সাক্ষাৎকার

‘সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায় না’

Looks like you've blocked notifications!
শামসুজ্জামান খান। ছবি : সংগৃহীত

শামসুজ্জামান খান। খ্যাতিমান লেখক, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ হিসেবে দেশ-বিদেশে তাঁর পরিচিতি। বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চাকে তিনি একটা উন্নত জায়গায় নিয়ে গেছেন। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত। এর আগে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রামবাংলার রঙ্গগল্প, বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, আধুনিক ফোকলোর চিন্তা, দৈত্য নাপিতের গল্প, সেনেগাল লিওপোল্ড সেঙ্ঘেরের আফ্রিকার কবিতা ইত্যাদি। এই সাক্ষাৎকারে তিনি ফোকলোর, বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি, জঙ্গিবাদ, শিক্ষা, হে উৎসবের নানা দিক, বাংলা একাডেমির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান

আপনার জন্ম কোথায়? শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে?

শামসুজ্জামান খান : আমার জন্ম বাংলা ১ আষাঢ় ১৩৪৪ সালে। ইংরেজি ১৯৩৭ সালের ১৫ জুন। আসলে আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে একেবারেই গ্রামে। আমার গ্রামের বাড়ি তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার সিংগাইর থানার অন্তর্গত চারিগ্রামে। গ্রামটি এখন মানিকগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। আমাদের এক আত্মীয়, পরবর্তীকালে তিনি আমার দাদাশ্বশুর, একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমি প্রথমে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করি, তার পর এই হাইস্কুলে ’৪৯ সালে ভর্তি হই। এই স্কুল থেকে ’৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করি।

আপনার বাবা কী করতেন?

শামসুজ্জামান খান : আমার আব্বার নাম মাহমুদুর রহমান খান। আমার যখন মাত্র দুই বছর বয়স, তখন আমার আব্বা মারা যান। আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল ’৩৩ সালে, আর আমার বাবা ’৩৯ সালে মারা যান। আমাদের পারিবারিক একটা ঐতিহ্য ছিল অনুবাদ করা। আদালত খান নামে আমার এক প্রপিতামহ ছিলেন, তিনি আমার প্রপিতামহের ভাই। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক ছিলেন তিনি। বেশ কটি ভাষা জানতেন, বাংলা-ইংরেজি-আরবি-পার্সি-উর্দু ইত্যাদি। তাঁর প্রায় দুই হাজার ৫২৭টির মতো বই ছিল। আমার প্রপিতামহের নাম ছিল আল-হেদাত খান। তিনি ফরিদপুরের স্কুল ইন্সপেক্টর ছিলেন। ১৮৬১ সালের দিকে তিনি ‘ফরিদপুর দর্পণ’ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। আমার আব্বা কলকাতা গভর্নমেন্ট হাউসের একজন অনুবাদক ছিলেন। কলকাতায় থাকতেন তিনি। আমার বাবা সম্পর্কে তো আসলে কোনো স্মৃতি নেই। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবা মারা গেছেন। আমার মায়ের কাছ থেকে যা শুনেছি, আমার বাবা দেখতে-শুনতে খুব সুন্দর ছিলেন। পোশাক-পরিচ্ছদেও আধুনিক ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক ছিলেন।

আপনার বাবা মারা যাওয়ার পর তো সংসারের হাল আপনার মাকেই ধরতে হয়েছিল?

