স্মরণ
শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না : ঋতুপর্ণ ঘোষ
অমন নয় যে শুধু আজকের দিনটিতেই ঋতুকে মনে পড়ে আমার। ঋতুকে বোঝাও সহজ নয়। তবে তাঁর মতো মেধাবী, প্রতিভাবান, উজ্জ্বল আলোকিত, মানবিক একজন মানুষকে ভুলে যাওয়া সত্যিই কঠিন।
দেশ পত্রিকা খুব সুন্দর প্রচ্ছদ করেছিল। সংবাদ প্রতিদিনের রোববার, ঋতুদার সম্পাদনায় প্রতি রোববার বেরুতো, অসাধারণ সংখ্যা করেছিল তারা, সংগ্রহ করার মতো। শ্রদ্ধা জানাতে কমতি করেনি এই মহান মানুষটিকে।
কিন্তু যখনই ঋতুর প্রসঙ্গ আসে, তখনই কানাকানি, ফিসফাস। ঋতুপর্ণ ঘোষ কি পুরুষ ছিল নাকি নারী? নাকি নারী-পুরুষ দুটোই ছিলেন? তবে হি হিজড়া ছিলেন ঋতুপর্ণ। আবার অনেকের মন্তব্য, ঋতু ট্রান্সজেন্ডার, পুরুষ থেকে রূপান্তরিত নারী। যার যা খুশি বলে, মন্তব্য করে। ঋতুকে নিয়ে এখনো রীতিমতো বিতর্ক হয়, খুব ক্লিশে বিতর্ক, বিতর্ক স্রেফ ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘লিঙ্গ’ নিয়ে!
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ঋতু রূপান্তরকামী না, হিজড়ে না, নারী না, পুরুষ না- ঋতু কোনোটিই না। ঋতু মানুষ ছিলেন। শুধু মানুষ। মানবিক একজন মানুষ। প্রচলিত জীবনের বোধ ও যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যে মানুষ দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। দাঁড়াতে পেরেও ছিলেন যিনি, তিনিই ঋতুপর্ণ ঘোষ। এই বামন সমাজে ঋতু অতিকায়, যার উচ্চতা আকাশছোঁয়া, ফলে ঋতুকে আমাদের কাছে কদাকার লাগার, ভাবার যথেষ্ট কারণ ও সুযোগ রয়েছে।
ঋতু বরাবরই চাপাপড়া, ঢেকে রাখা, না বলা, রাখঢাক করা সামাজিক যৌনতার গোপনীয়তা ভেঙেছেন। ভেতরকার তীব্র যৌন অবদমনকে বাইরে নিয়ে এসেছেন। মনে আছে, অন্দরমহলের (২০০৫) কথা? শুরুতেই সঙ্গমদৃশ্য। নপুংসক জমিদার স্বামীর পুত্রবাসনা পূরণের জন্য তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী যশোমতীকে প্রতি রাতে যন্ত্রণাকাতর সঙ্গমের শিকার হতে হয়। দৃশ্যটি বেদনার, যৌন উত্তেজনার নয়।
যৌনতা ও শরীরকে তিনি প্রয়োগ করেছেন পুরুষতন্ত্র, তার নীতিনৈতিকতা, অবদমন এবং নারী-পুরুষবাচক বাইনারি লিঙ্গীয় পরিচয়ের পাঁচিল ভাঙার অস্ত্র হিসেবে। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ কিংবা ‘আর একটি প্রেমের গল্প’ ছবিগুলোর কথাও নিশ্চয়ই মনে আছে। প্রচলিত আর্ট ফিল্মের বাধা ছাঁচের বাইরে গিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ দেখিয়েছেন ভিন্নমাত্রার এক সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন।
যৌনতার আধুনিক তত্ত্ব বলে, কামের ক্ষেত্রে দুনিয়ায় আদতে বিষম বলে কোনো মেরু নেই। সেক্সুয়ালিটির বিষয়টি মূলত খুব ফ্লুইড। সবার মধ্যেই সব লিঙ্গীয় যৌনতার আকাঙ্ক্ষা থাকে। যৌনতার ক্ষেত্রে দ্বিমেরু বিভাজন নিতান্তই অর্বাচীন। আসলে, প্রত্যেকেই নিজের শরীরকে অদম্য ভালোবাসে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। নারী কিংবা পুরুষের স্বমৈথুন তার এক অসাধারণ প্রমাণিত উদাহরণ। ছবিতে ঋতুপর্ণ জরুরি কিছু প্রশ্ন তোলেন। জগৎ শরীর নিয়ে আমরা যদি সুখী হই, তা হলে ছেলেরা চুল, নখ কাটে কেন? মেয়েরা কান বেঁধায় বা উল্কি কেন আঁকে?
