ম্যাটিরিয়ালটা কী বলে তা বুঝতে চাই : ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান

Looks like you've blocked notifications!
হামিদুজ্জামান খান। ছবি : রূপম চৌধুরী

এ অঞ্চলে আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার সূচনা করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে নভেরা আহমেদ। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভাস্কর্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার পর যে শিল্পীদের চর্চায় বাংলাদেশের ভাস্কর্যচর্চা প্রসার লাভ করে, লাভ করে গ্রহণযোগ্যতা— তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। তাঁর প্রচুর ভাস্কর্য এখন পর্যন্ত দেশে-বিদেশে স্থায়ীভাবে উন্মুক্ত উদ্যান ও সড়কদ্বীপে স্থাপিত হয়েছে। অথচ তাঁর শুরুটা হয়েছিল ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের এক উজ্জ্বল শিক্ষার্থী হিসেবে, ভেবেছিলেনও হবেন পেইন্টার। একটা দুর্ঘটনা মোড় বদলে দিয়েছিল শিল্পী হামিদুজ্জামানের শিল্পীত অভিপ্সার। যদিও তিনি জলরঙের কাজেও খ্যাতি লাভ করেছেন, তদুপরি বাংলাদেশে ভাস্কর হিসেবেই বেশি পরিচিত তিনি। 

হামিদুজ্জামান খান বাংলাদেশ সৃষ্টির ঐতিহাসিক ঘটনা, মুহূর্তকে স্থায়ীরূপ দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশপ্তক, সিলেট জালালাবাদ সেনানিবাসের হামলা, বিজয়কেতন, জাগ্রতবাংলা প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে। জয়নুলের মনপুরার মতোই উড়িরচরের সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে তিনি স্থাপনা শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যা স্থান পেয়েছে জাতীয় জাদুঘরে।  

ভাস্কর্যের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙেচুরে হামিদুজ্জামান খান সারাবিশ্বের প্রখ্যাত ভাস্করের মতোই সতত আধুনিকতার চর্চা করেছেন। ভাস্কর্য মানে যে শুধু মূর্তি-নির্মাণ নয় তা তিনি প্রমাণ করেছেন বঙ্গভবনের পাখি পরিবার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে করা ফার্মগেটের জাতীয় মাছ ইলিশ, ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া হামিদুজ্জামান খানের নির্মিত বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে ঝুলন্ত ভাস্কর্য, কল্যাণপুরে De La Acme, সোনারগাঁ মোড়ের UTC বিল্ডিংয়ের সামনের ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ‘শান্তির পাখি’ বহুল প্রসংশিত। সিউল অলিম্পিক পার্ক কোরিয়ায় হামিদুজ্জামান খানের ভাস্কর্য স্টেপস্ (সিঁড়ি) স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে দুর্লভ সম্মান। 

সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ হামিদুজ্জামানের প্রতিভা চিহ্নিত করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সেই ১৯৬৪ সালে। তখন থেকেই জয়নুল আবেদিনের প্রিয় ছাত্র হামিদুজ্জামান খান শিল্পগুরুকে দেওয়া সব কথাই মেনেছেন অক্ষরে অক্ষরে। হামিদুজ্জামান খানের বিস্তৃত জীবন ও কর্ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমিও বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি একজন শিল্পীর নিজের কাজের প্রতি মগ্নতা ও ভালোবাসা দেখে। এর আগে কখনোই না বলা অনেক কথা উঠে এসেছে এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কিশোরগঞ্জের সহস্রাম গ্রামে আপনার জন্ম এবং সেটা নাইনটিন ফরটি সিক্সে, তার মানে হলো স্যার ব্রিটিশ পিরিয়ডে আপনার জন্ম। 

হামিদুজ্জামান খান : এক্‌জাক্টলি— 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : যেহেতু ফরটি সিক্স, আপনার তো ব্রিটিশ আমল মনে নাই। শৈশবের কোন স্মৃতিগুলো স্যার আপনার সবার আগে মনে পড়ে?

হামিদুজ্জামান খান : আমার বাড়ির পাশেই একজন বড় আর্টিস্টের বাড়ি, হেমেন্দ্র মজুমদার।আমি উনাকে দেখিনি, উনি ফোরটি সেভেনের আগেই মারা গেছেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার গ্রামের বাড়ির পাশেই?

হামিদুজ্জামান খান : আমার গ্রামের বাড়ির পাশে। তাঁর বাড়িটা আমরা দেখছি। বাড়িটা একটু ছিল অন্যরকম। টিনের বাড়ি। কিন্তু জানালাগুলা রাউন্ড। একটু অন্য শেপের বাড়ি। ওইখানে একটা রথের মেলা হতো। রথও ছিল একটা। এইটা একটা কালচারালি ডিফারেন্স তৈরি করেছিল।ওরা যে একটু সফেসটিকেটেড, একটু শিক্ষিত লোক, আর একজন আর্টিস্টের বাড়ি, সাধারণ না, একটু ভিন্নতর ছিল। এটা আমাকে ইমপ্রেস করে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : সেই শৈশবেই স্যার?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, সেই শৈশবেই। আর আমি যেই ইস্কুলে পড়তাম, বনগ্রাম হাইস্কুল, এর বাড়ির পাশেই কিন্তু এনসি চৌধুরীর বাড়ি। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : নীরদচন্দ্র চৌধুরী মানে নীরদ সি চৌধুরী?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, তো নীরদ সি চৌধুরীর বাড়ির এক ছেলে আমার সাথে পড়তো। আমি কিন্তু, সকালবেলা আগে ওর বাড়ি যাইতাম। জাম গাছে গিয়ে জাম খাইতাম। ও গোসল করত, রেডি হইত আর আমি ওরে নিয়া আস্তে আস্তে স্কুলে যাইতাম। বন্ধুত্ব ছিল ওর সাথে খুব।ওই ছেলেডা এন সি চৌধুরীর বাড়ির ছেলে, এন সি চৌধুরী তাঁর কাকাটাকা হইতো মনে হয়। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কোন ক্লাসে স্যার তখন আপনি?

হামিদুজ্জামান খান : আমি ক্লাস সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত পড়ছি। এইটা সিক্সের সময়ের ঘটনা। তখন তো আমরা নীরদ সি চৌধুরী সম্পর্কে জানতাম না। পরে তো জানি তিনি তো বিশাল লোক। এখন যেইভাবে আমরা দেখি—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : অবশ্যই। তিনি অসাধারণ কাজ করেছেন। বিশেষত তাঁর ভাষার যে তীর্যক ভঙ্গি!

হামিদুজ্জামান খান : হুম, বিশাল লোক। অসাধারণ। আমার খুবই গর্ব হয় আমি শৈশবে উনাদের দেখেছি। উনাদের বাড়ির সংস্কৃতি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। শৈশবের কথা ভাবলে এসব মনে পড়ে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনারা স্যার কয় ভাইবোন ছিলেন? আপনার বাবা!

হামিদুজ্জামান খান : আমার বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। আমার বাবাকে বিশেষ করে আমি হেল্প করতাম। উনার ডিসপেনসারি ছিল। আমার মনে আছে আমি হোমিওপ্যাথি ওষুধের লেবেল লাগাইতাম। মাইপা কয়টা ফোটা দিতে হবে চিনির বড়িতে, তা দিতাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : নাক্স ভমিকা?

হামিদুজ্জামান খান : হা হা হা, তুমি দেখি নাম জানো। হ্যাঁ, নাক্স ভমিকা খুব ভালো অষুধ। আমাদের সবসময় একটু কিছু হইলেই, হোমিওপ্যাথি অষুধ খাইলে আমরা ভালো হয়ে যাইতাম। জ্বর হইছে, হোমিওপ্যাথি, ভালো হয়ে গেলাম। পইড়া গেছি, হোমিওপ্যাথি ওষুধ, কাইটা গেছে হোমিওপ্যাথি। সব ভালো। হোমিও প্যাথির ওপর আমাদের খুব আস্থা ছিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ছিল বলছেন কেন? এখন নাই?

হামিদুজ্জামান খান : এখনো আছে। তো আব্বা, আমি মেট্রিক পাস করলাম, আমি কী করব! একচুয়ালি আমাদের এলাকাটা একটু এনলাইটেনড, গচিহাটা। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল।আমার স্কুলের টিচাররাও হিন্দু ছিলেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার শৈশবের বন্ধুরা তাহলে হিন্দু ছিল?

হামিদুজ্জামান খান : বেশির ভাগই হিন্দু ছিল। প্রায় এইট্টি পারসেন্ট (৮০%) হিন্দু ছিল। ওদের পূজায় তো আল্পনাটাল্পনা লাগত। আমি যেহেতু ছবিটবি আঁকতাম, ওরা আমারে পছন্দ করত। আমাকে—
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বাবা কোনো বাধা দেন নাই আপনাকে ছবিটবি আঁকতে?

হামিদুজ্জামান খান : না, বাধা দেন নাই। আমার মনে আছে একবার আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন এক জায়গায়। আব্বা আবার খুব নামাজটামাজ পড়তেন। ধার্মিক ছিলেন। নিয়ে গেলেন আমাকে, বললেন মসজিদের ছবি আঁকতে। বিশাল বড় একটা মসজিদ, আমাদের কিশোরগঞ্জে, সৈয়দী মসজিদ।আমি সারাদিন বইসা বইসা একটা ড্রইং করছি। করার পর উনি আবার এটা নিয়া মসজিদের ইমামকে দিছেন।

দিয়া বলছেন, আমার ছেলে আঁকছে এটা। এ রকম ছবিটবি আঁকতাম। প্রাকৃতিকভাবেই একটা নেশা ছিল আমার ছবিটবি আঁকার। যেহেতু আমাদের হিন্দু মাস্টার ছিল বেশি, তারা কিন্তু এনলাইটেন্ড।

অনেক সময় দেখা গেছে ইন্ডিয়া থেকে অনেক ম্যাগাজিন আসত। পত্রিকায় ছবি থাকত, একজন আর্টিস্টের আঁকা হয়তো, এই দ্যাখ, হেমেন্দ্র মজুমদারের ছবি। হেমেন্দ্র মজুমদারের নাম শুনছি তার আগে, তাঁর ছবি তো দেখি নাই। মহিষের পিঠে একটা রাখাল বসে আছে, মহিষ যাচ্ছে, এ রকম, এটা হেমেন্দ্র মজুমদারের ছবি, আর হেমেন্দ্র মজুমদার ছবি আঁকতেন একটা মেয়ে পুকুরে গোসল করছে, উঠে যাচ্ছে, ভিজা শরীর এ রকম, এগুলা কিন্তু গছিয়াহাটারই সিন, ইন্টারেস্টিং। আর তার ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডের পদ্ম, এই পদ্ম কিন্তু গছিয়াহাটারই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মানে, হেমেন্দ্র মজুমদারের ছবি আপনাকে তাহলে ইনফ্লুয়েন্স করেছে?