শামসুজ্জামান খান : হ্যাঁ। তবে একটা সৌভাগ্য যে, আমার নানাবাড়িতে বিপুল সম্পত্তি ছিল। সেগুলো থাকার ফলে মাকে কষ্ট করতে হয়নি। আমার নানার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। মা ছিলেন একমাত্র সন্তান। অতএব, আমার বাবা নেই—এ কথা আমাকে কখনো বুঝতে দেওয়া হয়নি। আমার মা খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না। মোটামুটিভাবে তিনি বাংলা লিখতে পারতেন, পড়তে পারতেন। গোটা গোটা সুন্দর হাতের লেখা ছিল। চমৎকারভাবে কোরআন শরিফ পড়তে পারতেন। আমার মায়ের দুটো জিনিস মনে পড়ে। তিনি সকাল বেলায় যখন কোরআন শরিফ পাঠ করতেন, আমি তখন আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে শুনতাম। কী মিষ্টি যে লাগত তাঁর কণ্ঠে কোরআন শরিফ! মহররম মাসের পনেরো দিন ধরে আমার খালা, মামিরা মিলে বাড়িতে গোল হয়ে বসতেন, আর আমার মা মীর মশারফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু পড়তেন। আমিও মাঝেমধ্যে শুনতাম। ভালো লাগত খুব। আমার মাকে দেখেছি বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালিও পড়েছেন। আমার নানা আবদুল মোতালেব আমার মাকে খুব আদর করতেন। নানাও খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন বলে মনে হয় না। তবে তিনি যথেষ্ট বিচক্ষণ লোক ছিলেন বলে পরে আমি জানতে পেরেছি। আমার জন্মের আগে তিনি মারা যান। তিনি চাকরি করতেন কলকাতার বেঙ্গল কেমিক্যালে। প্রতিষ্ঠানটি ছিল বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, বাঙালি জাতীয়তাবাদী অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। তিনি আমার নানাকে খুব আদর করতেন। সর্বশেষে তাঁর বেতন হয়েছিল সাতাশ টাকা। ওখান থেকে বাড়িতে দশ টাকা পাঠাতেন নানির কাছে। দশ টাকা থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে তিনি সংসার চালাতেন, বাকি পাঁচ টাকা দিয়ে জমি কিনতেন। তখন এক পাখি জমি পাঁচ-সাত টাকায় কেনা যেত। এভাবে নানি জমি কিনে কিনে প্রচুর জমিজমা কেনেন। ফলে আমাদের কোনো আর্থিক অসুবিধা ছিল না। নগদ পয়সা ছিল না, পাট বিক্রির টাকাটাই ছিল একমাত্র নগদ পয়সা। আর বছরের পুরো সময়টা ধান চাষ হতো। তাতে সংসার চলত।

আপনারা কয় ভাইবোন?

শামসুজ্জামান খান : আমি একা। ভাইও নেই, বোনও নেই। যাই হোক, আমাদের পরিবারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য সব সময় ছিল। কোনো অসুবিধা হয়নি কখনো। ১৩৫০ সালের আকালের কথা মনে পড়ে। মনে আছে, আমি খাটের ওপর বসে খাবার প্লেটে দুধ-ভাত খাচ্ছি। কখনো কখনো ঘি দিয়ে ভাত মেখে দেওয়া হতো।

স্কুলজীবনে ছাত্র হিসেবে কেমন ছিলেন?

শামসুজ্জামান খান : ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। প্রাইমারি স্কুলে প্রথম হতাম সব সময়। অঙ্কে কাঁচা ছিলাম। আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন। সেকালে বিদ্যাচর্চা ভালো ছিল। এ এইচ আনিসুর রহমান সাহেব বাংলা পড়াতেন। তিনি বাংলা তো জানতেনই, ইংরেজিও জানতেন। অঙ্কও খুব ভালো জানতেন। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন তাঁর খুব প্রিয় কবি। ১৯৪৭-৪৮ সালে বাংলাদেশের একটি গ্রামের একজন প্রাইমারি শিক্ষক জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাঠ করছেন—এটি আসলেই বিস্ময়কর ব্যাপার। পরবর্তীকালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন তিনি বলতেন, আমার জন্য জীবনানন্দ দাশের বই পাঠাও। আমি পাঠিয়ে দিতাম। তাঁর কাছ থেকে হয়তো আমার ওপর সাহিত্যের প্রভাব পড়তে পারে।

