তরুণ প্রকাশকদের ভাবনায় যেমন যাবে বইমেলা

Looks like you've blocked notifications!
অমর একুশে গ্রন্থমেলা

বর্ণ. বর্ণ থেকে অক্ষর, অক্ষর জুড়ে জুড়ে শব্দ। আর সেই শব্দে সেজে ওঠে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ সাহিত্যের যতো লেখালেখি। সেইসব লেখা মলাটে আবদ্ধ হয়ে যেন প্রাণ পায়। লেখকের অনেকে মনে করেন, বই প্রকাশ হলে লেখক তার লেখায় আরও সচেতন হয়ে ওঠেন। আর কবি-সাহিত্যিকদের এই লেখাকে বইয়ে রূপ দেন প্রকাশক। বছরজুড়ে থাকে তাদের ব্যস্ততা। অমর একুশে গ্রন্থমেলা কেন্দ্রিক করেন পরিকল্পনা। তাই সাহিত্যকে এগিয়ে নিতে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন অনেকটাই জরুরি বলে মনে করেন পাঠক-ক্রেতা-সংশ্লিষ্টরা।

এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু বাকি আর দুদিন। তার আগে দম ফেলার ফুরসৎ নেই প্রকাশকদের। তারই মধ্যে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে। প্রশ্ন ছিল, ‘কেমন যাবে বইমেলা’ তাদের মধ্য থেকে আজ তুলে ধরা হলো তরুণ প্রকাশকদের ভাবনা।

‘বাবুই’য়ের প্রকাশক কাদের বাবু

বাংলা ভাষার পাঠক তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বইমেলার যে আয়োজন, সেটি সত্যি আমাদের মুগ্ধ করে, আনন্দিত করে। দীর্ঘ বিশ বছর বইমেলা নিয়ে কাজ করে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু পর্যালোচনা।

বইমেলায় মানুষ আসবে, বই দেখবে, পড়বে; ভালো লাগলে বই কিনে নিয়ে যাবে—এটাই তো মেলার আয়োজন।  এ ছাড়া বাঙালির বইমেলাকে প্রাণের মেলা বলা হয়। কারণ, সারাদেশ থেকে লেখক-পাঠক আসেন। সব মিলিয়ে মিলনমেলায় পরিণত বইমেলা প্রাঙ্গণ। তাই বই দেখার জন্য, বই কেনার জন্য সহজভাবে সবকিছু করা উচিত। পাঠক যেন বই দেখতে দেখতে ক্লান্ত হলে ছোট ছোট খাবারের দোকানে বসে অল্প খরচে কফি, চা-নাস্তা খেয়ে আবার নতুন উদ্যোমে বই দেখতে পারে, এমন কিছু। এ রকম একটা আয়োজন আমরা চাই। এখন যেভাবে দোকান দেওয়া হয়, সেভাবে নয়। সেইসঙ্গে বইমেলার সময় প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত করা দরকার। কারণ, দেশের ঢাকার বাইরে থেকে যারা মেলায় আসতে চান, তারা যেন দিনে এসে দিনে চলে যেতে পারেন।

আগামীতে সোহরাওয়ার্দীতে মেলা হবে কি না, তা নিয়ে এখনও দোলাচল চলছে। বাংলা একাডেমি এত বছর মেলার আয়োজন করছে, এটা নির্ধারণ করতে পারছে না কেন—সেটা একটি প্রশ্ন। শুনছি গণপূর্ত অধিদপ্তর এই মাঠ দিতে চাচ্ছেন না। বইমেলা সোহরাওয়ার্দীতে করতে একটা সুরাহা হওয়া জরুরি। সেই পদক্ষেপ আয়োজকদের নেওয়া দরকার।

বইমেলার কিছু অসামঞ্জস্য জিনিস দেখা যায়, এগুলোকে পরিহার করা জরুরি। বইমেলা মানে বইয়ের দোকান। বই বিক্রি হবে, বই নিয়ে আলোচনা হবে, বই নিয়ে কথা হবে, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে। বই নিয়ে অন্যান্য কাজ হবে, নানান রকম আয়োজন থাকবে বই নিয়ে। তবে বইমেলায় কিছু পাইরেটেড বইয়ের জ্বালাতন দেখা যায়, এগুলো পরিবেশ নষ্ট করে। আগে দেখতাম নিয়মিত টাস্ক ফোর্স এসব পাইরেটেড বই রোধে অভিযান পরিচালনা করত। ফলে যারা পাইরেটেড বই বিক্রি কমে যেত। এদিকে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করি।

ছেলেবেলা থেকেই ছোটদের জন্য লেখালেখি ও সাংবাদিকতা এবং দীর্ঘ সময় বই-বইমেলা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে আমাকে শিশুদের প্রকাশনায় আসা উচিত। ফলে একটা সময় সাংবাদিকতা থেকে প্রকাশনায় যুক্ত হই। শিশুকিশোরদের জন্য রঙিন ও মানসম্মত বই প্রকাশের স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশনায় আসা। ইতিমধ্যে মানসম্মত আড়াইশ বই প্রকাশ করেছে ‘বাবুই’।