হামিদুজ্জামান খান : প্রচণ্ড ইনফ্লুয়েন্স করছে। তখন আমি বুঝতে পারছি উনি কত বড়! ইন্ডিয়াতে তখন উনার মর্যাদা আকাশচুম্বী, সবাই উনাকে চিনে।আমি যখন চারুকলায় আসলাম, চারুকলা থেকে পাস করলাম—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার, চারুকলার প্রসঙ্গে এখনি যাইয়েন না। আপনি মেট্রিক পাস করলেন, তারপর আপনার বাবা-মা কী চাইলেন?

হামিদুজ্জামান খান : বাবা মা চাইলেন সায়েন্স পড়ি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ডাক্তারি করতে হবে?

হামিদুজ্জামান খান : ডাক্তারি পড়তে হবে। আমাকে নিয়া ভর্তিও করে দিলেন সায়েন্সে, কিছুদিন পড়ার পর আমার আর ভাল্লাগল না।আমারে ভৈরব কলেজে ভর্তি করে দিল। আমি বাড়িতে কয়েকদিন পর এসে বললাম, আমার ভাল্লাগছে না। আমি চারুকলায় যাব। বাই দিস টাইম আমি খবর পাইছি যে চারুকলা পড়া যায়। আব্বা তো রাজি না। আমি জিদ ধরলাম। পরে উনি সরাসরি আমাকে ঢাকা নিয়ে আসল।আবেদিন স্যারের (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন) কাছে নিয়ে আসল, উনি খোঁজখবর নিয়েই আসছে,উনার বাসায় নিয়া গেল, তহন কিন্তু আমি অলরেডি লেইট, দেরি হয়ে গেছে, দুই মাস—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : দেরি হয়ে গেছে দুই মাস? মানে দুই মাস আগেই ভর্তির ডেট চলে গেছে?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ। দুই মাস দেরিতে আমি আর আব্বা আসছি ঢাকায়। আবেদিন স্যার বললেন, দেখি, কী আঁকছ তুমি, কী আঁক দেখাও। তো, আমি সাহস কইরা একটু ড্রয়িং-ট্রয়িং কী আছে একটু ধইরা দিলাম। একটু দেইখা বললেন, যাও, ভর্তি হয়ে যাও। কালকে ডিপার্টমেন্টে গিয়া বইলো জয়নুল আবেদিন বলছে ভর্তি হইতে, ইন্টারভিউ নিছে, এই কথা বইলো। আমি অফিসে গেলাম, গিয়া বললাম, আমার ইন্টারভিউ হইছে, আমাকে ফর্ম দেন, আমি ভর্তি হবো।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হা হা হা (উচ্চস্বর হাসি)

হামিদুজ্জামান খান : (হাসতে হাসতে) দুই মাস লেইট কিন্তু! ভর্তি হইয়া গেলাম, ক্লাসে গিয়া দেখি সবাই খুব স্মার্ট, কী সুন্দর ড্রইং করে, আঁকে, তো আমি একটু ভীত হয়ে গেলাম, হেঁ, কোথায় আসছি এইটা!
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কাদের দেখে ভীত হয়ে গেলেন স্যার! মানে কাদের বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন? কারা সেই স্মার্ট?

হামিদুজ্জামান খান : কালিদাস কর্মকার আছে না! ও কিন্তু আমাদের ক্লাসের। কালিদাস ভালো, খুব ছটফটে ছিল তখনি, ও দুবছর এইখানে পড়ছে, পড়ে পরে ইন্ডিয়া চলে যায়। এ রকম আরেকটা মেয়ে ছিল মাহমুদা নাম, ড. মোতাহার হোসেনের মেয়ে। খুব সুন্দর ছবি আঁকে?

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মাহমুদা কি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ রাইট, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা?

হামিদুজ্জামান খান : না না, মাহমুদা, আর্টিস্ট, খুব বিখ্যাত হয় নাই, তবে কবিতা লিখত কী না আমি জানি না। তো এরা ভালো আঁকত, আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম, সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম পড়ে, সেকেন্ড ইয়ারে কোনো রকমে উঠলাম, কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারে উইঠা সাইরা আমি ভালো করতে শুরু করলাম, থার্ড ইয়ারে উঠার সময় আমি ফার্স্ট হয়ে গেলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আচ্ছা! ইটস চেইঞ্জড। বাহ্। তারপর?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, ইটস চেইঞ্জড মাই লাইফ, সবাই একেবারে হইহই পড়ে গেছে যে তহনকার সময়ে এক্সামে ফার্স্ট হওয়া তো বড় ব্যাপার। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : অন্য বন্ধুরা কীভাবে নিল, আপনি যে ফার্স্ট হইলেন?

হামিদুজ্জামান খান : আমি ফার্স্ট হইয়া গেলাম, আমার ওয়াটার কালারের খুব প্রশংসা করল সবাই। অন্যরা কীভাবে নিবে! আমি তো খালি কাজই করতাম, ছবি আঁকতাম, ওয়াটার কালার সবাই আমারটা পছন্দ করত, পুরা আর্ট কলেজেই একটা ইয়া ডাক পড়ে গেল যে ওর ওয়াটার কালার ভালো। আবেদিন স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তোমার ওয়াটার কালার ভালো। আমি তো অবাক হয়ে গেছি।

আনন্দে অবাক হইছি। আমাদের এখানে একটা অ্যানুয়াল এক্সিবিশন হয়, অ্যাক্সিবিশনে আমার কাজ ছিল, সবারই একটা-দুটা কাজ কিন্তু আমার সাতটা কাজ, আবেদিন স্যার বলল, ওর কাজ সব দিয়া দাও। আমারে বলল, তুমি ফ্রেম করবা। আমি বললাম,স্যার, ফ্রেম করার টাকা আমার কাছে নাই। তো আমার তো খাওয়ারই টাকা নাই। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : খাওয়ার টাকা নাই মানে? আপনার বাবা কি আপনারে টাকা পাঠাইতো না চলার জন্যে?

হামিদুজ্জামান খান : চারুকলায় পড়া কিন্তু অনেক খরচ, আমি যদি আঁকতে চাই, আমাকে পেপার কিনতে হয়, কাগজ কিনতে হয়, পেন্সিল কিনতে হয়, অনেক খরচ কিন্তু চারুকলায়, আর তখনকার দিনে ম্যাটেরিয়াল হইলো কস্টলি, বিদেশি ম্যাটেরিয়াল পাওয়াও যায় কম। খরচটা অনেক লাগত, আর আমি তো প্রচুর ইউজ করতাম। আবেদিন স্যারকে বললাম, স্যার আমি তো ফ্রেম করতে পারব না।

এরপর এক্সিবিশনের সময় গিয়া দেখি আমার ছবি সব ফ্রেম করা। আবেদিন স্যার বলল, আমি এইগুলা ফ্রেম করাইছি। আমাদের প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্টে অনেক ফ্রেম রাখা থাকতো, ভালো ছেলেদের ছবি বাঁধাই করার জন্য, আবেদিন স্যার পিওনদের দিয়া, নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়া ফ্রেম করাইছেন, সুন্দর কইরা ঝুলাইছেন, এই ঘটনায় আমি খুব ইন্সপায়ারড হইলাম আর কী!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আবেদিন স্যার এইটা করতেছে আপনার জন্য, আপনি তখনো মাত্র তাঁর স্টুডেন্ট, এই বিষয়টা এখন ভাবলে কী মনে হয়?

হামিদুজ্জামান খান : এইটা আমাকে অনেক ওপরে তুলে দিয়েছে নিজের কাছে,ইটস ইন্সপায়ারড মি, আমরা সরাসরি আবদিন স্যারকে পেয়েছি, এটা যে কত বড় প্রাপ্তি বলে বোঝানো যাবে না। উনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, হামিদ, ওয়াটার কালারটা তোমাকে দিয়ে হবে, তুমি এটা ছেড়ে দিও না। তারপর তো আমি পেইন্টিং এ পড়তে থাকি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনি আবেদিন স্যারকে পেয়েছেন, সরাসরি, এভাবে ইন্সপায়ারড হইছেন, আবেদিন স্যার ছাড়া আর কোন কোন স্যারকে পেয়েছেন আপনি চারুশিক্ষার্থী হিসেবে?

হামিদুজ্জামান খান : আমাদের সময় প্রায়, যাদের আমরা দেখি সীনে, এই বাংলাদেশের সবাই আমাদের শিক্ষক ছিলেন। সফিউদ্দিন স্যার, কিবরিয়া স্যার…

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আমিনুল ইসলাম স্যার!

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, আমিনুল ইসলাম স্যার, রাজ্জাক স্যার, বাসেত স্যার সরাসরি আমাদের টিচার ছিল। আমি যেহেতু পেইন্টিং এর এজন্য আমি সবাইকেই পাইছি। আমিনুল ইসলাম স্যারের ক্লাস আমি পাইছি, কিবরিয়া স্যারের ক্লাস আমি পাইছি, সফিউদ্দিন স্যারের গ্রাফিক্স ডিপার্টমেন্টে আমরা ক্লাস করতাম। সবাইকে আমরা পাইছি তখন। এই টাইমটা ছিল তখন, অল লিভিং—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : লিজেন্ডারি একটা টাইম!

হামিদুজ্জামান খান : একদম ঠিক বলছ! লিজেন্ডারি একটা টাইম।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনি তাহলে স্যার, কোন ব্যাচ? চারুকলার?

হামিদুজ্জামান খান : আমি সিক্সটি সিক্স না না সিক্সটি সেভেনে পাস করি, সিক্সটি টুতে ভর্তি হই। সিক্সটি সেভেনে পাস করি পেইন্টিং থেকে। 
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কিন্তু স্যার আপনার এই যে, পেইন্টিং থেকে, জলরঙ নিয়া তো আপনার সুনাম ছড়াইয়া পড়ল ক্যাম্পাসে, আবেদিন স্যার বলল, জলরংটা তুই ছাড়িস না, পেইন্টিং থেকে ভাস্কর্যে কীভাবে গেলেন?

