এস এম সুলতান, অতল শ্রদ্ধা

Looks like you've blocked notifications!

প্রচণ্ড মানসিক শক্তি আর সৃষ্টিশীলতা নিয়ে পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম হয়, যাঁরা অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখেন এবং সবাইকে জানিয়ে দেন তাঁদের আবেগের উত্তাপ। সারা জীবন যাঁরা ছুটে চলেন সৌন্দর্যের টানে, দুর্বার আকর্ষণে সৃষ্টির নেশায়। এমনই এক অনন্য সৃষ্টিশীল সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষ, বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান।

যিনি আবহমান বাংলার মানুষের সহস্র বছরের জীবনের মূল সুর-ছন্দ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতায় টিকে থাকার ইতিহাস এঁকেছেন তাঁর ক্যানভাসে। আজ সেই মহান শিল্পীর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী।

৭০ বছরের জীবনে তিনি তুলির আঁচড়ে দেশ, মাটি আর ঘামেভেজা মেহনতী মানুষের সঙ্গে নিজেকে একাকার করে সৃষ্টি করেছেন পাটকাটা, ধানকাটা, ধানমাড়াই, জমি কর্ষণে যাত্রা এবং চরদখলের মতো বিখ্যাত সব শিল্পকর্ম।

এ দেশের কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের মেরুদণ্ড কৃষক ও তাঁদের সংগ্রামী জীবনই ছিল তাঁর শিল্পকর্মের মূল বিষয়। সুলতানের কৃষকদের নিয়ে আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘সুলতানের কৃষকরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সাথে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফুল-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন, আজ এবং আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে।’

১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন মহকুমা শহর নড়াইলের চিত্রা নদীর পাশে সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা, মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শিল্পী এস এম সুলতান। তাঁর বাবা মো. মেছের আলী ও মা মোছা. মাজু বিবি।

দারিদ্র্যের শত বাধা থাকা সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে তাঁর বাবা তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই থেমে যায় পড়াশোনা। এরপর বাবার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেন। চলতে থাকে বিভিন্ন দালানে ছবি আঁকার কাজ। এখানেই সুলতানের শুরু।

তাঁর ইচ্ছে ছিল কলকাতা গিয়ে ছবি আঁকা শিখবেন। এ সময় তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ১৯৩৮ সালে সুলতান কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৪১ সালে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু তিন বছর আর্ট স্কুলে পড়ার পর একাডেমিক বাঁধাধরা নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে পড়েন নিজের মতো করে স্বাধীন শিল্পচর্চায়।

বেরিয়ে পড়েন উপমহাদেশের পথে পথে। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ছোট-বড় শহরগুলোতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি এঁকে ও তাদের কাছে ছবি বিক্রি করে জীবন ধারণ করেছেন।

১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভেদর দালি, পলক্লি, কনেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশীয় শিল্পী, যাঁর ছবি এসব শিল্পীর ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।

শিল্পী এস এম সুলতানকে ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্স আর্টিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি, ১৯৮৬ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। আজ এই কালোত্তীর্ণ মহান শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই অতল শ্রদ্ধা।