গুন্টার গ্রাসের সাক্ষাৎকার

সত্য অধিকাংশ সময় একঘেয়ে

Looks like you've blocked notifications!
গুন্টার গ্রাস। ছবি : মিডিয়া স্যালন

গত সোমবার, ১৩ এপ্রিল ২০১৫, পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে গেলেন নোবেলজয়ী জার্মান নাট্যকার, কবি ও কথাসাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মান সাহিত্যে গুন্টার গ্রাস গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। নিজ দেশের বাইরে তাঁকে যুদ্ধোত্তর জার্মানির বিবেক বলে ডাকা হতো। যে কারণে হয়তো গ্রাসের মৃত্যুর পর দেশটির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেছেন, ‘গ্রাস তাঁর লেখনীর সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সরব উপস্থিতির মাধ্যমে জার্মানির যুদ্ধোত্তর ইতিহাসের সঠিক অবয়ব দিয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে গুন্টার গ্রাস ভীষণ আমুদে ও আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। লেখালেখির বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাঁর উপস্থিতি ছিল। পাশাপাশি তিনি চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।

গুন্টার গ্রাসের বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম হলো ১৯৫৮ সালে লেখা ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি। ইউরোপিয়ান সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার ‘মূল লেখা’ (key text) হিসেবে গণ্য করা হয় উপন্যাসটিকে। ‘টিন ড্রাম’ পড়ার পর রুশদির বেস্ট সেলার উপন্যাস ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ পড়ে আমার মনে হয়েছে, সালমান রুশদি ‘টিন ড্রাম’ থেকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ উপন্যাসটি লিখেছেন। কারণ, টিন ড্রামের সঙ্গে মিডনাইট চিলড্রেনের গঠনশৈলী, চরিত্রায়ণ, বর্ণনাভঙ্গি—এগুলো বেশ মেলে।

মূলত টিন ড্রামের কারণেই গুন্টার গ্রাস ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পান। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে পড়ে ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’, ‘ডগ ইয়ার্স’, ‘ফ্রম দ্য ডায়েরি অব আ স্নেইল’, ‘দ্য ফ্লাউন্ডার’, ‘দ্য র‌্যাট’, ‘শো ইওর টাং’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

গ্রাসের জন্ম ১৯২৭ সালে পোল্যান্ডে। মা ছিলেন পোলিশ, বাবা জার্মান। বাবা-মা মুদিখানার দোকান চালাতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গ্রাস জার্মান সেনাবাহিনীতে একজন ট্যাঙ্ক গোলন্দাজ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে তিনি আহত হন এবং মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দী হন। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি কিছুদিন চুনাপাথরের খনিতে কাজ করেন। এর পর তিনি বার্লিনে আর্ট বিষয়ে পড়াশোনা করেন।

দ্য প্যারিস রিভিউয়ে প্রকাশিত গুন্টার গ্রাসের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন : আপনি লেখক হলেন কীভাবে?

গুন্টার গ্রাস : আমার মনে হয়, আমি যে সামাজিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি, তার সঙ্গে আমার লেখক হয়ে ওঠার একটা সম্পর্ক আছে। সামান্য নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। আমাদের দুই কক্ষবিশিষ্ট একটা বাড়ি ছিল। আমি এবং আমার বোনের আলাদা কোনো কক্ষ ছিল না। আমাদের শোবার ঘরের দুই জানালার আড়ালে এক কোনা খালি ছিল। সেখানেই আমি আমার বই, আঁকার রং ও অন্যান্য জিনিস রাখতাম। প্রায়ই আমার যে জিনিসগুলো দরকার, সেগুলো আছে বলে মনে মনে ধরে নিতাম। খুব ছোট থাকতেই আমি শব্দ-চেঁচামেচির ভেতর পড়ার কৌশলটা আয়ত্ত করে ফেলি। তখন থেকেই আমি লিখি এবং আঁকি।

প্রশ্ন : সংসারের এই গোলমেলে অবস্থায় আপনি খেলাধুলা বা অন্যান্য কাজের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে লেখালেখি এবং পড়ার ভেতর প্রবেশ করলেন কীভাবে?