হামিদুজ্জামান খান : এটা একটা মজার ব্যাপার। বলি আমি তোমারে। সিক্সটি সেভেনে আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়। আবদিন স্যার আমারে খুব হেল্প করেন তখন। আমি হসপিটালে ছিলাম অনেকদিন।

বাঁচার আশা ছিল না, কিন্তু ভালো হই। হয়ে, পেইন্টিং থেকে আমি তখন পাস করলাম। ভালো হওয়ার পরে আমার ট্রিটমেন্ট দরকার, ফারদার, মানে আমাকে প্লাসটিক লাগাতে হবে মাথায়, এজন্য আমি, ড. আছিরউদ্দিন আমার ডাক্তার।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : অ্যাক্সিডেন্টটা কী ছিল স্যার? মাথায় প্লাস্টিক লাগাতে হবে মানে!

হামিদুজ্জামান খান : মাথা ভেঙে গেছিল। ইট ওয়াজ সিরিয়াস এক্সিডেন্ট। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হায় আল্লাহ! কীভাবে স্যার! 

হামিদুজ্জামান খান : ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কোথায় ছিলেন স্যার আপনি তখন?

হামিদুজ্জামান খান : আমি ছিলাম সাইকেলে, হোস্টেল থেকে আসতেছিলাম। ধাক্কা লাগে ট্রাকের, অ্যাক্সিডেন্ট করি, আমাকে হসপিটালে নিয়া যায়, যারা ছাত্র ছিল আশপাশে তারা আমারে হসপিটালে নিয়া যায়। এইটা আমি অনেক দিন ছিলাম, প্রায় চার মাস ছিলাম হসপিটালে।আবেদিন স্যার তখন আমার জন্য কী যে করছে! যথেষ্ট করছে। স্টুডেন্ট এর জন্য একজন শিক্ষক এর চেয়ে বেশি করতে পারেন না।

করছেন, আমি যাতে ভাল হই। ড.আছিরউদ্দিন আমাকে ট্রিটমেন্ট করেন, আমার কোনো অসুবিধা হয় নাই, (ডানহাত দেখিয়ে) আমার এই হাতটা তখন প্যারালাইসিস হয়ে গেছিল, পরে আস্তে আস্তে ঠিক হইছে, ব্রেইনও সব ঠিক আছে, এমন সময় ড. আছিরউদ্দিন বললেন, তোমাকে ইংল্যান্ড গিয়ে অপারেশন করতে হবে আবার। মানে প্লাস্টিক সার্জারি। মানে আঘাতপ্রাপ্ত জায়গাটায় একটা প্লাস্টিক বসায়া দিবে, তাহলে তুমি ঠিক হবা। ড. আছিরউদ্দিনই, চেষ্টা কইরা আমাকে ইংল্যান্ড পাঠালেন, এডিনবার্গ গেলাম, এডিনবার্গ।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বিরাট খরচের ব্যাপার স্যার, টাকা-পয়সা কীভাবে ম্যানেজ হলো?

হামিদুজ্জামান খান : টাকাটা, এইখানে আমি দুইবার এক্সিবিশন করলাম, ওয়াটার কালার বিক্রি কইরা প্রায় টাকাটা জোগাড় করলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার চারুকলাতে এক্সিবিশন করে সাতান্ন সালে আপনি এডিনবার্গ যাওয়ার টাকা জোগাড় করে ফেললেন!

হামিদুজ্জামান খান : শুধু ঢাকায় তো না, চিটাগাংয়ে একটা এক্সিবিশন করলাম, আর ঢাকাতেও একটা করলাম। করে অনেক টাকাই জোগাড় করলাম। আমি  চিটাগাংয়ে ছবি নিয়া গেলাম, ছবিগুলো জাস্ট টানাইলাম, সবই বিক্রি হয়ে গেল। আর ঢাকাতে এক্সিবিশন করলাম, করে আমি গেলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কত টাকা স্যার? আনুমানিক?

হামিদুজ্জামান খান : তখন তো পাউন্ড নিয়া গেলাম, পাউন্ড তো তখন খুব কম দাম ছিল, পাঁচ টাকা বোধ হয় এক পাউন্ড তখন!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আচ্ছা আচ্ছা!

হামিদুজ্জামান খান : বেশ কয়েক হাজার পাউন্ড নিয়া গেলাম, কারণ ট্রিটমেন্টে তো প্রচুর খরচ আছে। টাকা দরকার। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মোট কতটাকা লাগল আপনার? মনে আছে? কত সালে গেলেন আপনি?

হামিদুজ্জামান খান : এইটা হলো সিক্সটি নাইনে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : সিক্সটি নাইন মানে, মুক্তিযুদ্ধ হয় নাই, পাকিস্তান আমল, এক রুপি মানে পাঁচ পাউন্ড বলতেছেন স্যার?

হামিদুজ্জামান খান : তুমি উল্টা বলতেছ, এক পাউন্ড পাঁচ রুপি। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : তার মানে আনুমানিক কত টাকা লাগল স্যার সেই সময়ে? 

হামিদুজ্জামান খান : আমি বেশ কয়েক হাজার পাউন্ড নিয়া গেছি। অনেক অনেক, আমার ঠিক এক্‌জাক্ট ফিগারটা মনে নাই। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আনুমানিক স্যার?

হামিদুজ্জামান খান : হাজার পাঁচেক হবে!ট্রিটমেন্টে লাগবে। তখন আমি একটা শিপে যাই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আচ্ছা। তখন আপনি স্টুডেন্ট?

হামিদুজ্জামান খান : তখন আমি স্টুডেন্ট না। পাস করছি। সিক্সটি সেভেনে পাস করছি, সিক্সটি নাইন। এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ছিলাম, টাকাটাও জোগাড় করতে সময় লাগছে। আমি এখান থেকে শিপে করে যাই। এডিনবার্গ। এইটা একটা ফ্রি টিকিট পাই (স্মিত লাজুক হাসি)। এটা একজন আমাকে জোগাড় করে দিল। তারপর আমি এডিনবার্গে যাই, এডিনবার্গ শিপ থেকে নেমে হসপিটালে যাই। হসপিটালে আমার ট্রিটমেন্ট হয়। ট্রিটমেন্ট হওয়ার পরে যেইটা খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, আমি যখন বিলটা দিতে যাই, তখন বলে তুমি তো স্টুডেন্ট আর বাংলাদেশ থেকে রিকোয়েস্ট করছে, তোমার কোনো বিল আমরা নেব না। এইটা ছিল খুব সারপ্রাইজিং।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হু রিকোয়েস্টেড ইট ফর ইউ?

হামিদুজ্জামান খান : ড. আছিরউদ্দিন রিকোয়েস্ট করেছেন, ড. আছিরউদ্দিন। যার জন্য আমার কোনো টাকা ওরা নেয় নাই। ওরা টাকা না নিয়ে একটাই কথা বলল, এইটা যেহেতু ব্রেইনের ব্যাপার, তুমি ইংল্যান্ডে গিয়া বা এডিনবার্গে, তুমি চার মাস থাক। চার থেকে পাঁচ মাস। বা ইংল্যান্ডে যাও, তুমি গিয়া মিউজিয়ামগুলো দেখ। তুমি আর্টিস্ট, মিউজিয়াম দেখ, চার মাস থাক। এর মধ্যে যদি কোনো প্রবলেম হয় তোমার মাথায়, আমরা আবার চিকিৎসা করব ফ্রি, সমস্যা না হলে তুমি চলে যাবা। তো আমি ইংল্যান্ডে রয়ে গেলাম। সেখানে আমি চার মাস রয়ে গেলাম। থাকলাম। এই চার মাস যে আমি মিউজিয়াম গ্যালারিগুলো দেখছি, এইটা আমাকে খুব হেল্প করছে। ধরো, ব্রিটিশ মিউজিয়াম আমি একবার যাই নাই, বহুবার গেছি, ভিক্টোরিয়া আলবার্ট মিউজিয়াম, টেইট গ্যালারি বহুবার গেছি, এইটা আমার লাইফটারে চেইঞ্জ করে দিছে, কারণ আমার তো আর কোনো কাজ ছিল না। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার দেখার জগৎটা চেইঞ্জ করে দিছে আপনার এই থাকাটা!

হামিদুজ্জামান খান : একেবারে আগাগোড়া আমার অভিজ্ঞতার জগৎটাই চেইঞ্জ করে দিছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ভাস্কর্য নিয়ে ফ্যাসিনেশনটা কি সেই সময়ই শুরু?

হামিদুজ্জামান খান : এই যে আমি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়া দেখি সারা দুনিয়ার জিনিস এহানে আছে। রোম গ্রিস ইতালি …

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ!

হামিদুজ্জামান খান : ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, কোথাও বাদ নাই, সব ওদের কাছে আছে। আর ওখানে স্কাল্পচারের এইটা অনেক বেশি। ধরো মিসরের, অনেক দেখলাম, বড় বড় স্টোনের স্কাল্পচার আইনা ওখানে রেখে দিছে। এইটাতে আমার মধ্যে একটা ইয়াও গ্রো করছে যে, স্কাল্পচার তো প্রাচীন দিনের জিনিস এহনো আমরা সমান আগ্রহ নিয়া দেখতেছি, মানে এক্কেবারে লিভিং একটা জিনিস, একেবারে চোখের সামনে দেখছি, কত হাজার বছরের পুরানো কে জানে! এবং আমার মনে হলো ইটস মোর স্ট্রঙ্গার দ্যান পেইন্টিং। এইটা আমার ভেতরে একটা তৈয়ার হইছে যে স্কাল্পচারটা অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। অনেক বেশি লাস্টিং করে আর অনেক বেশি টিকে থাকে, একসাথে অনেক মানুষ এইটা দেখতে পারে যদি ওপেন এয়ার হয়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : তার মানে আপনি ইংল্যান্ডের সব মিউজিয়াম দেখে ফেললেন। 

হামিদুজ্জামান খান : শুধু ইংল্যান্ড না, আমি আসার সময় আমি কিন্তু প্যারিসও হয়ে আসি। প্যারিসে ছিলাম প্রায় তিন সপ্তাহ। রশিদ স্যার আমারে অ্যারেঞ্জ করে দিলেন। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : শিল্পী রশিদ চৌধুরী?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, আর্টিস্ট রশিদ চৌধুরী।  তো প্যারিসও ভালো করে দেখা হইলো। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এটা কিন্তু স্যার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, স্যাররা আপনাকে প্রচণ্ড পছন্দ করত। 

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ তা ঠিক। প্যারিসে রশিদ স্যারের শ্বশুর আসছিল এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে। ওরা আমাকে অনেক হেল্প করছে। ফ্যামিলিটা। তো অনেক দেখছি আমি প্যারিসে। মিউজিয়ামগুলো। আমি যখন ল্যুভরে ঢুকি তখন একটা কনটেমপোরারি আর্ট এক্সিবিশন চলতেছে। সেইখানে তখন একটা স্কাল্পচার প্রদর্শনী ছিল, জিয়াকোমিতির স্কাল্পচার এক্সিবিশন। হি ওয়াজ ফ্যামাস দ্যাট টাইম। ওয়ার্ল্ড ফ্যামাস। এখনো। (আলবার্তো জিয়াকোমেত্তি প্রখ্যাত ফরাসি ভাস্কর। দ্রষ্টব্য: উইকিপিডিয়ায় Alberto Giacometti)কী লম্বা লম্বা ফিগার আমার দেইখা খুব ভাল্লাগছে। তো এইটা আমারে খুব ইনফ্লুয়েন্স করছে। জিয়াকোমেত্তির কাজ। খুব ইনফ্লুয়েন্স করছে। তো প্যারিস হইয়া আমি যখন ফিরলাম তখন আমি ভাবলাম স্কাল্পচারটা আবার আমি ভালো করে পড়বো। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এখানে তো তখন কেবল শুরু হয়েছে স্কাল্পচার বিভাগ! তাই না? রাজ্জাক স্যারের দায়িত্বে!

