সাক্ষাৎকার

আমার লেখালেখি জীবন বিচ্ছিন্ন নয় : মহাশ্বেতা দেবী

Looks like you've blocked notifications!

সমাজ সচেতন কথাশিল্পী মহাশ্বেতা দেবী মারা গেছেন গত ২৮ জুলাই। লেখালেখিই ছিল তাঁর পেশা, একমাত্র উপার্জনের পথ। মাঝখানে অবশ্য কিছুদিন অধ্যাপনাও করেছেন। সার্বক্ষণিক সমাজসেবক হিসেবেও নিরলসভাবে কাজ করেছেন তিনি। বিশেষ করে ভারতের আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সবাই জানেন। পশ্চিবঙ্গ খেড়িয়াশবর কল্যাণ সমিতির হয়ে মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের জন্য কাজ করতেন। এ ছাড়া তিনি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে কয়েকজন ভারতীয় সাহিত্যিক বাংলাদেশ সফরে আসেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র বাঙালি লেখক ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি জন্মেছিলেন এই বাংলাদেশেই, ঢাকার জিন্দাবাহারে। বহুবছর পর ৯৬ সালে ঢাকায় এসে খুবই ব্যস্ত সময় কাটান তিনি। এই ব্যবস্ততার ভেতরেই, ২৩ নভেম্বর, সদ্য প্রয়াত মহান কথাশিল্পী মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার নেন মারুফ রায়হান। সাক্ষাৎকারটি একই বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় ‘প্রকৃতি’ নামের একটি পত্রিকায়। সেই সাক্ষাৎকারটিই এখানে আবারো ছাপানো হলো।  

প্রশ্ন : অরন্যের অধিকার, চোট্টি মুন্ডাও তার তীব্র এরকম বেশ কিছু রচনায় আপনি আদিবাসীদের সংগ্রাম ও জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। আদিবাসীদের নিয়ে আপনার লেখার চিন্তা কীভাবে এলো?

মহাশ্বেতা দেবী : লেখার চিন্তা থেকে লেখাগুলো লিখি নি। আদিবাসীদের সংগ্রাম, বাঁচার লড়াই, তাদের অস্তিত্বে অর্থাৎ তাদের সমগ্র জীবনধারার সঙ্গে আমি বহুকাল থেকে বহুভাবে জড়িত। এর অনেক পরে লিখতে শুরু করেছি আদিবাসীদের নিয়ে। এখনো আমি আদিবাসীদের জীবন নিয়েই আছি। কলকাতার মূলধারার জীবনস্রোতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ খুবই কম।

প্রশ্ন : ভবিষ্যতে এই আদিবাসীদের নিয়ে নতুন কিছু লেখার পরিকল্পনা কি আছে?

মহাশ্বেতা দেবী : আদিবাসীদের জন্যে যে সংগঠন আছে আমাদের, সেটা বিদেশি টাকা নেয় না। সেভাবেই প্রতিষ্ঠানের জন্য ভারতের রাজ্য সরকারের যা বরাদ্দ আছে সেটা নিয়েই এই সংগঠনের কাজ করা হয়। কাজেই সেসবের জন্য প্রচুর লেখালেখি ও দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এ কাজের বিশদ পরিচয় এত অল্প সময়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এটাই আমার জীবন হয়ে দাড়িয়েছে বিগত পনেরো বছর ধরে।

প্রশ্ন : আপনার জীবনের একটা সময় কেটেছে এই ঢাকা শহরে। আপনার পরিচিত শহরে আপনি দীর্ঘকাল পরে এলেন, কেমন লাগছে?