বই মেলা নিয়ে আমার উৎসাহ উদ্দীপনা সব সময়ই ছিল, সামনের দিনগুলোতেও বইমেলা নিয়ে কাজ করব। সারাদেশের পাঠক বইমেলায় আসুন, গ্যাজেটের এই যুগে শিশুকিশোরদের হাতে মুঠোফোন না দিয়ে বই তুলে দিন। সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বই পাঠে অভ্যস্ত করান। কারণ, বইই পারে একজন মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ করে গড়ে তুলতে।

‘সাহিত্যদেশ’র প্রকাশক শফিক সাইফুল

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলছে বইমেলার প্রস্তুতি। ‘বইমেলা এবার কেমন হবে’—এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। যদিও আমি বইমেলা আয়োজকদের কেউ না। মেলায় অংশগ্রহণকারীদের একজনমাত্র। তবে, একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে বলতে পারি, গত পাঁচ বছর থেকে মেলা এবার ভালো হবে।

বইমেলার প্রাণ—পাঠক, ক্রেতা ও দর্শনার্থী৷ বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর উপস্থিতিতেই বইমেলার প্রাঙ্গণ আলোকিত হয়৷ জমে ওঠে বইয়ের কেনাকাটা ও বইকে ঘিরে লেখক প্রকাশকের আড্ডা৷ বইমেলা ফিরে পায় প্রাণের স্পন্দন৷ সুতরাং, বলতেই পারি—এবারের বইমেলা হবে আগামী পাঁচ বছরের মেলার চেয়ে অনেকটাই জমজমাট ও প্রাণবন্ত৷

অতীতের বইমেলার চেয়েও এবারের মেলাটাও হবে অন্যরকম৷ ২০২১ সালের বইমেলা ছিল পুরোপুরি লকডাউনের মেলা৷ পরের বছরও ছিল করোনার প্রভাবে জর্জরিত৷ গত বছর ছিল করোনা আক্রান্ত বাজারব্যবস্থার মধ্যে৷ প্রকাশনা জগতে নেমে আসে প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট পণ্যদ্রবের আকাশছোঁয়া মূল্য বৃদ্ধির অভাবনীয় প্রভাব৷ ফলশ্রুতিতে লেখক ও প্রকাশকদের বই প্রকাশ ও মেলার আয়োজন নিয়ে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছিল৷ এসব দুর্বিপাকের মধ্যে বইমেলার যে আয়োজন ও সফলতা ছিল, তা ছিল অনেকটাই নির্জিব ও প্রাণহীন৷

সুতরাং, অতীত ও ভবিষ্যতের বইমেলার সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা থেকে বলতেই পারি—এবারের অমর একুশে বইমেলা হবে অনেকটাই জাঁকজমকপূর্ণ ও ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক৷

‘চমনপ্রকাশ’র প্রকাশক এনাম রেজা

মানুষজাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্বতা, কিছু স্বকীয়তা আছে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদেরও নিজস্বতা রয়েছে। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আমাদের নিজস্বতার উজ্জ্বল বহিপ্রকাশ। প্রকাশক হিসেবে প্রত্যেক বইমেলায়ই কিছু নতুন ভাবনা থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তরুণ লেখক মানসম্মত কিছু পাণ্ডুলিপি নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে পাঠাকের হাতে তুলে দিতে চাই। আশা করি, পাঠক এবারের নতুন বইয়ে নতুন কিছু পাবেন।

‘দ্বৈতা প্রকাশ’র প্রকাশক সাইদ মাহমুদ

মানুষের শৈল্পিক চিন্তাবোধকে মলাটে আবদ্ধ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে বই। আর এই শৈল্পিক কাজটি করেন প্রকাশক। শিশুতোষ লেখার প্রকাশক হিসেবে কাজটি করতে পেরে খুব আনন্দ বোধ করি। প্রতি বছর বইমেলা আসে বইমেলা চলে যায়, আমাদের কাছে বইমেলা মানে হচ্ছে ঈদের মতো মিলন মেলার একটি স্থান। আমি সব সময় চিন্তা করি—বইকে সর্বোচ্চ শৈল্পিক ও নান্দনিক রূপ দিয়ে সর্বোচ্চ শিখের নিয়ে যাব।

এবারের বইমেলায় ‘দ্বৈতা প্রকাশ’ থেকে অনেকগুলো নতুন শিশুতোষ বই প্রকাশিত হচ্ছে। আশা করছি, অন্যান্য বছর থেকে এবারের বইমেলাটি ভিন্ন হবে। তবে, বইমেলার স্টল বিন্যাস যদি আরও নান্দনিকভাবে সাজানো যেত তাহলে অনেক সুন্দর-সুশৃঙ্খল হতো। আমি আশা করি, কর্তৃপক্ষে এ বিষয়ে আগামীতে দৃষ্টি দেবেন। সব মিলিয়ে এবারের বইমেলাটি আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে।

পাঠকদের উদ্দেশে বলতে চাই—আপনারা বইমেলায় আসবেন, ঘুরে দেখবেন এবং আপনার শিশুর হাতে নতুন সুন্দর বই তুলে দেবেন; যে বইয়ের মাধ্যমে আপনার শিশু সুন্দর এবং আগামীর ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে।