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, তুমি তো সব জানো দেখতেছি। রাজ্জাক স্যার তখন বিভাগ শুরু করছেন, জাস্ট শুরু হইছে। আমি আইসা স্যারকে বললাম ‘স্যার, আমি কাজ করবো’। স্যার বলল কাজ করতে তো কোনো বাঁধা নাই, হ্যাঁ,করো কাজ করো। বেশি না, ছয় থেকে নয় মাস কাজ করার পরে আবেদিন স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তোমাকে টিচার করে দিচ্ছি। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কিসের টিচার?

হামিদুজ্জামান খান : (হাসছেন প্রাণখুলে) কিসের টীচার? স্কাল্পচারের টিচার। আমি বললাম, স্যার স্কাল্পচার তো স্যার আমি এখনো শিখিইনি। স্যার বলল, তোমারে দিয়া হবে, কারণ তুমি ভালো ড্রয়িং পারো, তোমার আগ্রহও আছে। এই আমাকে আবেদিন স্যার টিচার করে দিলো। আমিও মাস্টারি শুরু করলাম। তখন কিন্তু আমাদের বেতনটেতন বেশি ছিল না। হয়তো চারশো টাকা বেতন, এইরকম।

টিচার হয়ে গেলাম—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : টিচার হলেন স্যার কতসালে?

হামিদুজ্জামান খান : সিক্সটি নাইন, না, সেভেন্টিতে।   

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মানে মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর?

হামিদুজ্জামান খান : মানে তোমার সিক্সটি নাইনে ইউরোপ থেকে আসলাম, তারপর একটা টাইম, তারপরই টিচার হইলাম। মুক্তিযুদ্ধের টাইমটা গেলো। দেশ স্বাধীন হলো, তো আমার একটা ভাবনা ছিল, এত কিছু দেখলাম, এতো বিরাট, জীবনের এত অভিজ্ঞতা, এর পর কিন্তু আমি সাবজেক্টই নিয়া নিলাম, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে ভাস্কর্য করা শুরু করলাম। মুক্তিযুদ্ধের উপর অনেক কাজ করলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রচুর কাজ আপনার—

হামিদুজ্জামান খান : এরপর আমি সেভেন্টি ফোরে না সেভেন্টি থ্রিতে আমি স্কলারশিপ পাইছি, ইন্ডিয়া পড়ার জন্য, মাস্টার্স—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বরোদায়!ভাস্কর্যের উপর?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ বরোদায়। বরোদা ছিল ভাস্কর্যের জন্য বেস্ট, ইন্ডিয়ার মধ্যে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : রামকিঙ্কর বেইজ কি বরোদায় ছিলেন তখন?

হামিদুজ্জামান খান :  না, উনি ছিলেন শান্তিনিকেতনে। অ্যাকচুয়ালি কনটেম্পোরারি আর্টের জন্য বরোদা ভালো। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আচ্ছা!

হামিদুজ্জামান খান : আমিই প্রথম যাই বরোদা, বাঙালি হিসেবে। আমি সেভেন্টি থ্রি তে স্কলার শিপ পাইছি তো ওদের সিস্টেম অনুযায়ী—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বাঙালী হিসেবে মানে স্যার কী বাংলাদেশি হিসেবে? কলকাতা থেকে আপনার আগে কোনো বাঙালি পড়ে নাই বরোদায়?

হামিদুজ্জামান খান : না বাংলাদেশি, বাংলাদেশ থিকা, বাংলাদেশের কোন স্টুডেন্ট আমার আগে যায় নাই। আমি সেভেন্টিথ্রি তে স্কলারশিপ পেলাম, গেলাম সেভেন্টি ফোরে কারণ ওদের সীট ছিল না। ওরা বলল, ওয়েট করেন। আমি বললাম, ওকে ওয়েট করবো। ওয়াইট করে পরের বছর গেলাম, সেভেন্টি ফোরে। দুই বছরের মাস্টার্স করলাম,এইখানে আমি মনে প্রাণে স্কাল্পচার নিয়ে ইনভলভড হয়ে গেলাম। 
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বরোদায় গিয়ে শিক্ষাগুরু হিসেবে কাদেরকে পাইলেন আপনি স্যার?

হামিদুজ্জামান খান : বরোদায় তো অনেক অনেক শিক্ষক পেয়েছি। অনেক। কারে রেখে কার কথা বলবো। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মানে কারা স্যার আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণীত করেছে?

হামিদুজ্জামান খান : বরোদার প্রসংগে যেইটা আমি বলতে চাই যে ইন্ডিয়ায় অনেক ভাল টিচার আছে, আমাকে স্কাল্পচারটা ভালো করে বুঝাইতে পারছে, এইটা একটা বিরাট ব্যাপার। আরেকটা আমি লাকী যে বরোদা আমি যখন শেষ করলাম, শেষের দিকে, তখন বরোদার টুয়েন্টিফাইভ ইয়ারস, একটা উৎসব হচ্ছে। তখন যারা অগ্রজ স্টুডেন্ট বরোদার, বড় শিল্পীর সম্মান হয়তো তখনি আছে তাদের একটা স্কাল্পচার এক্সিবিশন হবে বোম্বেতে। বড় এক্সিবিশন ছিল। তো আমার তিনটা কাজ নিয়া যায় ওরা। আমরা তহন স্টুডেন্ট ওখানে। এইটা দিয়া আমি বুঝতে পারলাম, যে আমার পজিশনটা কি! সবাই আমাকে স্কাল্পচার বিষয়ে খুব প্রতিশ্রুতিশীল মনে করত। তো বোম্বেতে যখন এক্সিবিশনটা হয় আমি দেখতে যাই। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বাহ্

হামিদুজ্জামান খান : খুব ইন্টারেস্টিং। তো, আমি যাওয়ার পরে যারা এক্সিবিশন স্পন্সর করেছে তাদের একজন বলল, তোমাকে তো খুঁজছে! আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে খুঁজছে? তো সে বলল, হুসেন!
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হু ইজ হুসেন ইন মুম্বাই?

হামিদুজ্জামান খান : হুসেন হইলো তখন ইন্ডিয়ার টপ মোস্ট ফ্যামাস আর্টিস্ট!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এম.এফ হুসেন, মকবুল ফিদা হুসেন?

হামিদুজ্জামান খান : একদম ঠিক ধরেছো, এম এফ  হোসেন, মকবুল ফিদা হুসেন— তো সেই লোক বলল, হুসেন তোমাকে খোঁজ করতেছে, কেন! তোমার কাজ দেখে সে তোমাকে খোঁজ করতেছে, কিছু কথা বলতে চায়। আর বলছে এই নাম্বারে টেলিফোন করতে। সাথে সাথে ওরা টেলিফোন করল, লম্বাচূড়া, দাঁড়িওয়ালা, খালি পায়ে আসছে হুসেন, শাদা পোশাক পরা। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হা হা হা, তারপর? 

হামিদুজ্জামান খান : খুব খুশি! বলে ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ! আমি বললাম, হ্যাঁ আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি। কয়, ইউ হ্যাভ ইন্নোভেটিভ স্টাইল। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বাহ্! তো আপনার কোন জিনিসটা হুসেনরে মুগ্ধ করছিল?

হামিদুজ্জামান খান : তখনো কিন্তু স্কাল্পচার আমরা যেইভাবে দেখি মোটামুটি সেই কনভেনশনের মধ্যেই ছিল। একটা পেডেস্টালের উপর স্কাল্পচার রাখা হতো। আমার স্কাল্পচারটা এইজন্যই উনার চোখে পড়ছিল, আমি করতাম কী, ডেডবডি করতাম, একটা শায়ীত ফিগার, একটা লোকের কিছুটা খেয়ে গেছে, কিছু আছে, কিছু নাই, কিছুটা কুকুরে মাংস খেয়ে ফেলেছে, এ রকম একটা দৃশ্য, মুখটা হা করে আছে, কিছুটা নাই, তো আমি একটা কাপড়, শাদা কাপড় বিছিয়ে, তিনগজ কাপড় কিন্না ফিগারটা এর উপর শুয়াইয়া দিছি, ফিগারটাও শাদা, প্লাস্টারের, তো এইটা হুসেনকে খুব ইয়া করছে (কাজটি রয়েছে এখন শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে), যে স্কাল্পচার যে এরকম নিচে, গ্রাউন্ডে থাকতে পারে, এইটা তখন পর্যন্ত ভাবা যাইতো না, সবার জন্যই এমনকী হুসেনের জন্যও ইট ওয়াজ স্ট্রাইকিং, আমি সাহস কইরা দিছি তখন, তো হুসেন বলছে, হৌল ইন্ডিয়ার জন্য এইটা খুব ইম্পরটেন্ট, তুমি স্কাল্পচারটারে শোয়াইছো, নীচে নামাইছো, প্যাডেস্টাল বা বেইজ এর থেকে নিচে, এইটা খুব অসাধারণ হইছে সে বলতেছিল। আর আমার কিছু সাবজেক্ট ছিল গরুর গাড়ি,গরুর গাড়ির মধ্যে একটা ডেড ফিগার পড়ে আছে, রিকশা, রিকশাটা একটু ভেঙেটেঙে আছে, রিকশাওয়ালাও পড়ে আছে রিকশার নিচের অংশে এমন কাজ ছিল— সব মুক্তিযুদ্ধের উপর করা কাজ। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার এই কাজগুলো কী কোনভাবে আপনার প্রিয় শিক্ষক জয়নুল আবেদিন প্রভাবিত? উনার বিষয়বস্তুর সাথে একটা সামঞ্জস্য কিন্তু আছে স্যার!

