়েই মানবতার সত্তা গড়ে উঠেছে। ভারতীয় বা ইউরোপিয়ানদের জন্য আলাদা কোনো সত্য থাকতে পারে না। সত্য সবার কাছেই এক, একই রকমের বিশ্বাস আমাদের মাঝেও রয়েছে, সেটাই মানবতার মূল্যবোধ।

আইনস্টাইন : আমরা জার্মানরা প্রজাতি বলতে সব প্রাণীকেই বোঝাই। এর মধ্যে ব্যাঙ আছে, বানরও আছে। 

রবীন্দ্রনাথ : বিজ্ঞানে আমরা বেশকিছু যুক্তির ভেতর দিয়ে যাই। যেটা মানুষের ব্যক্তিগত ভাবনার সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যায়। এই ছাড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কিন্তু বিজ্ঞান মানবতার সত্যটা তুলে ধরে। বিজ্ঞানকে জানলে আপনি মানবতার সত্য উদঘাটন করতে পারবেন সহজে।  

আইনস্টাইন : মুশকিলটা হচ্ছে সত্য কি আমাদের সচেতনতার বাইরেও আলাদা সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কি না?

রবীন্দ্রনাথ : সত্য হচ্ছে বৈষয়িক এবং নৈর্ব্যক্তিক বিষয়গুলোর মধ্যে একটা যৌক্তিক সঙ্গতি।  দুটি বিষয়ই কিন্তু মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। 

আইনস্টাইন : এমনকি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরা যেসব জড় পদার্থ ব্যবহার করি, সেগুলোও কিন্তু নিজেদের জায়গায় স্বাধীন। কেউ তাদের সাথে কোনো ঝামেলা করছে না। এই যে এই টেবিলটাকে কক্ষের ভেতর যেভাবে রাখা হয়েছে, সেটা কিন্তু সেভাবেই আছে। এটাকে বারবার সরানো হয়নি। তার জায়গায় সে দিব্যি আছে। আমাদের এই বোধগুলো এবং অভিজ্ঞতাগুলো থেকেই আমরা সত্যটা উপলব্ধি করি। 

রবীন্দ্রনাথ : হ্যাঁ, সেটাই। আলাদাভাবে এই উপলব্ধিগুলো সব মানুষের মধ্যেই আছে। কিন্তু সেটার সামগ্রিকতা নেই। টেবিলের যে উদাহরণটা আপনি দিলেন, সেটা কিন্তু আমি আমার কক্ষের টেবিলটা থেকেও অনুভব করতে পারি। সেটাও কিন্তু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিজে থেকে যায় না। 

আইনস্টাইন : এই ঘরে যদি কেউ নাও থাকে, তাহলেও কিন্তু টেবিলটা তার জায়গায় স্থির থাকবে। কিন্তু আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে তো বিষয়টা অনুচিত। কারণ টেবিলটা যে এখানেই রয়েছে, এটা আমরা কোন যুক্তি দিয়ে বোঝাব?  আমরা যখন থাকি না, তখন এর স্থান পরিবর্তন হয়নি সেটা তো আমাদের নিজেদের বিশ্বাস থেকে বুঝে নিতে হবে। অস্তিত্ব বা সত্য সম্পর্কে আপনার, আমার যে বিশ্বাস সেটা সব সময় ব্যাখ্যা বা প্রমাণ করা সম্ভব না। কিন্তু এই বিশ্বাসটা ছাড়াও আপনি চলতে পারবেন না। আপনাকে একটা বিশ্বাস ধারণ করতে হবে। 

রবীন্দ্রনাথ : বিজ্ঞান তো এটা প্রমাণ করেছে যে টেবিল জড় পদার্থ। এর কোনো বোধশক্তি বা চলৎশক্তি নেই, তাই সে কোথাও যেতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তাকে না সরাচ্ছে। আবার এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে পদার্থবিদ্যার সত্যটা হচ্ছে আলাদা কয়েকটি বিষয়ের সমষ্টি, মানুষ সেটা আলাদা করে নিজের মতো ভাবতে পারে। তাহলে আমরা দেখতে পাই যে সত্য সব সময়েই সাংঘর্ষিক। ব্যক্তিগত সত্তা আর বৈশ্বিক সত্তার মধ্যে থেকে আপনাকে সত্যটা বেছে নিতে হবে। নিজেকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আর এগুলো বেছে নিতে হবে বিজ্ঞান, দর্শন এবং আমাদের মূল্যবোধ থেকে। এমন কোনো সত্য নেই যেটা মানবতার সাথে সম্পর্কিত নয়। আমাদের চিন্তাভাবনার সবকিছুরই যে সব সময় দৈহিক উপস্থিতি থাকবে তা কিন্তু না। সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ বা সুরের তো কোনো দৈহিক অস্তিত্ব নেই কিন্তু আমরা কিন্তু সেগুলো বুঝতে পারি। কারণ আমরা আমাদের মনকে সেগুলোর সাথে অভ্যস্ত করে তুলেছি। এই ব্যাপারটা কিন্তু আপনি পীথাগোরাসের জ্যামিতিক সূত্র দিয়ে বর্ণনা করতে পারবেন না। আবার ধরেন বিভিন্ন পোকামাকড় কাগজ খায়। গুরুত্বপূর্ণ একটা বই কেটে খেয়ে ফেলল। তার কাছে কিন্তু সেটার কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু যে মানুষটার বই, সেটা তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য কিন্তু মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মানুষের চিন্তাভাবনাকে যৌক্তিক করে তোলে। 

আইনস্টাইন : আমার মনে হচ্ছে আপনার চেয়ে আমি বেশি ধার্মিক!

রবীন্দ্রনাথ : আমার ধর্ম হচ্ছে বৈশ্বিক মানবতা। এর আত্মাকে ধারণ করে নিজস্বতা নিয়ে বেঁচে থাকা।