মহাশ্বেতা দেবী : ‘প্রমা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আমি আত্মজীবনী লিখছি। সেখানে ঢাকার কথা এসেছে। আমার পিতৃকুল মাতৃকুল দুটোই পাবনার নতুন ভরেঙ্গা গ্রামে। আমার ঠাকুরদা আর বাবা দুজন্যই সরকারি কাজ করতেন বলে অনেক জায়গাতেই ঘুরে বেড়াতে পেরেছিলাম। কলকাতায় পোস্টেড হতেন, আবার একইভাবে বগুড়া, পাবনা ও রংপুর বিভিন্ন জায়গায় কর্মের সুবাদে থাকতে হতো। রাজশাহীতে ঠাকুরদা একটা বাড়ি করেছিলেন। আমার দাদামশাই ঢাকায় থাকতেন। তখন যেমন নিয়ম ছিল সন্তান হওয়ার কালে মেয়েরা বাপের বাড়ি আসত- সেভাবেই আসা যাওয়া ছিল পনেরো নম্বর জিন্দাবাহার লেনে। সেই বাড়িটা আমি কালকেও দেখেছি, পরশুও দেখেছি। বর্তমানে সেটা নয়া সড়ক ফাঁড়ি এবং একেবার একই রকম আছে। সাতচল্লিশ সালের পর এই প্রথম এ দেশে এলাম, ঢাকাতে এলাম। পুরোনো ঢাকার সামান্যই জানতাম।

৩৬-৩৭-এর পর এসেছি কি না মনে পড়ে না। বয়স তখন খুবই কম ছিল। হয়তো একবার তেতাল্লিশে এসেছিলাম। আমরা বাড়িতেই থাকতাম, মাঝে মধ্যে একটু বেরিয়ে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া, আরমানিটোলা, পিকচার হাউসে যাওয়া এটুকুই ছিল গতিবিধি। কিন্তু এখানে এসে যেটা আমার অসম্ভব রকম ভালো লাগছে সেটা হলো নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, নতুন মানুষ সবকিছু নতুন লাগছে। ঢাকা শহর আমার চোখে খুবই সুন্দর লেগেছে। আমি কিন্তু একটু ও নষ্ট্যালজিয়ায় ভুগছি না। এই শহরে এত গাছ সত্যি মন ভরে যায়। যা দেখছি তাই ভালো লাগছে। সাভারে স্মৃতিসৌধে গেছি, এখানে শহীদ মিনারে গেছি- একুশে ফেব্রুয়ারির কথা কে ভুলতে পারে বলুন। সিলেটে কমলা বলে একটি মেয়ে ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছিল। আমার বাবা তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। ঢাকার ব্যাকগ্রাইন্ড অনেক কবিতা আছে তাঁর।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পড়ার সুগোগ কি আপনার হয়?

মহাশ্বেতা দেবী : বাংলাদেশ বলে কথা নয়, আমি বহুদিন যাবতই পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্য পড়ে উঠতে পারি না। কেননা আমার অত পড়া  হয় না। যখন যেটুকু সুযোগ হয় পড়ি। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। ওদের লেখা পড়েছি। চিঠি লিখি ইলিয়াসকে। তবে আমি সবসময়ে যে ধরনের লেখা পড়ি তা হচ্ছে জরিপ, সরকারি আইন, পরিসংখ্যান ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে কাজ করতে আমি বেশি ভালোবাসি। এগুলো নিয়েই অধিকাংশ সময় চলে যায়।

প্রশ্ন : দুই বাংলার কথাসাহিত্যের একটি তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করবেন? সব দেশেই তো জনপ্রিয় ও সিরিয়াস সাহিত্যের দুটি ধারা থাকে।

মহাশ্বেতা দেবী : এ বাংলার কথাসাহিত্যের কথা আমি তেমন কিছুই বলতে পারব না, ওই বাংলারও সকলের কথাসাহিত্য সম্পর্কে বলতে পারব না, তবে আমি বলব, আমার যত মেজর লেখা, যেমন অরন্যের অধিকার হোক, বা হাজার চুরাশির মা হোক, চোট্টি মুন্ডার ও তার তীর- সবই বড় কাগজে বা কমার্শিয়াল কাগজে এ জন্য বেরিয়েছে যে প্রথম থেকে লেখাই আমার জীবিকা- আমি আর কিছু করিনি। একটা কলেজে কিছুকাল পড়েয়েছি, মাইনে খুব কম ছিল, তারপর ছেড়ে দিয়েছি। তবে বড় কাগজে শুধু নয়, আমি লিটল ম্যাগেও লিখেছি।