হামিদুজ্জামান খান : কিছু মিল তো আছেই। যেহেতু আমিও তো কিশোরগঞ্জেরই। আবেদিন স্যারের শ্রেষ্ঠ ছবি তো দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা, স্কেচগুলো। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হ্যাঁ একভাবে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। 

হামিদুজ্জামান খান : এই স্কেচগুলা করার পরে আবেদিন স্যার একদম ইনডিয়াকে কাঁপায়া ফেলছে, কারণ উনার যে টিচার, তারাও বলছে তখন, আরে জয়নুল এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আর  উনার যে টান, তুলির, এইটা তো দেওয়া কঠিন এক জিনিস। উনার সে চিত্রমালা সেসময় আমাদের সবাইকেই প্রভাবিত করেছে। উনি সেই স্কেচগুলো না আঁকলে আমাদের চিত্রকলার ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। অসাধারণ সেই চিত্রমালা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : তার মানে জয়নুলের একটা বড় প্রভাব আপনার মধ্যেও আছে। 

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, অবশ্যই। কিছুডা আছে।  চেতনাগত প্রভাব। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার, এম এফ হুসেন যে আপনার ব্যাপক প্রশংসা করল, আপনার কাজ নিয়ে কথা বলল, এইটা তো স্যার আপনারে ইন্সপায়ার করে!

হামিদুজ্জামান খান : এইটা আমাকে সাংঘাতিক ইন্সপায়ার করছে। আমাকে উনি একদম স্কাল্পচারের ভিতরে ঢুকায়া দিলো। স্কাল্পচার আমার ব্লাডের মধ্যে তখন। উনার প্রশংসা আমার ভিতর স্কাল্পচার আরো বেশি করে ঢুকিয়ে দিল। এবং আমি আত্মবিশ্বাসও পেলাম যে স্কাল্পচার আমাদের হবে। এটা বিরাট ব্যাপার। কারণ এম এফ হুসেন আমি তো তারে খুঁজতেও যাই নাই। আমার সাহসও ছিল না। নিজে থেকে আমার কাজ দেখে তিনি আসছেন। এসে আমাকে খুঁজে বের করে কথা বলছেন, তো, এইটা আমার জন্য ছিল অনেক বেশি পাওয়া।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার কাজের যে ফর্ম, মূলত ভাস্কর্যের কথা যদি বলি, পেইন্টিং ছাড়া, আপনার কাজ তো ফর্মবেইজড, আপনার কাজে ফর্মের বিবর্তনটা কীভাবে হলো স্যার?

হামিদুজ্জামান খান : বিবর্তনের মধ্য দিয়েই আসছে। আমাকে একজন খুব নামকরা ক্রিটিক প্রশ্ন করছিল যে, তুমি যা করছো,একজন প্যারিসের ভাস্কর একই কাজ করে, তাহলে ফর্মটা কেনো আলাদা রকম!

আমি বলেছিলাম, এইখানেই ভাস্করের শক্তি। ফর্মটা ইউনিভার্সাল, এন্ডলেস। একটা ফর্ম থেকে অসংখ্য ফর্ম একই প্যাটার্নের তৈরি হতে পারে। আসলে হৌল বিশ্বেই কিন্তু আর্টিস্টরা একেকজন একেকটা ফর্ম ক্রিয়েট করেন, তাকে ব্র্যান্ডিং করেন, সেইটা নিয়ে কাজ করেন, এইটা নিয়ে তার আইডেন্টিটি হয়, এইটা যখন রিকগনাইজ হয় তখন তিনি ফেমাস হয়ে যান, অনেক বড় হয়। ফর্মই তাই মোস্ট ইম্পরটেন্ট। ফর্ম ইজ এন্ডলেস। সরাসরি স্বীকার করলে তো এইটা ডেসক্রেপটিভ একটা ইলাস্ট্রেটিভ ব্যাপার হয়, কিন্তু ফর্ম ব্যাপারটা অনেক ইউনিভার্সেল। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার এই যে পাখির ফর্ম, উড্ডীন অবয়ব এইটা তো সুবিদিত। আপনার প্রচুর কাজ এই ফর্ম ভেঙে করা। টিএসসির সামনের কাজটা স্যার, হাজার হাজার পাখি মনে হয় উড়ে যাচ্ছে, এই আইডিয়াগুলো জেনারেট করার স্যার, প্রক্রিয়াটা কি?

হামিদুজ্জামান খান : আমি তো কাজের মধ্যে থাকি। এইটা আমার খুব ইম্পরটেন্ট।ক্রিটিকের কথা বলতেছিলাম। আমারে সে অনেক মজার প্রশ্ন করছিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : নামটা কি স্যার ক্রিটিকের! তা তো বললেন না!

হামিদুজ্জামান খান : জেরার্ড জুড়িগুয়েরা। হি ইজ ফ্রম ফ্রান্স, হি ইজ ওয়ান অব দ্যা লিডিং ক্রিটিক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড। মে বি নাম্বার ওয়ান, মে বি নাম্বার টু। আই লাইক হিজ ওয়ার্কস। উনি যখন জিজ্ঞেস করলেন ফর্মগুলো কই পাই, আমার উত্তরটা ছিল যে আমি তো কাজ করে করে পাচ্ছি। আমি তো প্যারিসে নাই, আমি তো নিউইয়র্কে নাই, আমি কাজ করি বাংলাদেশে, প্রচুর কাজ করি, এখনো চব্বিশ ঘন্টার ১৬ ঘন্টাই কাজ করি, ফলে কাজের ভিতর দিয়ে দিয়ে আমার বিবর্তনটা, পরিবর্তনটা ঘটে। যেইটা তুমি বুঝতে চাইতেছো। এইটা আমার ভালো লাগছে যে তুমি বুঝতে চাইলা। আমি অনেক ইন্টারভিউ দিছি কিন্তু এইভাবে ব্যাপারটা কেউ জানতে চায় নাই। একটা ড্রয়িং করার সময় আমি অনেক অনেক ড্রয়িং করি। করে করে করে করে এইটাকে একটা আমার সাথে ভাবি, আমি আমার সাথে মিশাই,এভাবে পরিবর্তনও হয়, হয়ে হয়ে আমার আইডেনটিটি, আমার চিন্তুাভাবনা এসব আসে, আমার ভিতর থেকে তখন যেটা আসে শেষপর্যন্ত ওটা রাখি আমি, ওটাই আমি বের করতে চেষ্টা করি। এভাবেই কিন্তু বিবর্তনটা আসছে আমার কাজের মধ্যে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার, আপনার প্রথম দিকের কাজের কথা যদি বলি আমরা, অনেক বেশি ব্রোঞ্জ, মেটালে অর্থাৎ ধাতব মাধ্যমে কাজ করতেন আপনি। আপনাকে অনেকেই ‘ধাতব ভাস্কর’ নামে অভিহিত করেছেন, আপনার ইন্টারভিউগুলো পড়তে গিয়ে দেখলাম, গত বছর শুধু কাঠের কাজ দিয়ে আপনার একটা প্রদর্শনী হইলো। আজকে স্যার বাসায় এসে দেখলাম আপনি প্রচুর রকের কাজ করতেছেন। এই ট্রান্সফর্মেশনটা কীভাবে হলো? ব্রোঞ্জ থেকে উড, এরপর রক, এই ভ্রমণটারে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

হামিদুজ্জামান খান : আমি যেইটা বুঝতে চাই আসলে স্কাল্পচার তো স্থায়ী জিনিস, অনেকদিন টিকে থাকবে। এই জন্যে পৃথিবীতে দুইটা মেটেরিয়াল খুব ইম্পরট্যান্ট, একটা হলো স্টোন, আরেকটা হলো মেটাল। যারা বেশি মেটালের কাজ করে তাদের বলে মেটাল আর্টিস্ট। যেমন আমাদের এখানে কিন্তু স্টোনটা সেইভাবে অ্যাভেইলেবল ছিল না, বা আগে এইভাবে দেখিনি, আর এত এক্সপ্লোরও করতে যাইনি, দু সুলভ তা দিয়া কাজ করছি। আমাদের এখানে তো মেটালের কাজ প্রচুর, শিপবিল্ডিং হয়, মেটালটা প্রচুর ইউজ হয় আমাদের দেশে, আমরা ঘরে একটা স্টিলের আলমারি রাখি, স্টিলের চেয়ার রাখি, মেটালের সাথে আমাদের একটা সম্পর্ক আদি থেকেই আছে। ইভেন আমাদের দাও কাঁচি এগুলো মেটালেরই। আমি দীর্ঘদিন থেকে মেটালের কাজ করি। মেটালটাকে এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করতেছি দীর্ঘদিন থেকে, বেশিদিন না, এই যে স্টেইনলেস স্টিল এইটা তো বেশিদিন হয় এখানে আসে নাই। আমি যেইটা তোমারে বলি, দাঁড়াও, আমি এইহানে প্রথম যে কাজটা করি সেইটা বঙ্গবভনে, বড় কাজ আর কী! যে কাজটা করি বঙ্গবভনে এটা মেটালের, ব্রোঞ্জ, মেটাল শিটে করা। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার পানি খেয়ে নেন। 

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, কাজটা ছিল আধুনিক ফর্মে। কিন্তু তহন তো স্কাল্পচার এই দেশে এতটা—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : পপুলার না!

হামিদুজ্জামান খান : শুধু পপুলার না, না, বোধগম্যও না। আমি দেখছি ঐডা করার পরে, অনেক বিরূপ, মানে এইটা হয় নাই কিছু এরকম, পাখি পাখির মতো হবে, এরকম ধাতব কিছু হবে না, এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা তখনো হয় নাই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ফর্মের কারণে লোকজন বলছে যে এইটা পাখি হয় নাই!

হামিদুজ্জামান খান : বঙ্গভবনে মন্ত্রী, সেক্রেটারি এমন বড় মানুষজন যায়। গিয়া যদি বলে এইটা কিছু হয় নাই তাইলে তো সমস্যা। ফাইনালি এইটা যখন শেষ হইল, পাখিটাখির সব কাজ, আসলে এই টা তো ফোয়ারা, সুন্দর ফোয়ারা, যখন শেষ হইলো তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এইটা দেখে বলল ‘ভেরি গুড’। তখন আবার সবাই পছন্দ করছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : (জোরে হেসে উঠে) হা হা হা, জিয়াউর রহমান বলছে বইলা সবাই পছন্দ করছে, না? জিয়াউর রহমান না বললে যেন কিছু হয় নাই, এমন!

