স্মরণ

ফিকশনের মাধ্যমে আরো গভীরভাবে সত্যকে তুলে ধরা যায় : চিনুয়া আচেবে

Looks like you've blocked notifications!

একটা দীর্ঘসময় ধরে আফ্রিকার গল্প বলে এসেছেন ইউরোপিয়ান লেখকরা। ১৯৫০ এর দশকে এসে এই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। আফ্রিকান দেশগুলো তখন স্বাধীন হতে থাকে এবং আফ্রিকান লেখকরা নিজেদের গল্প লিখতে আরম্ভ করেন।

এই সময়ে একটা উপন্যাস পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তোলে, ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। বিশ্বসাহিত্যে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে এই উপন্যাস। ৫০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়া এই উপন্যাসের সারা বিশ্বে এক কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।   

নাইজেরিয়ার একটি গ্রামের গল্প তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। সেখানকার ইবো আদিবাসীদের সাথে ইউরোপিয়ান খ্রিস্টান মিশনারিদের সাথে প্রথমবারের মতো সংঘর্ষ বাধে। এরপর এগিয়ে যায় উপন্যাসটির গল্প।

চিনুয়া আচেবে জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ লেখার সময় চিনুয়া আচেবের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। এটাই ছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস। এরপরও বেশকিছু উপন্যাস লিখেছিলেন চিনুয়া আচেবে। যার বেশিরভাগেরই প্রেক্ষাপট, ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত আফ্রিকা।  এর পাশাপাশি নন-ফিকশন এবং কবিতাও লিখেছেন তিনি। ফিকশনের জন্য ম্যানবুকার পুরস্কার জিতেছেন চিনুয়া আচেবে।

১৯৯০ সালে এক দুর্ঘটনার পর চিনুয়া আচেবের শরীরের অংশ বিশেষ অবশ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৩ সালের ২১ মার্চ মারা যান চিনুয়া আচেবে।

আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে পুরোনো একটি সাক্ষাৎকারের অনুবাদ ছাপা হলো। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ উপন্যাসটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৮ সালের ২৭ মে ওয়াশিংটনে মার্কিন টেলিভিশন পিবিএসকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন চিনুয়া আচেবে। এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন পিবিএস টেলিভিশনের সংস্কৃতি ও বিনোদন বিভাগের প্রধান জিওফ্রে ব্রাউন।

চিনুয়া আচেবে : আমি জানি কিছু কাজ এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

জিওফ্রে ব্রাউন : কিছু কাজ অসমাপ্ত আছে?

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ

জিওফ্রে ব্রাউন : কোন কাজগুলো?

চিনুয়া আচেবে : পৃথিবীকে আমার জন্মস্থানের কথা জানানো, আমার কথা, আমাদের গল্প, আমার মানুষের গল্প। আমি অন্যদের গল্প সম্পর্কে জানি। কিন্তু নিজেদের গল্পটা এখনো বলা বাকি আছে।

জিওফ্রে ব্রাউন : আপনি অন্যদের গল্পগুলো জানেন, কারণ আপনি ইংরেজি সাহিত্য পড়ে বড় হয়েছেন।

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ। ইংরেজিতে ভালো দখল থাকার কারণে এবং অন্য মানুষদের গল্পগুলো জানার কারণে, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন নিজের গল্পটাই হয়তো বলতে পারিনি। অনেকটা বইয়ের তাকের মতো। ধরুন, বইয়ের তাকে অনেক বই। এর মধ্যে একটা বই সরিয়ে নিলে জায়গাটা কিন্তু ফাঁকা থেকে যায়। আমি ওই বইটা সরিয়ে নিয়েছি। তাই জায়গাটা এখনো ফাঁকাই আছে।

জিওফ্রে ব্রাউন : আর সে কারণেই আপনি ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন? বিংশ শতাব্দীর সেই সময়ে যখন বলা যায়, একটা সময় শেষ হয়ে গিয়ে আরেকটা নতুন সময়ের সৃষ্টি হচ্ছে?

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটাই।

জিওফ্রে ব্রাউন : তখনই কেন?

চিনুয়া আচেবে : আমার পরিবর্তনের ওই সময়টা দরকার ছিল। সে সময়ে সংস্কৃতির সাথে একটা যোগাযোগ ছিল, একটা বাহাস ছিল, একটা সংস্কৃতির সাথে আরেকটা সংস্কৃতির কথোপকথন এবং সময়টাই এমন ছিল যে কিছু একটা ঘটবে সেটা অবধারিত ছিল।

জিওফ্রে ব্রাউন : আপনি যে গ্রামীণ জীবন তুলে ধরেছেন, সেটা ইউরোপীয়রা আফ্রিকায় যাওয়ার আগেকার সময়। আপনি একটি আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তা গড়ে তোলেননি। মূল চরিত্র ওকোনকো চিন্তাশীল কিন্তু সহিংস। অনেকটা ফিকশনের ভেতর দিয়ে সত্য বলা।

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ, সেটা আমি ইচ্ছে করেই করেছি। তখন তরুণ হিসেবে আমি জানতাম যে আমি সত্যিটাই বলতে চাইছি। ফিকশনের মধ্যে দিয়েও সত্যিটা তুলে ধরা যায়।

জিওফ্রে ব্রাউন : এর মাধ্যমে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?