আমাদের এলাকাটি ছিল নিম্নাঞ্চল। আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি। মাঝেমধ্যে নৌকা করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। আমার তখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, নৌকায় বসে বই পড়া। তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’, ‘ধাত্রিদেবতা’ পড়েছি। ওই সময় আমার প্রিয় লেখক ছিল অমিয়ভূষণ মজুমদার। তাঁর ‘গড়শ্রীখণ্ড’ উপন্যাসটি আমার খুব প্রিয় ছিল। এ ছাড়া বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ও খুব প্রিয় ছিল। এই বইগুলো এত আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি এবং এত যে ভালো লেগেছে তখন, বলে বোঝাতে পারব না। তবে তখনকার পড়ায় একটা ফাঁক থেকে গেছে। আসলে আমি মনে করি যে, ধারাবাহিকভাবে ক্ল্যাসিক সাহিত্য পড়া দরকার। আমি যদি আরেকটু আগে মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ পড়ে আধুনিক সাহিত্য পড়তাম, তাহলে অনেক ভালো হতো। আগে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ায় পরে বঙ্কিম, মাইকেল পড়তে অসুবিধা হয়। কম বয়সে পড়ার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। সে জন্য তরুণ যারা সাহিত্য চর্চা করবে তাদেরকে আমি বলব, মাইকেল এবং বঙ্কিম ভালো করে পড়ে তার পর রবীন্দ্রনাথ পড়ো। তার পর আধুনিক সাহিত্য পড়ো।

যাই হোক, আমার আরেকজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে, আমাদের হেডমাস্টার বশির উদ্দিন আহমেদ। তিনি অঙ্কে খুব ভালো ছিলেন। কিন্তু ছাত্রদের খুব বেত মারতেন। আমি অঙ্কে ভালো ছিলাম না বলে তাঁকে খুব ভয় করতাম। ক্লাসে ফার্স্ট হতাম বলে ক্লাসের ক্যাপ্টেনও ছিলাম আমি। একদিন স্যার বললেন, যা একটা বেত নিয়ে আয়। আমাদের ক্লাসের পেছনে একটা ঝোঁপ ছিল। আমি সেখানে বেত আনতে গেলাম, কিন্তু আর ফিরে আসিনি। কেননা, বেত আনলে অন্যদের সঙ্গে আমার পিঠেও বেত পড়ত। এটা একটা মজার ঘটনা।

লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি খেলাধুলাও করতাম। স্কুলে ব্যাডমিন্টন, রিঙ, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতাম। হাইস্কুলেও বিভিন্ন খেলা খেলেছি। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা ছিল আমার খুব শখের বিষয়। পলো দিয়েও মাছ ধরতাম। হাজার হাজার লোকের মধ্যে বিলে মাছ ধরতে যেতাম। এটা খুবই মজার ব্যাপার ছিল।

আমার এক শিক্ষক রাজেশ্বর চৌধুরী ইংরেজিটা খুব ভালো জানতেন। তিনি আমাকে হাইস্কুলের লাইব্রেরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘দেখি, নতুন কী বই আনলি।’ আমরা বইগুলো তাকে দিতাম। তখন লম্বা গ্রীষ্মের ছুটি হতো। একবার একটা ইংরেজি-বাংলা অভিধান এনেছিলাম। তিনি সেটা দেখে বললেন, ‘না, নতুন কোনো শব্দ পেলাম না!’ এতটাই পণ্ডিত ছিলেন তিনি।

একবার আমি একটা পরীক্ষায় ইংরেজিতে ৪১ নম্বর পেয়েছিলাম। তিনি আমাকে বেত মারলেন। বললেন, ‘তুই আমার হাতে ৪১ পেলে তো বোর্ডে ৭০ পাবি। সুতরাং নিশ্চয়ই নকল করেছিস!’

স্কুলে ফজলুল করিম নামের আরেকজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে হেডমাস্টার হয়েছিলেন, তিনিও বাংলা সাহিত্যের লোক। সাহিত্যের প্রতি উৎসাহী ছিলেন খুব। কিন্তু তার চেয়ে বড় উৎসাহটা আমি পেয়েছিলাম আমার হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক খলিলুর রহমানের কাছ থেকে। বামপন্থী ছিলেন তিনি, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁর স্ত্রী রোকাইয়া সুলতানা, যিনি পরবর্তীকালে ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের পালিতা কন্যা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা দুজন আমাকে সাহিত্যের প্রতি দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। স্কুল থেকে তখন হাতেলেখা একটি পত্রিকা বেরিয়েছিল ‘পূর্বাভাস’ নামে। বেশ পরিশীলিত, সুন্দর পত্রিকা। আমাকে দিয়েই সম্পাদনা করিয়েছিলেন। খলিল স্যার ও তাঁর স্ত্রী প্রায় গোটা পত্রিকাটা করে দিয়েছেন, আমার নামটাও দিয়ে দিলেন। তখন আমার ইচ্ছে হলো, তাহলে আমি বাংলা সাহিত্য চর্চা করব, অধ্যাপনা করব বাংলায় এবং সেটা হয়তো জগন্নাথ কলেজ।

স্কুলের বন্ধু-বান্ধবদের কথা মনে পড়ে?