হামিদুজ্জামান খান :  এইগুলা এক্সেপ্ট হইছে এইভাবে। কিছু করার তো নাই। কাজ করতে হবে। প্রসিডিউরগুলো শিল্পীদের জন্য খুব ভালো ছিল না। জিয়াউর রহমানের বলার মধ্য দিয়া এইটা বঙ্গভবনে এক্সেপ্ট হইলো এভাবে। আমি মেটালে কাজ করি দীর্ঘদিন থেকে। ধরো, ব্রোঞ্জে কাজ করতাম, ঢালাই করতাম, তারপর স্টেইনলেস স্টিলের প্রচুর কাজ করছি, ইদানীং আমার মনে হইছে, আরো মেটেরিয়াল তো আছে, হোয়াই নট আই এক্সপ্লোর! 

শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন : এখন তো রকে কাজ করতেছেন!

হামিদুজ্জামান খান : রক হইলো ফাইনাল মিডিয়া। এইজন্য আগে আমি কাঠে কাজ শুরু করছি। কাঠে প্রচুর কাজ করছি, দুই বছর আড়াই বছর কাজ করলাম কাঠের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নাই, তাই প্রচুর টাইম আমার, কাঠে কাজের পর এখন আমি স্টোন কাটছি। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার স্টোন নিয়া তো গ্যালারি কায়ায় প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে কয়েকদিন পর। 

হামিদুজ্জামান খান : তুমি তো বালো খবর নিছ আমারে নিয়া। স্টোনটা আমি ভাবছি এক্সক্লুসিভ একটা এক্সিবিশন করব। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হ্যাঁ স্যার, গৌতমদার এসএমএসে জানলাম ১৭ অক্টোবর আপনার স্টোনের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী শুরু হবে। 

হামিদুজ্জামান খান : ১৭ অক্টোবর শুরু হবে। ঠিকই আছে। গ্যালারি কায়ায়। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আগাম অভিনন্দন স্যার। আমরা একটু পেছনের প্রসঙ্গে যাই, আপনি তো ইউরোপ থেকে ফিরলেন, তো আপনার যে দেখার জগৎ বদলায়া গেল। আপনি প্রচুর ভাস্কর্যের ভাস্কর, যেগুলো খুবই আলোচিত আর বিখ্যাত। আমি জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী বলে আমার একটু জাহাঙ্গীরনগর প্রীতি আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক হয়ে আছে আপনার ভাস্কর্য ‘সংসপ্তক’। এই গল্পটা শুনি স্যার, সংসপ্তক কীভাবে বানাইলেন! 

হামিদুজ্জামান খান : সংসপ্তকটা ছিল প্রতীকী ফর্মে। তখনো ভাস্কর্য যেগুলো হচ্ছে সেগুলো আসল ফিগারের খুব কাছাকাছি করে হচ্ছে। সংসপ্তকটাতে প্রথম আমি অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মে নিয়া গেছি। এজন্য একটু বিরূপ ভাবও ছিল অনেকের। যে এইটা তো হয় নাই ঠিকমতো। কিন্তু টোটাল জিনিসটা, একটা পাওয়ার এর মধ্যে আছে, যেইটা কাজটারে পপুলার করছে আর কি! সংসপ্তক মানে একটা গতি, আমি বলছি মুক্তিযুদ্ধ মানে একটা পাওয়ার, একটা শক্তি, একাত্তর হইলেই আমরা ইয়া হই, উজ্জ্বীবিত হই, একটা এনার্জি আমাদের এমনি থিকাই আসে, কারণ স্বাধীনতা আমরা অর্জন করছি, এইটার চিহ্ন হইল মুক্তিযুদ্ধ, থ্রো মুক্তিযুদ্ধ আমরা এই ফোর্সটা পাইছি, এইডা যখন বলি, তহন এইডা গিয়া যখন তাকায়, তহন দেখে যে মিলে যায়। 

শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন : মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যেক বাঙালির চেতনাতেই ভিন্নভাবে কাজ করে। আপনি সেইটাক ধরছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং এর ঠিক আগের সময়গুলো নিয়ে জানতে চাই। আপনি তো তখন ঢাকাতেই।

তরুণপ্রাণ এবং ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকতেছেন। চারুকলার কাছেই রেসকোর্স ময়দান, সাতই মার্চের ভাষণ শুনতেছেন। সেই সময়টায় কী কী দেখলেন আপনি?

হামিদুজ্জামান খান : আমি দেখছি মুক্তিযুদ্ধের সময়, গ্রাম, গঞ্জে, শহরে বঙ্গবন্ধুরে নিয়া কী উত্তেজনা। একটা লোক সে কোনোদিন দেখে নাই বঙ্গবন্ধুরে, অথচ বঙ্গবন্ধুর জন্য সে রোজা রাখতেছে। এইটা কিন্তু আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, আমি তো বেশির ভাগ সময়টা গ্রামে ছিলাম, দেখছি, এ রকম পপুলার ছিলেন উনি। এই যে পপুলারিটি এটা কিন্তু একদম ভেতরের থেকে আসছে জিনিসটা। তো বঙ্গবন্ধু হইছে একটা প্রতীক, যাকে ধরে দেশটা স্বাধীন হইল। মানুষ যে এই যে জীবন দিল, একটা তো সিম্বল দরকার, বঙ্গবন্ধু যেভাবে ইন্সপায়ার করল জাতিকে, একত্র করল, করে আমরা দেশটাকে স্বাধীন করলাম এটা ভাবা যায় না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় কোথায় ছিলেন স্যার? সেই সময় কী কী করলেন? মুক্তিযুদ্ধ তো করেন নাই স্যার!

হামিদুজ্জামান খান :  না। মুক্তিযুদ্ধ করি নাই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : পালিয়ে গেছিলেন স্যার ভয়ে? কবে গেলেন ঢাকা থেকে?

হামিদুজ্জামান খান : কে ভয় পায় নাই তখন। আমি ঢাকা থেকে গেছি ২৫ মার্চের সপ্তাহখানেক পরে। হেঁটে হেঁটে গেছি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : কই গেছেন? 

হামিদুজ্জামান খান : কিশোরগঞ্জ। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ওই নয় মাসই কী স্যার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন?

হামিদুজ্জামান খান : না গ্রামের বাড়িতে ছিলাম না। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মাঝখানে আসছেন? 

হামিদুজ্জামান খান : মাঝখানে আসছিলাম ঢাকায় এবং শেষের দিকে ঢাকায়ই ছিলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : চেকপোস্টে পাকিস্তান আর্মি ধরে নাই? 

হামিদুজ্জামান খান : অনেক অনেক। প্রথমদিকে সেকেন্ড ক্যাপিটালে আমি থাকতাম। রাত্রে, আর্মি আসল, আইসা বলল, সব দেখবে। আর আর একজন ধাক্কা দিয়ে আমাকে দিলো, ওকে গুলো করো। নিয়া গেলো গুলো করতে, মানে ড্রেনের কাছে নিয়া গেলো, তারপরে আমার ভাইস্তা ছিল আমার সাথে, তারে আবার বলল বাথরুমে ঢুক। তারে ঢুকায়া দিয়া, এই অবস্থা ছিল। ওরা ভেতরে ঢুকল, ঢুকে সবকিছু দেখল। তো আমি তো খুব ভয়ে ছিলাম। ওখানে একটা খুব খারাপ জিনিস হয়েছিল। ঐহানে, বরিশালের একটা গুপ্তি বলে, এইরকম লাঠির ভিতর ছুরির মতো, গুপ্তি—
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : চিনি স্যার। 

হামিদুজ্জামান খান : ভেতরে ছুরি বাইরে থেকে বোঝা যায় না, ঐটা ছিল। এটা বিছানার নিচে ছিল, তোষকের নিচে, ওরা তোষক টোষক সব দেখলো, আমাকে ড্রেনের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখল। গুপ্তিটা নিয়ে ভয়ে ছিলাম, তো ওরা এইটা পায়নি। যাওয়ার সময় আমাকে ধাক্কা মেরে ড্রেনে ফেলে চলে গেল। লিভ ইট। বইলা চইলা গেল। পরে ঘরে ঢুকে দেখি যে, কিছু কিছু জিনিসপত্র নাই। সেলাই মেশিন নাই, কিছু কাপড় নাই। তারপর ওই বাড়িতে একটা উর্দু স্পিকিং লোক ছিল, দেখি যে তারেও বাথরুমে আটকায়া রাখছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : সেকেন্ড ক্যাপিটাল মানে বুঝি নাই স্যার। এইটা কোথায় ছিল স্যার? 

হামিদুজ্জামান খান : এইটা ছিল শেরে বাংলানগর। টেলিসামাদের বাড়ি ছিল ঐটা। ঐ রাতে ঐ বাড়িতে আমি ঘুমাইছি ঐদিন। টেলিসামাদ বলে আমার বাড়িটা খালি, তুমি আমার বাড়িতে থাক। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : বাংলা সিনেমার কৌতুক-অভিনেতা টেলি সামাদ ওয়জ আপনার ফ্রেন্ড?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, ও আমার ফ্রেন্ড। ওর বাড়িতে আমার এই অভিজ্ঞতা হইল। এর পরের সময়গুলো আমি খুব আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। এর পরদিন কার্ফ্যু কয়েক ঘণ্টারজন্য স্টপ হলো, আমি আমার ভাইস্তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম। কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে একটা ট্রাকে উঠলাম, তারপর নদী পাড় হইলাম, নৌকায় উঠলাম এ রকম করতে করতে গ্রামে গেলাম। কিশোরগঞ্জ। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার এই যে যাওয়া এবং এরপর আবার আসা। ১৬ ডিসেম্বরের কথা মনে আছে স্যার? ১৬ ডিসেম্বর কী করলেন? 

হামিদুজ্জামান খান : ঐ সময়টাই আমি ঢাকায় ছিলাম। তখনো আমি, চারুকলায় গেলাম একবার। তখন আমার স্যার শফিকুল আমীন, উনি আমাকে এক আর্মিকে ধরায়া দিল, পাকিস্তানি আর্মি, সে আমার কাছে শিখতে চায়, ছবি আঁকা। আমি পড়ছি বিপদে। আর্মিকে আমাকে দিল। ইয়া লম্বা। গোঁফ ওয়ালা। আর্মি বলে তুমি আমাকে আর্ট শিখাবা। কী বিপদ বলো। আমি নিয়া গেলাম নিউমার্কেটে। আমাকে, লোকজন কীভাবে তাকায়া থাকে! মানে, আর্মির সাথে আমি! 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : লোকজন তো ভাবতেছে আপনি রাজাকার! 

