ঈদের আয়োজন

গিরীশ গৈরিকের ১০ কবিতা

Looks like you've blocked notifications!

মা-১

আমার মা যখন বালিকা ছিলেন

যখন তার একবারও ঋতুস্রাব হয়নি

তখন তাকে আমি প্রথম দেখি

সে হেমন্তের সন্ধ্যায় লেবুফুলে স্নান সেরেছে মাত্র

সে তখন নগ্ন ছিল—ঠিক আমারই মতো

কেননা আমরা দুজনেই সমবয়সী সময়ের অন্ধ জোনাকি

মা-১০

তোমার মুখে কলঙ্ক দেবার পর

আয়নার সম্মুখে দাঁড়ালে আমার মাথা খুঁজে পাই না

তাই গিয়েছিলাম শান্ত জলাশয়ের কাছে

সেই আমায় প্রথম শেখাল নার্সিসিজম

এভাবে আমি অন্ধগলিতে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধ হলাম

জানলাম আঁধারের কাছে জমা আছে আলোর ভাষা

অবশেষে মায়ের কাছে খুলে বললাম অন্ধত্বের কারণ

মা আমাকে শাস্তি ও বেঁচে থাকার জন্য শেখালেন

জন্মান্ধ বাদুড়ের প্রতিধ্বনি বিদ্যা

মা-১১

শহরের বাড়িগুলো খুব পাশাপাশি

অথচ ভেতরের মানুষগুলো অনেক দূরে দূরে বসবাস করে

আমার মা তাই কোনোদিন শহরের অধিবাসী হতে পারে নাই

সে এখন গ্রামে বসে—গবোর দিয়ে উঠান পবিত্র করেন; পূজায় বসেন

পূজা শেষ করে খোঁজ নেন—হাঁসমুরগিগুলো কোথায় কেমন আছে

লাউয়ের ডগা আর কত বড় হলে—মাচাটা কতটুকু করতে হবে

 

আমি শত শত পথ দূরে থেকেও মায়ের এসব কাজ দেখতে পাই

আর শুনতে পাই, মা আমাকে কখন কী বলছেন

যেমন করে শত শব্দের ভিড়েও বাসের ড্রাইভার—

হেলপারের কথা শুনতে পায়

মা-১৪

পূর্ণিমা এলেই আমার মা দখিনা পুকুরঘাটে

গোপনে। পুকুর জলে সোনালি টাকার কয়েন ছুড়ে মারেন

আর আমাদের পুকুর পালিত ইলিশের ঝাঁক

সেই সকল সোনালি কয়েন খেয়ে

তাদের শরীরে জন্মায়—খাঁটি সোনার আঁশ।

 

আমাদের পাড়া তো চোরেরা

সেই সকল ইলিশের সোনার আঁশ খুলে

তাদের বউদের বানিয়ে দেয় গায়না

অথচ! আমার মায়ের জীবন কাটে গয়নাহীন সাজে।

মা-১৫

পৃথিবীর অধিকাংশ ফুল ভ্রমর সঙ্গমে রত

তাই তারা কলঙ্কিত

তবুও দেবতারা কলঙ্কিত ফুল ভালোবাসে।

নারীরা ফুলের মতো

তাই তারা প্রেমে পড়ে অবিরত।

 

ভুল। নারীরা ফুলের মতো নয়

নারীরা নদীর মতো

তারা থেকে থেকে জীবনের বাঁক বদলায়

বুকের ভেতর ধরে রাখে জল

আবার বিদ্রোহী হলে সেই জলে ভাসায় স্থল।

তারা তো যৌবনের কুল ভেঙে কুল গড়ে

আবার অধিক শীত এলে নদীর মতো শুকিয়ে মরে।

 

না। নারীরা যতটা নদীর মতো তারও অধিক

আমার মায়ের মতো, বোনের মতো, আমার প্রিয়তমার মতো।

মা-২০

কোনো বিষধর সাপ ফণা তুলে দাঁড়ালে

প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে যায়।

অথচ! সাপদের কোনো প্রশ্নের উত্তর আজও মানুষের অজানা

তাই মানুষের সাথে সাপদের এত আড়ি।

 