শামসুজ্জামান খান : আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল শাহাবুদ্দিন। দুর্ভাগ্যবশত সে খুব কম বয়সেই মারা যায়। আরেকজন ছিল অথির, সেও মারা গেছে। অন্য বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে আবদুর রহমান, যার সঙ্গে পরবর্তীকালে হাইস্কুলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। সেও কিছুদিন আগে মারা গেছে।

ম্যাট্রিক পাস করে কোথায় ভর্তি হলেন?

শামসুজ্জামান খান : এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হলাম জগন্নাথ কলেজে। তখন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষকরা ছিলেন খুবই অসাধারণ। ইংরেজিতে ছিলেন শৈলেন ভদ্র, আরো ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মতিন, বাংলায় ছিলেন অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ। বাংলার অসাধারণ শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন অধ্যাপক তিনি। আরো ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল কাদের প্রমুখ। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে এ কলেজে পড়ালেখা করলাম। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হই ’৫৯ সালে। যখন ভর্তি হতে গেলাম, তখন আবদুল হাই সাহেব বাংলার অধ্যক্ষ। তিনি বললেন, ‘তুমি তো ইংরেজিতে বেশি নম্বর পেয়েছ, ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হও না কেন?’ আমি বললাম, ‘না স্যার, আমি আগে থেকেই ঠিক করেছি বাংলায় পড়ব, আমি বাংলাতেই ভর্তি হব।’

বিশ্ববিদ্যালয়েও আমার শিক্ষকভাগ্য খুব ভালো ছিল। প্রাইমারি, হাইস্কুল এবং কলেজে যেমন ভালো শিক্ষক পেয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভালো ভালো সব শিক্ষক পেলাম। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, রফিকুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান এঁরাই ছিলেন আমার শিক্ষক। বাড়ি থেকে আমাকে আড়াইশ-তিনশ টাকা দেওয়া হতো। অন্য ছাত্ররা যেখানে আশি-নব্বই টাকা খরচ করছে, আমি সেখানে এত টাকা খরচ করছি। আমি সেই টাকা থেকে বই কিনতাম বেশি। অতএব, একটা অসাধারণ সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমার শিক্ষাজীবন শেষ হয়।

মানিকগঞ্জ লোকসংস্কৃতির জন্য উর্বর জায়গা। ছেলেবেলায় এসব বিষয় আপনাকে কতটা টানত?

শামসুজ্জামান খান : হ্যাঁ, খুব টানত। আমাদের এলাকার ভাওয়াল যাত্রা, আমিনা যাত্রা, আলাল-দুলাল, গুনাইযাত্রা, রামযাত্রা, কৃষ্ণলীলা এগুলো ছেলেবেলাতেই দেখেছি। এসবের একটা প্রভাব আমার ওপর পড়েছিল। কিন্তু তখন সেটা উপলব্ধি করিনি। উপলব্ধি করেছি আমাকে সাহিত্য করতে হবে এলিটিস্ট সাহিত্য।

এলিটিস সাহিত্য করার পেছনে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণ?

শামসুজ্জামান খান : ওই যে বললাম খলিলুর রহমান স্যার, রোকাইয়া ম্যাডামদের প্রভাব। জালালুদ্দিন নামের একজন সিনিয়র ছাত্র ছিল, তিনিও লিখতেন, তাঁর প্রভাব। কলেজে অজিতবাবু, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ এঁদের মতো শিক্ষক পেয়েছি। এঁরা বিখ্যাত সাহিত্যিক। ‘সমকাল’ বের করছেন হাসান হাফিজুর রহমান, সিকান্দর আবু জাফরের সঙ্গে। এঁরা আমাকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করলেন। হাসান স্যার ‘সমকালে’র এডিটরিয়াল নিয়ে আসতেন, পড়ে শোনাতেন আমাদের। তাঁর বাড়িতে আমরা প্রায়ই যেতাম। এসব প্রভাব কাজ করেছে।

তখনো কি আপনি লিখতেন?