হামিদুজ্জামান খান : ঠিক তাই! লোকজন তো ততদিনে শিল্পী হিসেবে আমাকে চিনে। তো তারা মিলাইতে পারতেছে না। আমি তারপর নিউমার্কেট থেকে কাগজ, রং, পেন্সিল, তুলি এসব কিনে তাকে দিলাম। দিয়ে বললাম, ইউ কাম টুমরো, আইসা আমাকে নিয়া যাও। আজকে তুমি চলে যাও। তারপর আমাকে চারুকলায় আর্মি জিপ থেকে নামায়া দিয়া ও চলে গেল। যাওয়ার সময় বলল, আই উইল কাম টুমরো মর্নিং। টুমরো আর কি! আমি যে ভয় পাইছি, ঢাকা থেকে অনেক দূরে চইলা গেলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : পালাইলেন! একটা আর্মি ছাত্রের মায়া ত্যাগ করলেন আপনি ভয়ে! আহা!

হামিদুজ্জামান খান :  ও পরদিন চারুকলায় আইসা নাকি খুঁজছে আমারে। বলছে, হোয়ার ইজ হামিদুজ্জামান? ও তো বলে, আমাকে আসতে বলছে হামিদুজ্জামান। আমি তো অনেক দূরে চলে গেছি (হাসি) যাতে আমাকে ট্রেস করতে না পারে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার, মুক্তিযুদ্ধে যাইতে ইচ্ছে করে নাই কখনো!

হামিদুজ্জামান খান : আমি ঠিক এই লেভেলটা তখন এইভাবে পাই নাই। এইটা হলো, দেশ স্বাধীন হলো, সিনটা দেখছি। ইচ্ছে তো করছে, কিন্তু কীভাবে যাইতে হবে, সেই কানেকশনগুলো আর আমার গড়ে উঠে নাই। সিনটা দেখছি। ঢাকার যে সিনগুলা। অনেক জায়গায় কিন্তু নিউমার্কেটের কাছাকাছি, ডেডবডি পড়ে ছিল, রায়ের বাজারে, এগুলা আমরা হেঁটে হেঁটে গিয়ে কিছু দেখছি। এইগুলা কিন্তু আমাকে খুব ইয়ে করে। পরবর্তী সময়ে আমার স্কাল্পচারেও খুব ছাপ ফেলছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার কাজের মধ্যে এগুলা আছে। এই যে আপনি বলতেছিলেন, মকবুল ফিদা হুসেন যে খুব খুশি হইল আপনার কাজটা দেইখা, বা শাহবাগের জাদুঘরে রাখা আপনার কাজ এগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ, বদ্ধভূমিতে পড়ে থাকা লাশ ব্যাপারগুলা খুব আছে। 

হামিদুজ্জামান খান : এইগুলা কিন্তু সরাসরি আমি দেখছি। ইভেন আমি যখন, দেশে যাই দেখি কী পানির মধ্যে লাশগুলা ভাসতেছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : তার মানে স্যার, আপনার কাজ আপনার দেখার জগৎ দ্বারা প্রভাবিত! 

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ, এইগুলার প্রচণ্ড ইনফ্লুয়েন্স আছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার আপনার কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পাখির ফর্ম, বা পাখির মোটিভ। 

হামিদুজ্জামান খান : পাখি আমার খুব ভাল্লাগে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : পাখি হয়ে যায় এই প্রাণ! পাখি ভালো লাগার কারণগুলো কি স্যার ব্যাখ্যা করতে পারেন?

হামিদুজ্জামান খান : আমি বলি, আমি যখন স্কুলে যেতাম, গ্রামে। আমার স্কুলটা ছিল প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। হেঁটে যাইতাম। রাস্তায় ছিল, তোমরা বলো বিল, গ্রিন, ধানক্ষেত সবুজ হয়ে আছে বিলে, এর মধ্যে হঠাৎ সাদা পাখি উড়া দিল, তো পাখিকে তো ওপেন, মুক্ত দেখছি। পাখিকে আমার কাছে মুক্তির প্রতীক মনে হইল। যেখানে খুশি উড়ে যাইতে পারে। এজন্য আমি, আমাকে প্রথম যখন বঙ্গভবনে বলল, বকের ফর্মটাই আমি এহানে কিন্তু আনছি—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : মাথা উপর দিকে করে বক যেটা দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকটা সেই কাজটা স্যার?

হামিদুজ্জামান খান : হ্যাঁ। সেই কাজটা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ওইটা ছাড়াও স্যার, ওপেন ইউনিভার্সিটিতে একটা কাজ দেখলাম কয়েকদিন আগে, এ ছাড়া পটুয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজগুলোতেও আপনার পাখির ফর্ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনের কাজটাও তো পাখিভর্তি, তো স্যার রিসেন্ট কাজ নিয়েই যদি বলেন, ওপেন ইউনিভার্সিটির কাজ নিয়েই যদি বলেন!

হামিদুজ্জামান খান : মুক্তিযুদ্ধ এর প্রধান ফোকাস ছিল। যেহেতু এটা একটা গ্রাম, ওপেন ইউনিভার্সিটি তো প্রায় গ্রামের মধ্যে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : গাজীপুরেরটা স্যার! 

হামিদুজ্জামান খান : ওহ! না। এইটা পাখি করছি আমি। আর চারদিকে রিলিফ আছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাবলি, বিজয় দিবস, এসব। তুমি দেখেছ এটা?

শিমুল সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ স্যার। সপ্তাহখানেক আগে। বিশাল কাজ। 

হামিদুজ্জামান খান :  হ্যাঁ, বিশাল স্কেলে করা কাজ। বিশালই কিন্তু! হাইট প্রায় সিক্সটি ফিট। এইটা একচুয়ালি শুরু করছিল রাজ্জাক স্যার। খালি ডিজাইনটা করছিল উনি। পরে তো উনি মারা গেল, আমাকে বলা হইল এটাকে ফুল স্কেলে করে বড় করার জন্য। আমি প্রায় দেড় বছর কাজ করে এটা করলাম। আমার মতো করেই করলাম। একটু আধুনিক ফর্মে। বলাই হইছে, তুমি তোমার মতো করে কর, তবে স্যারের আদলটা যেন থাকে। তো, রিসেন্টলি আমি এই কাজটাই শেষ করলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আচ্ছা। স্যার ঢাকা শহরে ওপেন এয়ারে বা মুক্ত যে ভাস্কর্যগুলো আছে, তাতে তো আপনার চেয়ে মৃণাল হকের ভাস্কর্যের সংখ্যা বেশি। আমার সাথে একটা সাক্ষাৎকারে শিল্পী হাশেম খান বলছিলেন, অরুচিকর ভাস্কর্যের সংখ্যাই বেশি। মূলত মৃণাল হক প্রসঙ্গে। এগুলো নিয়া আপনার মতামত কি স্যার?

হামিদুজ্জামান খান : আমি বলি (মৃদু হাসছেন) যেহেতু স্কাল্পচার একটা পারমানেন্ট স্ট্রাকচার, এখন আর্কিটেক্টরাও কাজ করে। যখন স্ট্রাকচারটা সুন্দর হয়, তখন অনেক বেশি লুক্রেটিভ লাগে। এখন ওপেন এয়ারে রাখা মানে একটা চ্যালেঞ্জও কিন্তু আছে। কারো মুখ তো ধরে রাখতে পারব না আমি। ভালো মন্দ সে বলবেই, চ্যালেঞ্জও একটা। আমার মনে হয় যারাই কাজ করবে এই চ্যালেঞ্জটা মাথায় রাখা উচিত। আমি যে এখানে কাজটা দিচ্ছি, এটাতো আলোচিত হবে। এটা অনেক দিনের জন্য দিচ্ছি, সুতরাং অনেক দিন আলোচিত হবে। তো, যখন কেউ কাজটা করবে তখন উচিত সুস্থভাবে, অনেক ভেবে চিন্তে, যাতে এইটার মানটা আরো উঁচু হয়, সেইটা নিশ্চিত করে কাজটা করা। বাংলাদেশের স্কাল্পচার যাতে সামনের দিকে যায় সেইভাবে সুস্থভাবে করা উচিত। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : ঢাকা শহরে রাস্তায় যে ভাস্কর্যগুলো আছে তার মধ্যে আমরা দেখি যে, নিতুন কুণ্ডুর ভাস্কর্য আছে, আবদুর রাজ্জাক স্যারের ভাস্কর্য আছে, হামিদুজ্জামান খানের ভাস্কর্য আছে, মৃণাল হকের ভাস্কর্য আছে। আপনি ছাড়া বাকিদের কাজগুলোর মধ্যে আপনার সবচেয়ে পছন্দের কাজ কোনটা? 

হামিদুজ্জামান খান : মৃণালের কিছু কিছু কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। একেবারে ফালায়া দেওয়া মতন না। আমি বলব। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনি কী বর্ষারানির কথা বলছেন? সাতরাস্তা মোড়ে? নাকি কাকরাইল মোড়ের সমতা বা ইকুইটির কথা বলছেন?

হামিদুজ্জামান খান : না, না, তোমার (ইনডিপেনডেন্ট) টেলিভিশনের কাছে যে, চ্যানেল আইয়ের কাছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : হ্যাঁ স্যার, চেইন দিয়ে করা পুরনো গাড়ি। পেট্রোল পাম্পের সামনে যে! 

হামিদুজ্জামান খান : এইটা কিন্তু মৃণালের খুব ইন্টারেস্টিং কাজ। আমি বলব। তবে মৃণালের কাজ প্রপোরশনটপোরশন মিলায়া আরো সুচিন্তিত হওয়া উচিত আর কি! ওর কিছু কাজে প্রপোরশনের খুব ঝামেলা আছে। চোখে পড়ে সেগুলো। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : নিতুন কুণ্ডুর সার্ক ফোয়ারা আপনি কোথায় রাখবেন স্যার অ্যাজ এ স্কাল্পচার?

হামিদুজ্জামান খান : আমি খুব বড় একজন ভাস্কর্য স্কলারকে সার্ক ফোয়ারা নিয়া প্রশ্ন করছিলাম। তো সে বলছিল, সার্ক ফোয়ারার একটা মজার দিক হইল এইটার অবস্থানটা। যেকোনো দিক দিয়া দেখলেই এইটা সেইম। এইটা যদি একটু উঠানামা করত আরো বেশি ইমপ্রেসিভ হতো। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার শিক্ষকতা জীবন শেষ হলো। ৪২ বছরের শিক্ষকতা। এখন তো স্যার আর বিশেষ অকেশন ছাড়া চারুকলায় যান না। নিজের বাসারেই স্কাল্পচার স্টুডিও বানিয়ে নিছেন। এখন স্যার আপনি কীভাবে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন? 