চিনুয়া আচেবে : ফিকশনের মাধ্যমে আরো গভীরভাবে সত্যকে তুলে ধরা যায়। এমনকি আপনি যখন একটা গল্প বলছেন, তখন আপনি সেই গল্পটা তৈরি করছেন, কিন্তু সেটা আপনার নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং সেটা আপনাকে কিছু বলবে, আপনার কানে কোনো একটা বার্তা পৌঁছে দেবে। আপনি জানেন, কোনটা ভুল, কোনটা সঠিক, কোনটা মিথ্যা। আমি সেই পথটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। আমি এর মধ্যে থাকা সব আভিজাত্য যেমন দেখাতে চেয়েছি তেমনি তুলে ধরতে চেয়েছি এর দুর্বলতা। আমার কাছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

জিওফ্রে ব্রাউন : সভ্যতার মধ্যে যখন সংঘর্ষ বাধে, সেটা প্রথমে ধর্মের ওপরই আঘাত হানে।

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ।

জিওফ্রে ব্রাউন : এবং আমি এটা পড়ে খুব আগ্রহী হয়েছিলাম যে আপনার নিজের মা-বাবা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন...

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ।

জিওফ্রে ব্রাউন : তখন মিশনারিরা সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

চিনুয়া আচেবে : সেটা ঠিক। আমি ধর্মের মধ্যে ডুবে ছিলাম সে সময়। আমার বাবা যখন ধর্মান্তরিত হন আমি তখন সেখানে ছিলাম না। সেটা ছিল জীবনের একটা দৃষ্টিভঙ্গি। সে বিষয়ে আমার কোনো প্রশ্ন ছিল না। আমার বরং মনে হয়েছিল খ্রিস্টধর্ম বেশ ভালো এবং আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু তার কিছু পরই আমি বুঝতে শুরু করলাম, আমি ধর্মের যে গল্পগুলো এতদিন শুনে এসেছি, সেটা পরিপূর্ণ ছিল না। সেখানে অনেক কমতি ছিল। ইবো ধর্মের মধ্যে কী আছে সেটা বোঝার জন্য কোনো চেষ্টা করা হয়নি। পাথরের পূজা করাটাকে নিমিষেই বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারণ সেটা খ্রিস্টধর্মের মতো মঙ্গলজনক ছিল না।

জিওফ্রে ব্রাউন : এই প্রশ্ন করাটা হয়তো হাস্যকর হবে, তবুও করছি। আপনি কি ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এর সাফল্যে অবাক হয়েছিলেন?  এটা যে এত মানুষ পড়বে সেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন? আপনি সেটা কীভাবে বুঝতে পেরেছিলেন?

চিনুয়া আচেবে : না, আমি বুঝতে পারিনি।

জিওফ্রে ব্রাউন : কিন্তু সেটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

চিনুয়া আচেবে : আমি একটা ধারণা দিতে পারি। আমার মনে হয়, মানে কিছু কিছু বিষয় যেটা আমাকে বিদেশি পাঠকরা বলেছেন, যে তারা এই বইতে এমন কিছু পেয়েছেন যেটা তাদের নিজেদের ইতিহাসের সাথে, নিজেদের মানুষের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন স্থানের মানুষেরা আমাকে এটা বলেছেন। একটা উদাহরণ দেই। কোরিয়ার একটি মেয়েদের কলেজ। ওই কলেজের একটি ক্লাসের সবাই আমাকে অনেক বছর আগে চিঠি লিখত। কারণ, তখন তারা মাত্র ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ পড়ে শেষ করেছে। পড়ে তাদের অনুভূতি ছিল- ‘এটা আমাদের ইতিহাস, আমাদের।’  

জিওফ্রে ব্রাউন : কোরিয়ানরাও এটা বলেছে?

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ। কোরিয়ানরা পর্যন্ত বলেছে। আর এটা যদি ব্যাখ্যা করতে চাই তো বলতে হয়, কোরিয়া ছিল জাপানের উপনিবেশ এবং ওদের জন্য সেটাই যথেষ্ট ছিল। তাই মানুষের ইতিহাসে কিছু বৈশ্বিক বিষয় রয়েছে। যেটা সবার ক্ষেত্রেই ঘটেছে।

জিওফ্রে ব্রাউন : এবং আফ্রিকার গল্প, অবশ্যই। যেটা একসময় ইউরোপিয়ান লেখকরা বলেছেন।

চিনুয়া আচেবে : হ্যাঁ। সেই পুরো প্রক্রিয়াটাই শুরু করা হয়েছিল শুধু আফ্রিকার গল্প বলার জন্য এবং সেটা দাস ব্যবসার মতোই একটা ব্যাপার ছিল। কারণ ইউরোপিয়ান লেখকদের লেখার মাধ্যমে আমাদের মানে আফ্রিকানদের হীনভাবে প্রকাশ করা হতো, যাতে মানুষের মনে আফ্রিকা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়।

জিওফ্রে ব্রাউন : এখন কি সেখানে ভারসাম্য এসেছে বলে মনে করেন? আফ্রিকার নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরি হওয়ায় কি আপনি সন্তুষ্ট?

চিনুয়া আচেবে : এটা কেবল শুরু। আরো সময় লাগবে। তবে অবশ্যই আরো বেশি মানুষকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে হবে এবং সেটা ঘটছে। আমার উপন্যাস ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে আফ্রিকার মানুষেরা যেন অনেকদিন ধরে এটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। নাইজেরিয়ায়, ইবো-ভূমিতে, সমগ্র আফ্রিকায় যেন নিজেদের গল্পটা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরার জন্য একটা অপেক্ষা ছিল এবং আমার কাছে এটা খুবই ইতিবাচক মনে হয়েছিল।