শামসুজ্জামান খান : হ্যাঁ, লিখতাম। আমাদের পাশের গ্রাম পারিল বলধারায় ভাষাসৈনিক রফিকের বাড়ি। সে যখন মারা গেল, তখন আমরা মিছিল-মিটিং করেছি স্কুলে। ‘নুরুল আমিনের কল্লা চাই/রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে সারা থানা ঘুরে বেড়িয়েছি। এর প্রভাব নিয়ে স্কুলজীবনে লিখলাম ‘লাল শার্ট’ নামের একটা গল্প। ছাপা হলো ‘মুকুলের মহফিলে’, ১৯৫৭ সালে। তখন আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমি তখন মুকুলের মহফিলে লিখি, ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর, মিল্লাতের কিশোর দুনিয়া, আলাপনী পত্রিকা—এসব পত্রিকায় লিখি। আগে শিশুদের আসরগুলোতে শিশুতোষ গল্প-কবিতা লিখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরে ঝোঁকটা এসে গেল প্রবন্ধের দিকে। এর কারণ হয়তো আনিসুজ্জামান, মুনীর চৌধুরী, অজিত বাবুদের প্রভাব। সবাই গদ্যের লোক। তাঁরা সাহিত্যের যেভাবে বিশ্লেষণ করেন, সেটা আমাকে হয়তো বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে গদ্যের প্রতি।

ছাত্রজীবনে কি প্রেমে পড়েছিলেন? ওই বয়সে তো সাধারণত সবাই প্রেমে পড়ে। কোনো নারী আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল?

শামসুজ্জামান খান : তা তো পড়েছি (হাসতে হাসতে)। আসলে সেকালে সমাজ তো এ রকম ছিল না। অনেকটা বদ্ধ সমাজ ছিল। সমাজ তার গণ্ডির বাইরে যাওয়ার সুযোগ দিত না মেয়েদের। এখন যেমন স্কুল-কলেজের ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের দেখা হয়, দেখা হওয়ার ফলে যেমন একটা মেলামেশা হয়, সহজ একটা সম্পর্ক হয়, তখন এমন ছিল না। মেয়েরা একটু বড় হয়ে যেত, কিন্তু স্কুল-কলেজে যাওয়ার সুযোগ পেত না। মুরুব্বিরা যেতে দিতেন না। বলতেন, পর্দার লঙ্ঘন হবে। কখনো কখনো বলা হতো, মেয়েদের বাইরে যেতে নেই। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আর কী। এখন অবশ্য সেটা নেই। এখন আমাদের গ্রামের হাইস্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। আমাদের চেয়ে বয়সে বড় এ রকম অনেক মেয়ের সঙ্গে আমাদের প্রেমের ব্যাপারটা ঘটেছিল। তারাই অগ্রণী হয়ে ছেলেদের সঙ্গ কামনা করত।

দাম্পত্য জীবন শুরু হলো কবে?

শামসুজ্জামান খান : ১৯৬৬ সালে। আমার তিন মেয়ে। সবাই হলিক্রস স্কুলে পড়েছে। বড় মেয়েটি খুবই মেধাবী ছিল। ঢাকা বোর্ডে ম্যাট্রিক-ইন্টারমিডিয়েট দুটোতেই সেকেন্ড হয়েছিল। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। ওখানেই চাকরি করতে শুরু করে। দ্বিতীয় মেয়েটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইকোনমিকসে স্নাতক হয়ে দেশে ফিরে আসে। সে এখানে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে চাকরি করত। এখন আর চাকরি করে না। ওর স্বামী একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করে। ছোট মেয়েটি বর্তমানে স্বামীসহ লন্ডনে আছে। ওর স্বামী ব্যাংকে চাকরি করে।

কর্মজীবন শুরু হলো কবে থেকে, কোথায়?

