ব্যস্ত শহরের ‘সাকরাইন’ উৎসব

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : ফেকাস বাংলা

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় একটি উৎসব সাকরাইন, যা পৌষ সংক্রান্তি উৎসব বা ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত। সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ থেকে সেটি ঢাকা অংশে সাকরাইন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলা পৌষ মাসের শেষ দিন এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

তবে বর্তমানে বাংলা ক্যালেন্ডার আর পঞ্জিকার মধ্যকার তারতম্যের কারণে তা দুই দিনব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে। পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারের এই জনপ্রিয় উৎসব বর্তমান সময়ে রায়সাহেব বাজার, বংশাল, বাংলাবাজার, সদরঘাট, দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা, কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাইনানগর, লক্ষ্মীবাজার, সিংটোলা, সূত্রাপুর, ধূপখোলা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সদরঘাট, কোটকাচারী এলাকায় আয়োজন করা হয়। সারা দিনব্যাপী নীল আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ায় রঙ-বেরঙের নানান আকৃতির ঘুড়ি, আর সাথে থাকে পুরান ঢাকার নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সমারোহ।

ঘুড়ি ওড়ানোর কাজ যে নিদারুণ কলাকৌশল ও কারুকার্য সমৃদ্ধ, তা সবাইকে মুগ্ধ করে তোলে। ঘরে ঘরে মুড়ির মোয়া, বাকরখানি আর হরেক রকম মিঠাইয়ের আয়োজন করা হয়। আগে অবশ্য বাড়িতে-বাড়িতে পিঠা বানানো হত, এখন সেটা আনেকটাই কমে গেছে। ১৭৪০ সালের দিকে নবাব নাজিম নওয়াজেস মোহাম্মদ খাঁন-এর সময় থেকে ঢাকায় ‘ঘুড়ি ওড়ানো’ উৎসব হিসেবে প্রচলিত হয়। লোকমুখে শোনা যায়, এটি মূলত আগে জমিদাররা এবং নবাব পরিবারের লোকেরা আয়োজন করতেন। পরবর্তী সময়ে কালের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এ উৎসবে এসেছে ভিন্ন কিছু আয়োজন। এ উৎসবে অংশ নেন বিভিন্ন পেশার এবং বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষেরা।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তের শত শত মানুষের আনাগোনায় ভরে ওঠে সব এলাকা। যুবক থেকে যুবতী, জোয়ান, বৃদ্ধসহ সব এলাকাজুড়ে চলে উৎসবের ঘনঘটা। আকাশজুড়ে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই রঙ-বেরঙের ঘুড়ি। এদিন আকাশে রঙ ওড়ানো হয়। ঘুড়ি আর নাটাইয়ের বৈচিত্র্যতার সাথে চলে সুতায় মাঞ্জা দেওয়ার হিড়িক। ঘুড়ি কাটাকাটির এক তীব্র প্রতিযোগিতা চলে সেখানে। একটা ঘুড়ি কাটলেই (যেটাকে ভো’কাট্টা বলা হয়) সবাই সেই ঘুড়ির পেছনে দৌঁড়ে হামলে পড়ে সেটা পাওয়ার জন্য, আর এটার মধ্যে রয়েছে অনেক আনন্দ।

সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় বর্ণিল আতশবাজির উৎসব এবং আগুন নিয়ে খেলা করা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ফায়ারফক্সের লাল-নীল আলো। রঙ-বেরঙের ফানুসের বাহার ছড়িয়ে পড়ে পুরো আকাশজুড়ে। রাতে বিভিন্ন গান-বাজনার আয়োজনও করা হয়। সেখানে থাকে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, ডিজে গানসহ নানান কিছু। সবকিছু মিলিয়ে দারুণ মুহূর্ত কাটে সবার। যদি কেউ শতরঞ্জি আলোকসজ্জিত মুহূর্তে সাক্ষী হতে চায়, তাহলে সাকরাইন উৎববের কোনো বিকল্প নাই। এ উৎসব দেশজুড়ে উদযাপিত হয় না। তবে ঢাকা ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পৌষ সংক্রান্তির এই উৎসব পালনের রীতি চালু আছে।

নেপালে একে বলে মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান ও ভারতে মকর সংক্রান্তি। ‘সাকরাইন’ বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও এ উৎসবটি হারায়নি তার ঐতিহ্য। বাংলা সংস্কৃতির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এ উৎসব। শহরের মানুষের ব্যস্ততার মাঝেও এ দিনটি সবার কাছে এনে দেয় অপরিসীম আত্মতৃপ্তি।