ঋতু সব সময় বলতে চেয়েছেন, শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না। বরং জেন্ডারকে একমাত্র মহান শিল্পীরাই অতিক্রম করে যেতে পারেন। যেটি অতিক্রম করতে যে মহত্ত্ব, মানবিকতা, বিপুল বিস্তারিত যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করা দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়, তা ঋতুর বরাবরই ছিল। যৌনতা, যৌন-অযৌন সম্পর্ক, অবদমন, রূপান্তরকামিতা এমনকি মৈথুন, স্বমৈথুন এমন কোনো বিষয় নেই যা ঋতু তার ছবিতে নিয়ে আসেননি। সুযোগ হয়েছিল এসব নানা বিষয় নিয়ে ঋতুর সঙ্গে আলাপ করার। ঋতু নিজেই বলেছিলেন ‘শিল্পীকে যে তার জেন্ডার অতিক্রম করে যেতে হয় সেটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। সামাজিক লিঙ্গ আমার পরিচয় নয়। শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না, এটা বাবা-মাই আমাকে শিখিয়েছিলেন।’
জেন্ডার চেঞ্জ, ট্রান্সজেন্ডারশিপ নিয়েও কথা হয়েছিল ঋতুর সঙ্গে। ঋতুদা নিজেই বলেছেন, ‘আমি কোনো দিনই নিজেকে পুরোপুরি নারী মনে করতে চাইনি। হতেও চাইনি। ছোটবেলা থেকেই তো প্রচুর টাকা রোজগার করেছি রে বাবা! অনেকে সেক্স চেঞ্জ করাতে চেয়েও পারে না টাকার কারণে। আমার তো তা হয়নি কখনো। বিজ্ঞাপনে যখন কাজ করতাম, এখন যা করি তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা রোজগার করতাম। কিন্তু সচেতনভাবে সেক্স চেঞ্জ করা থেকে দূরে থেকেছি। প্রচলিত জেন্ডার আইডেনটিটি থেকে বের হয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেও পেরেছি আমি।’
আসলেই তাই, ঋতু নিজেকে প্রচলিত যৌনতার, নারী-পুরুষের সীমাবদ্ধ সীমারেখার ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
ঋতুর আবরণ ও আভরণ নিয়েও কথা ওঠে প্রায়। নিতান্ত মূর্খ না হলে বোঝা উচিত, ঋতুপর্ণ ঘোষ বেশ বছর কয়েক ধরেই ‘ইউনিসেক্স’ পোশাক পরতেন। যেটি কামিজ, সালোয়ার নয়, প্যান্ট-শার্ট নয়, আবার পাঞ্জাবি, পাজামাও বলা যাবে না তাকে। যেটি একান্তভাবেই ‘ঋতুর পোশাক’, যা কেবল মানায় ঋতুকেই।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মেয়েরা ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট কিংবা যে কোনো উপাদান গ্রহণ করলে সেটি ততটা নিন্দনীয় নয়, যতটা ভয়ংকর নিন্দনীয় কোনো ছেলে যদি মেয়েদের কিছু গ্রহণ করে।
যে সমাজে আমরা বাস করি তা নিতান্ত ইতর, অসভ্য ও অমানবিক। এখানে মানুষের মূল্য নেই, নেই মানবিকতার মূল্য। এখানে মানুষের চেয়ে ‘লিঙ্গ’ বড় ও প্রধান হয়ে ওঠে। একটি মানবশিশু জগতের সঙ্গে সঙ্গেই, জগতের আলো দেখতে না দেখতেই, অস্থির চোখের দৃষ্টি উপুড় হয়ে পড়ে, রীতিমতো হামলে পড়ে দেখতে, শিশুটি নারী নাকি পুরুষ! শিশুটির ‘লিঙ্গ’ কী? পুরুষ হলে উৎসব, নারী হলে বিষাদ!
এ তো অনিবার্য!
যে সমাজ এমন, অসম্ভবরকম লিঙ্গ শাসিত, সেখানে নারী-পুরুষ যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যাওয়া মানুষকে নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য হবে, গুঞ্জন হবে, কানাকানি হবে, ঠাট্টা-তামাশা হবে, ইতরামি-ফাতরামি হবে, ঢিঢি করবে লোকে- এটাই স্বাভাবিক।