শামসুজ্জামান খান : এমএ পাস করার আগেই মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে চাকরি হয়ে গেল আমার। তখন চাকরি পাওয়াটা অত কঠিন ছিল না। কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন আজিমুদ্দিন সাহেব, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বাবা। ’৬৪ সালে আমি ওই কলেজে মাত্র চার মাস চাকরি করি। একদিন দুপুরবেলা টিচার্স কোয়ার্টারে খেতে বসেছি, পিয়ন এসে বলল, ঢাকা থেকে আমার ফোন এসেছে, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি দৌড়ে এলাম। স্যার বললেন, ‘জামান শোন, তুমি কি আজ রাতেই জগন্নাথ কলেজে শিক্ষক হিসেবে জয়েন্ট করতে পারবে?’ আমি তো অবাক! বললাম, ‘স্যার, আপনি বললে কেন পারব না?’

অজিত স্যারের কথাটা আমি আমাদের প্রিন্সিপাল সাহেবকে জানালাম। তিনি নিয়মমাফিক কথা বললেন যে, ঠিক আছে আপনি যাবেন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু নিয়ম আছে আপনাকে এক মাসের নোটিশ দিতে হবে। এক মাসের নোটিশ দিয়ে তার পর যান। প্রিন্সিপালের কথাটি আমি অজিত স্যারকে জানালাম। স্যার সম্মত হলেন। সুতরাং একটি মাস দুই কলেজে শিক্ষকতা করতে হলো। দিনে হরগঙ্গা কলেজে ক্লাস করাই, রাতে জগন্নাথ কলেজে। মুন্সীগঞ্জ থেকে তখন লঞ্চে দেড় ঘণ্টা লাগত ঢাকায় আসতে। মুন্সীগঞ্জে কাজ করি সারা দিন, বিকেল সাড়ে ৪টায় লঞ্চে করে ঢাকায় আসি। সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত ক্লাস করাই। রাতে ঢাকা শহরে ঘুমিয়ে সকালে আবার মুন্সীগঞ্জে চলে যাই। এভাবে এক মাস চলল। তখন হরগঙ্গা কলেজে আমার বেতন ছিল ২৯৬ টাকা, জগন্নাথে ৫৯০ কি ৫৯৪ টাকা।

জগন্নাথ কলেজে তো তখন শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বিখ্যাত লেখকরা শিক্ষক ছিলেন? তাঁদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

শামসুজ্জামান খান : হ্যাঁ, জগন্নাথে এসে আরেক অভিজ্ঞতা। আমার যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা এখন আমার কলিগ হলেন। অজিত স্যার তো আছেনই। তিনি নানা বিষয়ে আলাপ করেন আমাদের সঙ্গে। আমি অভিভূত হয়ে শুনি। তখন আলাউদ্দিন আল আজাদ নেই, কাদের সাহেবও নেই। হাসান হাফিজুর রহমান আছেন। আমার যোগ দেওয়ার আগে শওকত আলী সাহেব যোগ দিলেন। এ ছাড়া আছেন মীর্জা হারুনুর রশীদ সাহেব। আমি যোগ দেওয়ার পরে হায়াৎ মামুদ, মাহবুব তালুকদার, সৈয়দ আবদুল হাদী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তো বয়সে আপনার জুনিয়র ছিলেন?

শামসুজ্জামান খান : হ্যাঁ, জুনিয়র। তখন তো সে অত বিখ্যাত হয়নি। আমরা তখন কলেজের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে থাকতাম একসঙ্গে। সে পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়ত মনোযোগ দিয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বই পড়ত এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, (হাসতে হাসতে) বাজারে কিছু পর্নোগ্রাফির বই পাওয়া যেত, এগুলো ইলিয়াসের খুব আগ্রহের বিষয় ছিল। পরে ইলিয়াস পুরান ঢাকায় থাকতে শুরু করল, আমি নতুন ঢাকায় থাকি। পুরান ঢাকায় থেকে তার লাভ হয়েছে বটে। সেখানকার জীবনযাত্রা, মানুষের ভাষা, কথা বলার ভঙ্গি এগুলো ইলিয়াসকে অনেক আকৃষ্ট করেছিল।

আপনি তো ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন?

