খামখেয়ালী সভায় রবীন্দ্রময় হুমায়ূন

Looks like you've blocked notifications!
খামখেয়ালী সভার ১৫তম আড্ডায় আলোচকরা। ছবি: রাহিন রায়হান শুভ

‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল/ সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ মর্মবেদনার কথা জানিয়েছেন তাঁর জীবনদেবতাকে। জীবন-সুধাসাগরের তীরে বসে মানুষ শুধু হলাহল (বিষ) পান করছে— কবির কাছে এ গভীর সন্তাপের বিষয়। রবীন্দ্রনাথের এ কথাগুলো আমাদের জীবনের জন্যও প্রযোজ্য বলে মনে করে ‘খামখেয়ালী সভা’।    

খামখেয়ালী সভা নামে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একটি আড্ডা শুরু করেন ১৮৯৭ সালে, কলকাতায়। ‘ডাকাতের দল’ নামে সে সময়ের একটি চমকপ্রদ সংগঠনের উত্তরসূরি হিসেবে খামখেয়ালী সভার জন্ম। ডাকাতের দল একেক সময় একেক সভ্যকে চিঠি দিয়ে জানাত— আজ তার বাড়িতে ডাকাতি হবে; অর্থাৎ সবাই মিলে ওই সভ্যর বাড়িতে আড্ডা জমাবে ও খাবে। ডাকাতের দলের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক আড্ডা খামখেয়ালী সভা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, জগদীশ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো রথী-মহারথীরা ছিলেন ওই সভার সভ্য। রবীন্দ্রনাথ ওই সভায় তাঁর নিজের নতুন নতুন লেখা পড়ে শোনাতেন। সেখানে গান হতো, থাকত খানাপিনার আয়োজন। বছর দুয়েক চলেছিল সভাটি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় সংগীতসমাজ প্রতিষ্ঠা করলে আর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনা করতে এলে বিলুপ্তি ঘটে খামখেয়ালী সভার। তবে রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখার প্রথম পরিচয়ের সাথে জড়িত থাকার কারণে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে খামখেয়ালী সভা।

১১৫ বছর পর ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকায় আবার শুরু হয়েছে খামখেয়ালী সভা। মাহমুদ হাশিম এর আহ্বায়ক। পেশায় সাংবাদিক। পূর্বনির্ধারিত পাঠের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন ও মুক্ত আলোচনা খামখেয়ালী সভার মূলপর্ব। মাসে একবার বসে আড্ডা। রাজধানীর হাতিরপুলের কাছে খামখেয়ালী সভার যুগ্ম আহ্বায়ক আঁখি সিদ্দিকার বাসায় আয়োজিত প্রথম আড্ডার উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

খামখেয়ালী সভার ১৫তম আড্ডা বসে গত শুক্রবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। এবারের আড্ডায় ‘হুমায়ূন আহমেদের ভেতরে রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থান করেন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইফতেখার মাহমুদ। প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজম। সভাপতিত্ব করেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (বাংলা, স্কুল অব এডুকেশন) ড. শোয়াইব জিবরান। 

প্রবন্ধের আলোচনায় ড. মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য কালের বিচারে টিকবে না, এটি একটি বাজার-চলতি মত। তাঁর অন্তত ২০টি উপন্যাস রয়েছে, যেগুলো উপন্যাস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে নিয়ে একাডেমিক কাজ হয়নি, এটা হুমায়ূনপাঠে একটি বড় সমস্যা।’


রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দুটি জায়গায় হুমায়ূন আহমেদের প্রবল মিল আছে বলে মনে করেন মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের মতোই হুমায়ূন প্রচণ্ড জীবনবাদী ও ইতিবাচক। দ্বিতীয়ত, একটু ভিন্ন অর্থে হলেও হুমায়ূন রবীন্দ্রনাথের মতোই মানবতাবাদী।’

তবে রবীন্দ্রনাথ ও হুমায়ূনের লেখনীশৈলীতে তেমন মিল নেই বলে মনে করেন আজম। 

মেহের আফরোজ শাওন বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন রবীন্দ্রময়। আমি দেখেছি, এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-কবিতা পাঠ করেননি। তাঁর দিনের শুরু হতো রবীন্দ্রসংগীত শোনার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি ভক্তি করতেন। তাঁকে নিয়ে হুমায়ূন মজা করতেন। তবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেউ নেতিবাচক কিছু বললে তিনি রেগে যেতেন।’