গুন্টার গ্রাস : শিশু হিসেবে আমি ভীষণ মিথ্যুক ছিলাম। আমার সৌভাগ্য বলতে হবে যে, মা আমার সেসব মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতেন। আমি তাঁকে মজার মজার সব প্রতিশ্রুতি দিতাম। যখন আমার বয়স ১০ বছর, তখন মা আমাকে পীর জিন্ট (পীর জিন্ট হলো ইবসেনের পীর জিন্ট নাটকের নাম-চরিত্র; নরওয়ের ফোকটেলে এই চরিত্র আছে) নামে ডাকতেন। তিনি বলতেন, আমরা নেপলস ও অন্য যেসব স্থানে ঘুরতে যাব, তা নিয়ে তুমি আমাকে ভীষণ উপভোগ্য সব গল্প শোনাবে। আমি অতি অল্প বয়স থেকেই আমার বানানো গল্পগুলো লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার যখন ১২ বছর বয়স, তখনই উপন্যাস লেখা শুরু করি। যেটি বহু বছর পর দ্য টিন ড্রাম-এ রূপ নেয়। কিন্তু আমার প্রথম উপন্যাসটি লেখার সময় বড় ধরনের এক ভুল করে বসি। আমি যেসব চরিত্রের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিই, প্রথম অনুচ্ছেদের শেষ অংশে গিয়ে সব চরিত্রই মারা যায়। আমি আর চালিয়ে যেতে পারিনি! এটা ছিল আমার লেখালেখির প্রথম দীক্ষা : তুমি তোমার চরিত্রগুলোর পরিণতি নির্ণয় সম্পর্কে সদা-সতর্ক থাকবে।

প্রশ্ন : কোন ধরনের মিথ্যা থেকে আপনি সবচেয়ে বেশি প্রশান্তি পেয়েছেন?

গুন্টার গ্রাস : যে মিথ্যা কাউকে আঘাত করে না, সেই মিথ্যা থেকে। যেটা সাধারণত নিজেকে রক্ষা করা বা অন্যদের বিপদে ফেলার থেকে আলাদা। সেটি আমার কাজও নয়। তবে সত্য অধিকাংশ সময় একঘেয়ে।

প্রশ্ন : প্রথম উপন্যাসে ব্যর্থ হওয়ার পর আবার কবে শুরু করলেন?

গুন্টার গ্রাস : আমার প্রথম বই ছিল কবিতা ও চিত্রকর্মের মিশেল। পরে যখন আমার বয়স ২৫ বছর হলো এবং একটি টাইপরাইটার কিনতে পারলাম, আমি আমার দুই আঙুল দিয়েই কাজটি চালিয়ে নিলাম। দ্য টিন ড্রাম-এর প্রথম সংস্করণ টাইপরাইটারে লেখা। এখন যখন আমার সময়ের অনেক লেখক কম্পিউটারে লিখছেন, তখন আমি পুরোনো দিনেই পড়ে আছি। আমি সাধারণত আমার উপন্যাসের প্রথম সংস্করণ হাতে লিখেছি, পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণের কাজ টাইপরাইটারে সেরেছি। আমি কখনই তিনটি সংস্করণের নিচে কোনো বই শেষ করতে পারিনি।

প্রশ্ন : এডিটিংয়ের কাজটি কীভাবে করেন?

গুন্টার গ্রাস : আমি প্রথম সংস্করণটি ভীষণ তাড়াহুড়োর ওপর সারি। যদি কোথাও কোনো কিছু পড়ে যায় তো আমি আর সেটি নিয়ে মাথা ঘামাই না। দ্বিতীয় সংস্করণটা তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ, পুঙ্খানুপুঙ্খ আর সম্পূর্ণ হয়। এখানে কোনো অসংগতি থাকে না, তবে প্রাণটা কম থাকে। তৃতীয় সংস্করণে এসে আমি প্রথম সংস্করণের সেই সজীবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি এবং দ্বিতীয় সংস্করণের দরকারি বিষয়গুলো রেখে দিই। এটা বেশ কঠিন একটি কাজ।

প্রশ্ন : আপনি কোন সময়ে লিখতে বসেন?

গুন্টার গ্রাস : রাতে কখনই নয়। আমি রাতে লেখার ব্যাপারে বিশ্বাসী নই; কারণ এ সময় অনর্গল সব বের হয়ে আসে। যখন সকালে পড়ি, তখন দেখি যে সেটি আসলে ভালো হয়নি। লেখার জন্য আমার দিনের আলো দরকার। আমি সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে গান শুনতে শুনতে অথবা পড়তে পড়তে ভারী নাশতা সেরে নিই, তার পর লিখতে বসি। বিকেলে কফির জন্য ব্রেক নিই। আবার শুরু করে ৭টা পর্যন্ত লিখি।

প্রশ্ন : কোনো বই শেষ হলো কি-না, সেটি আপনি কীভাবে বোঝেন?