শামসুজ্জামান খান : আমি যখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র, তখন প্রথম ছাত্রলীগে যোগ দিই। আমাদের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বাবা আবদুল ওয়াদুদ ‘ইত্তেফাক’-এর ম্যানেজার ছিলেন। তিনি আমাকে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। এর আগে আমি রাজনীতি না করলেও রাজনীতিসচেতন ছিলাম। ভাষা আন্দোলনের মিছিল-মিটিং করেছি। রাজনীতি বিষয়ে স্কুলের নানা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। তখন আমরা শেরেবাংলার ভক্ত। জগন্নাথ কলেজে আসার পর রাজনীতিতে ঢুকে গেলাম। মনে আছে, তখন একটা ভুখা মিছিল হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। মিছিলটা মুহসীন হল থেকে বেরিয়ে চকবাজার পর্যন্ত গেল। সেখানে গুলি বর্ষিত হলো। জগন্নাথ কলেজের ইকবাল নামের এক ছাত্র আহত হলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমি তাকে দেখতে গেলাম। ততদিনে আমি ঘোরতরভাবে রাজনীতিতে সক্রিয়।

তখন বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল?

শামসুজ্জামান খান : পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু যখন মন্ত্রী হলেন, তখন আমি দেখেছিলাম তাঁকে। সেই দৃশ্য এখনো চোখে লেগে আছে। সুন্দর মানুষ। ছয় ফুট লম্বা। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা গায়ে। সদরঘাটের মল্লিক লাইব্রেরির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলেন। ড্রাইভার বলল, ‘স্যার, গাড়ি কি সামনে নিয়ে যাব?’ তিনি বললেন, ‘না, আমার গাড়ি লাগবে না, কোনো সিকিউরিটিও লাগবে না, আমি হেঁটেই যাব।’ সিমসন রোডে একটা হলুদ বাড়িতে আওয়ামী লীগের অফিস ছিল তখন। সদরঘাটে যেতে ডানদিকে পড়ত। তিনি সেখানে গেলেন হেঁটে হেঁটে। তখন তাকে আমি প্রথম দেখি।

তার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই, তখন তো মার্শাল ল, রাজনীতি করা প্রায় নিষিদ্ধ। ঢাকা হলে থাকতাম আমি। ঢাকা হল ছিল তখন একমাত্র কসমোপলিটন হল। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যে কেউ থাকতে পারত। অন্যগুলো ছিল মুসলিম বা হিন্দু ছাত্রদের জন্য। আমি যেহেতু সেক্যুলার হওয়ার চেষ্টা করেছি, সে জন্যই আমি ওখানে থেকেছি।

সেক্যুলার হওয়ার চিন্তাটা মাথায় এলো কীভাবে?

শামসুজ্জামান খান : স্কুলজীবন থেকেই এটার প্রভাব পড়েছিল আমার ওপর। খলিলুর রহমান স্যার যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, তাঁর একটা প্রভাব ছিল। সমাজবিজ্ঞান পড়ার চেষ্টা করেছি তখন। ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি এসব বই পড়েছি। সে কারণেই ঝোঁকটা ওদিকে চলে গেল। যদিও আমার মা ও নানি খুবই ধার্মিক ছিলেন, রোজা-নামাজ ইত্যাদি ধর্মীয় সব অনুষ্ঠান নিয়মিত করতেন। কিন্তু তাঁরা আমার ওপর কোনো ধর্মীয় কট্টর বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেননি। আমার নানা প্রফুল্ল চন্দ্রের স্নেহভাজন ছিলেন বলে তাঁর প্রভাব নানার ওপর পড়েছিল। তিনি অনেক মানবিক ছিলেন, দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসাম্প্রদায়িক। তাঁর প্রভাব আমার মা-নানির ওপরও পড়েছিল বলে আমি অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠতে পেরেছি।

’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় আপনি কোথায়?

শামসুজ্জামান খান : আমি তখন ময়মনসিংহ এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটিতে।

আপনি তো জগন্নাথ কলেজে ছিলেন, ময়মনসিংহ কেন গেলেন?

