ঈদের আয়োজন

চামেলী বসুর ১০ কবিতা

Looks like you've blocked notifications!

প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাক তোমার সময়

শর্তারোপকারীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে

নারীত্বের গোপন বাসনাগুলোয় কেমন শুঁয়োপোকার ঘরবসতি—

অনন্ত শয়নের পথে উন্মাতাল সংগীত

সতীত্বেও থালাবাসন ধুতে-মুছতে দময়ন্তীর হাতের চেটয় ঘা;

স্বর্গের ভাঙা সিঁড়িতে বসা নলের সন্ধানী চোখে

অশরীরী শরীরের অকারণ আনাগোনা—

নীল রক্তের জোয়ারে বুভুক্ষু বাসনার বুদবুদ

ধারণার বাইরে সব অভিশাপের ষোলপাতের ঘর

উড়ে গেলে মায়া শকুন অফুরান নীলিমায়

দময়ন্তীর বিবর্ণ বসন;

 

আপন মন্ত্রের ঘোরে নস্যি কাটা পুরোহিতও জানে

এই পৃথিবীর মহেন্দ্র ঘরে পাপ বলে কিছু নেই...

রবীন্দ্রনাথ—অতঃপর আমরা

তোমার ছত্রছায়াকে বিপণির স্তম্ভ বানাতে এসে দেখি

বোধের সীমানায় পাহারারত কয়েকটি ধূর্তকাক;

অঙ্কুরিত মেধাকে ঐশ্বর্যের দেয়াল টপকাতে শিখিয়েছি

আপন পারঙ্গমতায় । আত্মম্ভরিতার উদ্ধত কলমকে

জোড় করে বসিয়েছি প্রতিভার ঘরে—

এখন, অচর্চিত প্রতিভা আর লজ্জা লাঞ্ছিত উপেনিবেশি মন

চৌর্যবৃত্তি ছাড়া কিছুই বোঝে না।

তোমাকে স্বাগতম

একদিন বাম গালের তিলটি দেখিয়ে বলেছিলে

এখানেই ভালোবাসা আছে।

অবাক হয়ে দেখেছি মৃত নক্ষত্রের কালো আভাস নিয়ে

অপেক্ষমাণ তিলটিকে

 সে কেমন আগ্রাসী নদীর মতো

 বাহু মেলে ভেঙেছে মনের দু’পাড়।

 স্থির চোখে টুকরো টুকরো করে কেটেছি

 চেনা নদীটির চেনা গতি পথ—

 বসন্তের উষ্ণ হাওয়ার ঘ্রাণে

 গাছেদের শীর্ণ বাহু যখন ভরে ওঠে পাতার গানে

তখনো বৃষ্টির আগমনী গেয়ে কেউ আসেনি

ছিপ নৌকায় বাদাম উড়িয়ে

তৃষ্ণার্ত মনটিকে বৈকুণ্ঠে নিতে...

অথচ একদিন এই তুমিই

বাম গালের তিলটি দেখিয়ে বলেছিলে

এখানেই ভালোবাসা আছে।

অন্তরগত ভালোবাসা—যার কোনো ডাকনাম নেই

আমি তাকে ভালোবেসে জমিয়ে রাখি লাল নীল টিপের পাশে...

অথবা মাঝেমধ্যে কিছু ব্যক্তিগত হুকের কার্নিশে

যদিও সে চোখে আঙুলের বদলে সুরমা দিয়ে বলেছিল—

আমরা একদিন রুমালের ভাঁজে বসবাস করব অথবা আধছেঁড়া পলিব্যাগে চড়ে

উড়ে যাব হাওয়ার উদ্দেশে...     

আর একদিন চার আনা স্বপ্ন হাতে দিয়ে বলেছিল—

মেঘেদের মেয়েদের গা থেকে যেমন জল জল গন্ধ আসে তেমনি তোমারও—

তুলোতুলো ভাবনা মাথায় এঁকে সাবলীল হেসে আমি হয়ে যাই মেঘ

সে হয় পথ ভুলো বুনো হাঁস—

আমরা ছাড়িয়ে যেতে থাকি আমাদের নিজস্ব চেনা গণ্ডি এবং গণ্ডির মতোন কিছু ছলনার দাগ—

তারপর একদিন সে দেয় পাড়ি তার দীর্ঘ ভুল পথ;

আর আমি, জল হয়ে ঝরে পরি সোমেশ্বর নদীটির বুকের ক্ষতে...

মা-২

তোমার মতো অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকা পথের

চোখে জ্বলে আশার তৃষ্ণা

কত দিন হয়ে গেল—কত দিন হয়

দীর্ঘ পথটাকে ভাঁজ করা কাথার মতো

 তোমার পায়ের কাছে রেখে দেখি

সময় ফুরিয়ে গেছে আঁচলে মুখ মোছার

মা

তুমি নারী

তুমি পথ

তুমি মধুমতী

 তোমার সরল চোখে জেগে থাক অনন্তকাল এই ঘরে ফেরার ডাক।

তোমাকে বিবর্তিত হতে মানা

মোমের মতো শাদা পা ফেলে তুমি

চলে যেতে চাও নীল নীল অপরাজিতার বনে

অথচ তুমিই একসময় ছেঁড়া কাগজে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলে

শহরের ফুটপাতজুড়ে;

কিংবা দুই চোখে দুই রঙের স্বপ্ন বুনে বুনে

 বেতের কাঁটার মতো আঁকড়ে ধরেছিলে অন্ধকারের হাত

অথবা খুব সাধ্যি সাধনায় তুমি হয়ে যেতে পেরেছিলে

 চতুর শহরের চিলেকোঠায় জ্বলা নিয়ন বাতি

আর তোমার পেটের ক্ষুধাকে মঞ্চ বানিয়ে নেচে গেলে কিছু উদম পায়রা

তুমি ভাব লক্ষ্মীপেঁচা বুঝি এসেছে নিয়ে ডানা ভরে অগাধ জোছনা...

