ঢাকার কথা ৪৫

মোগল ঢাকার পটভূমি

Looks like you've blocked notifications!

১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ কর্তৃক সোনারগাঁওয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল দুইশত বছরব্যাপী বাংলার স্বাধীন সুলতানি রাজ্যের। এই সময়কাল থেকেই একটি ছোট্ট শহর হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া যায়।

সতের শতকের শুরুতে ঢাকায় মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ যুগের আকর গ্রন্থ বাহারিস্তান-ই-গায়েবিতে মির্জা নাথান ঢাকার যে অবস্থার বর্ণনা করেছেন তা অনেকটা এমন, শহরটি বুড়িগঙার পূর্ব তীরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তা প্রলম্বিত ছিল বর্তমান বাবু বাজারের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে কয়েক মাইল পর্যন্ত।

বর্তমান পুরনো ঢাকার অনেক স্থান-নাম হিন্দু নামে দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে। অনুমান করা হয় মুসলিম অধিকার ও সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে প্রাচীনকাল থেকেই এখানে হিন্দু বসতি এবং তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। হাকিম হাবিবুর রহমান  উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর ‘ঢাকা পঁচাশ বরস পহেলে’ গ্রন্থে বলেছেন বিক্রমপুর যখন সেন রাজাদের রাজধানী তখন ঢাকার দক্ষিণাংশে হিন্দু বসতি গড়ে উঠেছিল। সেই যুগের স্মৃতি বিজড়িত নামগুলো হচ্ছে লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুনগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতিবাজার, সুতারনগর, কামারনগর, পাটুয়াটুলি, কুমারটুলি ইত্যাদি। এই নামগুলো মোগল-পূর্ব যুগে হিন্দু নিয়ন্ত্রিত নানা পেশাজীবীদের অবস্থানও নিশ্চিত করছে। রাজধানী সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য অঞ্চল বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এই অঞ্চলে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিকাশ ঘটে। সোনারগাঁও হতে ঢাকার নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হয় নদী পথে যোগাযোগ থাকায়। প্রাক-মোগল যুগে ঢাকার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমা নির্ধারণ করেছে যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা ও দোলাই খাল। সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে প্রাক-মোগল ঢাকার পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন।

১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খাঁ বারোভুঁইয়াদের পরাজিত করে ঢাকায় মোগল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার অঞ্চলে ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে একটি দুর্গ ছিল। দুর্গের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরের ঘাটটির নাম ছিল চণ্ডীঘাট। বাহারিস্তান-ই-গাইবির বক্তব্য অনুযায়ী এই অংশে তখন দুটি অঞ্চলের বিকাশ ঘটে। এই চণ্ডীঘাটটিই পরে চকবাজার নামে পরিচিত হয়। দুর্গ থেকে চণ্ডীঘাট পর্যন্ত বাজারের বিস্তার ছিল। ঢাকা নগরীর ক্রমবিকাশের যুগে ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি.) এখানে রাজধানী স্থাপন করেন এবং সম্রাটের নাম অনুসরণে এর নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর  (Abdul Karim, ‘Dhaka the Mughal Capital’, Dacca, Asiatic Society of Pakistan, p. 2) । এক শতকের চেয়ে সামান্য বেশি সময় ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময় প্রশাসনিক-বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিকাশ অব্যহত থাকে।

বাংলায় স্বাধীন সুলতানি রাজ্যের অবসান ঘটে ১৫৩৮ সালে। এ সময় শেষ স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ মোগল সম্রাট হুমায়ুনের কাছে পরাজিত হন। কিন্তু বাংলায় মোগল আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। হুমায়ুন গৌড় অধিকার করে মাত্র ছয় মাস টিকে থাকতে পেরেছিলেন। এ পর্যায়ে বিহার অঞ্চলের আফগান শাসক শেরখান হুমায়ুনের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। ১৫৩৯ সালের জুলাই মাসে হুমায়ুন বিতাড়িত হন। এভাবে বাংলা আফগান শাসনের অধীনে চলে আসে আর দিল্লির মোগল শাসন যুগে বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ধরণের স্বাধীন অঞ্চলে পরিণত হয়। এভাবে দীর্ঘকাল বাংলা মোগল অধিকারের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করছিল। ভাটি বা নিচু অঞ্চল বলে পূর্ববাংলা বরাবরই বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ পেয়েছে। স্বাধীন সুলতানি যুগের পরও তাই পূর্ব বাংলা তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে টিকে ছিল। এই পর্বে পূর্ববাংলায় একক কোনো রাজ্য গড়ে ওঠেনি। অনেক বড় বড় জমিদারের অধীনে বিভক্ত ছিল বাংলার এ অংশটি। এঁরা সাধারণভাবে ‘বারোভুঁইয়া’ নামে পরিচিত।

এই বারোভুঁইয়ারা একযোগে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সম্রাট আকবরের আমলে বারভুঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান মসনদ-ই-আলা। মোগল সুবাদার ইসলাম খানের ঢাকা দখলের সাধারণ কারণ বারোভুঁইয়াদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা। মোগল অধিকারের পর ঢাকা মোগল সুবা অর্থাৎ প্রদেশ বাংলার রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ সময় পরিকল্পিত নগর ঢাকার বিকাশ ঘটতে থাকে।