প্রশ্ন : বর্তিকা নামে আপনি একটি কাগজ বের করতেন…

মহাশ্বেতা দেবী : সেটা অবশ্য সাহিত্যের কাগজ নয়, অনুসন্ধানধর্মী লেখা থাকে ওতে, মাটির মানুষের কথা থাকে। একজন চাষি, একজন শিক্ষক, একজন গ্রামীণ লোক তার নিজের কথা নিজেই বলত- সেটাই বর্তিকায় বেরুত। কাগদীপ আন্দোলন নিয়ে সংখ্যা করেছি। ইট-ভাটার মজুরদের নিয়ে সংখ্যা করেছি, বন্ধ করখানার নিয়ে সংখ্যা করেছি, আবার আলাদা আলাদাভাবে আদিবাসীদের নিয়ে সংখ্যা করেছি যেমন সাঁওতাল বা মুন্ডাদের নিয়ে সংখ্যা। মুসলিম সমাজ ভাবনা নিয়ে একটা সংখ্যা করেছিলাম, বেশ পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।

প্রশ্ন : নারীমুক্তি আন্দোলন নিয়ে কিছু বলবেন?

মহাশ্বেতা দেবী : আমি ভাবি দারিদ্রসীমার নিচে যাদের অবস্থান সেইসব মানুষের মুক্তির কথা। সেখানে একা নারীটির মুক্তি হতে পারে না। সমস্ত শ্রেণিটাকে যদি দারিদ্র্যসীমার ওপরে আনা যায় তাহলে কিছু একটা হতে পারে। কাজেই বিষয়টা আমি শ্রেণিগতভাবে দেখি।

প্রশ্ন : ইউরোপের নারী সমাজ অনেকদূর এগিয়েছে...

মহাশ্বেতা দেবী : শুনুন, আমি অতসব জানি না, মাটি থেকে আহরিত জিনিস ছাড়া আমি বেশি কিছু জানি না। ইউরোপের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত যা তার বাইরে কোনো কিছুকে আমি জানা বলি না। কাগজে পড়াটাকেও আমি জানা বলি না।

প্রশ্ন : বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে বাঙালি নারীর আজকের যে অবস্থান সে সম্পর্ক কিছু বলবেন?

মহাশ্বেতা দেবী : বাঙালি নারী অনেক দিক থেকে অনেক দূরে এগিয়েছে, বহু কাজ করা এখনো বাকি আছে। শুধু নারীর কথা কেন বলি, পুরুষদের অনেক কিছু করা বাকি আছে। শুনুন, বেদে পড়া যায়, সুকুমারী লিখেছেন, বাড়ির কাজকর্ম করার জন্য পরিবারের একটি মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে রেখে দেওয়া হতো, তাকে বলা হতো জরদকুমারী। তাদের নারীর অবস্থান কোথায় এটা সহজেই বোঝা যায়।

প্রশ্ন : পুঁজিবাদী সমাজ নারীদের পণ্যে পরিণত করে...

মহাশ্বেতা দেবী : দেখুন, আমি অত শিক্ষিত কর্থাবার্তা বলতে পারি না, ডোন্ট আস্ক মি সাচ থিংস। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টেলিভিশেন মেয়েদের যেভাবে দেখাচ্ছে তার কথা সবাই জানে, কিন্তু পুরুষদেরও বা কীভাবে দেখাচ্ছে? তারাও কি পণ্যে পরিণত হচ্ছে না? এসটিইউডি- স্টাড বললে যা বোঝা যায় সেইভাবে দেখাচ্ছে, তাতে পুরুষদের অসম্মান হচ্ছে না? পুরুষদের নানারকম জিন্স পরিয়ে প্রায় অর্ধনগ্ন দেখানো হচ্ছে। তাতে সমগ্র মানুষকেই অপমান করা হচ্ছে। তবে মেয়েদের বেশি, পুরুষদের কম।