গুন্টার গ্রাস : যখন আমি দীর্ঘ পরিসরের কোনো বই লিখি, তখন লিখতে লিখতে অনেক সময় চলে যায়। সব সংস্করণ শেষ করতে পাঁচ বছরের মতো লেগে যায়। যখন বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তখন শেষ হয়েছে বলে ধরে নিই।

প্রশ্ন : ব্রেশট (জার্মান নাট্যকার বার্টল্ড ব্রেশট) তাঁর লেখাগুলো সব সময় এডিট করতেন। সেটি প্রকাশ হয়ে গেলেও তাঁর এডিটিং থামত না। তিনি কখনই তাঁর কোনো লেখা সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে বলে মনে করেননি।

গুন্টার গ্রাস : আমার মনে হয় না, আমি সেভাবে পারতাম। আমি ‘দ্য টিন ড্রাম’ অথবা ‘ফ্রম দ্য ডায়েরি অব আ স্নেইল’-এর মতো বই জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময়ই কেবল লিখতে পারব। কারণ, এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভাবনা এবং অনুভূতি। আমি নিশ্চিত, আবার যদি দ্য টিন ড্রাম বা ডগ ইয়ার্স অথবা ফ্রম দ্য ডায়েরি অব আ স্নেইল লিখতে বসতাম, তাহলে সেটি নষ্ট করে ফেলতাম।

প্রশ্ন : আপনি আপনার ফিকশন এবং নন-ফিকশন কীভাবে আলাদা করেন?

গুন্টার গ্রাস : এ দুটোকে আলাদা ভাবার কোনো কারণ আমি দেখি না। এই ভাগ করাটা বই ব্যবসায়ীদের কাজ।তাদের হয়তো ব্যবসায়িক কারণে করতে হয়।

প্রশ্ন : ঠিক আছে। তবে আপনি প্রবন্ধ বা ভাষণ লিখতে যে কৌশল অবলম্বন করেন, নিশ্চয়ই সেই একই কৌশলে গল্প বা বানোয়াট কাহিনী লিখছেন না?

গুন্টার গ্রাস : নিশ্চয়ই, আলাদাভাবেই লিখছি আমি। কেননা, যে বাস্তবতার সম্মুখীন আমি হচ্ছি, সেটি আমি পরিবর্তন করতে পারি না। আমি সব সময় ডায়েরিতে নোট লিখে রাখার কাজটি করিনি। তবে ফ্রম দ্য ডায়েরি অব আ স্নেইল-এর ক্ষেত্রে আমি ডায়েরি ব্যবহার করেছি। আমার মনে হচ্ছিল, ১৯৬৯ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হতে চলেছে। কাজেই আমি ওই সময় ডায়েরিতে নোট টুকতাম। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে কলকাতায় অবস্থানকালে, যেটি থেকে পরে আমি শো ইয়োর টাং লিখি।

প্রশ্ন : কীভাবে আপনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা মতাদর্শকে আপনার চিত্রকর্ম বা লেখার সঙ্গে মেলান?

গুন্টার গ্রাস : লেখকরা কেবল তাঁদের অন্তর্মুখী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনযাপনের ভেতরেই থাকেন না, তাঁদের বাইরেরও একটা জীবন থাকে। আমার কাছে লেখালেখি, আঁকাআঁকি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড—সবকিছুরই একটা আলাদা উদ্দেশ্য আছে। আমি যে সমাজে বাস করি, সেটার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে এবং মেলাতে চাই। আমার লেখা ও আঁকা আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে আলাদা নয়। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, আমি জেনেশুনে আমার লেখার মধ্যে রাজনীতি টেনে আনি। কিন্তু এটা কোনো না কোনোভাবে চলে আসে।

প্রশ্ন : আপনার বেশ কটি বইয়ের গল্প জীবজন্তুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এর কারণ কী?

গুন্টার গ্রাস : আমার সব সময় মনে হয়েছে, মানুষ নিয়ে অনেক বলা হয়েছে। এই পৃথিবীতে শুধু মানুষ নয়, আরো লাখো-কোটি প্রাণী আছে। আমরা পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই তারা আছে, আবার আমরা যেদিন থাকব না, সেদিনও হয়তো তারা থাকবে। আমাদের সঙ্গে তাদের একটি পার্থক্য আছে। পৃথিবীতে একটা সময় ডাইনোসরের মতো দীর্ঘদেহী প্রাণী লাখ লাখ বছর বেঁচে ছিল। কিন্তু যখন তারা মারা গেছে, তখন তারা পৃথিবীকে দূষিত করে রেখে যায়নি। তার হাড়গোড় ভীষণ রকমের পরিষ্কার-দূষণমুক্ত। আমরা মিউজিয়ামে সংগ্রহ করে রেখেছি। মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটবে না। আমরা যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেব, তখন পৃথিবীর বায়ুদূষণ করে যাব। আমাদের মনে রাখা উচিত, পৃথিবীর বাসিন্দা কেবল আমরা একা নই। বাইবেল আমাদের ভুল শিক্ষা দেয় এই বলে যে, মানুষের প্রতিটি জীবজন্তুর ওপর কর্তৃত্ব আছে। আমরা বিশ্বজয় করার চেষ্টা করেছি, ফলাফল সব সময় সুখকর হয়নি।