 

‘বিক্রীত মাংস ফেরত নেয়া হয় না’ এ জাতীয় বিলবোর্ডের রক্তচক্ষুকে

উপেক্ষা করে তবু তুমি চলে যেতে চাও

নীল নীল অপরাজিতার বনে!

অভিধান-সংক্রান্ত মনের খসড়া

আমি তার স্বচ্ছ জলের মতো চোখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতে পাড়ি যে,

একদা তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য যে নাম রাখা হয়েছিল তার

আভিধানিক অর্থ প্রজ্বালনকারী—মধ্যবিত্তের শিৎকারবিহীন সংগমের মতোই

তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখি অতি উৎসাহী ভয়ের সীমানায়—ইদানীং ভোরবেলার

আনন্দহীন খবরের কাগজ হতে কিছু মলিনতা হাতের মুঠোয় পুরে সে আমার ঠোঁট

বরাবর ছুড়ে মারে কয়েকটি উত্তপ্ত অচল পয়সা...। আনুমানিক সীতারামের ঘোড়াগুলো যখন মধুমতীর ঘাটে জল খেয়ে চলে যেত নক্ষত্রের পথে—আর শরীরে জল জল গন্ধ নিয়ে কুমারী মেঘের মতো নক্ষত্রও সেবিকা হয়ে অপেক্ষায় মগ্ন হতো আর একটি সতেজ সকালের—এই সব ভুলভাল হিসাব মেলাতে গিয়ে আমিও অনুমান ঘাঁটি—

অথচ অভ্যেস বসত বুকের বাম পাশে হাত রেখে আঁকড়ে ধরি একটি শব্দ—যা সে ব্যক্তিগত ব্যবহারের পর খুলে রেখেছিল অভিধানের পাতায়।

সভ্যতার প্রতিনিধি

তোমরা আমায় আর কী কী দিতে পারো? এই ধরো বকুনির আগের মুখভঙ্গি—

ভালো করে তাকাবার আগে চোখ ডলে নেওয়া—ঠোঁটের মাঝের লুপ্তপ্রায় তিলটি

খুঁজতে গিয়ে হাঁচি দিয়ে ফেলা—কিংবা শরীর থেকে লেবু পাতার গন্ধ নিংড়ে নিয়ে

পারফিউমের কোটোয় বন্দি করা ছাড়া? লাল-নীল স্মৃতি ইরেজারে মুছে দিয়ে

আঁচল ভরে মাছ ধরবো বলে নেমে যাই ক্ষেত ভরা জলে—আর যখন

 মাছের বদলে তুলে আনি কয়েকটি শক্ত মাটির ঢেলা—তোমরা তখন

গন্ধম খাওয়াবার প্রতিশোধ নিতে আমাকে ছুড়ে মার নগরীর সবচে বড়

 বিলবোর্ডে—আর আমি নগ্নপ্রায় হতে হতে তোমাদের প্রতিশোধের

প্রতিনিধিত্ব করি বোকা বোকা হেসে; এই সব বেঁচে থাকার এফোঁড়-ওফোঁড়

সংগ্রামে শামুকের জীবন থেকে মুক্তি হলে পরে...তোমাদের চেতনার ঘুণপোকা

চলে যাবে দূরে , আমার শরীর থেকে ‘বিপণিবিতান’

এই নামখানি কুরে কুরে খেয়ে...

শিরোনামহীন-৪

ফিরে যাও কবি : অষ্টপ্রহর করো চাষ বেলে দোআঁশ মাটি; অঙ্কুরিত

হবার যোগ্য বীজভাণ্ডার শূন্য, যদিও ভাণ্ডরিকা রতি-সরস্বতী।

ঘুম ঘুম রাজকন্যারা জাগে না নিষ্কাম আহ্বানে।

কবিতারা ঘুমিয়ে গেলে হৃদয় পাটাতনের অন্তঃপুরে

 ঢেউ জাগে আর তোমার মস্তিষ্ক ঘিওে কড়িকাঠ আঁকিবুঁকি...

শিরোনামহীন-৬

যদিও চাঁদা দেওয়া হয়নি, তারপরও জ্যামিতি বক্স

অলৌকিক চিহ্ন এঁকে জতুগৃহে শয্যাসুখী ধ্রুপদ নন্দিনী। জনান্তিক ভাবনাগুলো

নলখাগড়ায় সরস্বতী আর সংহিতার মন্ত্র এখন ভাড়ায় খাটা জোয়ান ঋষি।

গলির গুহায় অষ্টাদশীর ধমনীতে আগুন উসকানি; ইমিটেশন হাসির

মায়ায় থেঁতলানো মানবীয় কিছু নৈবেদ্য—উপঢৌকন দিলেই মেলে

নীল-কালো-ধূসর মাথার অধিকার। সরল উপপাদ্যেও নিয়মটাই জটিল

অথচ মূর্খের হাতে সে হয় সবচেয়ে সস্তা কাঠি লজেন্স।