প্রশ্ন : আপনার ব্যক্তিজীবন সম্পর্ক কিছু বলুন।

মহাশ্বেতা দেবী : আমার জীবন আমার সাহিত্যকর্ম, পত্রিকা সম্পাদনা, আমার সৃষ্টিধর্মী রচনা সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমি সংগঠনমূলক যে কাজ করি, যে সাহিত্য রচনা করি, আমি যে জীবন যাপন করি তার সবই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যারা আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন তাঁরা জানেন, আমার বাড়িতে কোনো টিভি নেই, কোনো দামি জিনিস পাবেন না আমার বাড়িতে, আমার বাড়িতে আদিবাসী আসে, ভাত চড়ে ভাত খায়- এভাবেই আমার জীবন চলে। আমার লেখালেখি এই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

প্রশ্ন : আপনি সেদিন শ্রুতিবাণীর কথা বলছিলেন...

মহাশ্বেতা দেবী : আসলে আমি ঠিক শ্রুতিবাণীর কথা বলিনি, বলেছি ওরাল ট্রাডিশনকে যথেষ্ট মূল্য দিয়ে সংরক্ষণ করা হয় না।

প্রশ্ন : শ্রুতিবাণী বলুন আর ওরাল ট্রাডিশন বলুন, আপনি লেখার ভেতরে সেটা আনার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ওরাল ট্রাডিশন যে ফর্মে আছে সে ফর্মেই কি সাহিত্যে আনার কথা বলছেন? নাকি আধুনিক আঙ্গিকে আসবে?

মহাশ্বেতা দেবী : যে যেভাবে আনতে চান সেভাবে আনবেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামাতে এই ওরাল ট্রাডিশন এনেছেন।

প্রশ্ন : কিন্তু বিশ্বব্যাপী ইলেট্রনিক মিডিয়ার যে আগ্রাসন তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা, এই ওরাল ট্রাডিশন কি বিকল্প শক্তি হতে পারে?

মহাশ্বেতা দেবী : না আমি বিকল্প কিছুর কথা বলছি না। ওরাল ট্রাডিশন রক্ষা করা প্রয়োজন আমাদের জীবনের স্বার্থেই, মাটি ও বনের স্বাথেই।

প্রশ্ন : আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি…

মহাশ্বেতা দেবী : হ্যাঁ করেছেন, আপনি শিক্ষিত শ্রেণির কথা হয়তো বলেছেন। কিন্তু গ্রামে গঞ্জে চাষি, মজুরদের মুখে সেই একাত্তরের যুদ্ধই গান হয়ে, গাথা হয়ে বেঁচে আছে। সেগুলো তো সংগহ করা উচিত। গ্রামের সেই সাধারণ মানুষটি যুদ্ধকে কীভাবে দেখেছিল, কী ভেবেছিল সেটা কি জানা দরকার নেই? ছাত্র আর বুদ্ধিজীবীরা কী ভেবেছিল সেটাই একমাত্র জানার বিষয়? “কী হলো রে জান, পলাশীর ময়দানে মাদান, নবাব হারালো যে প্রাণ”- এই গানের মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষের কাছে পলাশী যুদ্ধের কথা বেঁচে আছে। যারা লিখতে জানত না, পড়তে পারত না তারা ওরাল ট্রাডিশান বা শ্রুতি পরম্পরায় এসব জিনিস বাঁচিয়ে রাখত। একাত্তরের যুদ্ধের কথাতেই আবার ফিরে আসি। নানাভাবে যুদ্ধ হয়েছে সেসব কথাসাহিত্যে এসেছে। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে যারা প্রাণ দিয়েছিল, যত অজানা জায়গায় গণকবর আছে, সেই সব জায়গায় মাঝিদের মুখের, চাষিদের মুখের গানে-গল্পে গাথায় তারা একাত্তরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই সব সংগ্রহ করার প্রয়োজন আছে। এখনো সুযোগ আছে সেগুলো ধরে রাখার। কারণ একাত্তর থেকে ছিয়ান্নব্বই খুব বেশি বছর নয়।