হামিদুজ্জামান খান : আমি দুই বছর হলো চাকরি থেকে ফ্রি। আমার মনে হয় এই রিটায়ারমেন্ট যদি আরো আগে নিতাম তাহলে আরো ভালো হতো। আরো বেশি কাজ করতাম। কাজ করি আমি প্রচুর।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনার চেইঞ্জও কিন্তু প্রচুর।

হামিদুজ্জামান খান : অ্যাকচুয়ালি চেইঞ্জ করতে আমার ভাল্লাগে। আমি প্রথম দিকে ছিলাম ব্রোঞ্জ কাস্টার, তারপর শিট মেটাল, তারপর মেটাল পাইপ, পাইপ থেকে কিন্তু আবার কাঠ, উড থেকে আবার স্টোন, এগুলো আমি মেটেরিয়ালের যে কোয়ালিটি তাকে এক্সপ্লোর করতে চাই, এই যে আমার সামনে এখন যে স্টোনটা আসবে, সে মানে ম্যাটিরিয়ালটা কী বলে তা বুঝতে চাই। এই বয়সে এসে আমি আসলে, আমি এইটা ধরতে চাই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : তার মানে এখনো আপনি শিল্পের অন্বেষণটা করছেন, একজন নবীন শিল্পীর মতোই। 

হামিদুজ্জামান খান : চেষ্টা করছি। প্রতিমুহূর্তেই আমরা নতুন।  

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন স্যার। এখন যেহেতু অবসর নিয়েছেন, শিক্ষক থাকলে যেসব কথা বলা যেতো না সেরকম একটা প্রশ্ন করি স্যার।
হামিদুজ্জামান খান : করো—

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আপনি সব কিংবদন্তি সব শিক্ষকদের পেয়েছেন নিজের ছাত্রজীবনে। জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে বাসেত স্যার, কামরুল হাসান, কিবরিয়া স্যার—
হামিদুজ্জামান খান : আমিনুল ইসলাম স্যার।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : জ্বি স্যার, তো আপনি উনাদের কাছে যে স্টুডেন্টলাইফটা পাইছিলেন, আপনি আপনার গত বিশবছরের শিক্ষকতায় কী এমন ছাত্রজীবন কাউকে উপহার দিতে পেরেছেন?

হামিদুজ্জামান খান : আসলে এখন অনেক ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ে আসছে চারুকলায়। কিন্তু এখনো, যখন অ্যাডমিশন টেস্ট আসে সব পেইন্টিংয়ে দৌড়ায়। কিন্তু ফাইন আর্টসের দুইটা মূল মাধ্যম, একটা হইল স্কাল্পচার আরেকটা পেইন্টিং। এর পরে বাকিগুলো। এইটা যেইভাবেই হোক, এইটা মানতে হবে। আমরা দেখতাম, স্কাল্পচারে অত স্টুডেন্ট তখন আসত না। যারা ভর্তি পরীক্ষায় খুব ভালো করল, তারা অন্য জায়গায় চলে যাইত। পেইন্টিং তো নিবেই।  স্কাল্পচারে আমরা বসে থাকি, স্টুডেন্ট আসে না এমন একটা সময় ছিল। কিন্তু এখন ভালো স্টুডেন্ট আসছে। আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জায়গাটা অনেক চেইঞ্জ। স্কাল্পচারেও যে একটা ভালো করার ব্যাপার আছে, সেটা একভাবে প্রতিষ্ঠিত হইছে। আর স্কাল্পচার তো এখন আগের চেয়ে অনেক পপুলার। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : অবশ্যই। 

হামিদুজ্জামান খান : আমরা যখন স্কাল্পচার করি তখন স্কাল্পচারের চলনবলন কিছুই ছিল না। ঐ যে আমি তোমারে বললাম, গণভবনে কাজ করলাম মিনিস্ট্রির লোকজন এসে বলল, এইটা কী করছে! আর এখন আমি একটা কাজ করলাম, আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘হামিদ ভাই, একটা সুন্দর মডার্ন ফর্ম আমাদের দিছেন।’ এই কথাটাই কিন্তু চেইঞ্জ। আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা অনেক অনেক বেটার এখন। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আমি আসলে একাডেমির কথা জানতে চাইতেছি স্যার।

হামিদুজ্জামান খান : বলতেছি। আজকেও একটা ছেলে আমার কাছে আসছিল। তুমি ফোন করার একটু আগে। ভালো কাজ করে। এহন তো অনেকে ভালো কাজ করে। আমাদের কিছু ছেলে জাপান গেল। জাপানি একজন আর্টিস্টকে হেল্প করার জন্য। ফলে বলা যায় কিন্তু যে এক ঝাঁক ছেলে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এগুলো নিয়ে আমরা আশাবাদী স্যার। কিন্তু আমি জানতে চাই চারুকলার যে সামগ্রিক পরিস্থিতি, যেখানে আপনি আপনার কর্মজীবন শেষ করলেন, তার পরিস্থিতি নিয়ে কি স্যার আপনি সন্তুষ্ট?

হামিদুজ্জামান খান : ইউনিভার্সিটির দিকে যদি আমরা যাই, ইউনিভার্সিটিতে অনেক প্রবলেম থাকে, স্টুডেন্ট প্রবলেম, পলিটিকাল প্রবলেম, আনরেস্ট থাকা, তো চারুকলায় কিন্তু কাজ বন্ধ নাই। ছেলেমেয়েরা যারা নিমগ্ন শিল্পে তারা কিন্তু কাজ করতেছে। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আমি স্যার জানতে চাচ্ছিলাম আবেদিন স্যারদের কাছে আপনারা যেমন গাইডেন্স পেয়েছেন এখন কী বর্তমান চারুশিক্ষার্থীরা সেই রকম পায়?

হামিদুজ্জামান খান : না, এইটা তুলনার কথা তো বলাই যাবে না। কারণ আবদিন স্যাররা ছিলেন অনেক ওপরে। আমরা এত বড় শিক্ষক ছিলাম না। উনারা যত ডেডিকেশন নিয়া আমাদের রাস্তা দেখাইছেন, সেই জায়গায় এখন নাই। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : তার মানে কী স্যার আপনি আমার সাথে একমত, চারুকলার শিক্ষকদের ডেডিকেশনের জায়গা কমছে আসলে! 

হামিদুজ্জামান খান : অন্যদেরটা কীভাবে বলি। আমি চারুকলায় কম যাই কেন, আমার হলো গাড়িটা পুরান (হাসি), গাড়িটা নিয়ে গেলে বাড্ডা থেকে অনেকেই আড়ালে মনে হয় হাসে। অনেক পুরান গাড়ি। গিয়া দেহি চারুকলার টিচারদের নতুন নতুন গাড়ির অভাব নাই। এইটা চেইঞ্জ। মানে, এখন ওরা প্রচুর কাজ করে, প্রচুর টাকা আর্ন করে, কাজের বাজারও আছে। ইনকাম করে, নতুন গাড়ি বাড়ি ব্যবহার করে। লাইফস্টাইল চেইঞ্জ হইছে শিল্পীদের। কিন্তু কাজের জায়গাটা তো এইটা হলে হবে না। তবে আমার মনে হয় আমাদের স্যারদের যে ডিভোশন ছিল তার কাছাকাছি ডিভোশন আমাদেরও ছিল, এখনো অনেকের আছে। কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্মের মধ্যে ডিভোশনটা একটু কম। কাজের জায়গাটায় ডিভোশন ছাড়া হয় না। আমার মনে হয় এইটা আরো বাড়াতে হবে। ডিভোশনটা। 
শিমুল সালাহ্উদ্দিন : স্যার, ইয়াং স্কাল্পটর যারা তাদের মধ্যে কাদের কাজ আপনার ভালো লাগে, সম্ভাবনাময় মনে হয়? 

হামিদুজ্জামান খান : আসলে অনেকেই খুব ভালো কাজ করতেছে এখন। নামগুলো সব ঠিক আমার মনেও নাই। নাম তো মনে থাকে না। মনে থাকে কাজ। চারুকলার সামনে জশের কাজটার কথা মনে পড়তেছে। ওইটা ভালো কাজ। এখন অনেকে ভালো কাজ করতেছে। স্কাল্পচারের সবচেয়ে বড় সমস্যা জায়গা পাওয়া। ইয়াং রা এই সমস্যায় বেশি পড়ে আরো এবং জায়গার সমস্যার সমাধান হলে স্ট্যাবিলিটিও আসবে না। আমি সংশপ্তক করছি নীলক্ষেতে বইসা। আমি তাকায়া দেখি আমার পিছনে দেড়শো লোক দাঁড়ায়া আছে। বাজার তো। দোকানের পর দোকান। হাজার হাজার মানুষ। এর মধ্যেই আমারে কনসেনট্রেট করতে হইছে। কাজ করতে হইছে, কারণ আমার জায়গা ছিল না। আর তখন নীলক্ষেত ছাড়া আর কোনো ওয়েল্ডিংয়ের জায়গাও ছিল না। তো এখন স্কোপটা বাড়ছে অনেক কাজ করার। আমি খুবই আশাবাদী এখনকার শিল্পীদের নিয়া। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : এই যে স্যার আপনার স্বপ্নের বাড়ি, নিজের মতো স্টুডিও, গ্যালারি বানাইছেন, আপনার কী মনে হয় না, আরো আগে এটা করতে পারলে আরো বেশি কাজ আপনি করতে পারতেন।

হামিদুজ্জামান খান : তা তো মনে হয়। তবে চারুকলা থাকায় আমার খুব একটা কষ্ট হয় নাই। যেহেতু আমি শিক্ষক ছিলাম। বঙ্গভবন থেকে সেই সময়েই আমারে ব্রাস মেটালের ৬লাখ টাকার মেটিরিয়াল কিনা দিছে, চারুকলা ছিল বলে আমি সেগুলো রেখে কাজটা করতে পারছি, না হলে তো পারতাম না। আর এখন আমি কাজ করি প্রচুর, সারাদিন, বাড়িটাই তাই স্টুডিও বানিয়ে নিলাম। 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : অনেক ধন্যবাদ স্যার। খুব ভালো লাগল আপনার সাথে কথা বলে। স্টুডিওটা দারুণ হইছে।

হামিদুজ্জামান খান :  তুমি তো সুন্দর কথা বলো আর্ট নিয়া। ভালো প্রস্তুতিও নিয়া আসছ আমার সাথে কথা বলার জন্য-এইটা ভালো লাগল। তোমাকেও ধন্যবাদ।