আমার মা বলেন—

কোনো কোনো মানুষ সাপেরও অধিক

তাদের এক ছোবলে হাজার মানুষ মরে।

বস্তুত সাপদের কাছে মানুষের শেখা উচিত

এই আভিশাপ থেকে মানুষ কবে মুক্তি পাবে।

মা-২১

হঠাৎ আমার মায়ের অসুস্থতার খবর পেলাম

ঠিক তখনই হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি

ঘড়ির কাঁটা উল্টা দিকে ঘুরছে।

এভাবে আমি ঘড়ির কাঁটার সাথে উল্টা দিকে ঘুরতে ঘুরতে

 শৈশবে ফিরে এলাম।

এমনি করে ফিরে পেলাম

 নগ্ন হয়ে মার্বেল খেলার দিন।

মা-২৮

আমার ঠাকুরমা অশ্রুবন্ধ্যা ছিলেন

লোকমুখে জানা যায় তিনি তার স্বামীর মৃত্যুতেও কাঁদেননি।

যেদিন তার শতবছর পূর্ণ হবে

সেইদিনই তিনি ঘোষণা দিলেন—স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করবেন

এবং তিনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন—তার ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করতে।

এটা নাকি তার আজন্মের শখ

মৃত্যুর আগে তার নিজের কবর ও ডেথ সার্টিফিকেট দেখে যাওয়া।

 

তার স্বেচ্ছামৃত্যুর সন্ধ্যায়—আমার মা যখন হাউমাউ করে কাঁদছিলেন

ঠাকুরমা তখন মাকে ডেকে জানালেন

 তার অশ্রুবন্ধ্যার গোপন রহস্য।

 

অতঃপর আমি জেনেছি—মায়ের অশ্রুলিপি থেকে

আসলে ঠাকুরমার কোনো অশ্রুগ্রন্থি ছিল না।

মা-৩১

মা তুমি নগ্ন হলে

তোমার সমস্ত শরীর আয়না হয়ে যায়

তখন তোমার দিকে তাকালে

শুধু আমাকেই দেখি।

 

এখনো শরীরের একটা বিশেষ অঙ্গ

অনেক কিছু।

তবুও আমি যখন কবিতা পাঠে নিমগ্ন থাকি

কিংবা মায়ের নান্দনিক নগ্নতা নিয়ে ভাবি

তখন আমার ওই বিশেষ অঙ্গের কথা মনে থকে না।

 

অথচ! এই আধুনিক সভ্যতার মানুষ কেন ভাবে না

পোশাক আবিষ্কারের পূর্বে—কোটি কোটি বছর ধরে

মা ও সন্তানেরা নগ্ন হয়ে বসবাস করেছে।

মা-৩৫

গভীর অন্ধকারে—একটি কেরোসিনের কুপি থেকে

আরেকটি কুপিকে আগুন ধার দিলে।

সেই কুপিদ্বয়ের দেনা-পাওনার লেনদেন সর্বসম হয়।

যেমন করে আমার মা ও আমার ভালোবাসার লেনদেন সর্বতো সর্বসম।

তবে। ওই অন্ধকারে কুপিদ্বয়ের আলো—

একটি আরেকটি আলো থেকে অপেক্ষাকৃত বড় হলে

ছোট্ট আলোটি বড় আলোর কাছে ম্লান হয়ে যায়।

এভাবে আমি মায়ের আলোর নিচে ম্লান হয়ে থাকি

কিংবা দিনের বেলায় সূর্যালোকে চাঁদ যেমন ম্লান হয়ে থাকে।

মা-৩৬

আমার মায়ের একটি ফুলবাগান আছে

আর বাবার আছে মৌমাছি প্রকল্প।

 

একদিন মা ও বাবার মাঝে তুমুল ঝগড়া হলো

ঝগড়ার মাঝে মা—বাবাকে তর্জনী তুলে বলল :

আজ থেকে তোমার মৌমাছি—আমার ফুলবাগানে নিষিদ্ধ।

 

সেই ভুল থেকে মায়ের বাগানের ফুলগুলো ঝরে গেল

অথচ! এখনো মায়ের আঁচলে পুষ্পহীন সুগন্ধ খেলা করে।

 

কবি পরিচিতি

গিরীশ গৈরিক