শামসুজ্জামান খান : আমি যখন জগন্নাথ কলেজে ছিলাম তখন মোনায়েম খান গভর্নর। একদিকে তার নির্বাচন চলছে, অন্যদিকে স্বৈরাচারবিরোধী, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তখন খুবই অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলেন মোনায়েম খান। জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে ওখান থেকে সরানোর চেষ্টা করলেন তিনি। কারণ জগন্নাথ কলেজ ছিল আন্দোলনের আখড়া, ছয় দফার আখড়া ইত্যাদি। যখন দেখলাম, অজিত গুহকে নিয়ে এ রকম একটা ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চলছে তখন ভাবলাম, আমাদের এখানে থেকে আর লাভ নেই। এমনিতেই আমরা সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তা ছাড়া কলেজটি তখন বেসরকারি। সরকার এই কলেজকে সরকারি করবে বলে শুনছি। আমি আবার বদলির চাকরি করতে চাই না। তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম, পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার নিয়োগ দেওয়া হবে। ওখানে তখন লেকচারার ছিলেন গোলাম মুরশিদ। ১৯৬৮ সালে আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম লেকচারার হিসেবে। গোলাম মুরশিদ চলে গেলেন রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। ততদিনে গণআন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ওখানে মোটামুটি সুবিধাজনক একটা অবস্থানে থাকলাম আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অনেক স্বাধীনতা রয়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারে তারা। তাই সেখানে আমরা সভা-সমিতি করলাম। প্রেসক্লাবে আমাদের নিয়মিত মিটিং হয়। আমরা ‘বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির’ গঠন করলাম। এই কমিটিতে ময়মনসিংহের বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক গোলাম সামদানি কোরাইশি, অধ্যাপক যতীন সরকার, আমি, রিয়াজুল ইসলামসহ একঝাঁক তরুণ রয়েছি। যতটা সম্ভব আন্দোলন করছি আমরা। ধারাবাহিকভাবে আমাদের আন্দোলন চলতে থাকল। ২৫ মার্চের বিকেল বেলা আমরা ইউনিভার্সিটিসংলগ্ন ছত্রপুর এলাকায় একটা মিটিং করলাম। মিটিংয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলাম সবাই।

২৬ মার্চ সকাল বেলার কথা। ছুটির দিন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সবাইকে ডেকে পাঠালেন টিচার্স ক্লাবে। তিনি জানালেন, ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হয়েছে, বিপুলসংখ্যক লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছে।

এর পর নানা দিক থেকে খবর আসতে থাকল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা একটা ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করলাম ইউনিভার্সিটিতে। আমি তার সদস্য। সৈয়দ আবদুল কাদের, আবদুল লতিফ মিয়া, ড. আবদুল অদুদ মিয়া, মোস্তফা আহমেদ হোসেন, জিন্নাতুন আরা বেগম—এঁরাও আছেন কমিটিতে। কমিটির ব্যানারে মিটিং-মিছিল ইত্যাদি চালাতে থাকি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সেই বার্তাটিও ইপিআরের মাধ্যমে ময়মনসিংহে পৌঁছে গেছে। পুলিশ লাইনেও পৌঁছেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রফিক ভূঞা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে এলেন এবং সেটি পাঠ করে শোনালেন আমাদের। ২৫ তারিখ রাত ১২টার সময় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

আমরা শপথ নিলাম, আজ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মালয়েশিয়ার কিছু ছাত্র ছিল। পাকিস্তানি ছাত্রও ছিল। বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে একটা প্রেস রিলিজ তৈরি করে মালয়েশিয়ার ছাত্রদের মাধ্যমে আমরা মালয়েশিয়া সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ওরা পৌঁছে দিয়েছিল সেটা।

কদিন পর সফিউল্লাহ সাহেব ময়মনসিংহ পৌঁছে গেলেন। তখন তিনি লেফটেন্যান্ট অথবা মেজর ছিলেন। পরবর্তীকালে জেনারেল হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক আলোচনা হলো। তাঁরা দুজন জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছিলেন। ওখান থেকে ভালুকা হয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছেন। ঢাকা থেকে অসংখ্য মানুষ আসছে ময়মনসিংহে। দুই-তিনদিন লাগছে পৌঁছতে। মানুষের মধ্যে যে কী সহমর্মিতা ছিল তখন! রাস্তায় রাস্তায় লোক পানি নিয়ে, দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। কারণ, ঢাকা থেকে যারা আসছে তাদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চাও আছে। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হবে। এ রকম একটা সহানুভূতি ছিল। দেখুন, কতটা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল মানুষ সে-সময়! গোটা দেশ আগে কখনো এতটা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ফলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।