নির্যাতিত জাতির অকাট্য এক দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’
প্রামাণ্যচিত্র কখনো কখনো নির্যাতিত মানুষের প্রমাণপত্র হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়। আবার কখনো প্রামাণ্যচিত্র হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা। ‘স্টপ জেনোসাইড’ ঠিক এমন একটি প্রামাণ্যচিত্র। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জহির রায়হান পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত।
১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট জহির রায়হান জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলাতেই বড় দুই ভাইবোনের কাছ থেকে রাজনৈতিক দীক্ষা পান জহির রায়হান। বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সার এবং বড় বোন নাফিসা কবির দুজনই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই জহির রায়হানের বামপন্থী রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। এরপর ১৯৫২ সালে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। সে সময়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার কারণে গ্রেপ্তারও হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকাকালে সাহিত্য রচনা শুরু করেন তিনি। ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন চলচ্চিত্রে। তার পর নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬১ সালে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি পায়।
এরপর তিনি ‘সোনার কাজল’, ‘সঙ্গম’, ‘বাহানা, ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ বেশকিছু কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। পরিচালনার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরেই ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। ধারণা করা হয়, আলবদর বাহিনী কর্তৃক তিনি অপহৃত ও পরে নিহত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন পূর্ব পকিস্তানের জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্যাতন, গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ও বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ে জহির রায়হান ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সহকারী আলমগীর কবিরকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। ক্যামেরাকে অস্ত্র বানিয়ে তিনি ছুটে চলেন এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। ছুটে যান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে। তুলে আনেন শরণার্থীদের মানবেতর জীবযাপনের করুণ দৃশ্য।
‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রটি শুরু হয় লেলিনের বাণী দিয়ে। তার পর দেখা যায়, গ্রামের এক কিশোরী ঢেঁকিতে ধান ভানছে। অবিরত ঢেঁকিতে পার দিয়ে চলছে সে। দৃশ্য পরিবর্তনে একসময় সেই কিশোরীর হাসি বাতাসে মিলিয়ে যায়। ব্রাশফায়ারের শব্দে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস। যেদিকে তাকানো হয়, সেদিকেই শুধু লাশ আর লাশ।
পাকিস্তানিদের এমন গণহত্যার দৃশ্য দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি উদাহরণ হিসেবে নেপথ্য কণ্ঠে ফরাসি বিপ্লব, আলজেরিয়া, প্যালেস্টাইনসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, এই প্রামাণ্যচিত্রে তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিলেন। সে সঙ্গে এই প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষকে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
১৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই প্রামাণ্যচিত্রে জহির রায়হান যেভাবে মানবতা লঙ্ঘনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে বিশ্ববিবেক নাড়া দিয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম, যাঁরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, নির্যাতন দেখেনি, তাঁরা ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখে বুঝতে পারবে সেদিন ক্ষমতার কাছে কতটা অসহায় ছিল বাংলাদেশের মানুষ। উপলব্ধি করতে পারবে নির্মমতার চিত্র।