অনুপ্রেরণার অপর নাম ‘মুখ ও মুখোশ’
সিনেমা হলে বসে নিজ দেশের, নিজ ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র দেখার আনন্দ অসাধারণ। নিজের দেশের চলচ্চিত্রকে যতটা আপন করে নেওয়া যায়, তা বিদেশি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। দেশের চলচ্চিত্র দেশের মানুষের কথা বলে, নিজস্ব সংস্কৃতির কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও নিজস্ব ছবি আছে। যেখানে নিজের ভাষা বাংলায় সিনেমা নির্মিত হয়। কিন্তু একসময় বাংলাদেশের নিজস্ব কোন চলচ্চিত্র ছিল না। বাংলা ভাষায় কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হতো না। শুধু তাই নয়, তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত এই ভূখণ্ডের সিনেমা হলগুলোতে কলকাতা ও লাহোরের ছবি প্রদর্শিত হতো।
অখণ্ড পাকিস্তানের পূর্বাংশে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠেনি তখনো। পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রই নির্মিত হতো। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অনেকেই মনে করতেন, পূর্ব পাকিস্তানে কখনোই চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, তারা নানা রকম বিরূপ মন্তব্য করতেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রযোজক এফ দোসানি ছিলেন তাঁদেরই একজন। তিনি একবার পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তার নেতিবাচক মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে আবদুল জব্বার খান নামে একজন ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। নির্মাণ করেন ‘মুখ ও মুখোশ’ নামে একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র।
যা পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। সে হিসেবে আবদুল জব্বার খানকে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দিকপাল বলা যেতে পারে। ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের একটি অনুপ্রেরণাময় ইতিহাস আছে। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের উচিত এই ইতিহাস জানা।
কখনো কখনো তীব্র ক্ষোভ, রাগ থেকে ভালো কিছু জন্মায়। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রটি ঠিক তেমনই। ১৯৫৩ সালে আবদুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রটির কাজ আরম্ভ করেন। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে কোনো চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠেনি। আবদুল জব্বার খান প্রায় এক বছর ধরে পূর্বপ্রস্তুতি নেন অর্থ্যাৎ প্রি-প্রোডাকশনের কাজ করেন। তারপর ১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট হোটেল শাহবাগে ছবিটির মহরত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ইস্কান্দার মির্জা চলচ্চিত্রটির মহরত উদ্বোধন করেন।
চলচ্চিত্রটিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদেরও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। অনেকটা মনের সাহসে নতুন কিছু করার প্রত্যয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয় করেন তাঁরা। কারণ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতিবাচক মন্তব্যের সমুচিত জবাব দিতে। শুটিং আরম্ভ হলে দৃশ্যধারণের পর নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য লাহোরে পাঠানো হয়। সে সময় স্থানীয়ভাবে কোনো স্টুডিও না থাকায় বাধ্য হয়ে লাহোরের স্টুডিওর দ্বারস্থ হতে হয়।
১৯৫৬ সালে কাজ শেষ হলেও আবদুল জব্বার খান ছবিটি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার অনুমতি না পাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী করা হয়। তারপর যখন ছবিটি নিয়ে তিনি দেশে ফিরলেন, তখন কোনো প্রেক্ষাগৃহ ছবিটি প্রদর্শন করার আগ্রহ দেখায়নি বা প্রদর্শন করতে চায়নি। তবু দমে যাননি আবদুল জব্বার খান। চেষ্টা চালিয়ে যান। অল্পদিনের মধ্যে ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ছবিটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় একযোগে মুক্তি পায়। ছবিটি সেই সময়ে আয় করেছিল ৪৮ হাজার রুপি। এখানে বলে রাখা ভালো ‘মুখ ও মুখোশ’ সবাক চলচ্চিত্র। এর আগে ‘দ্য লাস্ট কিস’ নামে একটি নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও সেটির কোন প্রিন্ট এখন আর পাওয়া যায় না।
আজ সেই ৩ আগস্ট। ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির ৬০ বছর পূর্ণ হলো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নিজস্ব জায়গা সৃষ্টি করার যে প্রয়াস ছিল ছবিটি নির্মাণের মধ্যে, সেই প্রয়াসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে আজ চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে প্রদর্শিত, প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে।