বৃষ্টির কবিতা
আষাঢ়
জেনিস মাহমুন
এখানে প্রাণ আকৃতি নিয়ে থাকে
প্রতিটি আকারই স্বয়ং
এখানে প্রাণ বুকে রাখে রং
আকাশকে কাছে ডাকে
ডাক শোনে মেঘ
ক্ষীণ এক তৃণের নামে
তার আকৃতি ভাঙে
ঝরায়, ঘনায় আবেগ
তুমি তো কেরানি
দশটা পাঁচটার আকার ছাড়োনি
শহর ভেসে গেছে
শহর গোল্লায় গেছে
নুয়ে গেছে গাছ
ল্যাম্পপোস্টার, গোলপোস্টার কাছটিতে
বিদ্যুতের তার দেখ না সেতার
কালো নোটেসনে উড়ছে কাক তার পাশটিতে
শহর ভেঙে গেছে
শহর ভিজে গেছে
শহর গোল্লায় গেছে আর আশপাশটা
তুমি তো কেরানি ভাঙেনি তোমার
দশটা পাঁচটা।
আমি ভেঙে গেছি
গোল্লায় গেছি, ভিজে গেছি
ঘটিতেছি
এখানে আষাঢ়, এখানে আকার
ভেঙে মেঘ ঝরে। এখানে শহরে
তরল বঙ্গাব্দ ঝরে
এক কবি
হৃদয়ে শব্দ করে
আমি গোল্লায় গেছি!
বৃষ্টি ও ইলেকট্রিক খাম
মজিদ মাহমুদ
বৃষ্টিকে যারা চেনে—তারা আমার ভাই ও পরম সুহৃদ
তারা নির্জন বনের ধারে অশ্রুসিক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
কেউ গ্রাম ছেড়ে বহুদিন আগে গিয়েছিল শহরের পথ ধরে
কিংবা তাদের স্মৃতির মধ্যে জেগে আছে বন-উজাড়ের গল্প
যারা দেখেছিল হাওয়ার বিমান ধরে সাগরের কন্যারা
নানা ভঙ্গিতে দলবদ্ধ মেঘের আদলে শরীর বিছিয়ে রাখে
তারাই তো একদিন এসেছিল নেমে হিমালয়ের গাত্র বেয়ে
ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বঙ্গোপসাগরে
বৃষ্টিকে তোমরা যতই চেনো, বৃষ্টি অচেনা—কেঁদে শরীর
ভিজিয়ে দেবে, সিক্ত-বসনে দেহের ভাঁজগুলো জানাবে
কামুক আহ্বান, অথচ তুমি প্রকৃত জেগে ওঠার আগেই
মিটে যাবে তার সকল বাসনা, বাতাসের ঘোড়ায় চেপে
চলে যাবে অবিভাসী পুরুষের অকাল রেতপাতের খোঁজে
বৃষ্টি কোথায় নামবে, তোমরা সরিয়ে নিয়েছ তার নৃত্যের
আসন—ভেজা পাগুলো মাটিতে নামাবার আগে—চিরচেনা
টিনের চালগুলো অদৃশ্য—নগ্নশরীরে যে-সব পুকুরে ছিল
তার অবাধ সাঁতার—তার একটিও কোথাও রাখনি অবশিষ্ট
তবু বৃষ্টিকে বলো, মাঠের ভেতর রোদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা
ইলেকট্রিক খামগুলো এখনো ভেজার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে
তারের গর্ভে বাইশ হাজার ভোল্টের আগুন ধরে রাখে।
জড়িয়ে আছে আজও
শাহনাজ নাসরীন
একটি দুপুর হত্যা করে
স্বেদের কণায় শরীরজুড়ে বর্ষা নামা
মধ্যরাতে শিশির ভেজা বকুলতলা
ধার দিয়েছে সত্যমিথ্যা আড়ালগুলি
বৃষ্টিঝরা বিষণ্ণ দিন আজও—
পরিহাসের বাক্যবাণে শীতল ছুড়ি
জড়িয়ে আছে তোমার দেওয়া নিষ্ঠুরতায়
পঞ্চাশেও একটি দুপুর একটি রাতে
ধার দিয়েছে সত্যমিথ্যা আড়ালগুলি
মধ্যরাতে শিশির ভেজা বকুলতলা
স্বেদের কণায় শরীরজুড়ে বর্ষা নামা
হত্যা করে একটি দুপুর
অগ্নিমল্লার
পিয়াস মজিদ
ঘুমিয়ে গেছে সন্ধ্যামেঘ, নিঝুম।
বনপরীর ঝোঁপ থেকে তারাবৃষ্টি তুমি
শুক-স্বাতী আর অরুন্ধতী অধ্যুষিত,
বৃক্ষসবুজ জলসায়
ঊষা ও গোধূলিগণ
সোনা-হীরার শিখা বুনে যায়।
এভাবে বিষমালঞ্চ জুড়ে
ফোটে ফুল; মরণমধুর।
ময়ূরমুহূর্তের ঝলসানো কেকায়
রঞ্জিত আমি;
অঘ্রানের অনন্ত আশ্রমে
নেহাত ক্ষণিকার রূপ ধরে
জন্ম নিই, মৃত্যু নিতে থাকি...
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
আবু তাহের সরফরাজ
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
আমার বাড়ির ছাদে কী বসে?
ভেজামেঘ ওরে আর ডাকে গুরু গুরু
আষাঢ় মাসের তবে আজ হলো শুরু।
দুটো ব্যাঙ চুপচাপ
পুকুরে দেয় ঝাঁপ
আর দেখি, সারা দিন বৃষ্টিতে শাদা
আমিও চুপচাপ
চা খাই তিন কাপ
আর দেখি, ভিজে গেছে কবিতার খাতা।
ভেজা ভেজা হরফে
বৃষ্টির তরফে
লিখি তাই, আষাঢ়ের দিবসে
আমার বাড়ির ছাদে কী বসে?
তোমার জন্য
জাহিদ সোহাগ
অথচ তোমার জন্য বৃষ্টি নয়। শুধু
পূর্বাভাস শুনে যেও
ধরে নাও একদিন ঝড় এলো খুব
কোনো রিকশা-গাড়ি নেই, দাঁড়িয়েছ তুমি
শাড়ির ভেতর একা
জানালা উদ্যম নেচে, ক্লান্ত। বৃষ্টিছাঁটে
বিছানায় ধুলোজল।
তুমি একা এতো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলো,
তবে আজ পরাজিত
বিস্কুটের মতো ভেজা, সামান্য রাত্রির?
বৃষ্টি
মামুন রশীদ
অদ্ভুত এক স্যুটকেসের ভেতর থেকে দারুণ ফর্সা দুটি হাত
নিরক্ষর ভোরের আলোয় মুঠো মুঠো বিলিয়ে দেয় ব্যক্তিগত নোটবুক।
কোন প্রতিরোধ ছাড়াই সেনাছাউনি থেকে তারা এলোমেলো ছড়িয়ে
পড়তে পড়তে শকুনের ডানার ভেতরে তৈরি করে ফেলে রহস্যময় জগৎ।
তার আন্দোলন, তার কাতরতা, বাজি ধরে বলতে পারি—
আপনি যেখানেই থাকুন তার অনর্গল ডানা ঝাপটানো
অলীক তরঙ্গের ভেতরে ঠিক জাগিয়ে তুলবে স্মৃতি।
একটি মেঘ
জয়নাব শান্তু
আকাশে তখনো কেউ ছিল না,
না সূর্য, অন্য কোন নক্ষত্রও নয়।
একাকী ছিলাম আমি—
নৈঃশব্দ্যে ধ্যানমগ্ন;
মেঘাবৃত গাঢ়তার শেষতম তলে,
বর্ণহীন রঙের বাতাসে ডুবে,
নেচে চলে কেবল একটানা পিউ কাঁহা।
বিস্বাদের আধমরা মেঘ বলে কিছু নেই
বিজলীর স্রোত, শহুরে নবীন।
ঝলসানো অভিধানে আজ শুধু
উন্মত্ত কান্নার প্রাচীন কারুকাজ।
টলোমলো নিশিথ দিগন্তে একাকার
ক্ষণপ্রহরের কাজলীজল,
জলে জলময়
শ্যামাঙ্গী কানু।