‘ছোটদের সময় প্রকাশনী’র প্রকাশক মামুন সারওয়ার

প্রথমে আমি একজন লেখক। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি করে আসছি। পাশাপাশি দুটি ছড়া ও শিশুসাহিত্যের লিটলম্যাগের সম্পাদক ও প্রকাশক। গত তিন বছর ধরে ‘ছোটদের সময় প্রকাশনী’ থেকে শিশুসাহিত্যের উপযোগী বই প্রকাশ করে আসছি। বর্তমানে এ প্রকাশনীর বইয়ের সংখ্যা অনেক। খ্যাতিমান, তরুণ ও নবীনদের বই আছে এর তালিকায়।

নবীন লেখকদের ভালো পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে আগ্রহী ‘ছোটদের সময় প্রকাশনী’। খ্যাতিমান লেখকদের নিয়ে আমাদের সম্পাদনা পরিষদ আছে। তাদের দিয়ে আমরা লেখা সম্পাদনা করিয়ে নিই। ছোটদের সময়ের প্রকাশনা উপদেষ্টা বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক  আমীরুল ইসলাম। তিনি সব সময়ই ভালো বই প্রকাশের পরামর্শ দেন। তার পরামর্শেই ছোটদের সময় প্রকাশনী এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক প্রকাশক ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী ও গোলাম রহমান। আমার বিশ্বাস, লেখক যখন প্রকাশক হন, তখন ভালো বই-ই প্রকাশ হওয়া সম্ভব। তিনি ভালো বই প্রকাশে আগ্রহী হন। তার হাত দিয়ে অলেখকের বই প্রকাশ সম্ভব না।

আমি একজন প্রকাশক হিসেবে মনে করি, পাঠকের জন্য ভালো বই প্রকাশ করতে হবে। অনেক বিখ্যাত লেখকের ভালো বই আছে, যা পাঠকের জন্য নতুন করে আবারও প্রকাশ করা উচিত। এ কাজটা একমাত্র প্রকাশকই করতে পারেন। তরুণ প্রজন্মের মাঝে ভালো বই প্রকাশের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে তারা ভালো বই পড়তে আগ্রহী হবেন।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা—২০২৪  আগের বইমেলা থেকে  অনেক ভাল হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের দেশে একুশে গ্রন্থমেলা ছাড়াও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বইমেলা করা যেতে পারে। তা ছাড়া ছোটদের জন্য আলাদা বইমেলা করা যেতে পারে।

‘রৌদ্রছায়া প্রকাশ’র প্রকাশক আহমেদ রউফ

বই হোক প্রতিটি মানুষের বন্ধু। বই যেন প্রাণের স্পন্দন, বই ছাড়া কেউ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না; পারে না জাতি গঠনে পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে। এই জন্যই যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি সুগঠিত ও উন্নত।

বইমেলা মানে একঝাক প্রকাশকের ভালো লাগা। বিশেষ করে প্রাণবন্ত তরুণ প্রকাশকদের চোখে বইমেলা মানে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলা। তারা সব সময় সুন্দরের পূজারী।

পরিপাটি ও স্বচ্ছ কাজ সবাই ভালোবাসে। তাই প্রকাশনায় তরুণরাই সব সময় এগিয়ে। তরুণ প্রকাশকরা সব সময় চান ভালো কিছু করার। নতুন কিছু ভালো বই পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রত্যয় খুব করে কাজ করে তাদের মনে। যদিও চাইলেও অনেক সময় পারছে না তারা। কথায় আছে, ‘সাধ আছে সাধ্য নেই’। তেমনই একটা অবস্থা। কাগজ, ছাপা, বাঁধাই—সব মিলিয়ে খরচ বেড়েছেই চলেছে। এতে বইয়ের মূল্য যাচ্ছে বেড়ে। তারপরও পাঠককে স্বস্তিতে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা কাজ করছে। আশা করছি, এর বাস্তবায়ন একটু হলেও করতে পারব।

এবারের বইমেলা নিয়েও আমি রঙিন স্বপ্ন দেখি। গত তিনটি বছর প্রতিটি মানুষের জীবনই ছিল বিষণ্নতায় ভরা। করোনা থেকে শুরু করে বিগত তিনটি বছরই ছিল দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবন। এই সংকটেও মানুষ মেলায় এসেছে। বইয়ের প্রেমে পড়েছে। বই কিনে বাড়ি ফিরেছেন। আমি দেখেছি পাঠকের উচ্ছ্বাস। এই ভালো লাগা সত্যিই আনন্দের ছিল। তাই আমার কাছে মনে হয়, এবার করোনা ও করোনা পরবর্তী ধাক্কা পেরিয়ে আসন্ন মেলায় আরও বেশি পাঠক-ক্রেতার আনাগোনা হবে। তারা বই কিনবেন গত বছরের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশের মানুষ বইপ্রেমী তারা বই কেনেন ও প্রিয়জনকে উপহার দেন।