চিত্তরঞ্জন সাহা ও একুশের বইমেলা

Looks like you've blocked notifications!

ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য এক প্রাণের মাস। কারণ, ১৯৫২ সালের এই মাসের ২১ তারিখে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে তার ভাষার অধিকার। বাংলা ভাষার জন্য বীরদের এই আত্মোৎসর্গকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং এ ঘটনাকে চিরদিন স্মরণীয় রাখতে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বইমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

দেশের সবচেয়ে বড়, ঐতিহ্যবাহী এবং পরিচিত এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা সব ধরনের বইপ্রেমী, লেখক, সাহিত্যিক ও প্রকাশকের একটি মিলনমেলা এবং আগ্রহের বিষয়, যার জন্য সবাই সারা বছর অপেক্ষা করতে থাকে। বহুদিন আগে শুরু হওয়া এই বইমেলার কলেবর এবং জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে প্রতিবছর। বইপ্রেমীদের জন্য এ মেলাকে প্রাণের মেলাই বলা চলে।

প্রতিবছরের মতো এবারও যথাসময়ে শুরু হয়েছে বইপ্রেমীদের প্রাণের এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা। অনেকে মুখিয়ে আছেন পছন্দের বই ক্রয় করার জন্য, প্রিয় লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। এই বৃহৎ মেলা কিন্তু একদিনেই গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সেই বইমেলা এখন আজকের এ অবস্থানে। এর পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস, যা অনেকেই জানেন আবার অনেকেই জানেন না, আবার অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে—কে, কীভাবে প্রথম শুরু করেছিলেন এই বইমেলার।

১৯৭২ সালে, অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পরপরই এ দেশে সর্বপ্রথম বইমেলার সূচনা হয়। সেদিক থেকে বাংলাদেশের বইমেলার এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ইতিহাস সমান পুরোনোই বলা চলে। তবে ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম সেই বইমেলা কিন্তু মোটেও একালের বইমেলার মতো এত জাঁকজমক এবং আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, চিত্তরঞ্জন সাহা এই বইমেলার সূচনা করেন। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ। তিনি বর্তমান বাংলা একাডেমি, তৎকালীন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এই বইমেলার গোড়াপত্তন করেন।

সে সময় চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনীর নাম ছিল স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ, যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই প্রকাশ করত। বইগুলো বের হতো কলকাতা থেকে। তিনি তাঁরই সেই প্রকাশনীর মাত্র ৩২টি বই দিয়েই বইমেলা সাজিয়ে বসেন। তাঁর ওই প্রকাশনীর বর্তমান নাম হয় মুক্তধারা প্রকাশনী। বইমেলায় প্রদর্শিত তাঁর ওই ৩২টি বইকে বলা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম নিদর্শন।

চিত্তরঞ্জন তাঁর স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদের বই দিয়ে একাই এবং নিজ উদ্যোগে বইমেলা চালিয়ে যান ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। এ চার বছরেই তাঁর বইমেলা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সফলও হয়। এর ফলে অন্যরা বইমেলায় অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত হোন এবং বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ বইমেলাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন।

এর পর ১৯৭৯ সালে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহারই প্রতিষ্ঠিত 'বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি'। এর ফলে সবার অংশগ্রহণে বইমেলা হয়ে ওঠে আরো উজ্জীবিত, যার ফলে ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে প্রথমবারের মতো ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ অনুষ্ঠিত করার আয়োজন সম্ভব হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে বছর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হওয়ায় সে বছর আর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়নি।

তবে তার পরবর্তী বছর ১৯৮৪ সালে পুরোদমে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সময়ের পরিক্রমায় চিত্তরঞ্জন সাহার সেই ৩২ বইয়ের মেলা পরিণত হয়েছে লাখ লাখ বইয়ের মেলায়।

সর্বপ্রথম বইমেলা করার সম্মাননাস্বরূপ ২০১০ সাল থেকে চিত্তরঞ্জন সাহার নামে 'চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার' নামক একটি পদক প্রবর্তন করা হয়, যা আগের বছরে প্রকাশিত বইয়ের গুণমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে পুরস্কার দেওয়া হয়। ভাষার মাসে সব ভাষাশহীদের জন্য এবং প্রথম বইমেলা করা এই মানুষটার জন্য রইল শ্রদ্ধা।