হুমায়ুন আহমেদকে স্মরণ করে ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না নিও না সরায়ে…’ গানটি শোনান শাওন। বলেন, ‘যে গানটি হুমায়ূন বেশি শুনতেন সেটি হচ্ছে, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।’ এ গানের কিছু অংশ গেয়ে শোনান তিনি। ‘হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, বুড়াটা (রবীন্দ্রনাথ) এ গানটি কেন যে আগেই লিখে ফেলেছে... গানটি লেখার কথা ছিল আমার।’ যোগ করেন শাওন।  

শাওন বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করতেন। তাই তিনি বিভিন্ন নাটক নির্মাণ করলেও রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ দেননি। হুমায়ূন বলতেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো ভুল করা যায় না।’ 

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়...’ হুমায়ূন আহমেদের লেখা গানটি গাইতে গেলে মন খারাপ হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন শাওন। অনেক অনুরোধে তিনি গানটি গেয়ে শোনান। 

এবারের খামখেয়ালী সভায় প্রবন্ধ আলোচনা পর্ব শেষে ছিল কবিতা ও গানের আয়োজন। বাচিকশিল্পী মজুমদার বিপ্লব ও সালমা শবনমের আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হন সবাই। রবীন্দ্রনাথের মুক্তি, আবেদন, হঠাৎ দেখাসহ বেশ কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন তারা।    

গান গেয়ে শোনান সংগীতশিল্পী রোকাইয়া হাসিনা নীলি। ‘ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা...’, ‘যে ছিল আমার স্বপ্নচারিণী...’ ও ‘কতবার ভেবেছিনু...’সহ মোট আটটি গান গেয়ে শোনান তিনি।

আলোচনা, কবিতা ও গানের পর্ব শেষে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে খানাপিনার আয়োজনও ছিল অন্য আড্ডার মতোই জমজমাট।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা খামখেয়ালী সভার আনন্দযাত্রায় যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, নাট্যজন আতাউর রহমান, গাণ্ডীব সম্পাদক তপন জ্যোতি বড়ুয়া, সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ, আবৃত্তিজন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, কামরুল হাসান মঞ্জু, শিমুল মুস্তাফা, ভারতের সংগীতশিল্পী পৌলমী গাঙ্গুলির মতো বিশিষ্টজনরা।

মাহমুদ হাশিম বলেন, ‘বাঙালির মহত্তম মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে আমাদের এ আয়োজন। আনন্দ-বেদনা, সংকটে-সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। খামখেয়ালী সভা মনে করে, বাঙালির সুন্দর ও পরিণত জাতি হয়ে ওঠবার পথে রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য। রবীন্দ্রনাথের শিখরস্পর্শী প্রতিভার সব দিক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। খামখেয়ালী সভার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে গভীরভাবে পাঠ ও নতুন নতুন রূপে আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। কবি যে আনন্দলোক ও স্বপ্নলোক রেখে গেছেন তাঁর সাহিত্যকৃতির মধ্যে; তাঁর কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যে পথ দেখিয়ে গেছেন, আমরা সে আলোর পথযাত্রী।’

মাহমুদ হাশিম বলেন, “বর্ষপূর্তিতেও গত এক বছরে খামখেয়ালী সভাকে ঋদ্ধ করেছেন- এমন গুণীজনদের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। আড্ডায় পঠিত প্রবন্ধগুলো নিয়ে সংকলন প্রকাশ করতে যাচ্ছি আমরা। প্রতিবছর এটি করব আমরা। এ বছরই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে আমাদের। দেশ-বিদেশের রবীন্দ্র-গবেষকরা লাইব্রেরিটি ব্যবহার করতে পারবেন। আমরা গবেষকদের বৃত্তি দেওয়ার কথা ভাবছি। প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হলেই আমরা বৃত্তির পাশাপাশি ‘খাপছাড়া’ নামে ছোটদের আড্ডা শুরু করব। কবিতায়, গানে, গল্পে, ছবিতে আনন্দময় আয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে জানবে ছোট্ট সোনামণিরা। রবীন্দ্রনাথকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো বেশি করে নিয়ে যেতে কাজ করছি আমরা। চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র গবেষক ইয়াং ওয়েই মিংকে তাঁর গবেষণায় সহযোগিতা দিচ্ছে খামখেয়ালী সভা। সামনের দিনগুলোতে এসব উদ্যোগ আরো বাড়াব আমরা।”